এলিজা পর্ব ৯০+৯১
Dayna
দেখতে দেখতে কেটে যায় ১৫ টি বছর। এলিজার মৃত্যুর পর পরই জাহাঙ্গীর স্ট্রোক করে।২০০১.০৫.০১ তারিখে জাহাঙ্গীর মৃত্যু বরন করেন।
এলিজা দুনিয়া ছেড়ে চলে যাওয়াতে জয়তুন, এবং রমজান দুজনেই ভেঙে পরে। একসময় রমজান হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। জয়তুন এখন ও বেঁচে আছে। তবে নিজের শক্তিতে চলার মত অবস্থায় নেই।তাই তাকে দেখা শোনার জন্য অপূর্ব চৌধুরী তার পরিবার থেকে একজন কাজের মহিলাকে ঠিক করে দিয়েছে।যার খরচা অপূর্ব চৌধুরী নিজেই বহন করেন।
১৬ মার্চ ২০০০ তারিখে থমকে গিয়েছিল অপূর্ব চৌধুরী। শেষ হয়ে গিয়েছিল একটি উৎফুল্ল মানুষের হৃদয়।সারাক্ষন মুখে এঁটে থাকা সুখ নিমিষেই ফুরিয়ে গিয়েছিল। হাজারো চেষ্টা, হাহা,কার কাকুতি মিনতি,করেও পারেনি তার প্রিয় মানুষটিকে বাঁচাতে। অপরাধী ছিল তার প্রান প্রিয় স্ত্রী।পরপর ৪২ টা খু,ন করার পর ও তার স্ত্রী ছিল তার কাছে নিষ্পাপ। এলিজার রুপের ঝলক,চুলের দর্পন,মায়াবী হাঁসি,নেশাযুক্ত চোখ, আলতো হাতের স্পর্শ যা ছিল অপূর্বর প্রতিদিনের অভ্যাস। এলিজার তির্ঝক কন্ঠ,যে কন্ঠস্বর অপূর্ব কে বারবার ক্ষতবিক্ষত করে দিতো।প্রতিটি ঘরের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে এলিজার স্মৃতি। যে স্মৃতি জড়িয়ে বেঁচে আছে অপূর্ব। এলিজা মৃত্যুর আগে তার ঘরটি নিজ হাতে যেভাবে সাজিয়ে, গুছিয়ে রেখেছে,১৫ বছর পর সেই ঘরটি তেমনি আছে। এলিজার ব্যবহৃত শাড়ির, স্নিগ্ধ গন্ধ শুঁকে অপূর্বর প্রতিদিনের সকাল শুরু হয়। তার দেয়া প্রথম ও শেষ চিঠি প্রতিদিন নিয়ম করে কয়েক প্রহর বুকে জড়িয়ে রাখে।যেভাবে জড়িয়ে ছিলো এলিজা।আজ এলিজা নেই, কিন্তু তার ফেলে যাওয়া স্মৃতির জোয়ারে ভাসছে অপূর্ব। অপূর্বর মস্তিষ্কের নিউরনের ভাঁজে ভাঁজে মিশে আছে তার প্রিয়তমা স্ত্রীর স্মৃতি।যা চাইলেও কোনদিন ভুলে যাওয়ার নয়।
অর্পা ,তার মা বাবা , এবং বউমনি চলে যাওয়ার পর সিদ্ধান্ত নেয় কোনদিন বিয়ে করবে না। তার ভাইয়ের দেখা শুনা করবে। রক্তের সঙ্গি হয়ে থাকবে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
অর্পা সকালের নাস্তা তৈরি করে অপূর্বর ঘরে আসে। কিন্তু অপূর্ব নেই। দ্রুত পায়ে হেঁটে নিচে আসে।এদিক সেদিক চোখ বুলিয়ে দেখলো কোথাও নেই।বাড়ির বাহিরে বের হয়।দেখলো বায়েজিদ হাতে তসবিহ নিয়ে পায়চারি করছে।পরনে পাঞ্জাবি।অর্পা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, বায়েজিদ ভাইয়া, অপূর্ব ভাইয়া কোথায় গেছে?ঘরে তো নেই!
