একটি নির্জন প্রহর চাই সিজন ২ পর্ব ১৯
Mousumi Akter
রোশানের সাথে সারাহর বিয়ে নিয়ে সারারাত বন্ধুদের মাঝে অনেক জল্পনা কল্পনাসহ অনেক আড্ডা হয়েছে। তন্ময়, মৃন্ময়,দ্বীপ ওরা সবাই খুব খুশী। সারাহ’র জন্য উপযুক্ত একজন পাত্র পাওয়া গিয়েছে। ওদের আনন্দ যেন আরোও চারগুন হয়ে গিয়েছে। চারদিকে বিশাল বড় বড় চারটা বক্স বাজছে। সে বক্সে সব হিন্দি গান চলছে। গানের তালে তালে স্টেজে উঠে নাচছে একেকজন। তন্ময়,মৃন্ময় এবং দ্বীপের পরণে একই রঙের পাঞ্জাবী পরা। দেখে তিন জমজ বলে মনে হচ্ছে। মৃন্ময় আর দ্বীপ এ দু’জনই যথেষ্ট একটা আসর মাতিয়ে রাখতে। সব মেয়েদের পরণে গায়ে হলুদের শাড়ি। শুধুমাত্র তরীর পরণে সিম্পল সালোয়ার কামিজ। মৃন্ময় পিহুকে ইশারা করে ডেকে নিয়ে শাড়ির প্যাকেট পিহুর হাতে দিয়ে বলল,
” এটা তরীকে পরিয়ে দে। ”
পিহু চোখ বড় বড় করে মৃন্ময় কে বলল,
” কোনদিন তো আমাকে একটা শাড়ি কিনে দিলেনা ভাইয়া।”
” তোকে শাড়ির দোকানের কর্মচারী দেখে বিয়ে দিবো। শাড়ির অভাব তোর কোনদিন হবেনা দেখে নিস।”
পিহু চোখ গরম করে জায়গা পরিবর্তন করল। সে তরীকে ডেকে সুন্দর করে শাড়িটা পরিয়ে দিলো। সাথে হালকা সাজ গোজ দিলো। এতেই তরীকে ভীষণ মায়াবী লাগছে। মৃন্ময় সারারাত ভরে যেন তরীকেই দেখে যাচ্ছে। ছোঁয়া তন্ময়কে ইশারা করে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” দেখ মৃন্ময় সারাক্ষণ তরীকেই দেখছে।”
তন্ময় সাথে সাথে ছোঁয়ার দিকে তাকালো। ছোঁয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো। তন্ময় ওভাবে তাকিয়ে থাকাতে ছোঁয়া বলল,
” হচ্ছে টা কি তন্ময়। ওভাবে তাকিয়ে থাককে কিন্তু অস্বস্তি লাগে।”
তন্ময় ফিস ফিস করে বলল,
” আমি যে আটটা বছর ধরে তোকে দেখছি, কখনো চোখের দৃষ্টি এদিক-সেদিক করিনি, তোর তো সেদিকে খেয়াল নেই।”
ছোঁয়া ফিসফিস করে বলল,
” চোখ নামা,লজ্জা করছে।”
পরের দিন দুপুর। বিয়ে পড়ানো শেষ। যাত্রীসহ সবার খাওয়া শেষ। তন্ময়রা সবাই এক টেবিলে খেতে বসছে। ওদের টেবিলে সবার প্লেটে রোস্টের লেগ পিস পড়েছে কিন্তু তরীর প্লেটে পড়েনি।
তন্ময় বলল, “ভাগ্য ভাল মৃন্ময়ের প্লেটে লেগ পিস গিয়েছে। না হলে কার প্লেট থেকে এক্সচেঞ্জ করত তার ঠিক নেই।”
দ্বীপ বলল, ” ছোঁয়া প্লেট ছাড়া আর কার প্লেট। সারাহ তো ম’রে গেলেও লেগ পিস দিবেনা।”
পিহু বলল, ” লেগ পিসের কি খায় শুনি।”
