একটি অপ্রেমের গল্প পর্ব ৪৮

একটি অপ্রেমের গল্প পর্ব ৪৮
জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা

গুরুম গুরুম শব্দ করে আজ নীরদ ডাক তুলেছে। পশ্চিমা গগনের গুমোট দশা দেখে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে কিছুক্ষণের মাঝেই ধরণীতে বৃষ্টি কন্যারা নেমে আসবে দলবল সমেত। বাতাবরণ এখন শান্ত, নীরব। ঠান্ডা মৃদু আন্দোলনে বইছে সমীরণ। চোখ বুজে বারান্দায় বসে আভা। ক্ষীণ বাতাস গায়ে মাখছে। অন্তরীক্ষের বিমর্ষ মেঘ তার মনেও এসে হানা দিয়েছে বোধহয়। দুইদিন ধরে অয়ন তাকে গান শেখাতে আসছে না। ফোন দিয়েছিল বার কয়েকবার, কিন্তু রিসিভ হয়নি। পরে অমিত থেকে জানতে পারে, তার বিশাল জ্বর।

অয়নের জন্য আজকাল বড্ড মন পুড়ে। প্রথমে কেবল ভালোলাগা মনে হলেও এখন মনে হচ্ছে তা অন্যকিছু। শুধু ভালোলাগাতে কারোর জন্য কারোর মন পুড়ে না। মন পুড়ে ভালোবাসাতে। ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে আভা। আকাশের অবস্থা ভালো নয়। অয়নও একেবারে সুস্থ হয়নি। আজও আসবে না নিশ্চয়। ক্ষুন্ন মনে ভেতরে আসার জন্য উদ্যত হতেই আবার থমকে দাঁড়ায়। বারান্দার গ্রিল গলিয়ে দেখে অয়ন গেইট পেরিয়ে ভেতরে এসেছে। চিত্ত জুড়ে শিহরণ জাগে তার। মনের ভেতর মাদল বাজে। মেঘ সরে যায় চট করে, উঁকি দেয় সোনালী সূর্য। দৌড়ে রুমে এসে নিজেকে একবার আয়নায় দেখে। হাত দিয়ে চুল ঠিক করে ওড়না চেপে ছুটে যায় দরজা খুলতে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কলিংবেল বাজানোর জন্য হাত উপরে তোলার আগেই দরজা খুলে যায়। অয়ন সামনে চেয়ে দেখে চমৎকার হেসে মেয়েটা দাঁড়িয়ে। অয়নকে সালাম দিল। সালামের জবাব দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল অয়ন। আভার ঘরে গিয়ে বসল। দরজা আটকে আভা আগে গেল রান্নাঘরে।
পাক্কা পনেরো মিনিট পর রুমে আসে আভা। অয়ন ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘এতক্ষণ কী করছিলেন?’
আভা মুচকি হেসে তার সামনে কফির মগটা রেখে বলল,
‘আপনার জন্য কফি বানাচ্ছিলাম। খেয়ে দেখুন, কেমন হয়েছে।’
‘ধন্যবাদ। বসুন।’

আভা বসল। সে আজকাল গানটা ভালোই রপ্ত করেছে। আভার গলার স্বর ভালো। অনুশীলন করলে বেশ ভালো জায়গায় যেতে পারবে সে। বাবাকে বলে হারমোনিয়াম কিনেছে। অয়নের কাছ থেকেও সেটা শিখেছে বেশ। অয়ন হারমোনিয়ামে হাত দিতেই আভা বলল,
‘আপনি কফি খান, আমি শুরু করছি।’
অয়ন হারমোনিয়ামটা আভার দিকে ঘুরিয়ে দেয়। বলে,
‘বেশ, একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত দিয়ে শুরু করুন।’
হারমোনিয়ামে হাত দিয়েও আভা সুর তুলতে পারল না। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছে ততক্ষণে। তার তুমুল শব্দ। বারান্দা আর জানলা দিয়ে বৃষ্টির পানি তার ঘর অবধি আসছে। বাতাসের দাপটে জানলার পর্দা খুলে আসার উপক্রম। আভা বিছানা ছেড়ে উঠে বলল,