বায়েজিদ অর্পাকে হাতের ইশারায় গেটের বাহিরে দেখিয়ে দেয়।
অর্পা গেটের বাহিরে আসে।এদিক সেদিক পরোক্ষ করে দেখলো, অপূর্ব হাতে ভারবহন লাঠি নিয়ে এলিজার কবরের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। অপূর্বর বর্তমান বয়স ৪৫। কিন্তু দেখে মনে হয় ৬০ বছরের বৃদ্ধা। এলিজা চলে যাওয়ার পর দ্বির্ঘদীন হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হয়। মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পরে।যা সেরে উঠতে ৮ মাস সময় লেগেছিল। নিজের যত্ন নিতেও ভুলে যায়। অনিদ্রা, পানাহারে থাকতে থাকতে শরীরের বল লক্তি একেবারেই চলে গেছে।
অর্পা অপূর্বর কাছে এগোয়। জ্বলজ্বল চোখে পরোক্ষ করলো। অপূর্বর হাতে বেলিফুল, এলিজার ব্যবহৃত শাড়ি বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরে রেখেছে।ডান হাতে ভারবহন লাঠি। হাঁটার জোড় তো সেদিন ই ফুরিয়ে গিয়েছিল,যেদিন তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে ফাঁ,সির দড়িতে ঝুলতে দেখেছে।
বাঁচানোর জন্য পারি দিয়েছিল ১০০ সিড়ি। কিন্তু পারেনি।কারন তার প্রান প্রিয় স্ত্রী নিজেই চেয়েছিল তার মৃত্যু।
অর্পা ভাঙ্গা গলায় বলল, ভাইয়া,ঔষধ খাওয়ার সময় হয়েছে। এভাবে বেশিক্ষণ দাড়িয়ে থাকলে রাতে পা বেথা করবে। আবার অসুস্থ হয়ে পরবে। অপূর্ব কাঁপা চোখে অর্পার দিকে পরোক্ষ করলো। অপূর্ব বাড়ির উদ্দেশ্যে হাটা শুরু করে।অর্পা অপূর্বর হাত ধরলো। অপূর্ব ফিরে আসতে আসতে,পেছন ঘুরে এলিজার কবরের দিকে একবার দৃষ্টি স্থাপন করলো।
অর্পা অপূর্ব কে সোফাতে বসিয়ে দেয়।
শান্ত স্বরে বললো, তুমি বসো,আমি খাবার আর ঔষধ নিয়ে আসছি।
অপূর্ব কে অর্পা খাইয়ে দিতে দিতে বললো, বউমনি চলে গেছে ১৫ বছর। কিন্তু তার উপর থেকে তোমার ভালোবাসা এক চুল পরিমান ও কমেনি। অপূর্ব মৃদু হাসলো। অপূর্ব আজকাল কথা বলে না।তার কন্ঠস্বর থেকে হ্যা,বা না,ছাড়া কোন বাক্য সহজে বের হয়না।
অপূর্ব কে ঔষধ খাইয়ে দেয়।
তৎক্ষণাৎ উপস্থিত হয় শ্রাবন। শ্রাবন অপূর্বর কাছে বসে। অপূর্ব মৃদু হাসলো। শ্রাবন অর্পাকে বললো,খিদে পেয়েছে আমাকেও খাবার দে।
অপূর্ব কাঁপা কন্ঠে বললো,ফ্যাক্টরিতে সবকিছু ঠিক আছে? শ্রাবন হাতে মোবাইল বের করে বললো,সব ঠিক আছে। আমাদের বাংলাদেশ গ্লাসকোফ ফরেন্সিক ডিপার্টমেন্ট থেকে ইনভাইট করেছে। সেখানে আজকে ইভেন্ট।
অপূর্ব শ্রাবণের দিকে দৃষ্টি স্থাপন করে কাপা ঠোঁটে বললো, কিসের? শ্রাবন বললো,সেটাতো গেলেই বোঝা যাবে। আজকে সন্ধ্যায় আমাদের যেতে বলেছে। এবং বিশেষ করে তোকে। অপূর্ব যেতে রাজি হয়।