দ্বীপ বলল,” বিয়ে খেতে আসিই তো রোস্ট এর লিগ পিস খেতে।”
এরই মাঝে মৃন্ময় ঘটালো অদ্ভুত একটা ঘটনা। নিজের ভীষণ পছন্দের লেগ পিস সে তরীর প্লেটে তুলে দিয়ে বলল,
“আমি লেগ পিস খাবো না তুমি খাও।”
তরী মায়াভরা গোল গোল চোখে মৃন্ময়ের দিকে তাকাল। এই চাহনি মৃন্ময়ের স্পন্দন যেন থামকে দেয়। কি ভয়ানক মায়া।
পিহু বলল,
“জীবনে তোমার জন্য লেগ পিস খেতে পারিনি আর সেই তুমি কীনা তোমার প্লেটের লেগ পিস তুলে দিলে।”
মৃন্ময় খুব মলিন কণ্ঠে বলল,
” আজ খেতে ইচ্ছা হচ্ছেনা।”
তন্ময় বলল,
” বুঝতে আর কিছু বাকি নেই।”
মৃন্ময় এর সমস্ত অনুভূতিতে পানি ঢেলে এরই মাঝে তরী বলল,
“আমি খাবোনা কাকু।”
দ্বীপ আর তন্ময় দু’জনে এবার বিকট শব্দে হেসে উঠে মৃন্ময়ের দিকে তাকালো। ওদের হাসি মৃন্ময়কে জ্বালিয়ে পু’ ড়ি’য়ে দিচ্ছে। সে কটমট করে তরীর দিকে তাকিয়ে বলল,
“লেগ পিস খাবেনা ভাল কথা আমার ক-লি-জা চিবিয়ে খাও তাও আর চাচা চাচা কইরোনা।তোমার পায়ে ধরি, তোমার হিটলার বাপের ও পায়ে ধরি।”
আবার ওরা খাবার টেবিলে ওরা হাসিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
ঘন্টাখানিকের মাঝে বিয়ের গাড়ি পৌঁছে গেলো সিদ্দিকী বাড়ির সদর দরজায়। সম্পূর্ণ একটা অচেনা জায়গা,অচেনা মানুষ এবং নতুন পরিবেশের মুখোমুখি হল সারাহ। প্রতিটা মেয়ের ই বোধহয় এই জার্নিটা জীবনের সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং ভয়াবহ জার্নি। গাড়ি থেকে সারাহকে নামানোর সাথে সাথে মানুষের ঢল নামল নতুন বউ দেখার জন্য। চারদিক থেকে গোটা বিষেক ক্যামেরা সারাহর সামনে। সবাই যে যার মত ছবি তুলতে ব্যস্ত। সারাহ’র বেশ অস্বস্তি হচ্ছে আবার লজ্জা ও করছে। রোশানের আম্মা মিষ্টি আর সরবত হাতে দাঁড়িয়ে আছেন ছেলের বউকে বরণ করার জন্য। পরপর কয়েকজন গালে চিনি দিচ্ছে আর বলছে বউ-এর কথা যেন মিষ্টি হয়। রোশান থম মেরে দাঁড়িয়েই রয়েছে। তার বেশ অসহ্য লাগছে চোখ, মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। রোশানের কাছে মনে হচ্ছে এগুলা যেন একটা মেয়কে রিতীমত টর্চার ছাড়া আর কিচ্ছুই না। রোশান দাঁতে দাঁত চেপে তার আম্মার কানের কাছে গিয়ে খুব আস্তে বলল,
” এসব ক্লোজ করো প্লিজ! আমি বিরক্ত হচ্ছি।”
রোশানের আম্মা জানে তার ছেলের এসব পছন্দ না। এমন কি বিয়েতে গায়ে হলুদটুকুও সে লাগায়নি, হাতে মেহেদী দেয়নি। মনে মনে বিড়বিড় করে বলল,
‘ এ ছেলের কি জীবনে বাচ্চা কাচ্চা হবে?’
