ওয়েলকাম টু মাই ডার্কসাইড পর্ব ৩৯
সারিকা হোসাইন
আকাশের মস্ত বড় থালার ন্যায় রুপালি চাঁদটা কুয়াশার চাদরে লুকিয়ে হালকা ঘোলাটে ঝাপসা আলো বিলিয়ে দিচ্ছে ।আকাশে কোনো তারকারাজির দেখা মিলছে না আজকে।মাঝে মাঝেই কালচে রঙা কিছু মেঘ এসে চাঁদটাকে ঢেকে দিচ্ছে।কিন্তু ঘন বাতাসের তোড় এসে মুহূর্তেই সেই মেঘ গুলোকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে অদূরে।
ঘন গহীন গজারি বৃক্ষের বনের আঁকাবাঁকা কাঁচা রাস্তা দিয়ে সাইসাই গতিতে এগিয়ে চলছে যুবরাজের ব্র্যান্ডেড গাড়িটি।কাঁচা এটেলমাটির কর্দমাক্ত উঁচু নিচু রাস্তাতেও গাড়ির গতি একশত এর উপর।আর কিছুক্ষন বন পেরুলেই বড় হাইওয়ে ।
এই পুরোটা সময় রাজ্য নীরব ছিলো।এখনো যেনো সে সন্ধ্যা বেলার ঘোর থেকে বেরুতে পারেনি।কিন্তু গাড়ির স্পিডে কিছুটা ভীত হলো সে।অন্ধ মানুষের ন্যায় বাধন যুক্ত হাত নিয়ে কিছুটা নড়েচড়ে উঠলো রাজ্য।
“যুবরাজ আমার ভয় করছে।কোথায় যাচ্ছি আমরা?
রাজ্যের কথা কর্ণপাত হতেই নিজের এক হাত দিয়ে রাজ্যের মাথায় মমতার পরশ বুলিয়ে যুবরাজ বলে উঠলো
“যতক্ষন আমি তোমার পাশে থাকবো ততক্ষণ তুমি পৃথিবীর সবচাইতে সেইফ জোনে আছো এটা সব সময় মাথায় রাখবে।ভয়ের কিছুই নেই।অক্ষত অবস্থায় তোমার ভাইয়ের কাছে পৌঁছে দেবো তোমাকে”
“আমি কোত্থাও যেতে চাইনা ।আমি আপনার সাথেই থাকতে চাই যুবরাজ”
“কিন্তু আমি রাখতে চাই না জান”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
শক্ত কন্ঠের সাবলীল স্বীকারোক্তি যুবরাজের।
রাজ্য আর কোনো কথা বাড়ালো না,দুই চোখ ফেটে তার অশ্রু কনারা আন্দোলন করে বেরিয়ে আসতে চাইছে।এই মুহূর্তে নিজের বাহুডোরে যুবরাজকে আবদ্ধ করতে বেশ ইচ্ছে হচ্ছে তার।যুবরাজকে দুই চোখ ভরে দেখার পিপাসায় অশান্ত হয়ে উঠেছে মন।কিন্তু তার দুই হাত শক্ত করে বেঁধে রেখেছে যুবরাজ।ভালোবাসার আপন মানুষটা কাছে থেকেও যেনো ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে গিয়েছে।হঠাৎ যুবরাজ এভাবে কেনো রূপ বদলালো এটাও তার অজানা।যুবরাজকে না পেলে এই নিষ্ঠুর ধরনীতে শ্বাস নিয়ে ভালোভাবে বেঁচে থাকা কি সম্ভব হবে তার কাছে?
চিন্তা ভাবনার মাঝেই গাড়ির স্পিড কমে এলো সেই সাথে স্মুদলী গাড়ি চলতে লাগলো।নিজের মনের কথা গুলো আর বন্দি করে রাখতে পারলো না রাজ্য।তার কাছে বারবার মনে হচ্ছে এই বুঝি যুবরাজ তাকে একা ফেলে হারিয়ে গেলো।
“আপনাকে জড়িয়ে ধরতে খুব ইচ্ছে করছে যুবরাজ!আমাকে একবার আপনার বুকে মাথা রাখার জায়গা দিবেন?
