কাছে আসার মৌসুম পর্ব ১২

কাছে আসার মৌসুম পর্ব ১২
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি

চারপাশে শোরগোলের কমতি নেই। হিজিবিজি মানুষের কণ্ঠগুলো একেক রকম উৎকট। কানাঘুষা,ফিসফিসে শব্দে সেন্টার ভরতি। অথচ তুশি কিচ্ছু শুনতে পারছে না। দুটো কান, একটা মাথা ঝিমঝিম করে সমান তালে দুলছে! ও ফ্যালফ্যাল করে ইয়াসিরের দিকে চেয়ে রইল। নিশ্চিত হতে শুধাল
“ হ্যাঁ?”
ইয়াসির এত শক্ত করে ধরেছে!
যেন খুনের মামলায় পালিয়ে যাওয়া আসামি। তার কথার সাথে মুখের মিল নেই। কঠিন কণ্ঠের গতি। জ্বলন্ত দুটো চোখ একভাবে তুশির মুখে ফেলে রাখল।
সৈয়দ পরিবার চমকে গেছে।
আশ্চর্য, বিহ্বলিত তারা। রেহনূমা বললেন,

“ সার্থ,কী বলছিস তুই? এই চোর মেয়ের সাথে তুই সংসার করবি?”
শওকত নিজে কিছু বললেন না। মুখে চুপ রইলেও,ভাইকে ইশারা দিলেন । সাইফুল সাথে সাথে বললেন,
“ তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে রে, বাবা! চেনা নেই জানা নেই, একে আমাদের বাড়িতে নিয়ে তুলব?”
ইয়াসিরের চাউনি সরল না। পাথুরে দুটো দৃষ্টি তুশির চেহারায় গেড়ে রইল। দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“ বিয়ে যখন হয়েছে,তখন নিতে তো হবেই। আমিও দেখি,টাকার জন্য বিয়ে করা মেয়েরা সংসার কেমন করে!”
তুশি ঢোক গিলল। এই বদ পুলিশের মাথার তার ছিঁড়ে গেছে নাকি! কী সব উল্টোপাল্টা বলছে!
রেহনূমা বললেন,
“ কীসের সংসার,কীসের বিয়ে? এই বিয়ে কি সহীহ নাকি! মেয়ের পরিচয়ই তো ভুল। কাবিননামায় বাপ-মায়ের নাম যা লিখেছে তাতো আর ঠিক নয়।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সবাই সহমত কথার সাথে। অতিথিদের কয়েকজন ‘ঠিক ঠিক’ রোল তুললেন। তুশিও মাথা নাড়ল সজোরে। এটাই তো আসল কথা। বিয়ে হয়নি ওদের৷ একজনের পরিচয়ে বিয়ে করলে সেটার কোনো ভিত্তি থাকে না কি!
সাইফুল সুর মেলালেন স্ত্রীর সাথে,
“ ঠিক তাই। এ মেয়ের বাপের নামও তো জানি না আমরা। এহসান সাহেব তো আর ওর আসল বাবা নয়। তাহলে ওনার নাম ভাঙিয়ে বিয়ে হয় কী করে!
অ্যাই মেয়ে অ্যাই, কী নাম তোমার বাবার,কী করে?”
শেষটুকু ধমকে জিজ্ঞেস করলেন।
তুশি ভয় না পেলেও মুখ ছোট করল। ভেতর ভেতর মেজাজটাও তেতে এলো ভারি। কিন্তু না,ত্যাড়ামো করা যাবে না। এই মুহুর্তে
ও কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। সামনে আবার ইয়াসিরের মতো পুলিশ।
ছুড়ে ছুড়ে বলল,
“ বেঁচে নেই। মরে গেছে।”
রেহনূমার গলায় বিরক্তি,
“ বেঁচে না থাকলেও একটা নাম তো আছে? কী নাম সেটা বলো।”
“ লোকমান হোসেন।”