বউ বরণের সময় সারাহ খেয়াল করল তার থেকে বয়সে বেশ খানিক বড়, সুন্দরী একজন মেয়ে কেমন আড়চোখে সারাহ’র দিকে চেয়ে আছে। তার দৃষ্টিতে ভয়ংকর ঘৃণা। সারাহ মনযোগে মেয়েটিকে দেখে বোঝার চেষ্টা করছে মেয়েটি কেন ওভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে। নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। অকারণ তো আর কেউ কারো দিকে ঘৃণা ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেনা। সারাহ তাৎক্ষণিক ভেবে নিলো এ কি তার বরের প্রাক্তণ। সারাহ পারলে এক্ষুণি রোশানের কলার ধরে জিজ্ঞেস করত,
” মেয়েটি কে? তার দিকে ওভাবে তাকিয়ে আছে কেন? ”
সারাহ এমনিই কৌতুহল বেশী সব বিষয়ে তবে ধৈর্য্য একেবারে নেই বললেই চলে। মেয়েটি কেন তার দিকে ওভাবে তাকিয়ে আছে সেই ধৈর্য্যটুকু এখন পাচ্ছেনা। বউ বরণ শেষ হলে নতুন বউ ঘরে নেওয়ার পালা এবার। রোশানের দাদু বললেন,
” একজন কোলে তুলে নিতে হবে। নতুন বউ কে হাঁটিয়ে নেওয়া যাবেনা।”
রোশানের ভাই ওশান বলল,
” তাহলে দাদুই কোলে নিক, কি বলো দাদু।”
দাদু বললেন,
” আমার কি আর সেই দিন আছেরে। থাকলে এত সময় দেখতি।”
লাফ দিয়ে এসে রোশানের চাচাত ভাই বলল,
” ভাবিকে আমি কোলে নিয়ে ঘরে যাচ্ছি।” কথাটা রোশানের কর্ণকুহরে যেতেই তার চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে গেল। পৃথিবীর সমস্ত অসহ্যকর অনুভূতি তার মাঝে বাসা বাঁধল। মানে কি? তার বউ অন্য একজন কোলে নিবে। মানুষের মাঝে যেখানে বউ এর হাত ধরাটাই রোশানের কাছে ভয়ানক ব্যাপার সেখানে সাথে সাথে সারাহকে পাজা কোলে তুলে নিয়ে বলল,
” কাউকে নিতে হবেনা, আমার বউ আমিই নিচ্ছি।” বলেই সোজা হেঁটে ঘরের দিকে রওনা হল। সবাই হা করে রোশানের দিকে তাকিয়ে রইলো। এ কি সেই রোশান যাকে ধরে বেঁধে বিয়ে দেওয়া যাচ্ছিলো না। আজ সে নিজের বউকে কোলে করে ঘরে নিচ্ছে। পুরুষ মানুষ কি সত্যি তাহলে বউ পেলে পরিবর্তন হয়ে যায়। রাত সাড়ে দশটা বেজে গিয়েছে। নতুন বউকে ঘিরে অনেক আনন্দ, উৎসব চলেছে এত সময়। রাত এগারোটার সময় সারাহ’কে বাসর ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। রোশানের ঘরের সামনে যেতেই সারাহ’র নাকে মিষ্টি বেলি ফুলের ঘ্রাণ ভেষে এলো। দরজায় বেলি ফুল দিয়ে সাজানো।
দরজা খুলতেই সারাহ’র চোখ দু’টো যেন মুগ্ধতায় ভরে উঠল। অনায়াসে কিঞ্চিৎ হাসি ঠোঁটের কোনের ফুটে উঠল। এত সুন্দর বাসর ঘর সে আগে দেখেনি। পুরা ঘরের ওয়ালে রজনীগন্ধ্যা আর তাজাগোলাপ। আর খাটটা সাদা বেলি দিয়ে মোড়ানো যেন। এত এত বেলি ফুল কোথায় পেল? এত পুরট করে বেলি দিয়ে সাজালো কীভাবে? সারাহ ইচ্ছা হচ্ছে ঘরের মাঝে ঘুরে ঘুরে নাচতে। সব ক্লান্তি,সব রাগ, সব দুঃখ এই ফুল দেখে কেটে গিয়েছে। কয়েকজন মিলে সারাহ’কে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে চলে গেল। সারাহ’র ইচ্ছা হচ্ছে প্রচুর ছবি তুলতে কিন্তু চারদিকে মানুষ, কীভাবে ছবি তুলবে। ঘরে এখন কেউ নেই। সারাহ’ র মোবাইল সারাহ’র হাতেই ছিলো। সে কিছু সেল্ফি নিচ্ছিলো। এমন সময় দরজার কড়া নড়ার শব্দ হলো। সারাহ তাৎক্ষনিক দরজার দিকে তাকালো। তাকিয়ে দেখল রোশান স্যার ভ্রু উঁচিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সারাহ দ্রুত ফোনটা নামিয়ে ফেলল। মনে মনে বিড় বিড় করতে করতে বলল,
