কাছে আসার মৌসুম পর্ব ২৬
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
সৈয়দ নিবাসের প্রাচীর হতে থমথমে ছাঁয়াটা এখনো যায়নি। সবকিছু পিনপতন নীরবতার ন্যায় নিশ্চুপ। অথচ কেমন আশ্চর্যজনক ভাবে তুশি ভীষণ স্বাভাবিক হয়ে গেল। একটু আগে যে সাংঘাতিক এক ঝড় বয়েছে ওর ওপর,চেহারায় তার চিহ্ন মাত্র নেই। তখন সন্ধ্যে। মাগরিবের আযান পড়েছে কিছুক্ষণ হবে। তুশি বইখাতা গোছাচ্ছিল। তক্ষুনি ঘরে ঢুকল ইউশা। হন্তদন্ত পায়ের শব্দে ফিরে চাইল তুশি। চেনা মানুষ দেখে সেই আগের মতো হাসল সে। স্ফূর্ত গলায় বলল,
“ আরে, তুমি চলে এলে? আমি আরো পড়তে যাব ভাবছিলাম।”
বিস্মিত ইউশার চোখজোড়া কপালে উঠে যায়। অবাক কণ্ঠে বলে,
“ তুমি আমার ওপর রেগে নেই?”
“ রাগ,কই না তো! রাগ করব কেন?”
তুশির এই অনাকাঙ্ক্ষিত সহজ কথাবার্তা ইউশা মেনে নিতে পারল না। নিশ্চয়ই মেয়েটা প্রচণ্ড কষ্টে এমন পাথরের মতো করছে। ভেতর ভেতর নির্ঘাত খুব অভিমান করেছে তুশি! অবশ্য করবে নাই বা কেন? ইউশাও তো বাড়ির সবার মতো ভুল বুঝল ওকে। তনিমা,শওকত জয়নব প্রত্যেকে ক্ষমা চাইলেও,ইউশার মুখ নেই ওসবের। তুশির সাথে এ বাড়িতে সব থেকে বেশি মেলামেশা ওর। অথচ ওই ওকে বুঝল না? নিজের প্রতি এক ছটা নিরাশায় ইউশার চোখ ভিজে এলো। তাকে ঠায় দাঁড়িয়ে দেখে কাছে এসে দাঁড়ায় তুশি। বাহু ধরে ডাকে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ এই ইউশা,কী হলো?”
তুরন্ত হুহু করে কেঁদে উঠল মেয়েটা। ভেজা,জড়ানো স্বরে বলল,
“ তুশি,তুশি আম সরি! আমাকে প্লিজ মাফ করে দাও। আমি যে কীভাবে তোমাকে অবিশ্বাস করলাম! আমার এখন নিজের ওপরে খুব রাগ হচ্ছে।”
বিপরীতে চমৎকার করে হাসল তুশি। বলল,
“ বোকা মেয়ে! তুমি এইজন্যে কাঁদছো? আমি তো বললাম আমি রেগে নেই।”
“ না। মিথ্যে বলছো। কেন রেগে থাকবে না তুমি? তোমার এত বড়ো বিপদে বন্ধু হয়েও আমি পাশে দাঁড়াতে পারিনি। আমার সাথে তো তোমার কথা বলাই উচিত না।”
“ ধুর, কী যে বলো তুমি! তুমি কি ভুল কিছু করেছ? আর পাঁচটা মানুষ যা করতো,আমাকে যা ভাবতো তুমিও তাই ভেবেছ। এখানে তোমার কোনো দোষ নেই ইউশা। আমি যে চোর,এটা তো সত্যি। আর চোরকে চোর ভাবা অন্যায় কবে থেকে হলো!”
ইউশা ঝরঝর করে কেঁদে উঠল ফের। তুশি চোখের পানিটা মুছিয়ে দিয়ে বলল,
“ কেঁদো না ইউশা। আমার সত্যিই তোমার ওপর কোনো অভিযোগ নেই। তুমি জানো, এই বাড়িতে আসার পর আমি কতবার এটা-ওটা চুরি করতে গিয়েছিলাম? শুধু ওই বিটকেলের ভয়ে পিছিয়ে এসেছি। আবার ভাবতাম,বাইরেই তো যেতে পারি না। চুরি করে কী করব? আর সত্যি বলতে, খারাপকে সবাই খারাপই তো ভাববে। আমি চুরি করতাম,তাই চুরির প্রথম তির আমার দিকেই এসেছিল। এটা আহামরি কোনো ব্যাপার নয়!