আহত সিক্ত কন্ঠে কথাটি বলে যুবরাজের রিয়াকশন দেখার জন্য মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে রইল রাজ্য।
মুহূর্তেই কড়া ব্রেকের শব্দে সচকিত হলো রাজ্য।গাড়ি থেমে গেছে,কোনো অস্থিরতা নেই কোনো শব্দ নেই।হালকা জানালার কাঁচ নামানোর কারনে দুই একটা বাদুর আর ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক কর্ণকুহরে এসে লাগছে।ঘটনা বোঝার জন্য অন্ধ মানুষের ন্যায় এদিক সেদিক মাথা ঘোরালো।হঠাৎই অজানা ভয় মনে জেঁকে বসলো।
“তবে কি যুবরাজ এখানেই তাকে ছেড়ে দেবে?
“চুপটি করে দুদন্ড বসতে পারো না?
আদুরে স্বরে কথাটি বলে রাজ্যের চোখের বাধন খুলে শক্ত করে জাপ্টে ধরলো যুবরাজ।এরপর হাতের বাধন উন্মুক্ত করে রাজ্যের গালে সিক্ত চুমু খেয়ে শুধালো
“এবার খুশি?”
দীর্ঘ সময় বাদে যুবরাজের হাসি মাখা মুখশ্রী দেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো রাজ্য।তৎক্ষণাৎ শক্ত হাতে যুবরাজের শার্টের কলার খামচে ধরে যুবরাজের চোখে চোখ রেখে রাজ্য শুধালো
“আমি আপনাকে এরেস্ট করবো এই ধারনা কিভাবে মাথায় এলো আপনার?পুরো দুনিয়া আপনার বিপক্ষে গেলেও তো আমি আপনাকে কখনো ভুল বুঝবো না!তবে কিসের এতো ভয় আপনার?
রাজ্যের কান্না জড়িত মুখশ্রী দেখে তোলপাড় শুরু হলো যুবরাজের বক্ষে।না চাইতেও বার বার সে মেয়েটিকে কষ্ট দিয়ে ফেলছে।নিজের হওয়া এতো এতো অপরাধের শাস্তি কিভাবে মওকুফ করবে সে?
রাজ্যের কপালে কপাল ঠেকিয়ে ধীর কন্ঠে যুবরাজ বলে উঠে
“যখন সকলে জানবে তোমার হাজব্যান্ড একজন কিলার তখন প্রশাসন তোমার দিকে আঙ্গুল তুলবে।তোমার চরিত্রে আর প্রফেশনে দাগ লাগবে।আমি আমার শত অপমান মেনে নির্লজ্জের মতো দিব্যি বেঁচে থাকতে পারবো।কিন্তু তোমার দিকে কেউ আড় চোখে তাকাবে সেটা আমি কখনোই মেনে নিতে পারবো না।আমার কুৎসিত ভালোবাসায় তোমাকে জড়িয়ে আমি অনেক বড় অপরাধ করে ফেলেছি বউ”
যুবরাজের অনুতপ্তে ভরা মুখশ্রী দুই হাতের আজলায় ভরে রাজ্য বলে উঠে
“যদি আমি আমার প্রোফেশন টাই ছেড়ে দেই তখন?
যুবরাজ আর কথা বাড়ায় না।ঠান্ডায় শুষ্ক হওয়া নিজের দুই ঠোঁট চেপে ধরে রাজ্যের কোমল ঠোঁটে।যুবরাজের উষ্ণ ভালোবাসায় চোখ বুজে নীরবে অশ্রু বিসর্জন দেয় রাজ্য।
যুবরাজকে কিভাবে সে বাঁচাবে সেই পথ তার জানা নেই।কিন্তু যেকোনো মূল্যে যুবরাজকে বাঁচাতে যে হবেই
দরকার পড়লে যুবরাজকে নিয়ে দূর কোনো দেশে বাসা বাধবে সে।তবুও যুবরাজকে হারাতে দেবে না রাজ্য।
“আমি আপনার অপকর্মে ঘেরা সাম্রাজ্যের রানী হয়েই সারাটা জীবন কাটাতে চাই যুবরাজ!আপনাকে শক্ত হাতে আগলে রাখার দায়িত্ব টা কি আমাকে দেবেন?
