ওয়েলকাম টু মাই ডার্কসাইড পর্ব ৩০

ওয়েলকাম টু মাই ডার্কসাইড পর্ব ৩০
সারিকা হোসাইন

দিনের ঝলমলে আলো গড়িয়ে ধীরে ধীরে দিগন্তে মিলিয়ে যাচ্ছে।একটু আগের মৃদু তাপ বিলিয়ে দেয়া সূর্যটা টকটকে লাল বর্ণ ধারণ করে পশ্চিম আকাশে সমুদ্রের কোল ঘেঁষে বিলীন হবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।ধীরে ধীরে বাড়ছে শীতের প্রকোপ।ভূ-উপরি ভাগের তুলনায় মাঝ সমুদ্রে শীতের মাত্রা যদিও কিছুটা কম।
বিশাল সমুদ্রের নীল জলরাশির বুক চিড়ে ধীরে ধীরে ছুটে চলেছে সাদা রঙের ছয় তলা বিশিষ্ট ক্রুজ শিপটি।চারপাশে শুধু জল আর জলের সমারোহ,দৃষ্টির সীমানায় সমুদ্রের কোনো কুলকিনারা দেখা যাচ্ছে না।শিপটি আপন মনে তার গন্তব্যে ছুটে চলেছে বিরামহীন ভাবে।এই শিপের গন্তব্যের শেষ কোথায় যুবরাজ জানেনা।যুবরাজ শুধু জানে যেকোনো মূল্যে রেহানকে সুস্থ করে বাংলাদেশে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে ।কারন রেহানের এরূপ নৃশংস অবস্থার সাথে কোনো না কোনো ভাবে সে উৎপ্রেত ভাবে জড়িত।

জাহাজের ওপেন ডেক এর বারান্দায় রেলিংয়ে দুই হাত ভাঁজ করে তার উপর থুতনির ভর দিয়ে জাহাজের চারপাশ জুড়ে উড়ে চলা সিগালের দিকে এক মনে তাকিয়ে আছে যুবরাজ সেই সাথে নিজের মনের সাথে চলছে নানান কল্পনা জল্পনা।গোধূলী লগ্নের শিরশিরে বাতাসে যুবরাজের ঝলমলে ছোট করে ছাটা চুলগুলো কিছুটা উড়াউড়ি করছে সেই সাথে পতপত করে উড়ে চলেছে গায়ের সাদা রঙের পাতলা শার্ট আর তার কলার।এই অল্প কদিনেই যুবরাজের মুখের মসৃন ত্বকে মলিনতা জেঁকে বসেছে।যেই গাল দুটো ক্লিন শেভে চকচকে দ্যুতি ছড়াতো সেই গাল দুটো খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে ভরে গিয়ে যুবরাজের বয়স আরো দুই ধাপ বাড়িয়ে দিয়েছে। আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেরই চিনতে বড্ড কষ্ট হয় তার।মুহূর্তের ব্যাবধানেই গন্তব্যহীন নাবিকের ন্যায় তার জীবনের রূপরেখা মোড় নিয়েছে।ভাগ্যই তাকে এখন সব কিছু নির্ধারণ করে দেবে কেননা তার নিজের হাতে এখন আর তার ভাগ্য নেই।যুবরাজ তার গভীর বাদামি দৃষ্টি মেলে ধীরে ধীরে সমুদ্রের অতলে তলিয়ে যাওয়া সূর্যের টিমটিমে আলো দেখছে আর শ্লেষত্বক হাসছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“নানান ঝড় ঝাপটায় পেরিয়ে গিয়েছে পনেরো টি দিন।আমাকে না পেয়ে পাপা আর মা কি খুব বেশি ভেঙে পড়বে?আমার কি একবার তাদের সাথে যোগাযোগ করা উচিত?কিন্তু কিভাবে যোগাযোগ এর মাধ্যম খুঁজে পাবো এই মাঝ সমুদ্রে?যদি পাপা কোনো ভাবে আমার জেল হওয়া বা পালিয়ে যাবার নিউজ শুনতে পায় তখন কি হবে?আমার এক্সপ্লেনেশন উনার বিশ্বাস হবে তো?
আজকাল নিজের জীবন যুবরাজের কাছে খুব খুব দুর্বিষহ ঠেকছে।সামান্য ভাবলেই চোখের দুকূল ছাপিয়ে অশ্রুরা এসে হানা দেয়।চিৎকার করে কান্না করতে খুব ইচ্ছে করে।কিন্তু ছেলে মানুষের এতো ফ্যাচফ্যাচ কান্না কি মানায়?
এরকম জীবন তো তার কাম্য ছিলো না।তবে চারপাশ থেকে হতাশা আর বিবিধ ভয় কেনো তাকে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে বারংবার?

