একটি অপ্রেমের গল্প পর্ব ৫৪

একটি অপ্রেমের গল্প পর্ব ৫৪
জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা

আচমকা পরিবেশ কেমন যেন অশান্ত হয়ে উঠেছে। প্রচন্ড ঝড় উঠেছে বাইরে। বেগতিক বাতাসে গাছগুলো ভেঙে পড়ার উপক্রম। আকাশ চিড়ে দেখা মিলছে স্ফুলিঙ্গের। আচানক কী হলো? কেন বাতাবরণ ভয়ংকর হলো এত? তবে কি তারা জানান দিচ্ছে কিছু মানুষের মনের ভেতরকার ঝড়? সেই ঝড়ের সাথেই পাল্লা মেলাতেই কি এত আয়োজনে নেমেছে তারা?

আই সি ইউ রুমের বাইরে নিরুত্তাপ দাঁড়িয়ে মাহির। চোখ মুখের দৃষ্টি শান্ত, নীরব। ছেলেটার ভেতরে কী চলছে তা বোঝা মুশকিল। তবে এইটুকু বোঝা যাচ্ছে, প্রকৃতির ঝড়ের চেয়েও মনের ঝড়ে বেহাল দশা তার। পাশ থেকেই শোনা যাচ্ছে এক ছোট্ট পুতুলের বিদঘুটে চিৎকার। জন্মের পর প্রথম আহারের জন্য বাচ্চাটা ছটফট করছে। আসিয়া বেগম পায়চারি করছেন তাকে কোলে নিয়ে। কান্না থামানোর বৃথা চেষ্টা। আভা সামনে এসে দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করল,
‘আন্টি, আমি কোলে নিব?’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আসিয়া বেগম বিমর্ষ সুরে বললেন,
‘মায়ের কোল খুঁজছে বাচ্চাটা।’
আভা ঠোঁট চেপে কান্না দমিয়ে রাখে। ছোট্ট তুলতুলে শিশুটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
‘আল্লাহ, তোমার দিকে চেয়ে যেন একটু দয়া করেন।’
আসিয়া বেগম ক্রন্দনরত সুরে বললেন,

‘মেয়েটার জ্ঞান ফিরে যখন তার আরেক মেয়ের কথা জানতে চাইবে, তখন আমি কী জবাব দিব?’
আসিয়া বেগম নাতনিকে বুকে জড়িয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদেন। আভা সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা পায় না। সে নিজেই তো এসব মেনে নিতে পারছে না। তার বান্ধবীর এমন করুণ দশা কেন হলো? কেন মেয়েটা এক সন্তান হারিয়ে আই সি ইউ তে মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে, কেন? সে নিজেকেই বোঝাতে পারছে না যেখানে, সেখানে আর অন্য কাউকে কী বোঝ দিবে?

তাইভিদ মাহিরের পাশে এসে দাঁড়াল। একবার তাকাল কাঁচ ভেদ করে ভেতরে। অক্সিজেন সহ নানান চিকিৎসা সামগ্রীর বহরে অন্বিতাকে দেখা যাচ্ছে না ঠিকমতো। একপল সেদিকে চেয়ে আবার চাইল মাহিরের দিকে। ঢোক গিলে বলল,
‘বাচ্চাটাকে কি ফ্রিজিং রুমে রাখব, স্যার? এভাবে বাইরে আর কতক্ষণ থাকবে?’
মাহির জবাব দেয় না কোনো। হয়তো কান অবধি কথাখানা প্রবেশ করেনি। সে পুনরায় একই প্রশ্ন করার আগে শশী এসে বলল,

‘মাহির এখন কিছু বলার মতো অবস্থাতে নেই, তাইভিদ। আপাতত ওকে ফ্রিজিং রুমেই রাখতে হবে।’
এই কথা শুনে আসিয়া বেগম সেখানে ছুটে এলেন। অস্থির হয়ে বললেন,
‘তোমরা কী বলছো এসব? আমার ছোট্ট নাতনিটাকে ঐ ঠান্ডা বরফের রুমে রাখবে? ওর তো কষ্ট হবে। আমার মেয়ে জানতে পারলে আমার উপর রাগ করবে খুব।’
শশীর কান্না পায় ভীষণ। কিন্তু সে কাঁদে না। সবাই একসাথে ভেঙে পড়লে সব সামলাবে কে। সে আসিয়া বেগমকে আশ্বাস দিয়ে বলে,