‘আমি জানলা দরজা লাগিয়ে আসছি।’
জানলা লাগানো হলো। বারান্দার দরজা লাগাতে গিয়ে হালকা ভিজে গেল সে। তাও কোনোরকমে লাগিয়ে আবার বসল এসে পূর্বের জায়গায়। অয়ন তার দিকে একপলক চেয়ে পকেট হাতিয়ে একটা টিস্যু বের করে দিল। বলল,
‘মুখটা মুছুন।’
খুশি হলো আভা। অয়নের দেওয়া টিস্যু দিয়ে মুখ মুছে নিল। তারপর আবার হাত রাখল হারমোনিয়ামে। গলা হালকা ঝেড়ে সুর তুলল,

“ভালোবাসি, ভালোবাসি
এই সুরে কাছে দূরে জলে স্থলে বাজায়
বাজায় বাঁশি
ভালোবাসি, ভালোবাসি….
আভার মন্ত্রমুগ্ধ সুর। অয়ন কপাল কুঁচকাল। মনে পড়ল সেই রাতের কথা, যেদিন তার অপূর্ণ ভালোবাসার মানুষটা এই গানটাই গাইছিল; অথচ অন্যকারোর জন্য। আজ আভার মুখে এই গান শুনে বক্ষের সুপ্ত পীড়া তরতরিয়ে বাড়ল। আভা এক সেকেন্ড বিরতি নিয়ে গাইল আবার,
আকাশে কার বুকের মাঝে
ব্যথা বাজে
দিগন্তে কার কালো আঁখি
আঁখির জলে যায় ভাসি
ভালো…”
বাকিটা শেষ করার আগেই অয়ন বলল,
‘থামুন।’

থেমে গেল আভা। ঢোক গিলে চাইল অয়নের দিকে। অয়ন কি তবে বুঝে গেল? বুঝে গেল কি, আভা যে তার মনের অনুভূতি প্রকাশের জন্য’ই গানটা গেয়েছে?
অয়নের বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করছে। আভা কেন এই গান গাইল? সে যে একই দহনে দুইবার পুড়তে চায় না। নিজেকে ধাতস্ত করে বলল,
‘অন্য গান ধরুন।’
আভা ইতস্তত সুরে বলল,
‘কেন, এটা কি ভালো হয়নি? সুর সুন্দর হয়নি?’
‘হয়েছে, সব ঠিক আছে।’
‘তাহলে?’

তাহলে অন্যকিছু। সেই অন্যকিছু অয়ন বলতে পারছে না। থেমে থেমে আকাশ গর্জন তুলছে। সেই গর্জনে কেঁপে উঠছে আভার ছোট্ট হৃদয়। অয়ন কেন উপেক্ষা করছে তাকে? তার ছোট্ট হৃদয়ের অনুভূতি কেন সে বুঝতে চাইছে না? সে অসহায় চোখে দেখছে অয়নকে। অয়ন সেই দৃষ্টি অগ্রাহ্য করে বলল,
‘কী হলো, বসে আছেন যে? অন্য গান শুরু করুন।’
মনঃস্তাপ প্রকট হলো। আভা হারমোনিয়াম ঘুরিয়ে দিল অয়নের দিকে। ক্ষীণ সুরে বলল,
‘আপনি শুরু করুন। আমার গলা দিয়ে আর সুর আসছে না।’
অয়ন কিছু বলল না। জানতে চাইল না, সুর না আসার কারণ। অভিমান করে বসে রইল আভা। সে আজকে আর গান’ই গাইবে না।

জানলা দিয়ে বাইরের আষাঢ়ী নৃত্য দেখছে অন্বিতা। সেই নৃত্যে গাছগুলো এমন ভাবে মাথা ঝাঁকাচ্ছে যেন এক্ষুনি মাথা খুলে পড়বে বোধহয়। অন্বিতা মৃদু হাসে। অপারেশন শেষ করে মাত্রই কেবিনে প্রবেশ করে মাহির। অন্বিতাকে দেখে জানলার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে। সে হাত মুখ ধুয়ে এসে তার পাশে দাঁড়ায়। বাইরে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘কী দেখছ?’
অন্বিতা মৃদু হেসে বলে,
‘বৃষ্টি।’
মাহির পুনশ্চ কিছু বলার আগেই অন্বিতা উত্তেজিত সুরে বলে উঠে,
‘এই, বৃষ্টিতে ভিজবে?’
‘অসম্ভব। জ্বর বাঁধাবে না-কি?’
ভ্রু কুঁচকাল অন্বিতা। বলে,
‘সেদিন তো ভিজেছিলে। আমি এতবার বলার পরেও আমার কথা শুনোনি। আমিও আজ তোমার কথা শুনব না। চলো।’

