কাছে আসার মৌসুম পর্ব ১৫

কাছে আসার মৌসুম পর্ব ১৫
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি

তুশির মাথা নত,চোখদুটো চকচকে টাইলসে। খরখরে কাঠের ন্যায় শুকিয়ে বসেছে মুখখানা। ভেতর ভেতর মানসিক প্রস্তুতির একটা প্রখর দ্বিধাদ্বন্দ্বে বেচারি। ইয়াসির তো ওকে দু চক্ষে দেখতে পারে না। কাল যা যা বলে গেছিল,তারপর তুশির হিসেব-নিকেষ এটুকু অন্তত বুঝেছে। বদ পুলিশের বরফ দুটো চোখে ও হলো গুড়ো গুড়ো বালি।
সে মানুষ এখন নিজের বোনের দোষ যে দেখবে না,সেতো জানা কথাই। নাহ,সব অন্যায় ওরই হবে। ওই হবে আসামি। একটা বিস্তর শাস্তির প্রস্তুতি মনে মনে নিয়ে, তুশি দীর্ঘশ্বাস ফেলল । মনোযোগ দিয়ে ভাবতে বসল,এখন ওকে ঠিক কী সাজা দিতে পারে! তার ভাবনার ইতি ঘটল ইয়াসিরের কথায়।
খুব শান্ত ভাবে বলল,

“ কী হয়েছে?”
আইরিন উত্তেজিত! শরীরের রক্ত টগবগ করছে রাগে। ক্ষুব্ধ চিত্তে বলল,
“ এই মেয়ের আপনি একটা বিচার করুন, ভাইয়া। আমাদের বাড়িতে বসে আমার সাথে বেয়াদবি করছে। সবে মাত্র ফ্রেশ হয়ে এসেছিলাম আমি,আর কী করেছে দেখুন!”
ইয়াসির সব কথা এড়িয়ে,আদেশ ছুড়ল স্পষ্ট ভাবে,
“ ডোন্ট শাউট আইরিন। আমি কানে শুনতে পাই। তুমি কথা আস্তে বলো।”
মেয়েটা একটু মিইয়ে গেল। ইয়াসিরকে রাগানো যাবে না। আজ তুশিকে একটা জব্বর শাস্তি দেয়াতেই হবে। তার চ্যাঁচামেচি শুনে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন রেহনূমা। ওপর থেকে তনিমা,ইউশা এমনকি মিন্তুও এলো।
ঘুমে জড়ানো দুটো চোখ নিয়ে কোনোমতে এসে দাঁড়াল সে। অয়ন বাড়িতে নেই। তার ক্যাম্পেইনের তারিখ আজ থেকে শুরু। খুব ভোরে বেরিয়েছে তাই।
তবে চিৎকার শুনেও বাড়ির বাকি পুরুষরা এলেন না। আর না এলেন জয়নব।
তনিমা হন্তদন্ত পায়ে নিচে নেমে বললেন,
“ কী হয়েছে? আবার কী হলো?”
বলতে বলতে চোখ পড়ল চোরের মতো চেহারা বানানো তুশির ওপর। অল্পস্বল্প শঙ্কা ভিড়ল মনে। ভীত গলায় বললেন,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ তুমি কি কিছু করেছে, তুশি?”
তুশি জবাব দিলো না। নিশ্চুপ মেয়েটাকে দেখে যা বোঝার বুঝে ফেলল ইউশা। তার রাঙা ঠোঁট উলটে বসল তাতে। ইস,নির্ঘাত তুশি কোনো ব্যাপার নিয়ে কেস-টেস খেয়েছে। এখন কী হবে?
রেহনূমার প্রশ্নবিদ্ধ চোখজোড়া দপ করে ওঠে। খোচা মেরে বললেন,
“ এইত, আপা একদিনেই তাহলে বুঝে গেলে যে এই মেয়ে সুবিধের নয়। দেখেছ,আমার কথা মিলল তো?”
তুশি এবার মুখ খুলল। মিনসে গলায় বলল,
“ আমার কী দোষ? হট ডু আই? আম..”
আইরিন ধমকে উঠল মাঝপথে,
“ তুমি চুপ করো! তোমার কথা এখানে কেউ শুনতে চায়নি। দেখো না ছোটো মামি,আমি এখানে চুপচাপ বসেছিলাম। ও কাজে এত ফাঁকিবাজি করছিল দেখে একবার শুধু বললাম যে ওদিকটা মোছো,তাতে আমার গায়ে নোংরা জল ঢেলে দিলো? কত বড়ো অসভ্য একবার ভাবো!”
রেহনূমা তেতে উঠলেন,
“ কী! এত বড়ো সাহস? আমাদের বাড়ির মেয়ের সঙ্গে অভদ্রতা?”
তুশি যেন আকাশ থেকে পড়ল।
হাঁ করে বলল,
“ কী মিথ্যুক মেয়ে গো তুমি! তুমিই তো আমার মো…”
ফের কথা কেড়ে নিলো আইরিন,

“ আবার কথা বলছো! তোমাকে চুপ থাকতে বলা হয়েছে না? কাজের মেয়ে কাজের মেয়ের মতো থাকবে।”
ইউশার ভারি মেজাজ গরম হলো। আইরিন বয়সে বড়ো দেখে তর্কে গেল না তাও।
মিন্তুর মনে কৌতূহল। অবাক হয়ে বলল,
“ কাজের মেয়ে! উনি তো আমাদের ভাবি। তুমি কাজের মেয়ে কেন বলছো, আইরিন আপু?”
রেহনূমা চোখ রাঙিয়ে বললেন,
“ অ্যাই,তুই এখানে কেন? কতবার বলেছি বড়োদের কথার ভেতর থাকবি না। যা, ঘরে গিয়ে হাতমুখ ধো,যা।”
মিন্তু গাল ফোলাল।
এখানে থাকার প্রচণ্ড ইচ্ছেটা তাও চাপা দিলো মায়ের ভয়ে। মাথা নুইয়ে চুপচাপ চলে গেল ঘরে।
তনিমা নরম গলায় শুধালেন,
“ তুশি,তুমি কেন ওকে ভিজিয়ে দিয়েছ?”