কাজী সাহেব চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বিয়েতে কনে পালটে যাওয়ার ঘটনা তার কাছে নতুন নয়। তুশির কথায় কপালে ভাঁজ পড়ল হঠাৎ। কেমন একটা খটকা জাগল মনে। সতর্ক চিত্তে বিয়ের পাতা উল্টালেন। পুরো কাগজে চোখ বুলিয়ে বললেন,
“ এখানে তো লোকমান হোসেনই লেখা।”
তুশির মাথায় বাঁজ পড়ল। চমকে উঠল নিস্পন্দ চোখ। ছানাবড়া দৃষ্টিতে হাঁ করে রইল। প্রত্যেকে বিমুঢ়, বিস্মিত।
শওকত আশ্চর্য হয়ে বললেন,
“ কী! কী বলছেন?”
কাজী সাহেব সৈয়দ পরিবারের চেনা। শওকত সাহেবই নিয়ে এসেছিলেন। খাতাটা বাড়িয়ে দিয়ে
বললেন,
“ জি, এই দেখুন। আর মায়ের নাম আফসানা,তাই না?”
দ্বিতীয় দফার বোমটা ঠিক তুশির তালুতে এসে পড়ল। চেয়ে রইল হতবাক হয়ে। উত্তর দেবে কী করে? সে তো নিজেই ধাঁধায় ডুবে গেছে। প্রশ্ন করল ধড়ফড়িয়ে,
“ কিন্তু এসব কে বলল আপনাকে?”
কাজী সাহেব সাথে সাথে জানালেন,
“ কেন,মাজহার সাহেব।”

সবার মাঝে তর্জনীটা তাক করতেই,মাজহারের চোয়াল ঝুলে যায়।
এতক্ষণ গা বাঁচাতে চাওয়া তিনি, জিভ কেটে চোখ বুজে নিলেন। এই রে, আর
শেষ রক্ষে হোলো না।
সবার বিস্ময়কর চাউনি নিজের দিকে ঘুরতেই, মাজহার থতমত খেলেন । এহসান অবাক হয়ে বললেন,
“ মাজহার,এসব কী?”
ভদ্রলোক সাফাই দিতেই যাচ্ছিলেন,
পাশ থেকে ফুঁসে উঠলেন শওকত,
“ তার মানে আপনি এতক্ষণ নাটক করছিলেন? এসব ইচ্ছে করে করেছেন,তাই তো!”
মাজহার দিশেহারা চিত্তে মেঝেতে এলোমেলো পাতা ফেললেন চোখের। জ্বিভে ঠোঁট ভেজালেন ঘনঘন।
তুশি স্তব্ধ তখনো। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাঝখানে তাকে লটকে রেখেছে কেউ।
কাজী সাহেব বললেন,

“ আসলে তখন বিয়ের জন্যে আপনারা অত তাড়া দিচ্ছিলেন, আমি তো আগেভাগেই নাম-ধাম লিখে রাখি। তাই সেভাবে উচ্চারণ করে করে বিয়ে পড়ানো হয়নি। ভুলটা এদিকে একটু আমারও হয়ে গেছে।
কিন্তু আমার একটা প্রশ্ন আছে। আচ্ছা মাজহার সাহেব,আপনি যে আমাকে তখন কিছু টাকা দিয়ে বললেন চা খেতে, কোনোভাবে কি সেটা ঘুষ ছিল? আসলে ব্যস্ততায় তখন ঠিক করে বুঝতে পারিনি। এখন সকলের সামনে একটু খোলাশা করে বলুন তো।”
মাজহার কটমটিয়ে চাইলেন। আচ্ছা ধুরন্ধর লোক তো! তখন টাকা নিলো হেসে হেসে। এখন সুড়সুড়িয়ে পল্টি খেয়ে ফেলল? আচমকা ক্ষিপ্ত হাতে তার কলার খামচে ধরলেন এহসান।
সকলে ভড়কে গেল। হকচকাল মাজহার। এহসান চ্যাঁচিয়ে উঠলেন আক্রোশে,
“ আমার ভালোমানুষির এই প্রতিদান দিলে, মাজহার? এত নিচ তুমি! তোমাকে আমি ভালো ভেবেছিলাম। ভেবেছিলাম পারিবারিক সব রেষারেষি ভুলে গেছ তুমি। আত্মীয়তার সম্পর্ক এসব সামান্য জমির জন্যে নষ্ট করতে চাইনি। আর তুমি কী না একটা বস্তির মেয়ের সাথে হাত মিলিয়ে আমার সম্মান ডোবালে?”
এহসানের স্ত্রী রণিতা বেগম এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন এক কোণে। বিগড়ে যাওয়া পরিবেশ সামলাতে ত্রস্ত ছুটে এলেন তিনি। কলার ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললেন,