যুবরাজের খুশি যেনো আর ধরেনা।রাজ্যকে নিয়ে ভেবে রাখা সকল ধারণা ভুল প্রমাণিত হবার খুশি এটা।নিজের শক্ত বাহুর বন্ধনে রাজ্যকে আবদ্ধ করে রাজ্যের গলায় মুখ ডোবায় যুবরাজ।
“আমার আমিকে পুরোটাই তোমার দখলে দিয়ে দিলাম রানী সাহেবা”
মুহূর্তেই খুশির জোয়ারে ভেসে উঠলো ব্যাথিত দুই হৃদয়।স্কেলেটরে পা চাপতেই তরতর করে স্পিড বাড়তে থাকলো।
“কোথায় যাচ্ছি আমরা?আমি না বললাম আমি দাদা ভাইয়ের কাছে যেতে চাইনা?
অবাক ভীত কন্ঠে কথাটি শুধিয়ে যুবরাজের বাহু খামচে ধরে রাজ্য।
বিগলিত হেসে যুবরাজ বলে উঠে
“তোমার শশুর মশাই একবার দেখতে চেয়েছেন তোমাকে।রাত টুকুন থেকে সকালে তোমাদের বাড়িতে যেও।দুদিন পর আমি গিয়ে নিয়ে আসবো।
“শশুর বাড়িতে আপনি যাবেন না?
“না”
“কেনো?
“শেরহাম তোমাকে ভালোবেসে বসে আছে যা আমার মোটেও সহ্য হচ্ছে না।তাই ওর সাথে একটু কাবাডি খেলতে যাবো ।
কয়েকদিন ধরে রাজ্যের কোনো খুজ খবর না পেয়ে এনি রেজোয়ান চৌধুরীর বাসায় এসেছে।মেইন গেটের সামনে এসে লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে কাচুমাচু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে সে।কলিং বেল দিবে কি দিবেনা সেই চিন্তা করতে করতেই কেটে গেলো কুড়ি মিনিট।
“ডক্টর রেহান নিশ্চয়ই বাড়িতে আছে।যদি তার সামনে পড়ে যাই তখন কি হবে?
দরজায় পিঠের সহিত হেলান দিয়ে এক মনে সেই চিন্তাই ভেবে চলেছে এনি।হঠাৎই খুট করে খোলে গেলো বিশাল দরজা খানা।তাল সামলাতে না পেরে চিৎ হয়ে পড়ে যেতে নিলো এনি।ভয়ে চোখ মুখ কুঁচকে চিৎকার করে উঠলো
“উড়ি মা রে”
কিন্তু কীয়তখন বাদে কোনো ব্যাথার উপস্থিতি টের না পেয়ে অল্প করে এক চোখ খুলে আশেপাশে নজর বুলালো।
“হে হে পড়িনি,কিন্তু হাওয়ায় ভাসলাম কিভাবে?
কৌতূহল নিয়ে দুই চোখ খুলে পিছনে নজর বুলাতেই রেহানের লাজুক মুখশ্রী দেখে চট করে সরে দাঁড়ালো এনি।
“সরি ডক্টর রেহান।আম রিয়েলি সরি।বুঝতে পারিনি এভাবে দরজা খুলে ফেলবেন।
রেহান কিছুক্ষন ইতস্তত করে মৃদু কন্ঠে বলে উঠলো
“আসলে বাসায় কেউ নেই।রাজ্য কাল আসবে”
কথাটি বলেই মাথা চুলকে এদিক সেদিক তাকাতে লাগলো রেহান।বুকের ধুকপুকুনি শব্দে স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছে না সে।এদিকে লজ্জায় বার বার হাসি এসে যাচ্ছে শুধু।কি এক আজব মুসিবত”
এনি রেহানের অস্বস্তি বুঝতে পেরে মাথা নিচু করে বলে উঠলো
“আচ্ছা ঠিক আছে আমি যাই তাহলে।আসলে কয়েক দিন ধরে ওকে ফোনে পাচ্ছিলাম না তো এজন্য ভাবলাম কোনো সমস্যা কি না।আচ্ছা ও আসলে আমাকে কল করতে বলবেন।আমি আসি”..