মেয়েটা সাফাই দেয়ার সুযোগ পেলো একটু। উদ্বেগ নিয়ে বলতে গেলে,ফের কথা টেনে নিলো আইরিন।
“ বড়ো মামি, তুমি ওকে কেন জিজ্ঞেস করছো? আমি তো বললাম ও ইচ্ছে করে এমন করেছে। বস্তিতে থাকা মেয়েছেলে কি এসব ভদ্রতা জানে?ক্লাসলেস,ভিখেরি মে…”
অমনি তপ্ত স্বরে বাক্য ছুড়ল ইয়াসির,
“ কিপ ইয়র মাউথ শাট, আইরিন।
কে কী করেছে,ওপর থেকে আমি সবটা দেখেছি।”
ব্যস,
আইরিনের সব কথা শেষ। বড়োসড়ো একটা তালা ঝুলে পড়ল মুখে। এক চোট বিস্ময়ে থতমত খেল। থেমে থেমে বলতে গেল,
“ না মানে…”

এর বেশিদূর আর যাওয়া হোলো না। কিংবা যেতে পারল না আইরিন। গাঢ় নীল পোশাক পরা এ এসপি ইয়াসির আবরার সার্থের ঐ দীপ্ত চোখেই আটকে পড়ল সব।
তারপর ঘর জুড়ে নির্বাধ নীরবতা নামল।
চোখেমুখে বিভ্রান্তির হুড়োহুড়ি নিয়ে চেয়ে রইল তুশি । বদ পুলিশ কতটা কী দেখেছে সে জানে না। যদি শাকচূন্নিটার কাজকর্ম দেখে থাকে,তাহলে নিশ্চিত ওর নিজের শাস্তির কোনো ভয় নেই। কারণ,তুশি তো কিছু করেইনি তাই না? এতক্ষণে একটু হাসিহাসি মুখ করে নড়েচড়ে দাঁড়াল সে।
পক্ষান্তরে ততটা আশঙ্কায় টলমলে আইরিন। ইয়াসির ভাই সব দেখে নিলে কী হবে? দুজনের দু রকম চিন্তার মাঝে বিভ্রমে ডুবে গেলেন বাকিরা।
রেহনূমা বললেন,

“ কী হয়েছে বল তো সার্থ! কী ঘটেছে এখানে?”
তুশি সাহস পেতেই হড়বড় করে উঠল।
“ আমি কিন্তু কিছু করিনি। তাই না সার? আপনার বোনই যেচেপড়ে আমার সাথে ঝামেলা করতে এসেছিল।”
তনিমার নজর পড়ল অদূরের মেঝেতে। গোটা পায়ের ছাপ গুলো দেখলেন এতক্ষণে। কণ্ঠে মিহি আর্তনাদ,
“ এ কী! কী অবস্থা ঘরের! এসব কে করেছে?”
ইউশা বলল,
“ কে আবার,যার পায়ে জুতো সেই করেছে।”
সবকটা চোখ একইসাথে বর্তাতেই, মাথা নুইয়ে নিলো আইরিন।
তুশি উদ্বেগ নিয়ে বলল,
“ আমি তো এই কথাটাই এতক্ষণ ধরে বলতে চাইছিলাম। আম…”
“ তুমি থামো।”

ইয়াসিরের নির্দেশ ছুটে আসতেই,থেমে গেল তুশি। ছেলেটা আইরিনের দিকে তাকাল। বললও সরাসরি,
“ তুমি বেশ গুছিয়ে মিথ্যে বলতে পারো। আগে একটু-আধটু জানতাম। আজ পুরোটা দেখলাম নিজের চোখে৷ যাক গে, তুমি অন্যের শাস্তির কথা বলছিলে? কিন্তু এখানে তো ভুল তোমার বেশি । তাই শাস্তিও নিশ্চয়ই তোমারই বেশি হওয়া উচিত?”
ঘাবড়ে গেল আইরিন।
“ শাস্তি!”
“ তো?
তুমি আমাকে চেনো না আইরিন? তোমার অন্যায়টা আমি নিজের চোখে দেখেছি,সেখানে ছেড়ে দেয়ার তো প্রশ্নই আসে না।”
একটু থামল ইয়াসির। ঘোষণা দিলো কড়া গলায়,
“ যেহেতু তুমি অন্যের মোছা ঘর ইচ্ছে করে নোংরা করছিলে,তাই এখন বাকিটা তুমি মুছবে। বাড়ির একটা কোণাও যেন বাদ না যায়!”
আইরিনের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। আর্তনাদ করে বলল,
“ আমি!”
তুশির ক্ষুদ্র আনন ঝলমলে। খুশিতে হাত তালি দিতে দিতেও দিলো না। তনিমা মৃদূ স্বরে বললেন,
“ কী বলছিস তুই সার্থ! ও কেন ঘর মুছবে? ও আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসছে। আর নীরু শুনলে কী ভাববে বলতো!”

সজোরে ঘাড় নাড়লেন রেহনূমা। বললেন,
“ সেইতো সেইতো। ওকে দিয়ে ঘর মোছাব?
ছি,ছি তা কখনো হয়?”
ইয়াসির ভ্রু কুঁচকে বলল,
“ কেন হয় না?
ও আমাদের আত্মীয় বলে?
এসব তো ওর আগে ভাবা উচিত ছিল ছোটো মা। কাজ যাই হোক,সেটাতে অন্যের কষ্ট আছে, শ্রম আছে। ও কেন সেসব নষ্ট করতে এসেছিল? ভুল করলে তার শাস্তি সবাইকে পেতে হবে। আর যেখানে আইন স্বয়ং আমি আছি, সেখানে এক চুল ছাড় আমি কাউকে দেবো না। সে আমার আত্মীয় হোক,বা অন্য কেউ!”
আইরিনের চোখে জল ছুটে এলো। জীবনে এক গ্লাস পানি ঢেলে খায়নি,সে মুছবে ঘর? উফ এত বড়ো বোকামিটা কী করে করল ও? একটা গোটা মানুষ ওপরে দাঁড়িয়ে সব দেখে ফেলল,আর আইরিন তাকে লক্ষ্যই করেনি?
ইউশা বিড়বিড় করে বলল,
“ একদম ঠিক হয়েছে।”
কিন্তু, তুশি অবাক হোলো। ভীষণ অবাক! চোখের পাতা ফেলতেও ভুলে বসল তাতে। ইয়াসিরের গৌড় মুখে মূক বনে চেয়ে রইল মেয়েটা।