নিজের জীবনের সমীকরণ কিছুতেই মেলাতে পারছে না যুবরাজ।তার মনে হচ্ছে সে যদি এই সিগাল গুলোর মতো বাধা হীন স্বাধীন ভাবে চলতে পারতো তবে কতই না ভালো হতো!কিন্তু এখন কি আর তা সম্ভব?সে তো এখন আর কোনো ডাক্তার ফাকতার নয় ।সেতো এখন জেল পলাতক খু*নের ওয়ান্টেড আসামি।
“এতক্ষনে নিশ্চয়ই পুরো নিউইয়র্ক জুড়ে আমার জেল থেকে পালানোর খবর ফলাও হয়ে গিয়েছে।পুলিশ বোধ হয় হন্যে হয়ে আমাকে খুঁজছে।অবশ্যই টিভিতে টিভিতে সংবাদ মাধ্যম গুলো রসিয়ে রসিয়ে আমাকে জড়িয়ে খুব বিশ্রী খবর প্রচার করে চলছে সমানে।আর শেরহাম?সেকি আমার পালানোর খবর জানতে পেরেছে?কিসের এতো শত্রুতা আমার সাথে তার?সেতো আমার আপন মামাতো ভাই”!

আর ভাবতে পারেনা যুবরাজ।লম্বা হাত যুক্ত শার্টের কাফ দিয়ে চোখের জল মুছে পুনরায় জাহাজের প্রোপেলার এর ঘূর্ণনে দ্বিভাগ হয়ে যাওয়া ঢেউয়ের দিকে দৃষ্টি বুলায়।
“ডক্টর ইউভি আপনার বন্ধুর শ্বাস প্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়েছে,প্লিজ কাম উইথ মি।”
বিদেশি ক্রুজ ডাক্তার এর কথা কর্ণপাত হতেই যুবরাজ যেনো কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেললো।নির্বাক হয়ে শূন্য দৃষ্টিতে ডক্টর এর দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করলো সে যা শুনেছে সেটা সঠিক কিনা!
যুবরাজের মুখের অবয়ব দেখেই ডক্টর নিকোলাস মৃদু হাসলেন।এরপর যুবরাজের কাঁধ চাপড়ে বলে উঠলেন
“ডোন্ট ওয়ারি,হি উইল রিকোভার সুন”

যুবরাজকে চোখের ইশারায় তাগাদা দিয়ে ডক্টর নিকোলাস প্রস্থান নিলেন।যুবরাজ নিজেকে ধাতস্থ করে ডক্টর এর পিছু পিছু আইসিইউ রুমের দিকে দ্রুত পদে অগ্রসর হলো।
লাইফ সাপোর্ট এর সকল মেশিন অক্সিজেন মাস্ক,আরো যাবতীয় যন্ত্রপাতি খুলে নরমাল একটি কেবিনে শিফট করা হলো রেহানকে।যুবরাজের ধারনাই সত্যি হয়েছে।রেহান ব্রেন ডেথ নয়।তার শারীরিক কন্ডিশন আগের তুলনায় অনেকটাই ভালো।মুখের পুড়ে যাওয়া বিকৃত অবস্থা ছাড়া আর বাকি কন্ডিশন পুরোপুরি ওকে।এখন শুধু জ্ঞান ফেরার পালা।বাকি ডক্টরদের মধ্যে রেহানের অবস্থা নিয়ে যতোটা খুশি দেখা গেলো যুবরাজের মধ্যে তার সিকি ভাগ ও দেখা গেলো না।

