একটি অপ্রেমের গল্প পর্ব ৪২

একটি অপ্রেমের গল্প পর্ব ৪২
জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা

পর্দায় নিগূঢ় ভাবে ফুটে উঠল কিছু মুখোশধারী মানুষের মুখোশের আঁড়ালের কুৎসিত চিত্রগুলো। উপস্থিত মানুষগুলো হতভম্ব, হতবাক। রা নেই কারোর মুখে। মাহিরের নিষ্পলক, নিস্তেজ চাহনি। অন্বিতার চোখে মুখে হতাশা, মাহিরের জন্য বড্ড খারাপ লাগছে তার। পনেরো মিনিটের ভিডিয়োতে সমস্ত ঘটনার আদ্যোপান্ত শোনা গেল, দেখা গেল। ঘৃণায় শরীর রি রি করছে আসিয়া বেগমের। নিজের মেয়ের বয়সী একটা মেয়ের সাথে এত বড়ো অন্যায় তারা কী করে করতে পারে। ভিডিয়োটা বন্ধ করে রিয়াল দাদুর সমীপে দাঁড়াল। নিরুত্তাপ সুরে শুধাল,

‘আপনার কি আর কিছু বলার আছে, দাদু?’
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন দাদু। বয়স হয়েছে উনার। এই বয়সে এসে মেয়ে আর নাতনির এহেন রূপ দেখে পীড়িত হয়েছেন তিনি। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। জিনিয়া বেগমের সামনে গেলেন। মাথা তুলে তাকানোর মতো বিন্দুমাত্র সাহস আর অবশিষ্ট নেই মা আর মেয়ের। জিনিয়া বেগম ভীত, নির্জীব। দাদু মেঘমন্দ্র সুরে বলে উঠলেন,
‘এই শিক্ষা’ই আমি দিয়েছি তোমায়? এই দিন দেখার জন্যই কি আমি বেঁচে আছি?’
শশী চোখ তুলে আকুতি করতে চাইল। বলল,
‘নানুভাই, আমরা আসলে..’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘থামো।’
চেঁচিয়ে উঠলেন দাদু। তিনি কাঁপছেন। আদর্শবান মানুষ তিনি। গ্রামের মানুষ ফেরেশতার চোখে তাঁকে দেখে। আর আজ তার’ই মেয়ে আর নাতনির এই অধঃপতন তিনি মেনে নিতে পারছেন না। অন্বিতা মাহিরের কাছে এল। উদ্বেগ নিয়ে বলল,
‘দাদুকে সামলাও, মাহির। নয়তো উনি অসুস্থ হয়ে পড়বেন।’
মাহির ছুটে গেল দাদুর কাছে। বৃদ্ধকে একহাতে আগলে ধরে বলল,
‘শান্ত হও, দাদু। এখানে এসে বসো।’
তাঁকে চেয়ারে বসায় মাহির। ইশারায় তাইভিদকে পানি আনতে বলে। তাইভিদ পানি এনে দেয়। মাহির দাদুর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে কোমল স্বরে বলে,

‘পানি’টা খাও, দাদু।’
দাদু এক ঢোক গিললেন বোধ হয়। চোখ মুখ দৃঢ় উনার। লাঠি ধরে রাখা হাতটা ঠকঠক করে কাঁপছে। মাহির সেই হাতে হাত বুলিয়ে বলল,
‘অস্থির হয়ো না, অসুস্থ হয়ে পড়বে তো।’
দাদু শ্বাস টানলেন খানিক জোরে। সন্তপ্ত সুরে বললেন,
‘তোমরা কী করে এসব করতে পারলে? এভাবে একটা মেয়েকে অসম্মান করার সাহস হলো কী করে? বিবেক বুদ্ধি কিছু নেই? এত জঘন্য তোমরা? এসব করার আগে একবার নিজের ভাতিজার কথাও কি স্মরণে আসেনি, জিনিয়া? ও তোমাকে নিজের মায়ের জায়গা দিয়েছিল, আর তুমি? ছি:’

বাবার কথা শুনে কেঁপে উঠলেন জিনিয়া বেগম। জীবদ্দশায় কখনও বাবার এমন তোপের মুখে তিনি পড়েননি। চোখ ভিজে উঠে উনার। তিনি ছুটে এসে বাবার পায়ের কাছে পড়েন। হাত জোড় করে আকুতি জানিয়ে বলেন,
‘আমায় ক্ষমা করো, বাবা। আমার ভুল হয়ে গিয়েছে।’
মাহির উঠে দাঁড়াল। দাদু মুখ ঘুরিয়ে নিলেন অন্যদিকে। রূঢ় সুরে বললেন,
‘কারোর বাবা বলে আমি অন্যায় মুখ বুজে সহ্য করব না। চোখের সামনে থেকে চলে যাও, আর কখনও আমি তোমাদের মুখ অবধি দেখতে চাই না।’