বাড়ির গৃহিনীদের আর বলার কিছু নেই। রেহনূমা পরাজিত সৈনিকের ন্যায় চ সূচক শব্দ তুললেন জিভে। পাশাপাশি মায়াও হলো আইরিনের ওপর। মেয়েটা যা ননীর পুতুল! ঘর মুছতে পারবে?
কী দরকার ছিল তুশির পেছনে লাগার কে জানে!
ইয়াসির হাত ঘড়িতে চোখ বোলায়। প্রায় আটটা বাজতে চলল।
তুশি তখনো একইরকম চেয়ে। তক্ষুনি চাইল ইয়াসির। এক পল চোখাচোখিতে ভড়কে গেল মেয়েটা। ফাঁকা ঠোঁট জোড়া মিশিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল।
ইয়াসির ছুড়ে ছুড়ে ডাকল,
“ আর তুমি, এই চোর,
তোমাকে বলছি!”
আবার চোর বলছে? ঠোঁট উলটে মাথা তুলল তুশি।
ইয়াসির হুকুম দিলো শক্ত স্বরে,
“ তুমি আইরিনের গায়ে ময়লা পানি ঢেলেছ,এটা তোমার অন্যায়। তাই শাস্তি হিসেবে ওর জামাকাপড় ধুয়ে,শুকিয়ে ইস্ত্রি করে ওর ঘরে রেখে আসবে।”
তুশি এসব আশা করেনি। তার বিমোহিত,হাস্যোজ্জ্বল মুখটা নিভে গেল অমনি। আশ্চর্য চোখে বলল,

আমি কী করলাম? ওই তো আগে আমার পেছনে এসে লেগেছে। আমি তো শুধু ওকে একটু শাস্তি দিতে এসব করেছি সার। ও ঘর নষ্ট করে…”
ইয়াসির কঠিন স্বরে বলল,
“ শাস্তি দেয়ার তুমি কেউ নও। রিভেইঞ্জ নেয়ার জন্যে কাউকে পালটা আক্রমণ করা আরো বড়ো অপরাধ।
কিন্তু তোমার অপরাধের পরিমাণ ছোটো,তাই শাস্তিটাও ছোটো। কথা কম বলে,যা বলছি তাই করবে।”
তনিমা ফোস করে শ্বাস ফেলে মাথা নাড়লেন। রেহনূমারও বলার কিছু নেই। আটা মাখা হাতটা নিয়ে ফের চললেন রান্নাঘরে। আইরিনের চোখের পানি গালে নেমে এলেও,
তুশির মন খারাপ হোলো না। ওই একটু গেঞ্জি সেট তো? ওসব ও তুড়ি বাজিয়ে ধুয়ে ফেলতে পারবে।
ইয়াসির ইউশাকে বলল,
“ যাকে যা কাজ দিলাম সেসব ঠিকঠাক হচ্ছে কী না দেখার দায়িত্ব তোর। বাড়ি ফিরে যেন না শুনি এর সামান্যতম নড়চড় হয়েছে।”
ইউশা সজোরে মাথা নাড়ল৷ দায়িত্ব পালনে সে এক পায়ে রাজি।
নিজের মতো বলে দিয়ে,ঘর ছাড়ল ইয়াসির। তুশি কিছুক্ষণ চেয়ে রইল সেদিকে। মেয়েটার মৃগনয়নের কোনে হয়ত কিছু মুগ্ধতার দেখা মিলেছে। লালচে ঠোঁট সরল একটুখানি। এক চোট শ্বাস টেনে ভাবল,
“ নাহ,যতটা বদ বলেছিলাম অতটাও না। একটু একটু ভালোও আছে।”

ইয়াসির থানায় ঢুকতেই ভড়কে গেল কিছু । প্রতিদিন যারা সালাম ঠুকতে দাঁড়িয়ে যায়,আজ তারা গোল গোল চোখে দেখছে তাকে। যেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে এমন অদ্ভুত প্রানী আগে দেখা যায়নি।
এই যে,চায়ের পানিটা মুখে পুরেও গিলতে ভুলে গেছে শফিক। নেহা খাতায় কিছু লিখছিলেন। ওসব ফেলে তাজ্জব চোখে সেও চেয়ে এদিকে। সবাইকে এক বার একবার দেখল ইয়াসির। কণ্ঠ ভারি করে বলল,
“ এনিথিং রং?”
ওই এক প্রশ্নেই যেন হুশ ফিরল সকলের। ত্রস্তবেগে উঠে দাঁড়াল তারা। কপালে চার আঙুল ঠেকিয়ে বলল,
“ স্যার,গুড মর্নিং স্যার।”
ইয়াসির তার ভড়কানো ভাব লুকিয়ে ফেলল কঠোর ব্যক্তিত্বের নিচে। একটু মাথা নেড়ে ঢুকে গেল কামরায়।
এতক্ষণে কথা বলার সুযোগ পেতেই এগিয়ে এলেন শফিক। ফিসফিস করে বললেন,
“ কী ব্যাপার বলুন তো, মিস নেহা,
কাল বিয়ে করে আজ থানায়?”
“ জানি না স্যার। আপনি বিয়েতে যাননি?”
“ না। আপনার ভাবির কাল জ্বর এসেছিল। অনেক শখ করেছিল স্যারের বিয়েতে যাবার। ওর জন্যে আমিও যাইনি। আপনিও কি যাননি? ”