কিছুক্ষনের মধ্যেই রেহান খুবই ধীরে ধীরে নিজের পায়ের আঙ্গুলি আর হাত নাড়াতে সক্ষম হলো।সেই দৃশ্য দেখে বাকি ডক্টরস দের মুখের হাসি প্রশস্ত হলো কিন্তু যুবরাজের ভয় দ্বিগুন হারে বাড়তে লাগলো।এক সময় যুবরাজের বুক ভার হয়ে দুই পা অসাড় হয়ে এলো।বলহীন মানুষের মতো পাশে থাকা চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লো যুবরাজ।
“ডক্টর ইউভি আর ইউ ওকে?
নার্সের চিকন সুরের উদ্বিগ্ন আওয়াজ যুবরাজের কর্ণকুহরে পৌঁছালো না।সে শুধু রেহানের কথা ভেবে চলেছে।
“রেহান তুই তোর এই অবস্থা সহ্য করতে পারবি তো?নিজের নিখুঁত সুদর্শন চেহারা হারিয়ে নিজেকে কিভাবে ধরে রাখবি তুই?আমি তোকে সামলাতে পারবো তো?

যুবরাজের মনের ভয় প্রবীণ ডক্টর নিকোলাস সহজেই বুঝে গেলো।রেহানকে দ্রুত হাতে কিছু ইনজেকশন পুশ করে যুবরাজকে এক প্রকার বগল দাবা করে কেবিনের বাইরে নিয়ে এলো।
“ডক্টর ইউভি ডোন্ট ওয়ারি।এখন এসব কোনো চিন্তারই বিষয় নয়।আজকাল চিকিৎসা বিজ্ঞান অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে।গড এর কাছে প্রে করুন সে জানে বেঁচে আছে।চেহারা সে তো চাইলেই পরিবর্তন করা যায়।
ডক্টর নিকোলাস এর স্মিত হাসি যুক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে যুবরাজ বলে উঠলো
“যখন সে সুস্থ ছিল সে একজন সুদর্শন পুরুষ ছিলো।আজ তার চেহারা কুৎসিত অঙ্গার এর ন্যায়।এটা সে কিভাবে মানবে ডক্টর?
যুবরাজের হতাশা কমাতে ডক্টর নিকোলাস নিজের ওয়ালেট বের করে তার থেকে একটা কার্ড বের করে যুবরাজের হাতে দিলো

“হি ইজ মাই ফ্রেন্ড এন্ড অলসো এ প্লাস্টিক সার্জন,শারীরিক পুনর্গঠন বা রূপ বর্ধক তার বা হাতের খেল।শুধু আমার পরিচয় দেবে।আর কিচ্ছু লাগবে না।আম সিউর ইউ উইল নট বি ডিসাপয়েন্টেড।”
ডক্টর নিকোলাস এর হাত থেকে কার্ডটি নিয়ে যুবরাজ কিছুক্ষন উল্টে পাল্টে দেখলো।এরপর চকচকে চোখে ডক্টর এর দিকে তাকিয়ে অধিক উচ্ছাসের সহিত বলে উঠলো।।
“থ্যাঙ্কিউ ডক্টর,থ্যাঙ্কিউ।আম রেস্পন্সিবল ফর হিজ কন্ডিশন।আমি কোনো ভাবেই তার এই অবস্থা মেনে নিতে পারছি না।বারবার নিজেকে চরম দোষী মনে হচ্ছে।আমি তার হতাশা আর বিষাদ গ্রস্ত হীনমন্যতায় ভোগা চেহারা কখনোই সহ্য করতে পারবো না।তাকে খুশি রাখার জন্য আমি সব কিছু করতে রাজি আছি ডক্টর”
ডক্টর নিকোলাস যুবরাজকে আশস্ত করে কেবিনে ঢুকে গেলেন।একটু পর যুবরাজ দ্রুত পদে কেবিনে ঢুকে রেহানের জ্ঞান ফেরার প্রতীক্ষা করতে লাগলো।নির্দিষ্ট সময় পার হবার পরও রেহান যখন চোখ মেলে তাকালো না তখন সকলের মনে দ্বিতীয় ভয় জেঁকে বসলো।