জিনিয়া বেগম আঁতকে উঠলেন। বাবার পাযুগল জড়িয়ে ধরলেন সঙ্গে সঙ্গে। ক্রন্দনরত স্বরে বললেন,
‘এভাবে বলো না, বাবা। তুমি ছাড়া আমার আর কে আছে? এভাবে আমার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিও না। মাহির বাবা, ক্ষমা করে দে ফুপিকে।’
মাহির দাঁতে দাঁত চেপে অন্যদিকে চাইল। এই মানুষ দুজনকে সে ক্ষমা করতে পারবে না। এত বড়ো হৃদয় তার নয়। ছোট্ট বক্ষে এত আঘাত লুকিয়ে মানুষগুলোকে ক্ষমা করা অসম্ভব।
দাদু শক্ত গলায় বললেন,
‘মাহির, ওদের চলে যেতে বলো।’

জিনিয়া বেগম ব্যাকুল হয়ে উঠেন। বাবার পায়ে মাথা ঠেকিয়ে বলেন,
‘এমন করো না, বাবা। ক্ষমা করো আমাদের। আমরা আর কখনও এমন করব না। প্রয়োজন পড়লে আমরা অন্বিতার পা ধরে ক্ষমা চাইব।’
‘তা তো অবশ্যই চাইবে। এখনই চাইবে। তুমি আর তোমার মেয়ে অন্বিতাসহ তার পুরো পরিবারের কাছে ক্ষমা চেয়ে এখান থেকে বিদায় হবে।’
শশী ক্ষুব্ধ চোখে তাকাল। সে সবার কাছে ক্ষমা চাইতে পারবে না। তার অহমিকায় আঘাত করবে এমন কিছুই সে করবে না। জিনিয়া বেগম উঠে দাঁড়ালেন। অন্বিতার দিকে এগিয়ে গেলেন তারপর। আচমকা তার পায়ের কাছে বসে যেতেই ঘাবড়ে কয়েক কদম পিছিয়ে যায় অন্বিতা। কম্পিত স্বরে বলে উঠে,

‘এসব কী করছেন? উঠুন।’
জিনিয়া বেগম মাথা তুলে চেয়ে বলেন,
‘আমাকে ক্ষমা করে দাও, অন্বিতা। আমার অনেক বড়ো ভুল হয়ে গিয়েছে।’
অন্বিতা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। মাহিরের দিকে তাকায় একবার। মাহিরের অভিব্যক্তির কোনো বদল না দেখে ইতস্তত সুরে বলে,
‘ক্ষমা চাইতে হবে না। উঠুন আপনি।’
‘না না, তুমি ক্ষমা না করলে বাবাও যে আমায় ক্ষমা করবেন না।’
অন্বিতা নীরব দাঁড়িয়ে থাকে। মাহির এগিয়ে আসে তখন। আমর্ষ স্বরে বলে,
‘তোমরা ক্ষমা পাওয়ার অযোগ্য। আজ থেকে তোমাদের সাথে আমার আর আমার স্ত্রীর কোনো সম্পর্ক নেই, চলে যাও এখান থেকে।’

জিনিয়া বেগম অনেক ভাবে আকুতি জানালেন। সবার কাছে ক্ষমা চাইলেন। কিন্তু ক্ষমা করল না কেউ। নিজের বাবাও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন তাঁর কাছ থেকে। ভগ্ন আর ব্যথিত হৃদয়ে মেয়েকে নিয়ে তিনি সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন। তাঁর চোখে মুখে কিঞ্চিৎ অনুশোচনার দেখা মিললেও তাঁর মেয়ের চোখ মুখ ছিল দৃঢ়। আমিত্বের বেড়া জালে আটকে যাওয়া ব্যক্তিত্ব ছাপিয়ে পরিতাপের কোনো দেখা মিলল না তার মাঝে।
বাতাবরণে বিরাজ করছে নিস্তব্ধতা। ক্লান্ত হয়ে চেয়ারে বসা দাদু, মেয়ের অন্যায়ের ভারী বোঝায় শৃঙ্খলিত। মাহির এগিয়ে গিয়ে রিয়ালের নিকটে দাঁড়ায়। রিয়াল ঠোঁট খুলে বলতে নেয় কিছু। থামিয়ে দেয় মাহির। যথাসাধ্য ঠান্ডা গলায় বলে,