“ ছাড়ো ওকে। কী করছো? শান্ত হও,শরীর খারাপ করবে।”
একমাত্র এসবের মাঝে ইউশা,অয়ন চুপ করে দাঁড়িয়ে। বড়োদের এই বিস্তর লড়াইয়ে তাদের বলার কিছু নেই৷ তবে ইউশার চোখজোড়া বারবার তুশিকে দেখছে। এত কাণ্ড,এত অপমানের পরেও এ মেয়ে কেমন শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দ্যাখো। ইউশা একটা ধমক খেলেও তো ভ্যাঁ করে কেঁদে দেয়!
মাজহারের মাথা নত। এহসান ঝাড়া মেরে কলার ছেড়ে দিলেন। হাই প্রেশারের রোগী তিনি। শ্বাস তুললেন ঘনঘন। শওকত অবাক হয়ে বললেন,
“ আপনাদের দুজনের মধ্যে পারিবারিক শত্রুতা আছে?”
এহসান সাহেবের কণ্ঠ ভেঙে এলো।
“ জি। একটা জমির দখল নিয়ে থানাপুলিশ হয়। কিন্তু সেসব বহু পুরোনো কথা। আমি তো ওসব ভুলে গিয়ে মেয়ের বিয়েতে ডেকে এনেছিলাম ওদের। কে জানতো, ও এখনো এসব মনের মধ্যে পুষে রেখেছে।”
মাজহার বলতে চাইলেন,
“ দুলাভাই আপনি ভুল…”
তেতে উঠলেন ভদ্রলোক,

“ চুপ করো তুমি। তোমাকে বিশ্বাস করাই আমার ভুল হয়েছে। আচ্ছা, কোনোভাবে কি আমার তুশিকে তুমি আর এই মেয়েটা মিলে লুকিয়ে রেখেছ মাজহার? সত্যি করে বলো।”
তুশির নাক-চোখ কুঁচকে গেল। এই ফালতু লোকটাকে যা বলার বলুক না! ওকে টানছে কেন? কিছু বলার আগেই মাজহার উত্তর দিলেন হড়বড়িয়ে,
“ না না দুলাভাই, আমি আসলেই জানি না তুশি কোথায়। এখন বললেও তো আপনি বিশ্বাস করবেন না।”
রণিতা বেগম রেগেমেগে বললেন,
“ বিশ্বাস করার জায়গা রেখেছিস তুই? নিজের বোনের সাথে এমন কাজ করতে তোর লজ্জা লাগল না? এতগুলো মানুষের সামনে আমাদের সম্মানটা এভাবে কেন নষ্ট করলি তুই? কী মজা পেলি এতে!”
মাজহার চুপ। সব দিক থেকে দারুণ ভাবে ফেঁসে গেছেন তিনি। এহসানের ওপর একটা দারুণ প্রতিশোধের সুযোগ পেয়েই করতে গেছিলেন এসব।

একটা চরম সত্যি হলো,তুশিকে তিনি খুঁজতেই চাননি। লোক পাঠানোর গল্পগুলোও বানানো। শুধু চাচ্ছিলেন, কোনোভাবে এহসান একটু হেনস্তার স্বীকার হোক। ঠিক যেমন হেনস্তা হয়েছেন তিনি ওই মামলা টানতে গিয়ে। তাই দাবার একটা সৈন্য হিসেবে তুশিকে ব্যবহার করা শুধু। কিন্তু অসভ্য কাজীটাই সব বিগড়ে দিলো। তার রাগের একাংশ পড়ল রেহনূমার ওপর। মহিলা মানুষ সবেতে বেশি বোঝে। ইয়াসির তুশিকে নিয়ে যাচ্ছিল, যেতো। বিয়ে সহীহ কি না এই আলাপ তোলার দরকার ছিল আদৌ? সিদ কেটে ঠিক বেরিয়ে যেতেন তিনি। এখন কী হবে? যদি এসবের জন্যে এহসান আবার পুলিশে খবর দেয়। বা ইয়াসিরই কিছু করে।
সেন্টারের বুকে একটা লম্বা নীরবতা নেমেছে। কারোর বলার কিচ্ছুটি নেই। ঘটনার মোড় এইভাবে ঘুরে যাবে কে জানতো! ইয়াসির তুশির ধরে রাখা হাতটা ছেড়ে দিলো হঠাৎ । তার শক্তপোক্ত মুখশ্রী অস্থির। মাথার পাগড়ি খুলে ঘাড় ডলল অশান্ত হাতে। ফরসা,হলদে চেহারা ঘামে একশেষ।
তুশি হাতটা বুকের কাছে নিয়ে আসে। কব্জির এখানে পুরূ লাল দাগ বসে গেছে। কীভাবে ধরেছে উফ! গণ্ডারের মতো শক্তি।
এহসান সাহেব ধপ করে সোফায় বসে পড়েছেন। বুকের বা দিকে সূক্ষ্ণ ব্যথার চিনচিনে ভাব। রণিতা বেগম পানি আনতে ছুটলেন। এসিটা বাড়ানো হলো।
ভদ্রলোকের মুখচোখ দেখে শওকতের মায়া হোলো ভীষণ। লোকটার তো এখানে কোনো দোষ নেই।
সবার মাঝে ইউশা মিনমিন করে বলল,