সন্ধ্যা বেলা শ্রাবন ইভেন্টে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়। মমতাজ হাতে ভারবহন লাঠি নিয়ে,কাপা শরীরে শ্রাবনের ঘরে আসে। কাপা কন্ঠে বললো, কোথায় যাস? শ্রাবন মৃদু হেসে বললো, আজকে ইভেন্ট আছে।যেখানে বিশেষ অতিথিদের মধ্যে একজন অপূর্ব।তাই সেখানে যাচ্ছি। মমতাজ খাটের কোনে বসে বললো, অপূর্বর হাঁটতে সমস্যা হয়।দেখে শুনে নিয়ে যাস।
শ্রাবন অপূর্বর ঘরে আসে। শ্রাবন ঘরের ভেতর প্রবেশ করতেই বুকের ভেতর দুবার চাপ সৃষ্টি হয়। এলিজা তার মৃত্যুর আগে ঘরটি যেভাবে সাজিয়ে রেখেছে ঠিক সেরকম সবকিছু। অপূর্ব কাউকে ঘরে প্রবেশ করতে দেয়না।ঘরের জিনিসপত্র পরিষ্কার করতে চাইলে , কাউকে পরিষ্কার করতে দেয় না। অর্পা বিছানা গুছাতে চাইলে অপূর্ব বারন করে। এলিজা যেভাবে বিছানার চাদর,বালিশ রেখেছে ১৫ বছরের ব্যবধানে সব সেভাবেই আছে। অপূর্ব খাটের উপর বসে আছে। শ্রাবন গলায় কাশি দিয়ে বললো, চল বের হই। অপূর্ব নড়েচড়ে বসল।
শ্রাবন খাটের পাশে দাড়ায়।নত কন্ঠে বললো,আমি তোর কষ্ট টা অনুভব করতে পারি।তোর প্রতিটা মুহূর্ত আমি উপলব্ধি করতে পারি। কিন্তু তাই বলে নিজেকে এভাবে শেষ করিস না। নিজের যত্ন নে। মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে তোল। অপূর্ব ভেজা কন্ঠে বললো,মুখের হাসিটা সেদিন ই ফুরিয়ে গেছে ,যেদিন আমার ম্যাডাম ,আমাকে ছেড়ে চিরতরে হারিয়ে চলে গেছে।
শ্রাবন অপূর্ব কে কিছুক্ষণ বোঝানোর পর, ইভেন্ট এর উদ্দেশ্য বের হয়।
বাংলাদেশ গ্লাসকোব ফরেন্সিক ল্যাবের সামনে হাজার ও মানুষ ভির করেছে। রিপোর্টার, থেকে শুরু করে,গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ সবাই উপস্থিত।
অপূর্ব কে দেখে একজন ফরেন্সিক ডাঃ এগিয়ে আসে। ডাঃ জুনায়েদ বললো, মি. অপূর্ব, আজকে বাংলাদেশের অনেক বড়
সায়েন্টিস্ট কে শুভেচ্ছা জানানো হবে। এবং তাকে স্বর্নের মেডেল প্রদান করা হবে। কিন্তু উনি তখন বললো, আমি আমার অর্জন, মি.অপূর্ব চৌধুরীর হাত থেকে নিতে চাই।
অপূর্ব কাঁপা কন্ঠে বললো কে সে?ডাঃ জুনায়েদ বললো, ভেতরে আসুন। জানতে পারবেন। শ্রাবন অপূর্বর এক হাত ধরে রেখেছে।
কিছুক্ষণ এর মধ্যে ই অনুষ্ঠান শুরু হয়।