শশব্যস্ত ওর হাতদুটো মুঠোয় ধরল ইউশা। কেঁদে কেঁদে বলল,
“ আমি আর কখনো এমন করব না,তুশি। আর কোনোদিন অবিশ্বাস করব না তোমাকে। তুমি দেখো, এরপর থেকে যা ঘটবে যা হবে সব বিপদে ভাইয়ার মতো করে তোমার পাশে থাকব আমি। ভাইয়ার মতোই লড়ব তোমার হয়ে। দেখো তুমি!”
তুশির কথার বান হারিয়ে গেল। হাসিহাসি দৃষ্টিযূগল স্পন্দন খোয়াল সাথে সাথে। চোখের পর্দায় ভেসে উঠল সকালের সেই দৃশ্যরা। ইয়াসিরের অমন দরাজ স্বর। সদর্পে ঘোষণা করা,
“ তুশি আমার স্ত্রী!”
ইউশা হাত ধরে ঝাঁকাল,
“ কী হলো, বলো কিছু।”
তুশি নড়ে ওঠে। বলে,
“ হুঁ? আচ্ছা বাবা ঠিক আছে। এখন এসব নিয়ে চাপ নিও না তো।”
সাথে সিক্ত গালজোড়া মুছে দিলো ফের। ইউশা বাচ্চাদের মতো বলল,
“ তাহলে আমরা আবার আগের মতো তো?”
হেসে ফেলল তুশি। কণ্ঠে উচ্ছ্বাস নিয়ে বলল,
“ অফকোস। এমন সামান্য কারণে আমাদের বন্ধুত্ব পাল্টে যাবে নাকি? তোমার ঐ পেত্নি বোনের এখনো এতটাও ক্ষমতা হয়নি বুঝলে।” ইউশার চপচপে মুখখানায় এতক্ষণে আলো দেখা গেল। ঠোঁট মেলে হাসল সেও। পরপরই রেগেমেগে বলল,
“ আইরিন আপুর ওপরে আমার যা রাগ উঠেছিল তখন। ইচ্ছে করছিল মেরে চাপার সব দাঁত ফেলে দিই। কত বড়ো খারাপ দেখলে। তুমি আগে চুরি করতে,তাই এই ব্যাপারে যে তোমাকে ফাঁসানো খুব সোজা সেটা বুঝেই অমন একটা কাজ করেছে আপু। ভাগ্যিস ভাইয়া ছিল,কী যে হতো নাহলে! এমন করে ওর পেট থেকে কথা বের করতে আমি তো পারতামই না।
আর লজ্জাও নেই জানো। এত বড়ো একটা কাণ্ডের পরেও কেমন সারাবাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি হলে তো দরজায় খিল দিয়ে বসে থাকতাম। ওখানে গলে পচে মরে গেলেও জীবনে আর বাইরে আসতাম না।”
ইউশা মাথা নেড়ে নেড়ে সব কথা বলছে। তবে তুশির মনোযোগের তরিটা নিখোঁজ হলো কূল হতে। বিড়বিড় করল আনমনে,
“ ভাগ্যিস ছিলেন উনি,ভাগ্যিস!”