“ গিয়েছিলাম। তবে শেষ অবধি থাকিনি। অনেক দূরের পথ,তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে বলে গিফট দিয়ে,খেয়েই চলে এসেছি। স্যারের বউ এত বড়ো ঘোমটা দিয়ে বসেছিল কী বলব!”
“ তাই নাকি,কেন? আজকাল বিয়েতে এরকম ঘোমটা তো রেয়্যার। ভেতরে কোনো গল্প আছে নাকি?”
নেহা মাথা নাড়লেন,
“ জানি না৷ ছুটি নিয়েও স্যার আজ অফিসে যখন,বোধ হয় কিছু আছে। আমাদের দুজনকে ছাড়া স্যার তো আর কাউকেই ইনভাইট করেননি। কাউকে যে জিজ্ঞেস করব,তাও হবে না।”
শফিক মাথা নাড়ল।
“ পারিবারিক বিয়ে তো। আপনি আমি স্যারের সাথে সব সময় কেস ফাইল করি দেখে আমাদের এড়িয়ে যেতে পারেননি। সে যাক গে, স্যারকে কি জিজ্ঞেস করব কিছু?”
পরপর নিজেই ঘাড় ঝাঁকিয়ে বললেন ,
“ না না থাক। স্যারের যা মেজাজ! দরকার নেই। ওনার বিয়ে, ওনার ডিউটি আমার কী?”
নেহাও এক মত। মাথা নাড়লেন সহসা।
তবে মুখে আমাদের কী বললেও শফিকের আগ্রহ গেল না।

বিয়ের জন্যে ইয়াসির ছুটি নিয়েছিল। তাহলে আজকে ডিউটিতে আসবে কেন? অন্তত বৌভাত অবধিও তো বাসায় থাকার কথা! ব্যাপারটা জানতে হচ্ছে তো!
ইয়াসির নিজের কক্ষে এসেই নাস্তার অর্ডার দিলো প্রথমে। সাথে এক কাপ কফি। ইদানীং সকালেই এত চডা রোদ পড়ে! এর মধ্যেই মাথা ধরে গেছে। দুই ভ্রুয়ের মাঝে আঙুল বুলিয়ে চেয়ারে পিঠ রাখল সে।
নিশ্চয়ই ওর বিয়ের পরদিনই থানায় আসা নিয়ে বাইরে কানাঘুষা হচ্ছে! হওয়ারই কথা। ও নিজেও কি ভেবেছিল একটা ঘটনায় জীবনের মোড় এমন আশ্চর্যরকম বদলে যাবে? রাস্তার একটা ছিচকেচোরের সঙ্গে বিয়ে হবে ওর?
শফিক আর নেহাকে তো কার্ড দিয়েছিল ইয়াসির। ওরা কি বিয়ে এ্যাটেন্ড করেনি? করলে তো সব জানার কথা।
ভাবতে গিয়েও ইয়াসির ঘাড় সোজা করল। জানলে জানবে,হু কেয়ারস?
তক্ষুনি দরজায় এসে দাঁড়াল শফিক। খুব ব্যস্ত স্বরে জানাল,
“ স্যার,এক বৃদ্ধা আপনার সাথে দেখা করতে চাইছেন। মানে কান্নাকাটি করছেন খুব! দেখা করা নাকি ভীষণ জরুরি। কী করব?”
ও বলল,
“ ডাকো।”

শফিক চলে গেল। একটু পরেই এসে দাঁড়ালেন হাসনা। সাথে টিনটিনও আছে। ভেজা চোখের সাথে,ঘামে সিক্ত মুখটা আঁচল তুলে মুছলেন তিনি। জীবনে কোনোদিন থানার পাশ মাড়াননি। সেখানে আজ স্বয়ং এক অফিসারের সামনে এসে থেমেছেন।
ইয়াসির বলল,
“ ভেতরে আসুন।”
ধীরুজ পায়ে ঢুকলেন তিনি।
ঢোক গিলতেই প্রশ্ন করল ও,
“ বসুন। বলুন,কী সমস্যা?”
হাসনা বসলেন না। পালটা প্রশ্ন করলেন নিভু গলায়,
“ তুশির লগে কি আপনার বিয়া হইছে ছার?”
অনাকাঙ্ক্ষিত, অপ্রত্যাশিত প্রশ্নে ইয়াসির হকচকিয়ে গেল।
মসৃণ কপালে ভাঁজ বসল অমনি। তবে উত্তর সে দিলো না। আড়চোখে দেখল শফিককে।
আদেশ ছুড়ল রাখ-ঢাকহীন,

“ তুমি এখন যাও।”
শফিকের সব উত্তেজনায় মাটি। কিন্তু মুখের ওপর তো কিছু বলতে পারবে না। বাধ্যের মতো বের হলো তাই। ইয়াসির ভ্রু নাঁচাল,
“ বসুন।”
হাসনা আস্তেধীরে বসলেন।
তার চাউনি উৎসুক। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে,অনেকের থেকে খোঁজ খবর নিয়ে ইয়াসিরের হদিস পেয়েছেন তিনি। যখন গাড়ি থেকে নেমে ঢুকছিল থানায়,টিনটিন দেখেই চিনেছে। তাই তো এক বুক আশা নিয়ে এলেন এখানে।
জিজ্ঞেস করলেন সাগ্রহে,
“ আমার তুশি কেমন আছে, ছার?”
ইয়াসির খুব শান্ত ভাবে বলল,
“ আপনার বোধ হয় কোথাও ভুল হচ্ছে। এই নামে আমি কাউকে চিনি না।”
হাসনা তাজ্জব হলেন। প্রত্যাশার বাতিটা ঝোড়োবাতাসের মতো দপ করে নিভে গেল যেন। হাহাকার করে বললেন,
“ কী কন? আমি যে হুনলাম আপনের লগে আমার নাতনির কাইল বিয়া হইছে? কী রে টিনটিন তুই-ই তো কইলি!”
ইয়াসির তাকাতেই ছোট্ট টিনটিন ঘাবড়ে গেল। মাথা নাড়তে গিয়েও থমকে রইল বেচারা।
ইয়াসিরের চোখমুখ শান্ত৷ এত সাবলীল দুনিয়ায় কিচ্ছুটি নেই। যেন এই মানুষ রাগ কী,মেজাজ কী জানেই না। অমন সুন্দর ভাবে শুধাল,