“ এখন তো বাবা মায়ের নাম ঠিক আছে, আম্মু। তাহলে তো ভাইয়ার সাথে ওনার বিয়ে হয়ে গেছে তাই না?”
তুশির বুক ছ্যাৎ করে উঠল। চ্যাঁচিয়ে বলল সবার মাঝে,
“ না না, কীসের বিয়ে? কোনো বিয়ে ফিয়ে হয়নি।”
ইয়াসিরের ভ্রুতে ভাঁজ পড়ল। ক্লান্ত চোখ লেজ গুটিয়ে,ফের বসল এসে তীক্ষ্ণতা । তুশির চেহারা উদ্বেগী। দুশ্চিন্তায় ফ্যাসফ্যাস করে শ্বাস নিচ্ছে। বিয়েটা যে বিয়ে নয়,সবাইকে সেটা বোঝানোর প্রয়াস। নজর অমনি সরু হলো তার। নিম্নোষ্ঠ দাঁতে পিষে ভাবল কিছু একটা। একটু আগেই ভেবেছিল,তুশিকে ছেড়ে দেবে। কিন্তু, সিদ্ধান্ত পালটে নিলো মুহুর্তেই।
রেহনূমা ধমকে উঠলেন মেয়েকে,

“ চুপ কর। সব এই মেয়ের কারসাজি। এও নিশ্চয়ই মাজহার লোকটার সাথে জড়িত।”
তুশি চ সূচক শব্দ করে বলল,
“ আরে না খালাম্মা। আমি কী করলাম? আমি ওনার সাথে নেই।”
রেহণূমা রুষ্ট চোখে চাইলেন। খালাম্মা?
কিছু বলবেন রেগে, কথা টেনে নিলেন
সাইফুল। কড়া কণ্ঠে বললেন,
“ একদম মিথ্যা কথা বলবে না। তুমি ওনার সাথে না থাকলে, উনি তোমার বাবা-মায়ের নাম জানলো কী করে হ্যাঁ?
বোকা পেয়েছ আমাদের?”
তুশি বোকা পাবে কী করে? ও নিজেই তো বোকা হয়ে গেছে। তখন ভেবেছিল ভূয়া নামে কবুল বললে বিয়ে হবে না। এখন তো ম্যাজিক করে বাপ-মায়ের নাম সত্যি হয়ে গেল। মেয়েটা ভাবতে বসল। ভীষণ গভীর ভাবনা। রেহনূমা খোঁচা মারলেন,

“ এই যে দেখলে,আসল জায়গায় হাত পড়েছে এখন উত্তর নেই। কেমন চুপ করে আছে দেখো।”
তুশি ওসবে কান দিলো না। চট করে মাথায় এলো তখনকার কথা।
মাজহার যখন কাজের কথা বললেন, ও প্রথমদিকে মানা করে দিলো। পরে রাজি হলো অতগুলো টাকার কথা শুনে।
কিন্তু ও মাজহারকে বিশ্বাস করতে পারেনি। তাই ভদ্রলোক অগ্রীম দু হাজার টাকা দিয়েছিলেন। বলেছেন, বাকিটা কাজ শেষে পাবে। তারপর বুঝিয়ে দিলেন কী কী করতে হবে! বেরিয়ে আসার সময় বললেন হঠাৎ,
“ তোর বাপ-মায়ের নাম বল।”
তুশি পালটা প্রশ্ন করল,
“ ওসব দিয়ে কী হবে?”
“ এত কথা কীসের? বলতে বলেছি বল।”
তুশি গোঁ ধরল,
“ কীসে লাগবে আগে লিসেন করে নেই। দেন ডিশিশন টেকিং।”
মাজহার মুখের ওপর বললেন,
“ বস্তির ছোটোলোকদের আমি বিশ্বাস করি না। টাকা নিয়ে যদি পালাস?
ঠিকানা সহ বাবা-মায়ের নাম বল। একটু ত্যাড়ামি করলে সোজা গিয়ে ধরে আনব।”
তুশির ভারি মেজাজ খারাপ হলো। চেয়ে রইল কটমটিয়ে। কিছু বলল না তাও। দাদি কথায় কথায় বলে,
যে গোরু দুধ দেয়,তার লাথি খাওয়া উপকার। বিশ হাজার টাকা মানে তুশির কাছে লটারি।
“ বললাম তো, কারওয়ানের ওভার ব্রিজের পাশের গলি দিয়ে যে বস্তি গেছে ওখানে থাকি। ২৭ নম্বর ঘরটা। বাবা-মা নেই। নাম লোকমান হোসেন,মা আফসানা।
আগে পরে কিছু আছে কী না মনে নেই। আর হ্যাঁ, তুশি কাজের বেলায় লয়েল ওকে? বলেছে যখন করবে,তখন ইসমুথ হবে সব।”
মাজহার বললেন,