তুশি সন্ধ্যে থেকে ওৎ পেতেছিল ইয়াসিরের বাড়িতে ঢোকার। অথচ ঘড়িতে নয়টা ছাড়াল,জনাবের এখনো খবর পাওয়া যায়নি। অন্য সময় তো নটার আগেই ফেরে। আজ কী হলো? মেয়েটা আরেকবার পর্দা সরিয়ে বাইরেটা দেখল। কেউ সদর দরজা দিয়ে ঢুকলে এখানে দাঁড়িয়েই দেখা যায়। নাহ,আসেনি। তুশি গিয়ে নীরস চিত্তে বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসল৷ টেবিলের ওপর একটা ছোট্টো ঘড়ি আছে। এটা ইউশার দেয়া। ছুটতে থাকা কাঁটাগুলোর দিকে ব্যগ্র নয়ন তুলে বারবার দেখছিল সে। এর মাঝেই সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এলো। চেনা বুটের শব্দে সচকিত হয়ে মাথা তুলল মেয়েটা৷ পরপরই ছুটে এলো ঝড়ের মতো। অল্প একটু পর্দা সরিয়ে মাথাটা বের করে উঁকি দেয় তুশি। ইয়াসির এসেছে। সদর দোর লক করে রওনা করেছে ঘরের পথে। তনিমা সোফায় বসেছিলেন। হাতে সুই-সুতো। ওকে দেখেই বললেন,
“ ভাত বাড়ব?”
“ না, কফি পাঠাও। মাথা ব্যথা করছে।”
শশব্যস্ত হাতের কাজ ফেলে রান্নাঘরে ছুটলেন রমনী। তুশিও আর থামল না। পিছু পিছু এসে রান্নাঘরে দাঁড়াল। তনিমা তাড়াহুড়ো করে কফির জন্যে পানি বসালেন। একেবারে কাপে ঢালা থেকে চামচ নাড়া অবধি দাঁড়িয়ে রইল তুশি। সবটা সে মনোযোগ দিয়ে দেখেছে। তারপর মাথা নেড়ে ভাবল, কফি তাহলে এভাবে বানায়! তনিমা কাপ নিয়ে ফিরতেই দুজন মুখোমুখি হলো। অমনি তুশি শিরদাঁড়া সোজা করে ফেলল। ভদ্রমহিলা থমকালেন প্রথমে। পরপরই ঠোঁটে হাসি টেনে বললেন,
“ কী তুশি,কিছু লাগবে?”
তুশি এক বার কফির দিকে,পরের বার ওনার মুখের দিকে চাইল। মেয়ের সুকোমল চেহারায় বিস্তর জড়তা। আবদার ছুড়ল মিনমিন করে,
“ এটা,এটা আমি নিয়ে যাই?”
তনিমা যেন আকাশ থেকে পড়লেন।
“ তুমি নিয়ে যাবে?”
চিবুক নামিয়ে মাথা নাড়ল তুশি। মেয়েটার এই আচমকা লজ্জা লজ্জা ভাব দেখে তনিমা আশ্চর্য হন। পরমূহুর্তে ঠোঁট চেপে হাসলেন তিনি। ছোট্ট ট্রেটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
“ আচ্ছা, নিয়ে যাও। তবে সাবধানে, খুব গরম কিন্তু।”
তুশি খুশি হয়ে গেল। কফিটা নিয়েই চড়ুই পাখির মতো স্ফূর্ত গতিতে পা বাড়াল তড়িৎ। তনিমা শ্বাস টেনে হাসলেন৷ কেন যেন মনে হচ্ছে, এই দূরুত্ব কমার আর বিশেষ দেরি নেই। খুব ঘনিষ্ঠে আসছে ওদের #কাছে_আসার_মৌসুম!
ইয়াসিরের মাথা ব্যথা জোরালো। বাইরের অতিরিক্ত রোদ আর গরমে পুরোদস্তুর মাইগ্রেন জেঁকে বসেছে। শরীরী ছুটন্ত ক্লান্তিটাও যেন এক ফোঁটা থামছে না। গায়ের ইউনিফর্ম নিয়েই সোজা এসে বিছানায় শুয়ে পড়ল সে। ঘরে তখন ডিমবাতি জ্বলছে। খোলা জানলার ওপাশ হতে যতটা আলো ফিনকি দিয়ে আসছে,তাতেও সব স্পষ্ট দেখা যায়। সেসময় নরম পায়ে দোরগোড়ায় এসে থামল তুশি। কফি নিয়ে তো এলো,কিন্তু ভেতরে ঢোকার সাহসে কূলোচ্ছে না। বিটকেলটা গতবার কেমন কড়া করে বলেছিল,
“ এ ঘরের দরজায়ও যেন তোমাকে না দেখি!” এখন যদি রেগেমেগে গুলি করে দেয়? চিন্তায় নুইয়ে পড়তে পড়তেও সোজা হলো তুশি। বুক টানটান করে ভাবল, আমি তো আর এমনি এমনি আসিনি। কফি দিয়ে ওনার উপকার করতে এসেছি৷ উপকারিকে নিশ্চয়ই উনি কিছু বলবেন না। ঠোঁট ফুলিয়ে দম ফেলে ঝট করে ঢুকে পড়ল তুশি৷ চোখজোড়া প্রথমেই গিয়ে খাটের ওপর পড়ল। লম্বালম্বি শুয়ে থাকা মানুষটাকে দেখে থতমত খেল এক চোট৷ ইয়াসিরের চোখ বন্ধ। কপালের ওপর পেশিবহুল ডান হাতটা আড়াআড়ি রাখা। তুশি কী করবে বুঝতে পারছে না। কিছুক্ষণ দোনামনা করে এগিয়ে এলো। কিন্তু যত সামনে আসছিল,কেমন আশ্চর্য রকম কাঁপুনিতে কাবু হলো ভেতরটা। ধুকপুক ধুকপুক শব্দের মাত্রা যে কী প্রগাঢ়!