“ তাই? তা আপনার নাতনী কী করে?”
হাসনার চেহারায় অস্বস্তি। একটু সময় নিয়ে বললেন,
“ আমরা বস্তিতে থাহি। ছোডোখাডো কাম করি ছার। কাইল হইতে আমার নাতনিরে পাইতাছি না। টিনটিন কইল ওয় নাকি দ্যাকছে আপনাগো বিয়া হইতে। সেই আশায় ছুইট্টা আইছিলাম এইহানে.. কিন্তু… “
হাসনা কেঁদে ফেললেন। মলিন মুখখানা চাপলেন আঁচলে। ইয়াসির নিম্নোষ্ঠ দাঁতে পিষে চেয়ে রইল। এটা নিশ্চয়ই তুশির দাদি হবে। কয়েকবার দাদি দাদি নাম করে চ্যাঁচাতে শুনেছিল মেয়েটাকে। কী চমৎকার করে নাতনির চুরির পেশা এড়িয়ে গেলেন। একপেশে হাসল ও। তাড়া দেখিয়ে বলল,
“ দেখুন,আমি তো বললাম আমি এ নামে কাউকে চিনিনা। আর আপনার নাতনির সাথে আমার বিয়ে হবে এতটা খারাপ সময় হয়ত এ এসপি ইয়াসিরের আসেনি। উত্তর পেয়েছেন না? আপনি এবার আসতে পারেন।”
হাসনার আর বলার কিছু রইল না। অসহায়ের মতো চোখ মুছে, কোনোরকমে সালাম দিলেন। টিনটিনের হাতটা ধরে বেরিয়ে এলেন তারপর। কিন্তু টিনটিন যেতে যেতে একবার পিছু ফিরে চাইল। ওর স্পষ্ট মনে আছে,সেন্টারে ও ইয়াসিরকেই দেখেছিল। তুশিও ছিল পাশে। তাহলে এই পুলিশ এখন মিথ্যে বলল কেন?

ইয়াসিরের নির্দেশে আইরিনকে ঘর মুছতেই হলো। সবাই যখন নাস্তা খাচ্ছিল খাবার রুমে, বিমর্ষ আদলে গোটা বাড়ি মুছল সে। শওকত,সাইফুল কেউই এ নিয়ে কোনো কথা বললেন না।
এটুকু শান্তির দরকার ছিল। অন্যের পরিশ্রম কেন নষ্ট করবে?
তবে
তারপর থেকে আইরিনকে আর নিচে পাওয়া যায়নি। সেই যে ঘরে গিয়ে খিল দিলো,আর নামলই না। মাঝে তনিমা খাবার দিয়ে এলেন।
মাথায় হাত বুলিয়ে বোঝালেন অনেক কিছু। কিন্তু আইরিনের দুঃখ কমেনি।
তারপরপরইই তুশি এলো ওর জামাকাপড় নিতে। মেয়েটার ঠোঁটে তখন দুষ্টু দুষ্টু হাসি। দুপিসের গেঞ্জি সেট ধুতে ওর কষ্ট হবে না। কিন্তু এত বড় বাড়ি মুছতে আইরিনের যে আজ কত জায়গায় ব্যথা করবে,সেটুকু ওর আন্দাজে আছে। আর ঐ মিটিমিটি হাসিতেই আইরিনের ব্রক্ষ্মতালু অবধি জ্বলে গেল রাগে।
তুশির প্রস্থানপথে দাঁত পিষে চেয়ে রইল সে। ফুঁসতে ফুঁসতে ভাবল,
“ খুব মজা নিচ্ছিস তাই না? দাঁড়া তবে, এরপর তোর এমন অবস্থা করব, ইয়াসির ভাই নিজেও টের পাবে না।”

বেশ রাত হয়েছে। অথচ সারাদিন তুশির খাটাখাটুনিতে শেষ। রেহনূমা এক দণ্ড জিরোতে দেননি। একটু বসতে এলেই ডেকে কাজ ধরিয়ে দিয়েছেন। তুশি আজ এত্তগুলো কাপড় কেচেছে। তিন বেলার গাদা গাদা থালাবাসন মেজেছে। আরো ছোটো ছোটো কতগুলো কাজ,তার তো হিসেবও করা যাবে না।
মেয়েটার সারা শরীর টনটন করছে ব্যথায়। রেহনূমা উঠেপড়ে লেগেছেন ওকে নাস্তানাবুদ কর‍তে। উফ, এ মহিলা তিন্নির মায়ের চেয়েও বড়ো মাপের খচ্চুরে। কোন জন্মের শত্রুতা মেটাচ্ছে কে জানে!
তুশি ঘরে এলো। সবে রাতের খাবার শেষ করেছে সবাই। গোটা খাবার রুম গুছিয়ে তবেই ফুরসত মিলল তার। রেহনূমাকে বকাঝকা করতে করতে তোষকে গা রাখল তুশি। পায়ের গোড়ালি সুদ্ধ লাফাচ্ছে এখন। এত ব্যথা তো কুস্তি শেখার প্রথম দিনও হয়নি। উফ
ঘরের কাজে এত খাটুনি! এত কষ্ট?
তুশি মাগো বলতে বলতে এপাশ-ওপাশ করল। সেইসময় ফের হাজির হলেন রেহনূমা। তুশি সবে চোখ বুজেছে ঘুমোবে বলে, অমনি কর্কশ গলায় বললেন,