‘আজকের রাতটুকু থাকুক, আন্টি। কালকে অন্বিতা সুস্থ হয়ে উঠলে ওর সিদ্ধান্তেই সব হবে।’
আসিয়া বেগমের ঠোঁট কাঁপছে। শরীরও কাঁপছে উনার। মাথা হেলিয়ে ক্ষীণ আওয়াজে বললেন,
‘আচ্ছা।’

তারপর তিনি গিয়ে বসলেন একটা চেয়ারে। কোলের বাচ্চাটা এখন ঘুমাচ্ছে। মা’র বিষাদে কাঁদতে কাঁদতে এবার অভিমানে ঘুম দিয়েছে সে। হয়তো মনে মনে পণ করেছে, মা ডাকা না অবধি আর চোখ খুলবে না।
নার্সিংহোমের দক্ষিণ পাশের বড়ো বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে অয়ন। বাইরের ঝড় এখন থেমেছে। তবে বৃষ্টি বহাল আছে এখনও। সোডিয়ামের আলো চুইয়ে পড়া বৃষ্টির ফোঁটাগুলো চমৎকার লাগছে বেশ। দীর্ঘশ্বাস ফেলে অয়ন। এমনটা তো না হলেও পারত। এই পৃথিবী এত নিষ্ঠুর কেন হলো? মেয়েটার জন্য মায়া হলো না একটুও?

তার এত সুখ এক নিমিষেই ছিনিয়ে নিল? অয়ন ভেবে পায় না, এসব ভাবলে দম বন্ধ লাগে তার। অন্বিতার মেয়েটাকে যতবার দেখেছে, ততবার’ই অন্বিতার মুখ ভেসে উঠেছে তার দৃশ্যপটে। সেই একই নাক, তীক্ষ্ণ চোখ, রক্তিম ঠোঁট, যেন অন্বিতার মুখটা কেউ বসিয়ে দিয়েছে। বাচ্চাটাকে দেখলে দম বন্ধ হয়ে আসে তার, যখন মনে হয় তার’ই মতো আরেকটা বাচ্চা মৃত। এই অমোঘ সত্য কী করে মেনে নিবে অন্বিতা? সব শোনার পর সে আদৌ বেঁচে থাকবে তো?

ফোনটা বেজে উঠে। হাতে নিয়ে দেখে অমিতের কল। অয়ন রিসিভ করে।
‘কিরে দোস্ত, অন্বিতার এখন কী অবস্থা?’
‘কোনো উন্নতি নেই।’
‘কী বলছিস! আর ওর মেয়েটা, ওকে কে দেখছে?’

‘আছে, আন্টি, আভা, অন্বিতার শ্বশুরবাড়ির মানুষজন; বাচ্চাটাকে দেখার জন্য সবাই আছে। তবে জানিস, মাহিরকে দেখার মতো কেউ নেই। একসময়ে সবচেয়ে হিংসে করা ছেলেটার উপর আজ আমার বড্ড মায়া হচ্ছে। কেমন অসহায় হয়ে চেয়ে আছে অন্বিতার আই সি ইউ রুমের দিকে। ওর ভেতরটা নিশ্চয় ছারখার হয়ে যাচ্ছে, তীব্র যন্ত্রণায় বুকে রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে, কিন্তু কাউকে বলতে পারছে না! কেন এমন হলো, বলতো? কেন সৃষ্টিকর্তা ওদের এত কষ্ট দিচ্ছেন?’