তুশি ভীষণ আস্তে করে কফির ট্রেটাকে রাখল টেবিলে। পিছু ফিরে দেখল,একইরকম শুয়ে আছে ইয়াসির। একটু নড়ছেও তো না। ঘুমিয়ে গেল কী? ইস,মনে হয় খুব ক্লান্ত! তুশির সাহসটা হঠাৎই বেড়ে গেল এবার। খুঁটে খুঁটে ইয়াসিরকে দেখার সুপ্ত এক ইচ্ছে মাথা চাড়া দিলো। অভিভূতের ন্যায় ধারালো চিবুক পানে চেয়ে রইল সে। আজ যেন কড়ায়-গণ্ডায় এই মুগ্ধতার মানে বুঝে নিলো তুশি। বুঝে ফেলল সে আর নিজের মাঝে নেই। হৃদপিণ্ডের লাব-ডাপের গতি বাড়াতে ইয়াসির এসেছে তার কাছে। বুঝে ফেলল ইউশাই ঠিক। তুশি হারিয়ে গেছে এক গভীর সমুদ্রের মাঝে। যে সমুদ্রে শুধু একটাই তির,একটাই কিনারা- ইয়াসির!
মেয়েটার আনচানে মনে সেই একই তাল তখন। ফের কানের পাশে বেজে উঠল মোহময় কিছু শব্দ,
“ তুশি আমার স্ত্রী!”
সাথে এক ঝটকা শনশন বাতাসে ছুটে বেড়াল মাতাল সেই সুর,
“ এলোমেলো হয়ে যায় মন,
কেন আজ বুঝি না!
দাবানল যেন ছড়াল,পার করে সীমানা।
সাগরের মতো হারাল, এ মনের কামনা।
নিজেকেই দেখে লাগে আজ,অচেনা অচেনা অচেনা।
বাতাসে গুণগুণ…….”
ধ্যানে মগ্ন মেয়েটার হঠাৎ চোখ পড়ল ইয়াসিরের পায়ের দিকে। জুতো জোড়াও খোলেনি। তুশি নিঃশব্দে এসে ওর পায়ের কাছে হাটুমুড়ে বসল। হাতটা বাড়াতে নিয়েও গুটিয়ে আনল এক বার। গলা উঁচিয়ে ইয়াসিরকে ফের দেখল ভালো করে। নাহ, জেগে নেই । তুশি সাহস করে জুতোয় হাত দিলো। এক পায়েরটা খুলতে যেতেই,এতক্ষণে নড়ে উঠল ইয়াসির। হাতটা চট করে সরাল কপাল থেকে। ভ্রু কুঁচকে চাইল পায়ের দিক। তুশিকে দেখেই তড়াক করে উঠে বসল অমনি।
“ কী হচ্ছে?”
