একটি নির্জন প্রহর চাই সিজন ২ পর্ব ১৬
Mousumi Akter
ছোঁয়াদের মেরুণ রঙের ডুপ্লেক্স বাড়ি। ছোঁয়ার বাবার ঢাকায় কয়েকটা বিজনেস আছে। ঢাকায় ও কয়েকটা ফ্ল্যাট রয়েছে। এই এত এত সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকার একমাত্র ছোঁয়া। ছোঁয়ার দাদা-দাদী ছোঁয়ার বাবাকে বিয়ে করাতে চেয়েছিলো। তারা চেয়েছিলো ছেলে সন্তান। কিন্তু ছোঁয়ার বাবা মেয়েকে ভীষণ ভালবাসার জন্য কখনো আর সন্তান চাননি। এক মেয়েই তার সব কিছু। ছোঁয়ার বাবা-মা ঢাকাতেই থাকেন বেশীর ভাগ সময়।
শুধুমাত্র ছোঁয়া থেকে গিয়েছে যশোর। তার একমাত্র কারণ সারাহ, তন্ময়, মৃন্ময় আর দ্বীপ। ছোঁয়ার নিঃশ্বাস যেন ঠিকভাবে চলেনা ওদের ছাড়া। বন্ধুদের সিনেমার টিকিট, রেস্টুরেন্টের বিল সব ছোঁয়াই দিয়ে থাকে। এমন নিঁখাত বন্ধুত্ব খুব কম মানুষের মাঝেই থাকে। সবচেয়ে বড় দূর্বলতার জায়গা তন্ময়। তন্ময়কে ছেড়ে ছোঁয়া কোথাও যেতে পারবে না। শুধুমাত্র তন্ময়কে রোজ একবার চোখের দেখা দেখার জন্য নিজের বাসার পাশে ৩ টা টিউশন ঠিক করে দিয়েছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তন্ময় ও কদিন ধরে বারবার বলছিলো ছোঁয়া যেন তার বাসার আশে-পাশে তন্ময়কে টিউশনি খুঁজে দেয়। তন্ময় ছোঁয়ার বাসার আশে-পাশে ছাড়া টিউশন করাবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। তন্ময়ের ভীষণ রকমের দূর্বলতা ছোঁয়ার প্রতি। কিন্তু কেন তন্ময় নিজেই তা জানেনা। এই দূর্বলতার কারণ কি? তন্ময় প্রায় আক্ষেপ নিয়ে বলে পরের জন্মে জন্ম নিলে সে কোটিপতির ঘরে জন্ম নিবে।
ছোঁয়ার বাবার চেয়ে কোটিপতি। যেন ছোঁয়ার বাবা খুব সহজেই মেনে নেন। রোজ রাতে ছোঁয়াকে নিজের করে পাওয়ার আক্ষেপ পোড়ায় তন্ময় কে। গতমাসেই ছোঁয়া তিনটস টিউশনি ঠিক করে দিয়েছে তন্ময়কে। তিনটা টিউশনি থেকে ৯০০০ টাকা দেয় কিন্তু ছোয়া আর ৬০০০ ভরে ১৫০০০ দিয়ে বলে টিউশন থেকে দিয়েছে। ভালবাসা বোধহয় গোপনেও সুন্দর। এইযে ছোঁয়ার ভয়ঙ্কর ভালবাসার কথা তন্ময় বুঝতেই পারেনা। ঘড়ির কাটায় বিকাল ৪ টা বেজে ১৫ মিনিট। ছোঁয়া নীল রঙের একটা টপ্স আর স্কার্ট পরে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। ঘাড় অব্ধি চুলগুলো ছেড়ে রাখা। হঠাৎ খেয়াল করল,
” তন্ময় তাদের বাসার সামনে কড়া রোদে দাঁড়িয়ে আছে। ”
সে চাতক পাখির ন্যায় অপেক্ষা করছে ছোঁয়াকে এক পলক দেখার জন্য। নিয়ম করে ছোঁয়াকে দেখবে বলেই তো এতদূর টিউশনি করাতে আসা। ছোঁয়ার চোখ তন্ময়ের চোখে পড়তেই তন্ময় মৃদু হেসে একটা টেক্সট করল,
” তোমার মুখের একটুখানি হাসিই আমার সব কষ্টের প্রাপ্তি। ”