“ সেসব কাজের সময় দেখব। এখন এই কাপড়গুলো পরে তৈরি হয়। আমি মুক্তাকে পাঠাচ্ছি। আমরা দুজন ছাড়া কেউ এলে দরজা খুলবি না। মনে থাকবে”
তুশি ঘাড়-টার নাড়ল না। কপাল কুঁচকে গেল অত ভারি লেহেঙ্গা দেখে। এই বস্তাটা পরতে হবে এখন!
মাজহার বেরিয়ে গেলেন। সাথে অতীত থেকে বর্তমানে মুখ থুবড়ে পড়ল তুশি। সব মনে পড়তেই,ভ্রু জোড়া তার শৃঙ্গে উঠে গেল। ব্রক্ষ্মতালু অবধি জ্বলে উঠল রাগে। এর মানে এই লোক ওকে ব্যবহার করেছে? সব ছক আগেই কষে রাখা ছিল?
সঙ্গে সঙ্গে ফুঁসে উঠল তুশি। মাজহার চুপ করে দাঁড়িয়েছিল। অত মানুষের মাঝেই বয়ষ্ক লোকটার দিকে আচমকা তেড়ে গেল সে।
“ শালা মাজহারের বাচ্চা, এক ঘুষিতে তোকে চ্যাপ্টা বানিয়ে ফেলব আমি। আমার টাকা তো দিলিই না। উলটে…”
তুশিকে ধেয়ে আসতে দেখেই,ভদ্রলোক ঘাবড়ে গেলেন। বাকিদের দশাও তাই। তুশি হাতদুটো বক্সারদের মতো মুঠো করে আসছিল, একটা প্রকাণ্ড ঘুষি মারবে বলে। মাঝখানে পথরোধ করে দাঁড়াল ইয়াসির। এহসান হতবিহবলতায় বুকের ব্যথা ভুলে গেছেন৷ রেহণূমা সহ বাকিদের ভ্রু কপালে। একটা মেয়ে মানুষের এমন রূপ তারা দেখেছেন আগে?
অত বয়ষ্ক লোকটাকে মারতে যাচ্ছিল? রেহনূমা নাক ফুলিয়ে বিড়বিড় করলেন,

“ কত বড়ো বেয়াদব।”
ইয়াসির দাঁড়ালেও তুশিকে থামানো গেল না। পেছনে লুকোতে চাওয়া মাজহারের ওপর ফোসফোস করছে সে। হাত বাড়িয়ে বাড়িয়ে ধরতে চাইছে তাকে। ইয়াসির চিবুক শক্ত করে ওর দুটো হাতই খপ করে ধরে রাখল। থামল তুশি। দমল একটু।
সাপের মতো ফুঁসতে থাকা ফণা নামিয়ে নিল মুহুর্তে। মিনমিন করে বলল,
“ সব এই লোক করেছে। আমি কিছু করিনি, স্যার। আমিতো শুধু টাকার লোভে একটু বউ সেজে বসেছিলাম।”
ইয়াসির চুপ। তার পোক্ত গড়নটা এখন নেই। বড্ড স্থির দৃষ্টিযূগল। পাশ থেকে এহসান সাহেব বললেন,
“ শওকত ভাই! ক্ষমা চাওয়ার মুখ আমার নেই। তবুও চাইছি। আপনি চাইলে পুলিশ ডাকতে পারেন। বাবা ইয়াসির,তুমি চাইলে মামলা করতে পারো। আমি আমার শ্যালকের পক্ষে একটা কথাও বলতে চাই না।”
মাজহার ঢোক গিললেন। তার স্ত্রী-সন্তান কেউ বিয়েতে আসেননি। নিজের পক্ষে কথা বলার লোক কেউ নেই। হন্তদন্ত বেগে এহসানের পায়ের কাছে বসলেন। কিছু বলতে চাইলেও সুযোগ দেয়া হলো না। মুখ ফিরিয়ে নিলেন তিনি। স্ত্রীকে বললেন,