অয়নের গলা ধরে আসে। অমিত বুঝতে পারে, অয়নও ঠিক নেই। সে ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
‘হয়তো এটা সৃষ্টিকর্তার পরীক্ষা, নয়তো কোনো ভুল না করা স্বত্ত্বেও অমন ফুলের মতো মেয়েটা কেন এত কষ্ট পাবে?’
‘জানিস, অন্বিতার বাচ্চাটা না পুরো ওর মতো দেখতে। সেকি কান্না তার, পুরো নার্সিংহোম গরম করে ফেলেছে।’
‘মা’কে খুঁজছে বাচ্চাটা।’
‘হ্যাঁ, কেউ থামাতে পারছিল না। কী করে পারবে বল, মায়ের অভাব কি আর অন্য কেউ পূরণ করতে পারে?’
অমিত আফসোস করে বলল,
‘মা অসুস্থ না হলে আমি এক্ষুনি চলে আসতাম। আমার এখানে বসে থেকে ভীষণ দুশ্চিন্তা হচ্ছে।’
‘দুশ্চিন্তা করে লাভ নেই। বরং সৃষ্টিকর্তার কাছে দোয়া কর, অন্বিতা যেন ঠিক হয়ে যায়।’

বাইরে মৃদু আলো। বিভাবসু উঁকি ঝুঁকি মারছে। পাখির কিচিরমিচির শব্দে মুখোরিত চারদিক। নার্সিংহোমে এখন জিনিয়া বেগম আর দাদু ব্যতিত সবাই আছে। দাদু অসুস্থ বিধায় তাঁকে এক প্রকার জোর করেই জিনিয়া বেগমের সাথে বাড়িতে পাঠানো হয়েছে।

চোখ লেগেছিল সবার। তবে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে মাহির। দু চোখের পাতা এক পলের জন্যও এক করতে পারেনি সে। পুরোটা সময় এক ধ্যানে আই সি ইউ রুমের দিকেই চেয়েছিল। যেন মন বলছিল, এই বুঝি অন্বিতা চোখ খুলবে, এই বুঝি মাহির বলে ডাকবে তাকে। কিন্তু তাকে আশাহত করে তেমন কিছুই হয়নি।
তারদিকে কফির গ্লাসটা এগিয়ে দেয় অয়ন। কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে অয়নের দিকে তাকায় মাহির। মলিন হেসে অয়ন মাহিরকে ইশারায় কফিটা নিতে বলে। তবে নিরুত্তাপ থাকে মাহির। কফি নেয় না। অয়ন আই সি ইউ রুমের দিকে তাকায় একবার। ভোরের আলো ফুটলেও ঐ রুমটা আগের মতোই ঝাপসা, ঘোলাটে। সে প্রলম্বিত শ্বাস টেনে বলল,
‘আরো অনেক কিছু সামালাতে হবে। এখনই এত ভেঙে পড়লে কী করে হবে, বলুন?’

মাহির জবাব দেয় না। অয়ন কিয়ৎক্ষণ চুপ থেকে জিজ্ঞেস করে,
‘অন্বিতাকে খুব ভালোবাসেন, তাই না?’
মাহির ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। তার অমন ব্যাকুল দৃষ্টি দেখে যুতসই জবাব পেয়ে যায় অয়ন। মুচকি হাসে। বলে,
‘মেয়েটাও আপনাকে ভীষণ ভালোবাসে। ধরে নিন, এটা আপনাদের ভালোবাসার পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে গেলে নিজেকে যথেষ্ট শক্ত রাখতে হবে, ভেঙে পড়া যাবে না একদম।’

‘আমার একমাত্র শক্তি অন্বিতা। ওকে ছাড়া আমি এক জীবন্ত লাশ বৈ আর কিছুই না।’
ডাক্তারের মুখে স্ত্রী সন্তানের বিভৎস অবস্থার কথা জানার পর সেই যে মুখে কুলুপ এঁটেছিল মাত্র’ই সেই কুলুপ ছুটেছে মাহিরের। এইটুকু কথা শুনেও অয়ন খুশি হয়। বলে,
‘দেখবেন, আপনার শক্তি আরো মজবুত হয়ে আপনার জীবনে ফিরে আসবে।’
‘সত্যি বলছেন?’

একটি অপ্রেমের গল্প পর্ব ৫৩

কেমন বাচ্চাদের মতো করে জানতে চাইল মাহির। যেন একটু ভরসা খুঁজছে। ডাক্তারের কাছেও কোনোরূপ ভরসা না পেয়ে ছেলেটা দিশেহারা হয়ে পড়েছে একেবারে। তাই অয়নের এইটুকু কথাতেই যেন প্রগাঢ় ভরসা খোঁজার চেষ্টা চালাল সে।

একটি অপ্রেমের গল্প পর্ব ৫৫