ছোঁয়া মেসেজটা দেখেও কোনো উত্তর দিলোনা। মাঝে মাঝে সে কি উত্তর দিবে বুঝে উঠতে পারেনা। তন্ময়কে আজ ভয়ংকর রকমের সুন্দর দেখাচ্ছে। ও কি দিন দিন আরোও ফর্সা হচ্ছে? কি দরকার ছিলো, আজ ব্লু রঙের শার্ট পরার। শার্টের স্লিভ গোটানোর জন্য পশমের আবরণে হাতা ফর্সা হাত দু’টো ভয়ংকর রকমের সুন্দর দেখাচ্ছে। এত সুন্দর কেন তন্ময়।
তন্ময় এর আজ পড়ানোতে খুব একটা মন নেই। তন্ময়ের ছাত্র এস এস সি পরিক্ষার্থী। সে বিষয়টা খেয়াল করল। এতদিন পড়াচ্ছে কখনো তন্ময়কে অমনোযোগী দেখেনি সে। তন্ময় খুব মনোযোগ দিয়ে বই পড়ায়। তন্ময়ের ছাত্র বলল,
” স্যার আমার একজন বান্ধবী আপনার কাছে পড়তে চাই। ওকে একটু পড়াবেন।”
তন্ময় শান্ত কণ্ঠে বলল,
” কোনো ছেলে পড়লে জানিও, আমি কোনো মেয়ে পড়ায় না। ”
তন্ময়ের ছাত্র খুব কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল,
” কেন স্যার?”
তন্ময়ের চোখের সামনে ছোঁয়ার মুখটা দৃশ্যমান হলো। এর একমাত্র কারণ ছোঁয়া। ছেলেটা তন্ময়কে চুপ থাকতে দেখে বলল,
” স্যার আপনি কি অসুস্থ? ”
তন্ময় মৃদু হেসে বলল,
” কিছুটা।”
ছেলেটা পড়ার ফাঁকে ফাঁকে প্রায় সময় তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। একদম মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে। তন্ময় আজ জিজ্ঞেস করল,
” এভাবে কি দেখো তাকিয়ে?”
ছেলেটা ঠিক যেন তার প্রেমিকার ন্যায় উত্তর দিলো,
” আপনাকে দেখি স্যার।”
তন্ময় ভ্রু যুগল কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
” আমার কি দেখো?”
“আপনি অনেক সুন্দর স্যার, এত সুন্দর মানুষ আমি আগে কোনদিন দেখিনি। আমার খালামনি কি বলেছে জানেন?”
তন্ময় সন্দিহান হয়ে জিজ্ঞেস করল,
” কি?”
” আপনার সাথে যার বিয়ে হবে সে খুব ভাগ্যবতী নারী। ”
তন্ময় এসব কথার জন্য প্রস্তুত ছিলোনা। সে একটু ধমক দিয়ে বলল,
” এসব বলার বয়স হয়নি এখনো তোমার। বই পড়ো।”
তন্ময় মনে মনে বলল,
” যার বলার কথা সে কখনো বলল না।”
পড়ানো শেষ করে তন্ময় ছোঁয়াকে কল করল। তন্ময়ের পকেটে চারটা লাভ ক্যান্ডি। ছোঁয়া তন্ময়ের ফোন পেয়ে নিচে নেমে এলো। রাস্তার পাশে কৃষ্ণচূড়া গাছটা ধরে দাঁড়িয়ে আছে তন্ময়। কেমন যেন ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাকে। ছোঁয়া তন্ময়ের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
” বললাম না তন্ময় নিচে আসতে পারব না, তাও এতবার ফোন দিচ্ছিস কেন?”
তন্ময় ক্লান্ত চোখে তাকালো ছোঁয়ার দিকে। ছোঁয়াকে দেখলেই ওর বুকের ধুকপুকনি কেমন যেন বেড়ে যায় বহুগুনে। খুব অসহায় কণ্ঠে তন্ময় বলল,
” আমাকে একটু সময় দিবি?”
