ওয়েলকাম টু মাই ডার্কসাইড পর্ব ৪২
সারিকা হোসাইন
দিনের আলো ফুরিয়ে দিগন্তের সূর্য ঘন তিমিরে তলিয়ে গিয়েছে বেশ কিছুক্ষণ আগে।নিশাচর প্রাণী গুলো বড় বড় ডানা ঝাপটিয়ে ছুটে চলেছে আকাশের এই কোন থেকে সেই কোন।বড় হাইওয়ে রাস্তার দুধার আলোকিত করে জ্বলে উঠেছে সোডিয়াম লাইট।সাই সাই গতিতে রাস্তা জুড়ে যাওয়া আসা করছে নানান পদের যানবাহন।
গাড়ির পেছনের সিট থেকে উঁকিঝুঁকি মেরে ঘটনা বুঝার চেষ্টা করছেন সুবহান শেখ।এই ভাবে এতো অল্প সময়ের ব্যাবধানে যুবরাজের গ্যাড়াকলে আটকা পড়বেন তা ঘূর্ণাক্ষরেও টের পাননি প্রবীণ এই ব্যাক্তি।টের পেলে কি আর দেশে আসেন নাকি?
যুবরাজ শক্ত স্কচটেপ এর সহিত তার দুই হাত দুই পা এবং মুখ বেঁ*ধে রেখেছে।সব কিছু অবলোকন করার জন্য শুধু দৃষ্টি দুটি খোলা।সেই খোলা দৃষ্টি দিয়েও আশেপাশের সব কিছু অনুধাবন করা যাচ্ছে না।এ যেনো বেঁচে থেকে মৃ*ত্যু সমতুল্য।
গাড়ির ভেতর সামান্য আলোকিত করে লুকিং গ্লাসে সুবহান শেখের অবস্থা দেখে নিলো যুবরাজ।
বুড়োটা হাত পা গুটিয়ে সিটে শুয়ে শুয়ে এদিক সেদিক তাকিমকি করছে।সুবহান শেখের এমন করুন অবস্থা দেখে বিগলিত হাসলো যুবরাজ।সেই হাসির শব্দ শুনে ধরফড়িয়ে নড়ে চড়ে উঠলো সুবহান শেখ।
‘দেখলে তো মামুজান ভাগ্নে হয়ে কিভাবে কব্জা করলাম তোমাকে?কেনো অযথা ভিমরুলের চাকে ঢিল ছুড়লে বলতে পারবে?নিজের পরিণতির জন্য নিজেই দায়ী হলে”চিন্তা করো না তোমার পিছে পিছে তোমার ছেলেও চম্বুকের মতো এসে হাজির হবে।বেশ মজার একটা খেলা হবে তাই না বলো?
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
যুবরাজের কথার মর্মার্থ বেশ ভালো করেই বুঝতে পারলেন সুবহান শেখ।তবুও মুখে কিছুই বলতে পারলেন না।কিন্তু চোখে তার ভীতি প্রদর্শিত হলো।
গাড়ির লাইট অফ করে যুবরাজ আরো জোরে স্কেলেটরে চেপে স্পিড বাড়িয়ে দিলো।নিয়ন্ত্রণ হীন গাড়ির মতো ঝড়ের বেগে চলতে লাগলো সুবহান শেখের কালো রঙের রোলস রয়েস গাড়ি খান।গাড়ির এতো গতিতে বেশ ভড়কে গেলেন সুবহান শেখ।ছেলেটাকে একদম ভরসা নেই।যখন তখন যা খুশি হয়ে যেতে পারে।শয়তানির চক্করে কোনো দিন সৃষ্টি কর্তাকেও ডাকা হয়নি।বুড়ো সুবহান জানেও না কিভাবে উপরওয়ালা কে ডেকে সন্তুষ্ট করতে হয়।আজ যেনো সত্যি সত্যি তার মৃ*ত্যু*র ডাক এসেছে!
যুবরাজকে কোত্থাও খুঁজে না পেয়ে যখন ক্লান্ত শরীরে নিজের এপার্টমেন্টে ফিরে আসে শেরহাম তখন বৃহৎ গেটের কাছে কালো রঙের কেটিএম মটর বাইক দেখে বেশ অবাক হয় সে।
তার নিজের বাইক চালানোর হবি নেই,সুবহান শেখ বৃদ্ধ মানুষ তার দ্বারা এটা মোটেও সম্ভব নয়।তাহলে কে?