তুশি লাফিয়ে উঠল। স্পর্ধা-টর্ধা ফানুসের মতো উড়ে গেল হাওয়াতে। বাড়ানো হাতজোড়া এক চোট কাঁপুনিতে ফিরে এলো জায়গায়। ধড়ফড় করে বলল,
“ আমি তো কফি দিতে এসেছিলাম।”
সাথে আঙুলের ইশারায় অদূরের টেবিলটাকে দেখাল সে। ইয়াসির এক পল চেয়ে চোখ সরিয়ে আনল। মুখায়ব শিথিল হলেও,ভারি গলায় শুধাল,
“ তুমি নিয়ে এসেছ কেন? মা কোথায়?”
তুশি জিভে ঠোঁট ভেজায়। থেমে থেমে বলে,
“ বা বাবা ডে ডেকেছেন বলে আমাকে দিতে বলেছেন।”
ইয়াসির কপাল কুঁচকে চেয়ে রইল তাও। চোখমুখ দেখে পরিষ্কার,একদম বিশ্বাস করেনি। তুশি হড়বড় করে উঠল,
“ সত্যি বলছি। বিশ্বাস নাহলে ডেকে জিজ্ঞেস করতে পারেন।”
“ এখানে কী করছিলে?”
ইয়াসির মেঝের কথা বোঝাল। আর এতেই সব যুক্তি গুলিয়ে ফেলল মেয়েটা। মিথ্যে বলতে ও যতই পাকা হোক,ইয়াসিরের চোখ দেখলেই সব আটকে যায়। তুশি গাল চুলকে এদিক-ওদিক তাকাল। বিটকেলটা যে কেন এত প্রশ্ন করে! কোন হতচ্ছাড়া একে পুলিশের চাকরি নিতে বলেছিল, সেটাকে হাতের কাছে পেলে মেরে তুশি রুটি বানিয়ে ফেলবে।
“ কিছু জিজ্ঞেস করেছি।”
পুরু স্বরে চটক কাটার ন্যায় ফিরল সে। আমতাআমতা করে বলল,
“ আসলে একটা ইঁদুর দেখলাম ঘরে। আমাকে দেখেই দৌড়ে খাটের নিচে ঢুকল। যদি আপনাকে কামড়ে টামড়ে দেয়,তাই আর কি উঁকি দিয়ে দেখছিলাম।”
ইয়াসিরের মুখের ধরণ বদলাল। আরো পাথুরে হলো তা। নিশ্চিত এইবারেও বিশ্বাস করেনি। নির্লিপ্ত, ঠান্ডা চোখের চাউনিতে তুশি নেতিয়ে আসে। সোজাসুজি চেয়ে থাকতে পারে না। ফ্লোরে এলোমেলো পাতা ফেলে চোখের। ইয়াসির নিরেট কণ্ঠে বলল,
“ যাও এখন।”
তুশি মাথা তুলল। শুনতে পায়নি এমন ভাবে শুধাল,
“ হু?”
“ যেতে বলেছি।”
কথাটায় বাধ্যের মতো ঘাড় নাড়ল মেয়েটা। ততক্ষণে টেবিল থেকে কফি মগ হাতে তুলেছে ইয়াসির৷ তুশি উঠে দাঁড়ালেও,এক ফোঁটা নড়ল না। ইয়াসির কাপে চুমুক দিতে গিয়েও থামল। ওকে ঠায় দাঁড়ানো দেখে প্রশ্ন ছুড়ল হাস্যহীন,
“ কিছু বলবে?”
তুশির অন্তঃপট উশখুশ করছে খুব। নিশপিশে ভাব নিয়ে চৌচির হচ্ছে জিভটা। মনের এই দোলাচলে বেচারি বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারল না। বলেই ফেলল মুখ ফস্কে,
“ আপনার না মাথাব্যথা, টিপে দেই?”
মহাভারত অশুদ্ধ হওয়ার মতো চাইল ইয়াসির। আকাশ ছোঁয়া গাম্ভীর্যতা কণ্ঠে এনে বলল,
“ আমি বলেছি?”
স্বর শুনেই নিভে গেল তুশি। সজোরে মাথা নাড়ল দুপাশে।
ইয়াসির মেঘমন্দ্র কণ্ঠে বলল,
“ তখন সবার সামনে স্ত্রী বলেছি দেখে কী সত্যিই স্ত্রী হতে চলে এসেছ? সেটা শুধুমাত্র আইরিনের সামনে তোমার সম্মান রাখতে বলেছিলাম। এত সিরিয়াসলি নেয়ার কিছু হয়নি।”
তুশি চুপ। চেহারায় খুব একটা পরিবর্তন এলো না। উলটে মনে মনে ভাবল,
“ আমি কীভাবে নেব, না নেব সে আমার ব্যাপার। মাই ডিসিসেন। আপনার তাতে কী?”