ছোঁয়া জানে তন্ময় তাকে কি বলবে। বিগত কয়টা বছর ধরে এমন দেখেই আসছে। ছোঁয়া চায়না তন্ময়ের সাথে জড়াতে। কারণ ছোঁয়ার বাবার আর কোনো সন্তান নেই। বাবা-মায়ের একমাত্র ভরসা ছোঁয়া। কোনোভাবেই বাবার মনে সে কষ্ট দিতে পারবে না। ছোঁয়ার কষ্ট হয়, তবুও তন্ময়কে ইগনোর করে। আজও ইগনোর করার জন্য বলল,
” আজ আমার সময় নেই তন্ময়।”
তন্ময় ক্লান্ত চোখে স্মিথ হেসে জবাব দিলো,
” আমার যদি প্রচুর টাকা থাকত, তোর সবটুকু সময় নিজের জন্য কিনে নিতাম। কিন্তু আফসোস আল্লাহ আমাকে হতদরিদ্র করে পাঠিয়েছেন। না আছে টাকা, না আছে ক্ষমতা কীভাবে তোকে পাবো আমি।”
“এসব ইমোশনাল কথা-বার্তা বলে কি প্রুভ করতে চাস? আমি লোভী? অর্থলোভী? তোর অর্থ নেই বলে আমি পছন্দ করিনা।”
তন্ময় আবার ও মৃদু হেসে বলল,
” আমার পাহাড় সমান ভালবাসার লোভ তোর নেই। আবার রেগে গিয়ে বুঝাচ্ছিস টাকার লোভ ও নেই? তাহলে কীসের লোভ তোর? একটা কিছুর অন্তত লোভ কর।”
ছোঁয়া একটা চলন্ত রিক্সা দাঁড় করিয়ে বলল,
” আয়,ওঠ।”
ছোঁয়া আগে উঠল তারপর তন্ময় ও উঠল। রিক্সাওয়ালা বলল,
” কোথায় যাইবেন?”
ছোঁয়া একটু রাগান্বিত কণ্ঠে বলল,
” যেদিকে মন চায় যান। ভাড়া যা হয় দিবো।”
রিক্সা চলছে। রিক্সার হুডিটা তোলা ছিলো। তন্ময় রিক্সার হুডি তুলে দিলো। ছোঁয়ার মুখের দিকে মায়াবী কণ্ঠে তাকিয়ে বলল,
” রেগে আছিস কেন? তুই রেগে থাকলে আমার খুব ভয় করে।”
ছোঁয়া আবার ও রাগান্বিত চোখে তাকিয়ে বলল,
” কেন আমি কি তোকে খেয়ে ফেলব নাকি। আমাকে কি ডা’ই’নি লাগে।”
তন্ময় আবার ও ভয়ংকর সুন্দর ইম্প্রেশন নিয়ে বলল,
” একদম প’ রী লাগে। যার দিক থেকে চোখ ফেরানো বড্ড মুশকিল।”
ছোঁয়ার হৃদয়ের মাঝে কেমন যেন চিন চিন করে ব্যাথা করে উঠল। তার পাশে বসে থাকা ভয়ংকর সুন্দর পুরুষটি সব পরিস্থিতিতে কেমন শান্ত থাকে। কখনোই উত্তেজিত হয়না। ছোঁয়ার মন খারাপ হলো। রিক্সা চলতে চলতে শহর ছাড়িয়ে গ্রামের দিকে প্রবেশ করল। এখন বর্ষার সিজন। রেগুলার বিকালেই বর্ষা হচ্ছে। রিক্সাওয়ালা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
” এমন একটা জায়গা আইলাম, বৃষ্টিতে ভেজা লাগবে। ”
ছোঁয়া হুডি থেকে মুখ বের করে বলল,
” তাইতো, এখন তো ভীষণ বৃষ্টি হবে। কি করব আমরা।”
তন্ময়ের ঠোঁটে হাসি। ভুবনভোলানো হাসি। সে যেন এমন কোনো মুহুর্তই চাচ্ছিলো। সে রিক্সাওয়ালাকে বলল,