লম্বা লম্বা পা ফেলে বাইকের নিকট এসে থমকে দাঁড়ায় শেরহাম।বাইকের হেলমেট এ খুব সুন্দর করে পেইন্ট করে লিখা “yuv”
যুবরাজের নাম দেখেই রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে বাইক থেকে হেলমেট তুলে সজোড়ে আছাড় মেরে পাথরের বাঁধাই করা রাস্তার উপর ফেলে দিলো শেরহাম।এতো জোরে আছাড় খেয়েও অক্ষত অবস্থায় পড়ে রইলো যুবরাজের দামি হেলমেট খানা।
আর এক মুহূর্ত সেই জায়গায় দাঁড়ালো না শেরহাম।ক্রোধে জেদে ফুঁস ফুঁস করতে করতে নিজের ব্লেজারের ইনার পকেট থেকে রিভলবার বের করে গুলি লোড করে সেটা তাক করে ছুটে চললো ঘরের ভেতর।
প্রথমে ড্রয়িং রুমে তন্ন তন্ন করে পাগলের মতো খুজলো এরপর চিৎকার করে ডেকে উঠলো
“যুবরাজ বা*স্টা*র্ড কোথায় তুই?সাহস থাকে তো আমার সামনে আয়”
শূন্য বৃহৎ এপার্টমেন্টে শেরহামের কথাই প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে এলো কিন্তু যুবরাজের কোনো শব্দ পাওয়া গেলো না।শেরহামের ক্রোধের মাত্রা ছাড়িয়ে যাবার উপক্রম হলো।সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে দুতলায় উঠতে উঠতে ডেকে উঠলো
পপ্স”!
সুবহান শেখের ও কোনো আওয়াজ পাওয়া গেলো না।বদ্ধ উন্মাদের ন্যায় প্রতিটা ঘরে চিরুনি তল্লাশি চালালো শেরহাম।কিন্তু ঘরের কোত্থাও না আছে যুবরাজ আর না আছে সুবহান শেখ।
কোনো উপায় না পেয়ে শেরহাম সুবহান শেখের নম্বরে কল করলো।
প্রথম রিং বাজতে না বাজতেই ফোন রিসিভ হলো
“হেই ডুড ইটস ইউভি।তোমার পপ্স কে নিয়ে সমুদ্রে হাওয়া খেতে এলাম”
কথাটি হাস্যরসাত্মক স্বরে বলে শেরহাম কে কিচ্ছুটি বলার সুযোগ না দিয়েই খট করে লাইন কেটে দিলো যুবরাজ।
শেরহাম সাথে সাথেই আবার কল করলো
কিন্তু নম্বর সুইচড অফ”
রাগে নিজের চুলের মুঠি চেপে ধরে নিজের রাগ কন্ট্রোলের চেষ্টা করলো শেরহাম।এরপর দুচোখ বন্ধ করে নিজের ক্রোধ কে গিলে খেয়ে ক্রুর হাসি হাসলো
“তাহলে তোর বাপকে নিয়ে আমিও একটু পিকনিক খেয়ে আসি”!
রিভলবার হাতে নিয়েই হনহন করে নিজের গাড়িতে গিয়ে বসলো শেরহাম।এরপর গাড়িখানা স্টার্ট দিয়ে ছুটে চললো সাদাফ শাহীরের বাড়ির উদ্দেশ্যে।
শেরহামের সাথে কথা শেষ করেই ফোনটা সজোড়ে রাস্তায় ছুড়ে মারলো যুবরাজ।শক্ত কাঠামোর পিচঢালা রাস্তায় বাড়ি খেয়ে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে ভেঙে পড়ে রইলো সুবহান শেখের বিদেশি দামি ফোন খানা।নিমিষেই আরেকটি মালবাহী কার্গো ট্রাক এসে রাস্তার সাথে পিষে ফেললো সিম সহ মোবাইলের অবশিষ্ট অংশ।
“তোর ছেলে তোর চাইতেও বোকা রে সুবহান।তোর ছেলের সাথে হাডুডু খেলতে আমার বাপকে ওই বাংলোতে আমি বসিয়ে রেখেছি নাকি?তামাম দুনিয়া এক করে ফেললেও আমার বাপের একটা চুলের হদিস ও পাবে না তোর ছেলে”
মনে মনে সুবহান শেখ জেদে ফেটে পড়ে ইচ্ছেমতো গালিগালাজ করে উঠলো যুবরাজকে।
এদিকে মিনিট বিশেকের ব্যাবধানেই যুবরাজের বাড়ির সামনে কড়া ব্রেক কষলো শেরহাম।বাড়িটির সামনে এসে তার পুরো শরীর থরথর করে কেঁপে উঠলো।বাড়িটির বিশাল গেটে মস্ত বড় বড় দুটো তালা ঝুলছে।
গাড়ি থেকে না নেমে পুনরায় সেই গাড়ি স্টার্ট দিয়ে রেহান দের বাড়ির উদ্দেশ্যে গাড়ি হাকালো।
সেখানেও একই দৃশ্য দেখে নিজের মাথাটাকে সজোড়ে স্টিয়ারিং এর সাথে বা*ড়ি মারলো শেরহাম।ক্রোধ এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে মনে হচ্ছে নিজের বন্দুকের গুলি নিজের ঘিলুতে ঢুকিয়ে দিতে পারলে বেশ হতো।
“কিন্তু তোর সমাপ্তি না দেখে আমি ম*র*বো না যুবরাজ।পাতাল থেকে হলেও তোকে খুঁজে বের করবো আমি…..