একজন উপস্থাপক তার নিয়মানুসারে কার্যক্রম শুরু করে। উপস্থাপক বলতে শুরু করলো, জীবন মানেই একটা যুদ্ধ।কেউ এই যুদ্ধে হার মেনে যায়,তো কেউ জিতে যায়।জীবনে চলার পথে হাজার ও বাধা বিপত্তি আসে। জীবনে সফল হতে হলে , থাকতে হয় ইচ্ছাশক্তি,থাকতে হয় প্রচেষ্টা,রাখতে হয় ধৈর্য, এবং অন্যর দেয়া কষ্ট গুলো উপেক্ষা করতে পারলেই সফলতা অর্জন করা যায়। কখনো কখনো নিজের পরিবারের মানুষ গুলো ও বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কখনো কখনো কেউ মনের সাথে সাথে,শরীর ও পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়। কিন্তু সমস্ত ঝড়ঝাপটা পার হয়েও এগোতে হয় সামনে।
মনে রাখতে হয় ”সফলতার মুল মন্ত্র কষ্ট, বিশ্বাসঘাতকতা, এবং সমালোচনার শিকার ‘।একটি খারাপ পরিস্থিতির জন্য শিকার হতে হয় , সমালোচনার। কিন্তু কখনো কোন পরিস্থিতিতে,অন্যর বলা বাক্য গুলো কানে নেয়া যাবে না।যত অন্যর বলা নিচু কথা গুলো কানে নিবে, মস্তিষ্ক আমাদের তত হয়রানি হবে।তাই সর্বদা নিজের ইচ্ছা শক্তি কাজে লাগিয়ে সামনে এগোতে হবে।
আজকে আমরা আমাদের মাঝে এমন একজন ব্যাক্তি কে সম্মান প্রদর্শন করবো,যে জীবনে অনেক সংগ্রাম এবং যুদ্ধ করে আজকের অনেক বড় একজন সায়েন্টিস্ট হয়েছে। আমরা ডেকে নিচ্ছি আজকের সেরা সফল ব্যক্তি কে। মঞ্চে উপস্থিত হবে, সায়েন্টিস্ট খুশি।
তৎক্ষণাৎ অপূর্ব হকচকিয়ে উঠে।সবাই কোলাহল সৃষ্টি করে। অপূর্ব দৃষ্টি আকর্ষণ করে দেখলো। এই সেই খুশি যার মুখ এ,সিডে পুড়িয়ে দেয়া হয়।যে চেয়েছিল একসময়,সে অনেক বড় সায়েন্টিস্ট হবে। কিন্তু পরিস্থিতি তাকে আটকে দেয়।সে ছিল পাখির বিশ্বস্ত বান্ধু।পাখি ই সেদিন খুশিকে অনুপ্রাণিত করার জন্য অপূর্ব কে নিয়ে যায়। এবং অপূর্বর বলা বাক্যে গুলো আজ সফল।
মঞ্চে খুশি উপস্থিত হয়।পরনে সাদা রঙের শাড়ি।চুল গুলো খোঁপা।মুখের ডান দিকের অংশ পোড়ারত।
তৎক্ষণাৎ খুশিকে মেডেল প্রদান করার জন্য অন্যান্য গুনিমান ব্যাক্তির সাথে অপূর্ব কে ডাকা হয়। শ্রাবন অপূর্ব কে ধরে মঞ্চে নেয়। খুশি অপূর্বর হাত থেকে মেডেল পরে। খুশি হাতে মাইক্রোফোন নিয়ে অনেক কথা বললো। খুশির শেষ কথা গুলো ছিল, আমার মুখ যে পুড়িয়ে দিয়েছে,এটা তার ব্যার্থতা। আমার নয়।যারা আমার পোড়া মুখ দেখে ভয় পায়,এটা তাদের ব্যার্থতা, আমার নয়।যে মানুষ গুলো আমাকে, বোঝা মনে করতো, আজকে আমি তাদের দায়িত্ব নিয়েছি।আমি পেরেছি।আমি ১ কে ১০০ তে পরিবর্তন করতে পেরেছি। খুশি ভারী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, আমার সফলতার পেছনে দুজন মানুষের অনুপ্রেরণা ছিল।এক আমার মা এবং দ্বিতীয়জন, যিনি আমার পাশে দাড়িয়ে মি.আপূর্ব চৌধুরী।যিনি আমার রক্তের ভাইয়ের থেকেও আপন। আমার রক্তের ভাই আমাকে বলেছিল,আমি কোনদিন সফল হতে পারবো না। কিন্তু তার ভাবনা বদলে দেয় অপূর্ব ভাইয়া।