” মামা আপনি রিক্সাটা দাঁড় করান। আমরা নেমে যাচ্ছি। আপনি ভেতরে বসুন।” বলেই তন্ময় নেমে দাঁড়ালো। ছোঁয়া ও নেমে দাঁড়ালো। আকাশ থেকে টুপটাপ বৃষ্টি পড়ছে। ছোঁয়া মাথার ওপরে থাকা লাল লাল ফুলে ভরা বিশাল কৃষ্ণচূড়া ফুলের গাছটার দিকে তাকালো। তন্ময় ঝুলে থাকা একটা কৃষ্ণচূড়ার ডাল এক লাফে পাড়ল। একটা ফুলের ডাল ভেঙে ছোঁয়ার দিকে এগিয়ে দিলো। ছোঁয়া ফুলটা তন্ময়ের হাত থেকে নিয়ে বলল,
” কেন এমন করিস তন্ময়? কেন বুঝিস না আমরা শুধুই ফ্রেন্ড, বেষ্ট ফ্রেন্ড।”
তন্ময় ছোঁয়ার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
” এত মায়াবী হয়ে জন্ম না নিলেও তো পারতি। আমাকে এভাবে না ফাঁসালেও তো পারতি। ”
ছোঁয়া অনুনয় করে বলল,
” এটা পসিবল নয় তন্ময়। আমরা বন্ধুর বাইরে আর কিছুই হতে পারব না।”
তন্ময় ব্যাথিত হৃদয় নিয়ে বলল,
” ভাল থেকে ভাল স্বামী -স্ত্রী হতে তো দোষ নেই। ”
” প্লিজ তন্ময়! তুই আমাকে লোভী, যা খুশি ভাব কিন্তু আমি বন্ধুর বাইরে আর কিছুই ভাবতে পারব না।”
কেন যেন তন্ময় আজ খুব বেশী ডিপ্রেশড। সে একজন ভিক্ষুকের মত ছোঁয়ার সামনে হাতজোড় করে বলল,
” আমি তোকে ছাড়া বাঁচতে পারব না ছোঁয়া। আমি তোকে বোঝাতে পারব না কত ভালবাসি। প্লিজ ছোঁয়া আমাকে একটা সুযোগ দে। আমার খুব শখ তোর সাথে জীবন কাটানোর। একটা সুযোগ আমাকে দে। প্রয়োজনে তোর বাবার পা জড়িয়ে ধরে তোকে ভিক্ষা চাইবো। আমি কথা দিচ্ছি আমার জীবন দিয়ে হলেও তোকে ভাল রাখব। তুই আমার না হলে তোকে না পাওয়ার শূন্যতা আমাকে শেষ করে দিবে।”
ছোঁয়া তন্ময়ের হাতের ওপর হাত রাখল। সাথে সাথে ছোঁয়ার হাত পুড়ে উঠল। তন্ময়কে ধরে বলল,
” এত জ্বর নিয়ে তুই বৃষ্টিতে ভিজছিস? মরণে ডাকছে নাকি তোকে।”
তন্ময় স্মিথ হেসে জবাব দিলো,
” হয় তুই নয় মৃত্যু। ”
ছোঁয়া রিক্সাওয়ালাকে ডেকে তন্ময়কে নিয়ে রিক্সায় উঠল।
আগামিকাল সারাহ’র গায়ে হলুদ। রোশানদের বাড়ি থেকে গায়ে হলুদ আর বিয়ের সমস্ত জিনিস পাঠিয়ে দিয়েছে। রোশান সারাহ’ র নাম্বারে মেসেজ করে বলল,
” লিস্ট এর সাথে সব ঠিকঠাক আছে?”
সারাহ উত্তর দিলো,
” না থাকলে পরে জানাবো।”
সারাহ’র মাথায় হঠাৎ দুষ্টুবুদ্ধি চাপল। সে রোশানকে মেসেজ দিলো আবার,
একটি নির্জন প্রহর চাই সিজন ২ পর্ব ১৫
” আগামিকাল আমার গায়ে হলুদ, পরশু বিয়ে। আপনার দাওয়াত। তবে রাইস কুকার বা প্রেশার কুকার বা গ্লাস সেট নিয়ে আসবেন না। অন লাইনে ড্রিম ফ্যাশনে সুন্দর সুন্দর থ্রি পিস আছে। গিফট যদি আনতেই চান তাহলে ওখান থেকে কিছু থ্রি পিস আনবেন।”
সারাহ’র এমন মেসেজ দেখে রোশানের ভ্রু যুগল কুচকে এলো। এ মেয়ে তো তাকে নাজেহাল করে ছাড়বে।