সুবহান শেখের নম্বর ট্র্যাক করে এটুকু জানা গিয়েছে তারা চট্রগ্রাম হাইওয়ের দিকে যাচ্ছে।এরপর থেকে আর কোনো খবর পাওয়া যায়নি।সোয়াট পুলিশ শেরহাম কে আশ্বস্ত করে নিজেদের টিমকে হেলিকপ্টার এ করে চিটাগাং এর দিকে পাঠানোর ব্যাবস্থা করলো সেই সাথে চিটাগাং পুলিশ কে পুরো ঘটনা ইনফর্ম করলো।
মুহূর্তের ব্যাবধানে পুরো চট্রগ্রাম শহর পুলিশের গাড়ির পু পু সাইরেন আর হেলিকপ্টার এর পাখার খটখট শব্দে উত্তাল হয়ে উঠলো।
রাস্তার বিভিন্ন সিসি টিভি ফুটেজ চেক করে সুবহান শেখের গাড়ি চিহ্নিত করতে সক্ষম হলো পুলিশ।গাড়িটি পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতের দিকে যাচ্ছে।
মুহূর্তেই যুবরাজ খেয়াল করলো পিছনে পুলিশের গাড়ির বহর আর উপর থেকে দুটো হেলিকপ্টার সমানে টর্চ জ্বেলে যাচ্ছে।তারা যুবরাজকে থামার জন্য বার বার হুঁশিয়ারি দিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু যুবরাজ আজ যেনো কিচ্ছুটি কানেও শুনছে না চোখেও দেখছে না।সে তার গতিতে অটুট।
রাস্তার সকল ট্রাফিক সিগন্যাল ভঙ্গ করে এলোমেলো স্পিডে জেটি ঘাটের দিকে এগিয়ে চললো যুবরাজ।
কিছু মুহূর্তের জন্য হেলিকপ্টার আর গাড়ি গুলোকে নজরে পড়ছে না।চতুর যুবরাজ এই সময়টাকেই কাজে লাগিয়ে বৃদ্ধ সুবহান কে এক হাতের ঝটকায় কাঁধে তুলে নিমিষেই হারিয়ে গেলো বড় বড় জাহাজের ভিড়ে।
সোয়াট হেলিকপ্টার এ করে ঝাঁকে ঝাঁকে নেমে এলো পঞ্চাশ জন টিম মেম্বার সেই সাথে শেরহাম।
বেনজির আশফী যাত্রা পথে বারবার শেরহাম কে সাবধান করেছে সে যাতে একা একা কোথাও পা না ফেলে কারণ সমস্ত পরিস্থিতি হাতের বাহিরে।কিন্তু উন্মাদ শেরহাম কি এতো কিছু বুঝে?
যেটি ঘাটে হেলিকপ্টার এর রশি বেয়ে নেমেই সকলের অগোচরে দৌড়ে চললো যুবরাজকে খ*ত*ম করার উদ্যমে।
জাহাজের বড় ওপেন ডেকে শক্ত করে দড়ি দিয়ে বেঁধে ক্রুর হাসলো যুবরাজ।
“তোর ছেলে আর তোকে জাহান্নামের দরজায় পৌঁছে দিয়ে তবেই দম ফেলবো আমি”
কথাটি বলতে বলতে নিজের গায়ের পোশাক গুলো খুলে একটি কাঠের বক্সে ভরে পানিতে ছুড়ে মারলো যুবরাজ।
কিছুক্ষণ আগেও যেই আশার আলো সুবহান শেখ দেখে ছিলেন হঠাৎই যেনো ঝড়ো বাতাসে তা দপ করে নিভে গেলো।শেষ ভরসা টুকুও যেনো অথাও পানিতে তলিয়ে গেলো।
“আর কি বেঁচে ফেরার পথ নেই তবে?