“ডক্টর রেহান কি কোমায় চলে গেলো?
ডক্টরদের মুখায়ব দেখে যুবরাজ যা আন্দাজ করার তা করে ফেললো।বিচলিত উদ্বিগ্নতা কাটিয়ে রেহানের বেডের কাছে এসে হাত টেনে ধমকে উঠলো যুবরাজ।
“এই উঠ,অনেক হয়েছে তোর নাটকবাজি,এসব হাইড এন্ড সিক মোটেও ভালো লাগছে না আর।এক থেকে তিন পর্যন্ত গুনবো।এর মধ্যে না উঠলে চিরতরে জেগে ওঠার সব পথ বন্ধ করে দেবো বলে দিলাম।
যুবরাজের এমন হুংকারে পাশে থাকা ডাক্তার গুলো নড়েচড়ে উঠলো এবং যুবরাজকে শান্ত করার চেষ্টা চালালো।কিন্তু যুবরাজ কি সেসব শোনার পাত্র?
ডক্টরস দের সকল নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে পুনরায় টেনে বালিশে হেলান দিয়ে রেহানকে বসিয়ে নাসারন্ধ্র চেপে ধরলো যুবরাজ।
এটা দেখে ডক্টর নিকোলাস চিৎকার করে উঠলো

“ডক্টর ইউভি আর ইউ ম্যাড?প্লিজ কাম ডাউন,কাম টু ইউর সেন্স”
কিন্তু এসব কিছুই যুবরাজের কানে গেলোনা।সে তার কাজে অনড়।এভাবেই কিছুক্ষন অতিবাহিত হবার পরে রেহান ডাঙ্গায় তোলা মাছের মতো তড়পাতে লাগলো ।যুবরাজকে পাগল খেতাব দিয়ে কিছুটা রাগত হয়েই ডক্টর নিকোলাস আর তার সহযোগী যুবরাজকে টেনে রেহানের থেকে দূরে সরাতে চাইলো।
কিন্তু অসুর সম যুবরাজকে কিছুতেই এক চুল ও নাড়াতে পারলো না।
টানাহেঁচড়ার এক পর্যায়ে রেহান পুড়ে যাওয়া কুঁচকানো চোখের পাতা কিঞ্চিৎ মেলে তাকিয়ে হাত পা ছুড়তে লাগলো।
এবার যেনো যুবরাজ স্বস্তির শ্বাস ফেললো।

“আমি জানতাম তুই কোমায় যাসনি, শুধু শুধু আমাকে হয়রানি করার ধান্দা করেছিলিস তাই না?
কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত হবার পর রেহান ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালো,এবং হাত পা ভালো মতো নাড়াতে সক্ষম হলো।বহু চেষ্টা করে কথা বলতে চাইলো।কিন্তু গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হলো না।
এবারও যেনো যুবরাজ অধৈর্য হলো।
“তোকে কি কথা বের করে আনার জন্য গলা টিপে ধরতে হবে নাকি?গলার ভেতর এক হাত ঢুকিয়ে দেবো?
যুবরাজের কথা শুনতে পেয়ে অজ্ঞজনক খানিক হাসলো রেহান।এরপর অনেক কষ্টে জড়িয়ে যাওয়া নিভু নিভু কন্ঠে শুধালো

“আমি দেখতে অনেক বিশ্রী হয়ে গেছি তাই না?
“কে বলেছে তুই বিশ্রী হয়েছিস?যার মন সাফ পরিস্কার সে কি কখনো বিশ্রী হয়?তুই আগের থেকে আরো বেশি সুদর্শন হয়েছিস।”
“মিথ্যে শান্তনা দিচ্ছিস?
“আমাকে কখনো মিথ্যা বলতে শুনেছিস?
“dr ফাইয়াজ আমাকে এসিড দ্বগ্ধ করেছে”
“বাহ্যিক সৌন্দর্য কি মানুষের সব কিছু রেহান?তুই তো ভেতর থেকে সুন্দর।বাইরের সৌন্দর্যে কি আসে যায়?
“আমি কুৎসিত হয়ে গেলাম,আমাকে সকলে ঘৃণার নজরে দেখবে”

ওয়েলকাম টু মাই ডার্কসাইড পর্ব ২৯

“তোকে আমি আমার মন মতো নতুন চেহারা দেবো, নিবি?
“আমি আয়নায় একবার আমাকে দেখতে চাই!
“উহু একদম না, সময় এলে অবশ্যই দেখবি।এখন দেখার কোনো দরকার নেই।

ওয়েলকাম টু মাই ডার্কসাইড পর্ব ৩১