“ আচ্ছা ফাঁকিবাজ মেয়ে তো তুমি। কী সমস্যা তোমার? একটু ছুঁতো পেলেই ঘরে দৌড়ে আসো কেন?”
তুশির বিশ্রামের দফারফা! হতাশ শ্বাস ফেলল সাথে। এই মহিলার কি আর কোনো কাজ নেই?
দিন দুনিয়ায় এমন কুচুটে ও দুটো দেখেনি। তিতিবিরক্ত চিত্তে উঠে বসল মেয়েটা। থমথম করে বলল,
“ কী হয়েছে বলুন! আবার কী করতে হবে?”
“ কী করতে হবে মানে!
ইয়াসিরের ফেরার সময় হয়েছে। যাও,ও আসার আগে ওর ঘরটা ঝেড়েমুছে রেখে এসো।”
তুশি কপাল কুঁচকে বলল,
“ সকালে না বললেন ও ঘরে না ঢুকতে?”
“ এখন তো যেতে বলছি। ইয়াসির তোমাকে ওর ঘরে ঢুকতে মানা করেছিল। এখন রেশমী ব্যস্ত!
তাই ওর কাজ তুমি করে দিয়ে এসো।”
তুশি দুই গাল ফুলিয়ে বিরক্তি ঝাড়ল। উঠে দাঁড়াতেই,
রেহনূমা সতর্ক বানি ছুড়লেন,
“ খবরদার, ঘরের কোনো জিনিসে কিন্তু হাত দেবে না।”
তুশি ততক্ষণে হাঁটা ধরেছে। কথাটা শুনেও গতির বেগ থামল না। ভেংচি কেটে ভাবল,
“ কী এমন আছে পুলিশের ঘরে? বন্দুক আর ওই ত্যানার মতো ইউনিফর্ম ছাড়া! ছোয়া তো দূর, ওসব তুশি ফিরেও দেখে না হুহ।”
কিন্তু ঘটনা ঘটল উলটোটা। ইয়াসিরের ঘরের আলো জ্বালাতেই তুশির ঠোঁট দুটো আলীবাবার গুহা বনে গেল। এত সুন্দর! এত বড়ো!

চোখ ছানাবড়া করে চারদিক চেয়ে রইল সে। এ বাড়ি আসার পর এটা ওর সাথে ঘটা নৈমিত্তিক ব্যাপার। যে ঘরই দেখে সেটাই সিনেমার মতো সুন্দর। তুশি আজীবন শুনেছে ছেলেরা অগোছালো, জংলি হয়। এরা ঘরদোর গোছগাছ করতে জানে না। কিন্তু ইয়াসিরের কামরা দেখেই মাথা চক্কর কাটল ওর। তালুর চুলগুলোও হয়ত লজ্জা পেলো কিছু। এমন কাকের বাসা ও প্রতিদিন সাথে নিয়ে ঘোরে। সেখানে ইয়াসিরের থাকার জায়গাটা অবধি পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন! একটা কোনা এদিক ওদিক নেই। টানটান বিছানার চাদর থেকে শেল্ফের বইগুলো অবধি গোছানো। তুশি হাঁ করে চেয়েই চেয়েই পা বাড়াল সামনে। নাক বরাবর সোজা দেওয়ালের সাথে একটা ছোটোখাটো শেল্ফ সেট করে লাগানো। স্বচ্ছ কাচের ভেতর থেকে একেকটি পুরষ্কার চকচক করে জ্বলছে। সব কি ওই বদ পুলিশের? এত পুরষ্কার ব্যাটা কীসে পেলো? মারপিটে!
তুশি ঠোঁট কামড়ে পুরষ্কারের গায়ের লেখা পড়ার চেষ্টা করল একবার। পারল না!
চোখদুটোর জ্যোতি বোধ হয় কমেছে। আরো এগিয়ে, কাচের গায়ে চোখ পেতে দাঁড়াল এবার। বানান করে করে আওড়াল,

“ ব এ কারে বে, স, ট। বেস্ট…”
তক্ষুনি, দোর হতে একটা জলদগম্ভীর স্বর ছুটে এলো কানে
“ অ্যাই মেয়ে!”
তুশি চমকে গেল। ছলকাল তার শীর্ন কাঁধ।
তড়িৎ ফিরে চাইল পেছনে। তপ্ত দুটো চোখ মেলে চেয়ে আছে ইয়াসির। মটমটে চৌকোশ চোয়াল দেখেই বুক শুকিয়ে গেল তুশির।
চট করে সোজা হলো মেয়েটা। ইয়াসিরের পায়ে বুট। উৎকট শব্দ তুলে সামনে এসে দাঁড়াল। দাঁত খিচে বলল,
“ হাউ ডেয়ার ইউ! আমার ঘরে কেন ঢুকেছ তুমি?”
তুশির কাম তামাম কর‍তে যথেষ্ট দুটো লাইন। ভয়ডরে চিমসে এলো মেয়েটা। চোখ নিচু। গলাও নিচু করে বলল,
“ ইয়ে মানে, ঘরটা গোছাতে এসেছিলাম।” চ্যাঁচিয়ে উঠল ইয়াসির,
“ আমার ঘর গোছাবে তুমি? তোমার মতো একটা বস্তির মেয়ে আমার জিনিসে হাত দেবে? নিজেকে কি আমার বউ ভাবা শুরু করেছ?”

তুশির ছোট্ট কলিজা ছলাৎ ছলাৎ করছে। কানের পর্দা হয়ত দুভাগ হয়েছে আগেই! মিনমিন করে বলল,
“ আমার কী দোষ? আমি তো আসতে চাইনি। আপনার ছোটো মা জোর করে পাঠিয়েছেন।”
কিছু বলতে গিয়েও থামল ইয়াসির৷ ছোটো মা গুরুজন। তুশির মতো বাইরের লোকের কাছে তো তাকে ছোটো করা সাজে না। ক্রোধের উত্তপ্ত লাভাটা গিলে নিলো সহসা। চোখ বুজে শ্বাস ফেলল । সরে এলো সামনে থেকে।
খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে থাকা তুশি, চোখের কোণ তুলে চাইল। বন্ধুক টন্দুক আনতে গেছে কী না! রাগে না গুলি মেরে ওর খুলি উড়িয়ে দেয়।
কিন্তু না,ইয়াসির ইউনিফর্ম ছাড়ছে। গাঢ় নীল শার্টটা শরীর থেকে সরাতেই লোমশ বুক বেরিয়ে এলো।
তুরন্ত চোখ নামিয়ে নিলো তুশি। হাতে তোয়ালে নিলো ইয়াসির। ওয়াশরুমে যেতে নিয়েও থামল আবার। তর্জন দিলো ঠান্ডা ভাষায়,
“ বের হয়ে যেন তোমাকে না দেখি।”