“ ওকে আমার সামনে থেকে সরতে বলো। নাহলে আমি কী করে ফেলব আমি নিজেও জানি না।”
রেহনূমা বললেন,
“ ইয়াসির তুই লেডি পুলিশ ডাক। এই মাজহার লোকটার সাথে ঠকবাজ মেয়েটাকেও জেলে ঢোকানো উচিত। টাকার লোভে বিয়ে করেছে,আবার বড়ো মুখ করে বলছেও সেটা।”
তুশির বুক ধক করে উঠল। হড়বড়িয়ে বলল,
“ না না, জেলে দেবেন না। এর থেকে একশবার কান ধরব? এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকি? আমি তো বলছি আমি এসব জানতাম না। আমাকে প্লিজ ছেড়ে দিন। আমি বাড়ি চলে যাই। টাকা-টোকা কিচ্ছু লাগবে না আমার।”
তুশির চোখে জল নেই। শুধু মুখটা কাচুমাচু করছে প্রতি কথায়। অথচ অন্য মেয়ে হলে
এতক্ষণ কেঁদেকেটে গঙ্গা বইয়ে দিতো। ইউশা আরেকদফা বিস্মিত সে নিয়ে। বিড়বিড় করল একা একা,
কী শক্ত মেয়েরে বাবা!
ইয়াসির তুশির দুটো হাত ক্রস করে ধরেছে। তার দুর্বোধ্য চাউনিতে ভিন্ন কিছু। বেশ শান্ত,ধীরস্থির ভাবে বলল,
“ শুনলে না, বিয়ে হয়ে গেছে? এবার ছাড়া পাবার কথা ভুলে যাও।”
তুশি বিভ্রান্তিতে ডুবে গেল। ইয়াসিরের মুখ দেখেই বুক কাঁপছে তার। ঝড় আসার আগে প্রকৃতি যেমন থমথমে হয়ে থাকে? অমন লাগছে ঠিক।

এ লোকের মাথায় নির্ঘাত কিছু ঘুরছে। ঠোঁটদুটো বিপদের জ্বালায় চূড়ায় উঠে বসল।
সহসা হাতে টান বসাল ইয়াসির। হাঁটা ধরল সামনে। তুশির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। বুঝে নেয়,আর নিস্তার নেই।
রেহণূমার মেজাজ খারাপ হলেও আর কিছু বললেন না। শওকত,সাইফুলও চুপ করে গেলেন। ছেলের হঠকারিতায় ফোস করে মাথা নাড়লেন শওকত। ছেলেটা কী করতে চাইছে কে জানে! তুশিকে টানতে টানতে নিচ্ছে ইয়াসির। একে অত ভারী লেহেঙ্গা,দুইয়ে হিল। প্রতি কদমে মেয়েটার হোচট খেয়ে পডার দশা হয়।
তুশির বুক হুহু করছে দাদির জন্যে। ইয়াসির ওকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?
কাঁদোকাঁদো মুখ করে ভাবল,

কাছে আসার মৌসুম পর্ব ১১

“ আর নট সি ইউ দাদি। গুড বাই দাদি। ভালো থেকো।”
ইয়াসিরের চোখ সামনে। সেন্টার পেরিয়ে বাইরে এসেছে। বরের সাজানো গাড়ির দোর খুলে ভেতরে ধাক্কা মারার মতো ঢোকাল তুশিকে। দরজাটা ধড়াম করে লাগাতেই,ভয় পেলো তুশি। ও জানলায় হাত রেখে ঝুঁকে আসে। মটমট করে চিবুক ফুটিয়ে বলে,
“ টাকার জন্যে বিয়ে বিয়ে খেলা?
এবার সংসারের নামে এমন আগুনে জ্বালাব,প্রতিটা দিন পুড়বে তুমি। বুঝবে, চোরের ওপর বাটপারি কাকে বলে!”

কাছে আসার মৌসুম পর্ব ১৩