‘তোর অপরাধও কোনো অংশে কম নয়। আমার বিশ্বাসে আঘাত করেছিস তোরা প্রতিটা মানুষ। আর তুই আঘাত করেছিস আমার ভালোবাসাতেও। এত আঘাতের পর তোকে আর ক্ষমা করা সম্ভব না। সামান্য কয়টা টাকার লোভে বন্ধুর বুক চিরতে যার হাত কাঁপেনি সে বন্ধু নামের কলঙ্ক। তোকে আঘাত করতে হাত নিশপিশ করছে আমার। নিজেকে সামলে রাখতে পারছি না। চলে যা এখান থেকে, আর কখনও আমার সামনে আসবি না।’
রিয়াল তেজ দেখিয়ে গটগট করে বেরিয়ে গেল সেখান থেকে। মাহির তাইভিদকে বলল,
‘দাদুকে নিয়ে আপনি বাসায় যান, তাইভিদ। আমরা আসছি।’
তাইভিদ মাথা হেলিয়ে দাদুকে ধরে উঠাল। লাঠি সমেত দাদু এগিয়ে গেলেন অন্বিতার মায়ের কাছে। তিনি অনুনয়ের স্বরে বললেন,

‘আমাদের ক্ষমা করবেন। এমন কিছু হয়েছে আমি জানতাম’ই না। জানলে আরো আগেই এই অন্যায়ের বিচার করতাম।’
আসিয়া বেগম ইতস্তত সুরে বললেন,
‘না না, আপনাকে ক্ষমা চাইতে হবে না। আমার মেয়ের বাকি জীবন যেন সসম্মানে কাটে শুধু সেইটুকু দেখলেই হবে।’
‘চিন্তা করবেন না। আমার নাতি আর নাতবউকে আমি আগলে রাখব।’
আসিয়া বেগম মলিন হেসে কৃতজ্ঞতা জানালেন। দাদু অন্বিতার দিকে চাইলেন। বললেন,
‘বুবু, এই বুড়ো দাদুকে তুমি ক্ষমা করতে পারবে তো?’

অন্বিতা দাদুর সামনে এল। নরম গলায় বলল,
‘আপনি কেন ক্ষমা চাইছেন, দাদু? এখানে তো আপনার কোনো দোষ নেই। আর যা হয়েছে আমি সব ভুলে গিয়েছি, আপনিও আর এসব ভেবে কষ্ট পাবেন না।’
দাদু অন্বিতার মাথায় হাত রাখলেন। বললেন,
‘দোয়া করি, জীবনে অনেক সুখী হও।’
তাইভিদ দাদুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। বিষন্নতার ভীড়ে তলিয়ে যাওয়া মাহির চোখ তুলে তাকাল আসিয়া বেগমের দিকে। বলল,

‘মা, আমি নিজেও এতকিছু জানতাম না। ঐ মানুষগুলোর জন্য আমিও অন্বিতাকে কম ভুল বুঝেনি। অন্যায় তো আমিও করেছি। তার জন্য অন্বিতা আমাকে ক্ষমা করে দিলেও আমি নিজেকে কখনও ক্ষমা করতে পারব না। আপনার কাছেও আজ ক্ষমা চাওয়ার মুখ নেই আমার।’
বিধ্বস্ত হয়ে একটা চেয়ারে বসল মাহির। আসিয়া বেগম এগিয়ে এসে মাহিরের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
‘মা ডেকেছ না, তাহলে মায়ের কাছে এত জড়তা দেখাচ্ছ কেন? তুমি ভুল কিছু করোনি, ঐ মানুষগুলো চোখ বেঁধে দিয়েছিল তোমার। চোখে পট্টি থাকলে মানুষ ডান বাম দেখবে না সেটাই স্বাভাবিক। যা হয়েছে এখন সব ভুলে যাও, বাবা। আমার মেয়েটাকে নিয়ে সুখী হও, এই দোয়াই করি।’

একটি অপ্রেমের গল্প পর্ব ৪১

নিষ্প্রভ হাসল মাহির। বলল,
‘দোয়া করবেন, মা। আমি যেন অন্বিতাকে এক অন্তরীক্ষ সুখ দিতে পারি।’
‘পারবে তুমি। আমার বিশ্বাস আছে।’

একটি অপ্রেমের গল্প পর্ব ৪৩