আজকে আমি আমার মেডেলটি আমার মা এবং আমার ভাই অপূর্ব চৌধুরী কে উৎসর্গ করতে চাই।
আমরা নারী আমরা চাইলেই পারি। নারি মানে শক্তি নারী মানে ভালোবাসা। “”অসম্ভব শব্দটির মাঝেই লুকিয়ে আছে সম্ভব””
খুশি খুশির বক্তব্য শেষ করে।
ইভেন্ট এ আসা সবাইকে রাতের খাবার দেয়া হয়।যে যার মত খাচ্ছে।
অপূর্ব মুখ ভার করে চেয়ারে বসে আছে। শ্রাবন অপূর্বর কাদে ভরসা সূচক হাত রাখলো। তৎকালীন সময় উপস্থিত হয় খুশি।
অপূর্ব পরোখ করলো।
খুশি অপূর্বর পাশের চেয়ারে বসে ভারী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “”সৃষ্টিকর্তা ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে না ” আমার মুখে যে এসিড নিক্ষেপ করেছিলো ,বর্ষন,সে ৫ বছর আগে তার গার্মেন্টসে আগুন ধরাতে পুড়ে মারা যায়।
অপূর্ব টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি খেয়ে ,কাপা কন্ঠে বললো, মানুষ অন্যায় কারীকে ছেড়ে দিলেও নিয়তি ছেড়ে দেয়না”অভিশাপ মানুষ কে উত্তম থেকে উত্তাপ করে দেয়। ধ্বংস করে দেয়।
ইভেন্ট শেষে সবাই যে যার মত চলে যায়।
রাত ১১:৩০ নাগাদ।
শ্রাবন প্রতিদিন ঘুমানোর আগে অপূর্বর সাথে দেখা করে।নিয়ম করে আজকেও আসে। কিন্তু অপূর্ব ঘরে নেই। শ্রাবন অবাক হয়।এত রাতে কোথায় যাবে।একা একা বেশিক্ষণ হাঁটতে পার না। কোথায় আবার লুটিয়ে পড়ে যাবে ,,এসব ভাবতে ভাবতে শ্রাবন অপূর্বর ঘর থেকে বের হয়। এদিক সেদিক পরোক্ষ করে দেখলো,৩ তলায় স্টোর ঘরে আলো জ্বলছে। শ্রাবন দ্রুত পায়ে উপরে উঠে।গিয়ে দেখলো, অপূর্ব স্টোর ঘরের ভেতর হাতে কিছু একটা নিয়ে দাড়িয়ে আছে। শ্রাবন ভ্রু কুঁচকে বললো এটা কি?
অপূর্ব কিছু বললো না।
শ্রাবন ভালো করে দেখলো। অপূর্বর হাত থেকে বোতলটা নিজের হাতে নেয়, শ্রাবন কাপা কন্ঠে বললো,এটা তো কেমিক্যাল।যেটা শরীরে পুশ করলে ,তার শরীর থেকে হার্ট বের করে নেয়ার পরেও ১৫ মিনিট বাঁচে।দেখে তো মনে হচ্ছে এটা অনেক দিনের পূরানো।
শ্রাবন অপূর্বর চোখে চোখ রেখে বললো,এই কেমি,ক্যাল দিয়ে কি করছিস।আর এটার তো মেয়াদ নেই। অপূর্ব কাপা হাতে বোতলা টা জায়গা মত রেখে দেয়।
বললো,চল ঘরে যাই।
শ্রাবন ভ্রু কুঁচকে বললো,যাবো,আগে বল এটা দিয়ে কি হতো? কেন এটা কিনেছিলিস?
অপূর্ব বললো,বলবো আগে ঘরে চল।
শ্রাবন অপূর্ব কে ঘরে নিয়ে আসে। অপূর্ব কে খাটে বসিয়ে দেয়। শ্রাবন পাশে দাঁড়িয়ে বললো,এবার তো বল, ওগুলো দিয়ে কি হতো?
অপূর্ব বিছানায় শুয়ে বললো, সকালে বলবো।
এখন বললে সমস্যা কি?