ছোট ছোট কদম ফেলে রেহানের দৃষ্টি সীমানার বাইরে চলে যেতে চাইলো এনি।কিন্তু হঠাৎই গাম্ভীর্য পূর্ণ মোটা কন্ঠে রেহান শুধালো
“আপনি কি সত্যি সত্যি রাজ্যের কাছে এসেছিলেন মিস এনি রহমান.??
রেহানের এরূপ প্রশ্নে ফ্লোরের সাথে এনির পা আঠার মতো লেগে গেলো।হাজার চেষ্টা করেও আর এক পা ও নড়তে সক্ষম হলো না।লজ্জায় ভয়ে চেহারা খানা ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করলো।
লম্বা লম্বা পা ফেলে রেহান এনির সামনে এসে দাড়ালো।লজ্জায় মুখায়ব অবনত রাখলো এনি।রেহানের জিজ্ঞাসা কৃত প্রশ্নের উত্তর তার কাছে নেই।তবে কি উপায় হবে এবার?
হঠাৎই এনির ছোট মুখশ্রী নিজের বৃহৎ হাতের আজলায় ভরে নিলো রেহান।এনির লম্বা ঘন পাপড়ি যুক্ত কুচকুচে কালো চোখে তাকিয়ে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় রেহান বলে উঠলো
“লজ্জা পেলে আপনাকে অনেক আকর্ষণীয় লাগে এনি”.
সহসাই দুই চোখের পাতা বন্ধ করে চুপচাপ ঠোঁট টিপে দাঁড়িয়ে রইলো এনি।
লাজুক রেহান এক মস্ত সাহসী কাজ করে বসলো।
এনির বড় বড় দুই চোখে নিজের উষ্ণ ঠোঁটের স্পর্শে গভীর এক চুমু একে দিয়ে বলে উঠলো
“আমাকে ভালো রাখার দায়িত্ব নিতে গিয়ে নিজেই যে বেকাবু হয়ে যাচ্ছেন মিস এনি”
কোনো রূপ জবাব দিতে পারে না এনি।থরথর করে তার সর্বাঙ্গ কেপে যাচ্ছে সমানে।গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে হৃদপিন্ডে ধুপধাপ হাতুড়ি পেটাচ্ছে।ফিনফিনে চিকন ঠোঁট দুটো তিরতির করে কাঁপছে শুধু।
নিজের হাতের আঙ্গুলির সাহায্যে এনির ঠোঁট টিপে ধরলো রেহান।
এরপর মাদকতা মিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠলো
ওয়েলকাম টু মাই ডার্কসাইড পর্ব ৩৮
“আমাকে বেসামাল হতে বাধ্য করবেন না প্লিজ”
রেহানের এমন কথায় চোখ মেলে তাকালো এনি।এর পর জড়িয়ে যাওয়া কন্ঠে বলে উঠলো
“ডক্টর রেহান আমার ভয় করছে।আমি আরেকটু হলে জ্ঞান হারাবো”
“হুঁশে ফেরানোর মেডিসিন যে আমার জানা আছে পুলিশ সাহেবা”!
এনিকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে শক্ত করে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে রেহান।তার প্রশস্ত বুকে মেয়েটি নিতান্তই ছোট তুলতুলে বিড়াল ছানার মতো।এই বিড়াল ছানাটিকেই সে আদর যত্নে পুষে বড় করতে চায়।
“আমার বউ হবেন এনি?