” আসার আর সময় পেলনা, ছবিগুলা ও মন ভরে তুলতে পারলাম না।”
রোশান ঘরে ঢুকেই দরজার সিঁটকিনি লাগিয়ে দিলো। সাথে সাথে সারাহ’র বুকের মাঝে কেঁপে উঠল। এই অসহ্য লোকটা সিঁটকিনি কেন লাগিয়ে দিলো। সারাহ’র মাথার মাঝে ভো ভো করে উঠল। বাসর ঘর মানে কি কি হয় সে বিষয়ে সে ভালোই জানে। বিবাহিত বন্ধবীগুলা তাকে আগেই ইঁচড়ে পাকিয়ে ফেলেছে। এখন কি তার সাথেও সেসব হবে। কখনোই না সে এসব পঁচা কাজ কিছুতেই পারতে পারবে না।
নাউজুবিল্লাহ, অস্তাগফিরুল্লাহ মানুষ যে কেন বিয়ে করে। খালি খালি এক বেটার সাথে ঘরের দরজা লাগিয়ে সুয়ে থাকার জন্য তারপর দুনিয়ার অকাজ,কুকাজ করার জন্য। ওইসব অকাজে সারাহ নেই। ওইসব পাপী কাজ সে কিছুতেই করবেনা। রোশাণের হাতে একটা প্যাকেট। দরজা লাগিয়ে প্যাকেটটা সেন্টার টেবিলের ওপর রেখে সারাহ’র দিকে তাকালো। সারাহ’র মুখের অবয়ব দেখে রোশান বুঝতে পারল এই মেয়ে দুনিয়ার কথা ভাবছে। তার তো ভাবনার কোনো শেষ নেই। নিশ্চয়ই আকাশ পাতাল অনেক কিছু ভাবা হয়ে যাচ্ছে। রোশান সারাহ’র দিকে আড়চোখে একবার তাকিয়ে বলল,
” শাড়িটা চেঞ্জ করে নাও। এত ভারী শাড়ি পরে ঘুমোতে পারবে না।”
বলেই আলমারি থেকে কালো রঙের ট্রাউজার আর সাদা টি-শার্ট বের করে ওয়াশরুমে প্রবেশ করল। মিনিট পাঁচেক পর ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখল সারাহ এখনো বিছানায় বসে রয়েছে। রোশান চোখের চশমাটা চোখে দিতে দিতে বিছানায় গিয়ে বসল। সারাহ’র দিকে তাকিয়ে বলল,
” কি ব্যাপার তুমি চেঞ্জ করোনি।”
রোশানকে বিছানায় আসতে দেখে সারাহ’র বুক আবার কেঁপে উঠল। এখন কি উনি সেসব শুরু করবেন। সারাহ থতমত খেয়ে বলল,
“এ কি আপনি কি এখন ঘুমোবেন?”
রোশান ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
“ঘুমোতে নিষেধ করছো?”
সারাহ’ র ইচ্ছা হচ্ছে হাজারখানিক ছবি তুলতে। এই আনরোমান্টিক লোক কীভাবে বউ এর সাথে কাপল ছবি না তুলে ঘুমোনোর প্ল্যান করছে। এত এত ফুল দেখলে তো এমনিই রোমান্স চলে আসার কথা মনের ভেতর। তার ওপর আবার সুন্দরী বউ। অন্তত একটা সেল্ফি তুলে তো নিজের সেরওয়ানি চেঞ্জ করতে পারত। না সেসব কিচ্ছু না। দিব্বি ঘুমোতে চলে এসছে। কি ভেবেছে কোনো রোমান্স ছাড়া অকাজ করতে চাইলেই তা সম্ভব হবে। এমনিও আমি ওনার সাথে কোনদিন কিচ্ছু করতাম না। তার ওপর এমন আনরোমান্টিক।
রোশান গম্ভীর কণ্ঠে আবার ও বলল,
” কি হল? ”
সারাহ বিরক্ত কণ্ঠে বলল,
“এই রাতে কেউ ঘুমায়।”
রোশান কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“তাহলে কি করে?”
“জানেন না যখন বিয়ে করেছেন কেন?”
রোশান সারাহ’র দিকে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে বলল,
“আচ্ছা তুমি তাহলে আমাকে বুঝিয়ে দাও কি জন্য বিয়ে করে।”
সারাহ দ্রুত বিছানা ছেড়ে নেমে বলল,
“কাছে আসছেন কেন? আমি ছবি তোলার জন্য বিয়ে করতে চাইতাম। অন্য কিছু না।”
রোশান ভ্রু যুগল উঁচিয়ে প্রশ্ন করল,
একটি নির্জন প্রহর চাই সিজন ২ পর্ব ১৮
” ছবি তোলার জন্য ও মানুষ বিয়ে করে।”
সারাহ দ্রুত কন্ঠে বলল,
” হ্যাঁ করে, করবে না কেন? আমার আইডির রিচ ডাউন। একমাত্র বিয়ের ছবিই ভরসা আইডির রিচ বাড়ানোর জন্য। ফটাফট
আমার সুন্দর কিছু ছবি তুলে দিন তো।”
রোশান চোখের চশমাটা খুলে আশ্চর্যজনক চাহনিতে সারাহ’র দিকে তাকিয়ে আছে। এমন উদ্ভট কথা কি আগে পরে কেউ বলেছে।এটা বউ নাকি বো’ম।