অপূর্ব চোখের চশমা টা পাশে রেখে বললো,চাদরটা দিয়ে দে। শ্রাবন চাদরটা জড়িয়ে দেয়। অপূর্ব বা কাদ হয়ে সুয়ে বললো,১৫ বছর আগে , কেমি,ক্যাল কেন এনেছি তা সকালে বলবো।এখন বললে সম্পুর্ন ব্যাখ্যা দিতে পারবো না।
শ্রাবন কথা না বাড়িয়ে শুভ রাত্রি বলে চলে যায়।
মমতাজ দু’দিন ধরে শ্রাবণের সাথে সোয়। মমতাজের শরীর টা ভালো যাচ্ছে না।
রাত ৩ টা নাগাদ। মমতাজ বুঝতে পারলো, শ্রাবন বিছানায় নেই। মমতাজ ঘুরে তাকায়। মমতাজ ঝাপসা চোখে উঠে বসে। বাল্ব জ্বালায়। ঘরের চারদিকে চোখ বুলালো।ঘরে নেই শ্রাবন। মমতাজ ধির পায়ে হেঁটে ঘরের বাহিরে বের হয়। মমতাজ হাতে ভারবহন লাঠি নিয়ে নিচে নামে। মমতাজ দেখলো ,ঘরের দরজা খোলা। বাহিরে কুকুর ডাকছে। মমতাজ কমড়ে হাত দিয়ে কাপা শরীরে বাহিরে বের হয়।টর্চ নিয়ে তাদের পারিবারিক কবর স্থানের দিকে যায়। মমতাজ বুঝতে পেরেছে। শ্রাবন ঘরে না থাকলে, কবরস্থানেই থাকবে। মমতাজ দেখলো, শ্রাবন পাখির কবরের কাছে দাঁড়িয়ে আছে।হাতে মোমবাতি।কে বোঝাবে মৃত মানুষের ভয়,ভীতি থাকে না। তাদের দুনিয়ার অনুভূতি থাকে না। তারা যে এখন পরপারের স্বরধী।সময়টা পেরিয়ে গেছে ,১৫ বছর হয়। কিন্তু শ্রাবন পরে আছে সেই পূরানো স্মৃতি তে। সারাদিন মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখে।যা সম্য অভিনয়। নিজের কষ্ট টাকে লুকিয়ে রাখার জন্য ক্ষনিকের অভিনয়।
মমতাজ ধির কন্ঠে ডাকলো শ্রাবন কে। মমতাজের ডাকে শ্রাবণের ধ্যান ভাঙ্গে।ডুবে ছিলো পাখির তিগ্ন স্মৃতিতে।
শ্রাবন হাতের তালু দিয়ে চোখ মুছলো। কবরের পাশে মোমবাতি টা রাখলো। কবরের উপর হাত দিয়ে অশ্রু চোখে বললো,”মানুষ কেন অল্প সময়ের জন্য জীবনে আসে ”চিরদিনের জন্য কে আসে না।” ভালোবাসার মানুষ কে হারানোর কষ্ট যদি”ভুলে না যাওয়া যায়!তবে কেন সৃষ্টিকর্তা ভালোবাসার মানুষ টির সাথে একই সময় বেঁধে দেয়না!