মুখে বলল,
“ আচ্ছা।”
ইয়াসির ক্ষেপে গেল।
“ কী আচ্ছা? অ্যাই চোর,যেতে বলেছি না তোমাকে?”
“ যাচ্ছি তো। এমন করছেন কেন?”
ইয়াসির চোখ পাঁকায়,
“ যাও আগে।”
তুশি ধুপধাপ পায়ে দোর অবধি এলো। কী মনে করে থেমে, আবার ছুটে গিয়ে দাঁড়াল ওর সামনে।
“ একটা কথা বলতাম!”
ইয়াসিরের কপালে গাঢ় ভাঁজ পড়ল। দৃষ্টিতে বিরক্তি। অথচ মেয়েটা কোমল স্বরে বলল,
“ আমাকে একটু দাদির সাথে দেখা করতে দিন না। কতদিন হয়ে গেল, দাদিকে দেখিনি। একটু বাইরেও যেতে দিচ্ছেন না। সামনে আমার জন্মদিন। দাদির হাতের সেমাই ছাড়া আমি কোনোদিনও জন্মদিন করিনি। দেখা করতে দেবেন একটু?”
তুশির চোখে অনুনয়। ইয়াসিরের উত্তর শোনার আগ্রহ। অথচ পাষণ্ডটা মুখের ওপর বলল,
“ না।”
তুশির মুখ কালো হয়ে আসে।
“ পিলিচ!”
ও কড়া কণ্ঠে বলল,
“ আমি এক কথা দুবার বলা পছন্দ করি না।”
তুশির উদ্ভাসনায় এক ঘটি জল দিতে এটুকুই যথেষ্ট আজ। ব্যর্থ শ্বাস ফেলল মেয়েটা। ফিরে আসতে নিয়েও, আবার একই জায়গায় দাঁড়াল। গলা তুলে বলল,
“ আরেকটা কথা ছিল।”
মহাবিরক্ত চোখে চাইল ইয়াসির,
“ সমস্যা কী তোমার?”
“ আমার না তো, আপনার।”
“ কীহ!”
“ না মানে, আপনি হাসতে পারেন না? সব সময় মুখটাকে এমন বাংলার পাঁচ করে রাখেন কেন? আপনি কি রামগরুরের ছানা,যে হাসতে আপনার মানা?”
তুশি গড়গড় করে বলল। যেন সব ভয়ডর কোথাও একটা ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। ইয়াসির তাজ্জব,স্তব্ধ। ধমকে কিছু বলবে,পূর্বেই সবেগে ছুট লাগায় মেয়েটা। দমকা হাওয়ার মতো গতিতে বেরিয়ে আসে বাইরে। সেই তোড়ে কাঠের দরজাটাও ধড়াম করে বাড়ি খেল এপাশে। ইয়াসির বোকা বনে গেল। কফির কথা ভুলে চেয়ে রইল হতভম্ব চোখে। তুশি একেবারে সিঁড়ির গোড়ায় এসে থামল। জোরে শ্বাস ফেলতে ফেলতে ফিক করে হেসে উঠল হঠাৎ। ঠোঁটে জ্বলজ্বলে দুষ্টুমি নিয়ে ভাবল,
কাছে আসার মৌসুম পর্ব ২৫
“ আপাতত যেতে বললেন,মেনে নিলাম। কিন্তু আপনি যে এই চোরের মন চুরি করার সাহস করেছেন। এখন তো গোটা আপনাকে চুরি না করা অবধি তুশি কোত্থাও যাবে না!”
মেয়েটা বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিয়ে হাসে। প্রফুল্ল স্বরে গান ধরে,
“ বলি ও দারোগা,পেয়েছি মওকা
তোমার পুলিশ ফেঁসেছে।
পরাণ আমার ভালোবেসেছে,ও দারোগা পরাণ আমার ভালোবেসেছে…”