জাহাজের ছোট গোপন বদ্ধ কক্ষে বসে খুবই সতর্কতার সাথে নিজের বানানো ছোট ড্রোনটি উড়িয়ে সব কিছু পর্যবেক্ষণ করছে রেহান।পুলিশের চাইতে তার মূল টার্গেট এখন শেরহাম।শেরহাম কে ধরতে পারলেই খেলা প্রায় শেষের পথে।হঠাৎই একটা ফিশিং জাহাজের আশেপাশে এলোমেলো দৌড়াতে দেখা গেলো তাকে।
মুখের হাসি প্রস্তুত হলো রেহানের।ব্লুটুথ ডিভাইস কানেক্ট করে বলে উঠলো
“ক্যাচ হিম”
রেহানের থেকে দিক নির্দেশনা পেতেই গায়ে জাহাজের নাবিকের পোশাক জড়িয়ে মাথায় পিকড ক্যাপ দিয়ে চোখ পর্যন্ত ঢেকে লাফিয়ে পড়লো জাহাজ থেকে।উদ্দেশ্য ফিশিং জাহাজ।নিচের দিকে তাকিয়ে হাটতে হাটতে হঠাৎই কারো সাথে জোরে ধাক্কা খেলো যুবরাজ।মুখে কিছু বলার আগেই ঝড়ের বেগে কেউ একজন যুবরাজের পিঠে জাপ্টে ধরে ফুঁপিয়ে উঠলো।
মানুষটি কে তা যুবরাজ জানে।কিন্তু এই মুহূর্তে রাজ্যকে প্রশ্রয় দেয়ার ফুসরত কই।হুট করেই এনি দৌড়ে এসে রাজ্যকে টেনে হিচড়ে দূরে নিয়ে চলে গেলো।
“পাগল হয়েছিস?চীফ দেখলে কি হবে ভুলে গিয়েছিস?এটা কি আবেগ দেখানোর জায়গা?এসব কি ধরনের ইম্যাচিউড়িটি?
কান্নার হিড়িক এ কথা বলতে পারছে না রাজ্য।যদি কখনো দুঃস্বপ্নেও ভাবত নিজের হাজব্যান্ড কে ক্র্শ ফায়ার করার জন্য তার নিজেকেই কোনো দিন বন্দুক তাক করতে হবে তবে সে পুলিশের চাকরি কেন অন্য কোনো চাকরিতেও যোগদান করতো না।গ্রামের মেয়েদের মতো সংসারী হয়ে পতি সেবায় জীবন উৎসর্গ করতো।
কান্না থামিয়ে আশেপাশে নজর বুলাতেই যুবরাজের আর দেখা পাওয়া গেলো না।কাদা মাটিতে হাটু গেড়ে বসে বালি যুক্ত কাদামাটির দিকে তাকিয়ে পিস্তল হাতে অশ্রু বিসর্জন দিতে লাগলো রাজ্য।
এই জাহাজ সেই জাহাজে উদ্ভ্রান্তের মতো যুবরাজকে খুঁজে চলেছে শেরহাম।কিন্তু কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না তাকে।শেরহামের ধৈর্যে আর কুলাচ্ছে না।ইচ্ছে হচ্ছে সব গুলো জাহাজ বো*মা মেরে ব্লা*স্ট করে দিতে।সামান্য একটা ছেলে হয়ে তাকে এত নাকনিচুবানি খাওয়াচ্ছে এটা কোনো ভাবেই মানা যাচ্ছে না।
ওয়েলকাম টু মাই ডার্কসাইড পর্ব ৪১
হঠাৎই মাথায় ভারী কিছুর আঘাত টের পেতেই পিছন দিকে ঘুরে তাকানোর সুযোগ পেলো না শেরহাম।তার আগেই পোক্ত হাতে কেউ তাকে ধরাশায়ী করে ফেললো।অজ্ঞাত ব্যাক্তির চেহারা দেখার আগেই দুই চোখ ঝাপসা হয়ে এলো।চোখ বুঝার আগে শুধু যুবরাজের গলার কাছের ট্যাটুটা দৃষ্টি গত হলো।
যুবরাজের হাতের ইশারা পেতেই দুজন শক্ত পেশী ওয়ালা ছেলে এগিয়ে এলো।কাঁধে তাদের কাঠের বড় একটি বাক্স।
আশেপাশে সর্তক দৃষ্টি বুলিয়ে যুবরাজ আদেশ করলো
“বাপের কাছে পাঠানোর ব্যাবস্থা কর”