ঐ পাখি! তুমি চলে গেছো ১৫ টি বছর। কিন্তু তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা সেই প্রথম দিনের মতই অক্ষয় আছে।
তোমার ফেলে যাওয়া স্মৃতি গুলো আমাকে গ্রা,স করে রেখেছে। শ্রাবন মাটিতে লুটিয়ে বসে পরে।
মমতাজ আর ডাকলো না। মমতাজ ধির পায়ে হেঁটে ঘরে চলে যায়।ঘরে যেতে যেতে দেখলো, অপূর্বর ঘরের দরজা খোলা। মমতাজ কিছুটা সামনে এগিয়ে উঁকি মেরে দেখল, অপূর্ব নামাজ পরছে। মমতাজ বুঝতে পেরেছে, তাহাজ্জুদ নামাজ পরছে। অপূর্ব ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।কান্নার ধ্বনি মমতাজ এর কানে ভেসে আসছে। মমতাজ ডান দিকে দৃষ্টি স্থাপন করলো। ২ তলার ডান দিকের জানালা দিয়ে কবরস্থান টা দেখা যায়। মমতাজ বিরবির করে বললো, একজন কাঁদছে কবরের কাছে বসে।অন্যজন কাঁদছে তাহাজ্জুদে বসে।
মমতাজ নিজের ঘরে চলে যায়। শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছে বললো, আমার দুই ছেলে কে ধৈর্য্য ধারন করার ক্ষমতা দাও।
অপূর্ব নামাজ শেষ করে সুয়ে পরে। এলিজার ব্যবহৃত শাড়ি বুকের ভেতর জড়িয়ে ঘুমিয়ে পরে।
রাত গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে।
অপূর্বর ঘুম ভেঙে যায়।টিপ টিপ করে চোখ মেলে দেখলো, বারান্দায় কেউ দাঁড়িয়ে আছে।যার শাড়ির আঁচল টা উড়ে চলে যাচ্ছে অনেক দূর।চুল গুলো ধমকা হাওয়া তে উড়ছে। অপূর্ব বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।কাট গলায় বললো,কে তুমি? বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি ঘরের বাহিরে বের হয়। অপূর্ব পেছন পেছন হাঁটতে শুরু করে। উল্টো দিকে মুখ ঘুরিয়ে থাকা মেয়েটা চলে যাচ্ছে অজানা পথে।যে পথের কোন শেষ নেই। অপূর্ব আশপাশ দৃষ্টিজ্বয় করে দেখলো, চারপাশ প্রকৃতিহীন। কোথাও কোন গাছ নেই,শষ্য নেই।যেমন মরুভুমি হয়,ঠিক তেমন যায়গা। সামনে থাকা মেয়েটি হেঁটেই চলেছে। অপূর্ব জোড় গলায় বললো, কোথায় যাচ্ছো?
মেয়েটি নরম কন্ঠে বললো,অজানা ঠিকানায়।
সেটা কোথায়?
যেখান থেকে কেউ কোনদিন ফিরে আসতে পারে না।
কিন্তু তুমি কে?
উক্ত সময় মেয়েটি অপূর্বর দিকে ঘুরে তাকায়। অপূর্ব স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পরে। অপূর্ব দেখলো তার সামনে থাকা মেয়েটি আর কেউ নয়, এলিজা।
এলিজা অপূর্বর দিকে হাত বাড়িয়ে জ্বলজ্বল চোখে বললো,চলে আসুন না। আমার যে আপনাকে ছাড়া থাকতে কষ্ট হয়।চলে আসুন।আমি প্রতি প্রহর আপনার অপেক্ষায় থাকি। অপূর্ব এলিজার হাত টি ধরতেই এলিজা দৌড়ে চলে যায়। অপূর্ব পেছন পেছন দৌড়াতে থাকে।কাট, গলায় বলতে থাকে,দাড়াও।আসছি আমি। চলে যাচ্ছ কেন আমায় রেখে!
ততক্ষণে এলিজা কোথাও গায়েব হয়ে যায়। অপূর্ব উষ্ন মরুভূমিতে বসে পরে। চাঁদনির আলোয় মরুভূমির বালু চিকচিক করছে। অপূর্ব চারদিকে পরোখ করে দেখলো, কোথাও এলিজা নেই। অপূর্ব বুক ফাটিয়ে কান্না শুরু করে। কম্পন ঠোঁটে বললো,কেন আমায় রেখে গেলে!! কেন এভাবে নিঃস্ব করে গেলে!
কাঁদছিস কেন? এই অপূর্ব! সকাল হয়ে গেছে।উঠে পর।
অপূর্ব চোখ মেলে তাকায়। আশপাশ পরোখ করলো। শ্রাবন দাঁড়িয়ে আছে। অপূর্বর শরীর থেকে বিন্দু বিন্দু ঘাম ঝরছে। শ্রাবন ঝুকে বললো, দুঃস্বপ্ন?
অপূর্ব চশমা টা পরে হ্যা সুচক মাথা নাড়ে।
শ্রাবন বললো, বাহিরে চল।ডাক্তার বলেছে প্রতিদিন সকালে ২০ মিনিট হাঁটতে। অপূর্ব বের হয়।
অপূর্ব শ্রাবন কে বললো,তোর প্রশ্নের উত্তর গতকাল দিতে পারিনি।আজ দেবো।
তো বল! কিসের জন্য ঐসব এনেছিলিস?