ভেতরে ঢুকতেই,ধরে রাখা নিঃশ্বাসটা ঠোঁট ফুলিয়ে ছাড়ল তুশি। বাপরে বাপ! পুলিশ না বোম? আরেকটু হলেই তো উড়িয়ে দিত ওকে। উফ,এর ঘর পরিষ্কারের আগে এর ব্যবহার পরিষ্কার করা উচিত।
তুশি রুমের এদিক সেদিক দেখল। তকতকে ঘরের কী মাথামুণ্ডু পরিষ্কার করবে ও? সব তো ঠিকঠাকই আছে। ধুর, দরকার নেই। থাকুক যেমন আছে। কেউ জিজ্ঞেস করলে নাহয় বলে দেবে, সব গুছিয়ে রেখে এসেছে।
তুশি ঝাড়ুটা হাতে নিতে গেল, আচমকা চোখ পড়ল টেবিলে। ইয়াসিরের মানিব্যাগ,ঘড়ি, ফোন রাখা । সব ছাপিয়ে ফুলকো ওয়ালেটেই আটকে গেল মেয়েটা। নিশ্চয়ই এর মধ্যে অনেক টাকা আছে!
ব্যস, চোরের মনটাই আবার জেগে উঠল তুশির। সতর্ক নয়নে আশপাশ দেখল এক পল। কোথাও কেউ নেই। ইয়াসিরও ফ্রেশ হতে গেছে। এই সুযোগে একটু চুরি করা যায় না? তুশি আজ আর নিজেকে সামলাতে পারল না। না পারল হাত নিশপিশ করা আটকাতে।
পা টিপে টিপে এসে ওয়ালেটটা তুলল। দু পাশ মেলতেই আস্ত আস্ত নোটগুলো চাইল ওর দিকে। সাথে চ্যাঁচিয়ে চ্যাঁচিয়ে বলল,
“ তুশি,আমাদের নিয়ে যা। নিয়ে যা আমাদের।”
তুশি ঢোক গিলল।

হাতটা বাড়িয়েও গুটিয়ে আনল আবার। ইয়াসির নিশ্চয়ই টাকা গুণে গুণে রেখেছে। যদি বড়ো নোট ধরে,নির্ঘাত বুঝে ফেলবে। যা বুদ্ধি এর! এক কাজ করুক, ছোটো নোট নিক। একশ- দুশো টাকার হিসেব নিশ্চয়ই রাখেনি?
নিজের মতো ছক কষে মাথা নাড়ল তুশি। একশ টাকার দুটো নোট ব্যাগে। হাতটা বাড়াল নেবে বলে,পেছন থেকে খপ করে কব্জিটা চেপে ধরল ইয়াসির। ছ্যাৎ করে উঠল তুশির বুক। ফ্যাকাশে মুখে চাইতেই,
ইয়াসির ভ্রু নাঁচায়,
“ আবার চুরি?”
তুশির গলা শুকিয়ে কাঠ। চেহারায় রক্ত নেই। তুঁতলে উঠল কথা বলতে গিয়ে,
“ ককইইইই! আ আমি মানে,ইয়ে মানে চুরি করছিলাম না।”
ইয়াসিরের সারা মুখে জলের ফোঁটা। এক হাতে তোয়ালে নিয়ে মুছল সেটুকু। ভীষণ শান্ত অথচ গম্ভীর গলায় বলল,
“ হাতটা খুব নিপুন। কিন্তু ভুলে যাচ্ছো আমি পুলিশ। চোখ বুজেও বুঝতে পারি চোরের হাত কেমন হয়!”
তুশির বুক কাঁপছে। কী বলবে, কী করবে দিশাহারা দশা। জ্বিভ দিয়ে ঠোঁটটা চেটেপুটে বলল,
“ আমি তো,আমিতো শুধু..”

ইয়াসির বলতে দিলো না।
কথা কেড়ে নিলো মাঝেই,
“ তোমার চোখ বলছে তুমি কী করতে যাচ্ছিলে। আর অপরাধীর চোখের ভাষা ইয়াসির আবরার জানে। তাই এখন অহেতুক মিথ্যে বলতে এসে নিজেই ফেঁসে যেও না।”
তুশি নেতিয়ে গেল। পরপরই কণ্ঠের ধরণ পাল্টে ফেলল ইয়াসির। গর্জে উঠল কড়া স্বরে,
“ স্বীকার করো চুরি করছিলে।”
তুশির রুহু উড়ে গেছে। ভয়ে ওষ্ঠাগত প্রাণ। চোখমুখ খিচে বলল,
“ করছিলাম,করছিলাম চুরি।”
ইয়াসির হাত ছেড়ে দেয়। মানিব্যাগটা টান মেরে নিয়ে নেয় কাছে। বাক্য ছুড়ে আগের ন্যায়,
“ কান ধরো।”
প্রকট চোখে চাইল তুশি,
“ হ্যাঁ?”
“ শুনতে পাও না? কান ধরতে বলেছি। কুইক!”
তুশির সরু নাক ফুলে উঠল এবার। মগের মুল্লুক নাকি! একশ টাকার জন্যে কান ধরতে হবে?
ও বস্তির সেলিব্রিটি । কারওয়ানের কত নাম করা পকেটমার। সবাই ওকে এক নামে চেনে। আর তাকে এই পুলিশ কান ধরতে বলছে?

ইয়াসিরের পেছনে ড্রেসিং টেবিল। মানিব্যাগটা সেখানে রাখতে পিছু ফিরল সে। চওড়া পিঠ দেখে দেখে কোন ভূত তুশির কাঁধে নামল কে জানে!
এক আধ্যাত্মিক শক্তিতে ফেঁপে উঠল সে। এই বদের হাড্ডি পুলিশটা ওকে একটু বেশিই পেয়ে বসেছে। সমঝে চলছে বলে কি মাথায় উঠে নাচবে?
ঘরের কাজ করাচ্ছে, আবার এখন কান ধরাবে? তুশির প্রেসটিজ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা?
মেয়েটা দন্তপাটি পিষল।
রাগে সারা শরীর জ্বলছে। কুস্তির সৈনিক সুলভ মনটা গর্জে উঠল সিংহের ন্যায়। পিছু ফিরে থাকা ইয়াসিরকে মেরে তক্তা বানানোর স্পর্ধায় ফুলে উঠল বুক। শিরদাঁড়া বরাবর একটা প্রকাণ্ড ঘুষি মারার জন্য তেড়ে এলো তুশি। বিধিবাম!
চট করে ফিরেই,হাতটা পিঠের সাথে মুচড়ে ধরল ইয়াসির। চমকে থমকে নিঃশেষ হওয়া মেয়েটা
ককিয়ে উঠল ব্যথাতে,
“ আয়ায়ায়া,ভেঙে যাবে। মাই হ্যান্ড ভেঙে যাবে সার।”
“ খুব সাহস! পুলিশের গায়ে হাত?”
তুশি হাহুতাশ করে বলল