মাহিরের হাত টেনে ধরে অন্বিতা। মাহির জিজ্ঞেস করে,
‘কোথায়?’
‘ছাদে। তোমার নার্সিংহোমের ছাদটা বেশ সুন্দর। সেখানে সুন্দর মতো বৃষ্টি বিলাস করা যাবে।’
‘পাগল হয়েছ তুমি? বৃষ্টিতে ভিজে এই ভেজা শরীর নিয়ে এখানে থাকবে কী করে? আমার সন্ধ্যায় আরেকটা অপারেশন আছে।’
‘আরে ভিজে বাসায় চলে যাব। তারপর ফ্রেশ হয়ে সন্ধ্যার আগে চলে এলেই হবে। এখন এত কথা না বলে চলো তো।’
অন্বিতার কাছে পরাস্ত হয়ে তার পথেই পা বাড়াল মাহির।

ছাদে গিয়েই ছুটে মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াল অন্বিতা। হাতের ইশারায় মাহিরকে ডাকল। মুচকি হেসে এগিয়ে এল মাহির। অন্বিতা দুই হাত মেলে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে। বর্ষণে তার পুরো বদন সিক্ত। চোখের ভেজা পাপড়ি, কপাল লেপ্টানো চুল, আর সিক্ত ঠোঁট দেখে মাহিরের বেহায়া মন উস্কে উঠল। এটা তার নার্সিংহোম, এখানে সে একজন ডাক্তার ভুলে বসল বেমালুম। সহসাই কাছে টেনে নিল অন্বিতাকে। চোখ পিটপিট করে তাকাল অন্বিতা। মাহিরের চঞ্চল চোখ দেখে হালকা শাসিয়ে বলল,
‘একদম না, ডাক্তারসাহেব। এটা আপনার নার্সিংহোম, ভুলে যাবেন না।’
মাহির এগিয়ে এল। ফিসফিসিয়ে বলল,
‘তুমি যে আমার বউ সেটাও তো ভুলতে পারছি না।’

মাহিরের অবাধ্য হাতের বিচরণে শিউরে উঠল অন্বিতা। আশেপাশে চেয়ে দেখল একবার। ধীর গলায় বলল,
‘এখানে আমি আপনার জুনিয়র। আপনি আপনার জুনিয়রের সাথে অসভ্যতামো করছেন।’
মাহির তার গালে গাঢ় চুম্বন এঁকে বলল,
‘বেশ করেছি। আরো করব।’
অন্বিতা ঠেলে সরাতে চাইল তাকে। ব্যর্থ হলো। মাহির হাসল কিঞ্চিৎ। বলল,
‘আমাকে সরানোর শক্তি এখনও হয়ে উঠেনি তোমার।’

বৃষ্টির বেগ বেশি। অন্বিতার চেয়ে থাকতেও বেগ পোহাতে হচ্ছে। তার ঠোঁট গলিয়ে পড়া পানিতে দৃষ্টি মাহিরের। তৃষ্ণা বাড়ল অচিরাৎ। অন্বিতার কপালে কপাল ঠেকাল। টের পাচ্ছে, মেয়েটার নিশ্বাসের গতি বেড়েছে। হয়তো বুকে কান পাতলেই শুনতে পেত ভয়নাক দ্রিমদ্রিম শব্দ। এত বৃষ্টি, এত শীতলতার মাঝেও তরতরিয়ে শরীরের উষ্ণতা বেড়ে গিয়েছে অন্বিতার। মাহিরের ঘনিষ্ঠতা তাকে বড্ড যন্ত্রণা দেয়। মনের অবস্থা বেগতিক করে তুলে। আর শরীরের’টা তো না’ই বলুক।

একটি অপ্রেমের গল্প পর্ব ৪৭

বেহায়া মনের বেহায়াপনা সামলানোর সাধ্যি নেই মাহিরের। সে চেষ্টাও করল না। বউ তার, বেহায়াপনা এই ক্ষেত্রে হালাল। তাই নিজের উন্মাদনা মেটাতে ঠোঁট বসাল অন্বিতার সিক্ত, কম্পিত ওষ্ঠপুটে। নিশ্বাস টেনে ধরল অন্বিতা। মনে হচ্ছে মাহির যেন তার সমস্ত শক্তি শুষে নিচ্ছে।

একটি অপ্রেমের গল্প পর্ব ৪৯