অপূর্ব বললো, বাড়ির পেছনের দিকে চল। শ্রাবন অপূর্বর হাত ধরে নিয়ে যায়।একটা গোলাকার জায়গা দেখিয়ে বললো,ঢাকনা টা তোল।
শ্রাবন পাতারহ সরিয়ে দেখলো,মাটিতে কিছু পুতে রাখা।আগ্রহ নিয়ে উপরের পাথরের ঢাকনাটা সরায়।দেখলো,তার ভিতরে কিছু মেডিকেলের সিজার এবং ঔষধ। এবং মাঝারি সাইজের রা,ম দা।
শ্রাবন জিজ্ঞেস করলো, এগুলো কয়েক বছরের পূরানো।
অপূর্ব বললো,১৫ বছরের পূরানো। শ্রাবন হাতে নিয়ে জিনিস গুলো দেখলো।
অপূর্ব ভারী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল এলিজার সমস্ত অতিত যেদিন জেনে গিয়েছিলাম,সেদিন নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছিল। শুধুমাত্র আমার জন্য ওর পরিবার টা বরবাদ হয়ে গেছিলো। আমার হৃদয়ের জন্য নিতে হয়েছিল হাজার ও হৃদয়।তাই চেয়েছিলাম,আমি নিজেই আমার হৃদয় টা খুলে ওর হাতে তুলে দিবো। এবং আমি যে ১৫ মিনিট বেঁচে থাকবো,সেই ১৫ মিনিট এলিজার কোলে মাথা রেখে মৃত্যু বরন করতাম।
শ্রাবন অপূর্বর কাছে এগোয়। মৃদু হেসে বললো,সে অপরাধী যেনেও তাকে ভালো_বেসেছিস।
অপূর্ব মৃদু হেসে বললো,সে আমার কাছে কখনোই অপরাধী ছিল না। যাকে আমরা ভালোবাসি তাকে কখনো ঘৃনা করা যায়না””আর যাকে ঘৃনা করি তাকে কখনো ভালোই বাসিনি।
বেলা ফুরিয়ে বিকেলের আগমন। শ্রাবন অপূর্ব বৈঠকখানায় বসে আছে।
অর্পা দু’জন কে চা দিয়েছে। অপূর্ব শ্রাবন কে উদ্দেশ্যে করে বললো, একটা ইচ্ছা পূরণ করবি?
শ্রাবন মৃদু হেসে বললো, এভাবে বলার কি আছে।
অপূর্ব বললো,আজ এখন একবার,তিলকনগর নিয়ে যাবি?
কেন?
এলিজার সাথে যেসব জায়গায় হাতে হাত, রেখে হেঁটেছি। শেষ বারের মত সেই জায়গা গুলো প্রদর্শন করতে চাই।
শ্রাবন, অপূর্ব আলি বাড়ি, রুশ রাজ্য, দিগন্ত নদীর তীর শেষ বারের মত প্রদর্শন করে।
ফিরে আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। অপূর্ব বললো, একবার এলিজার কবরের কাছে নিয়ে চল।
শ্রাবন, অপূর্ব দু জন মিলে,পাখি, এলিজা, এবং জয়ার কবর জিয়ারত করে।
এলিজা পর্ব ৮৭+৮৮+৮৯
অপূর্ব শ্রাবন কে জ্বলজ্বল চোখে বললো, আমার সমস্ত সম্পত্তি তোর আর অর্পার নামে লিখে দিয়ে যাবো। কালকেই উকিল কে নিয়ে আসিস।আর তার সাথে ঢাকার ১৮ টি বাড়ি বিক্রি করে সেই টাকা এলিজার নাম করে , মসজিদ,মাদ্রাসা, এবং এতিমখানায় দিয়ে দিবি।কারন এসব এলিজার।
শ্রাবন বললো, হঠাৎ এসব বলছিস কেন?
কারন গতকাল এলিজা নিতে এসেছিল।আমি আর বেশিদিন বাঁচব না….