“ করব না,আর করব না। ছেড়ে দিন সার,এবারের মতো ছেড়ে দিন।”
“ ভেবেছিলাম ছেড়ে দেবো। কিন্তু না,তুমি পাল্টাবে না। তাহলে বরং থানায় যাই?”
হাতে টান বসাতেই,শঙ্কায় জমে গেল তুশি। আবার থানা! ততক্ষণে এক পা বাড়িয়েছে ইয়াসির। তুরন্ত, ধড়ফড় করে মেঝেতে বসেই অন্য পা-টা চেপে ধরল তুশি। হড়বড় করে বলল,
“ ভুল হয়ে গেছে,ভুল হয়ে গেছে। আর করব না সার। এবারের মতো ছেড়ে দিন সার। সরি সার। মাফ চাই সার।”
ইয়াসির থামল। চাইল ফিরে।
তুশি অজগরের মতো পা প্যাঁচিয়ে ধরেছে দেখে শ্বাস ফেলল ছোট্ট। সরু চোখে বলল,
“ মনে থাকবে?”
সবেগে মাথা নাড়ল মেয়েটা। ও বলল ,
“ ওঠো।”
তুশি আস্তেধীরে দাঁড়াল
সোজা গিয়ে ডিভানে বসল ইয়াসির। হাতলে বাহু ছড়িয়ে বলল,
“ এবার কান ধরো।”
তুশি আর গাঁইগুঁই করল না। ওই সাহস আর নেই। খুব অসহায় কণ্ঠে শুধাল,
“ এক কান না দুই কান?”
ইয়াসির চোখ রাঙাতেই,ত্রস্ত দুই কানে হাত দিলো মেয়েটা।
সে বলল,

“ এবার ওঠবস করো। প্রত্যেক ওঠবসে বলবে,আমি আর চুরি করব না।”
তুশির বুক কষ্টে খানখান হয়ে যাচ্ছে।
ওর রেকর্ড ভেঙে চুরমার তো হলোই, সাথে সেলিব্রিটি ইজ্জতটা পুরো তছনছ করে দিলো ইয়াসির।
মেয়েটা কটমট করে ভাবল,
“ বিটকেল পুলিশ,
একশ টাকা নিয়ে এত কিছু করছিস! ইতর,ইচ্ছে করছে কষে তোর জায়গামতো দিতে।”
“ কী হোলো? কথা কানে যাচ্ছে না?”
স্থূল স্বরে ধ্যান ছুটল ওর। কান ধরে,
মুখ গোজ করে বসল। থমথমে গলায় বলল,
“ আমি আর চুরি করব না।”
উঠে দাঁড়াল আবার। বলল,
“ আমি আর চুরি করব না।”
গুণে গুণে ত্রিশবার ওঠবস করানোর পর ইয়াসিরের মায়া হলো বোধ হয়। ছোট করে বলল,
“ থামো।”

থামল তুশি। হাঁপিয়ে গেছে। টনটন করছে কোমর। আঙুল দিয়ে তুড়ি বাজাল ইয়াসির। সোজা দোর দেখিয়ে বলল,
“ নাউ গেট লস্ট। আর কক্ষনো আমার ঘরের দরজায়ও আসবে না।”
রুক্ষ স্বর শুনে নিরাশ শ্বাস ফেলল মেয়েটা। গত দুদিন ধরে ওর সাথে যা যা ঘটছে, এতটা খারাপ দিন তুশি জন্মের পর দেখেনি। চুপচাপ ঝাড়ু হাতে নিয়ে দোর অবধি এলো ও।
তক্ষুনি ডাকল ইয়াসির,
“ শোনো…
দাঁড়াল তুশি। ফিরল অবসন্ন চোখে। ইয়াসিরের ফরসা আনন
নিরুত্তাপ। কেমন কাঠখোট্টা বলল,
“ এরপর থেকে টাকার দরকার হলে আমাকে বলবে। কিন্তু না বলে কখনো কারো জিনিসে হাত দেবে না।”
তুশি হোচট খেল। ভীষণ বিস্ময়ে চোখ বড়ো বড়ো করে বলল,
“ আপনি আমাকে টাকা দেবেন?”
ইয়াসির আর কিছু বলল না।
ব্যস্ত হলো নিজের কাজে। তার এই মৌনতায় উত্তর বুঝে নিলো মেয়েটা। সীমা ছাড়ানো আনন্দে ঝলকে উঠল মুখশ্রী। মানুষটা বলল,
“ দরজা টেনে দাও।”

কাছে আসার মৌসুম পর্ব ১৪ (২)

তুশি যেন বাধ্য মেয়ে। কাঠ টেনে দিলো সুধীর হাতে। পুরোপুরি লাগিয়ে দেয়ার ফাঁক গলে একবার দেখল ইয়াসিরকে। লোকটা ডিভানে বসে ফোন মেলেছে।
হলদে আলোয় জ্বলজ্বল করছে মুখ। দু সেকেন্ড চেয়ে থেকেই চোখ সরিয়ে নিলো তুশি। একটা সিনেমার দৃশ্যের কথা দপদপ করে নেচে উঠল মাথায়। হিরোইন ঠিক এইভাবে দেখতে দেখতেই হিরোর প্রেমে পড়ে গেছিল।
তুশি জিভ কাটল। ছিঃ ছিঃ বদ পুলিশ আর প্রেম!
সিনেমায় দেখিয়েছে বুকে শব্দ করলে প্রেম হয়। পরীক্ষা করতে নিজের বুকে হাত দিলো তুশি। নাহ,ধকধক করছে না। যাক, প্রেম-ট্রেম হয়নি। এবারের মতো বেঁচে গেল তাহলে!
কিন্তু, সত্যিই কি তাই?

কাছে আসার মৌসুম পর্ব ১৬