কাছে আসার মৌসুম পর্ব ২৯ (২)
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
ইউশার আজকের জন্মদিন বিগত বছরগুলোর সীমায় আটকে থাকতে পারল না। আর না হলো, ওর সাদামাটা সেজে কেক কাটাকাটি। মায়ের আলমারি থেকে বেছে বেছে সবচেয়ে সুন্দর শাড়িটা পরল সে। রেশমের মতো নরম চুলগুলো খুলে রাখল পেছনে। দুহাত ভরতি চুড়ি জানান দিলো,এসব কারো নিবেশন পাওয়ার চেষ্টা। যেখানে অয়ন ভাই নিজে মুখ ফুটে বলেছেন,শাড়ি ওনার পছন্দ!
সেখানে ইউশা না পরে থাকবে কী করে? ফোলা গালদুটোয় এক প্রস্থ লজ্জা,আর চোখজোড়ায় দূর্দান্ত আশা নিয়ে মন ভরে সাজল সে। কপালে টিপ পরে ভালো করে দেখল আয়নায়। সুন্দর লাগছে? অয়ন ভাই পছন্দ করবেন তো! ওনার ওই আশ্চর্য সুতনু মুখটা আদৌ হাঁ হবে একটুও? ইউশা মাথা নামিয়ে হাসল। কুণ্ঠায় নুইয়ে পড়া কলমী লতার মতো হাসি। আচমকা, ঘাড়ের ওপর তপ্ত কিছু শ্বাস ঠিকড়ে পড়ল তক্ষুনি। দেহ শিরশির করা অনুভূতি নিয়ে চমকে চোখ তুলল মেয়েটা। অয়ন দাঁড়িয়ে আছে। আয়নায় ঠিক ওর পেছনে,শরীরের খুব কাছে এই থাকা। বিস্ময়ে আকাশ থেকে মাটিতে থুবড়ে পড়ল ইউশা। ঠোঁট চিড়ে বেরিয়ে এলো অস্ফূটে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ অয়ন ভাই!”
মানুষটা হাসল একটু। প্রেমিকার মনে কাঁপন ধরানোর মতো আলোড়ন তোলা হাসি। তরুণীর বিস্মিত দৃষ্টির পানে চেয়ে গান ধরল হঠাৎ,
“ আয়নাতে ঐ মুখ দেখবে যখন,
কপালের কালো তিল পড়বে চোখে,
ফুটবে যখন ফুল বকুল শাখে,
ভ্রমর যে এসেছিল জানবে লোকে।”
বলতে বলতে তার বলিষ্ঠ দুই হাত শীর্ণ শরীরটা পেছন থেকে জড়িয়ে নিলো বুকে। সেই ছোঁয়ায় পৃথিবীটাও এক চোট কেঁপে উঠল ইউশার। হতবাক, নিস্তব্ধ হয় মেয়েটা! এসব সত্যি? এই স্পর্শ, এই ঘনিষ্ঠতা এমনট সত্যিই ঘটছে? এসব যে ভীষণ কাঙ্ক্ষিত হলেও এক্ষুনি অপ্রত্যাশিত ওর কাছে। অয়ন ভাই কবে থেকে ওকে….”
বিভ্রান্ত চোখদুটো ফের আয়নায় ফেলল ইউশা। অয়নের ওই মুগ্ধ চাউনি যেন লজ্জার বান। তারওপর ঠোঁট ফুড়ে বেরিয়ে আসা গানে প্রখর লজ্জায় বুঁদ হলো সে। বুকের ধুকপুক গতির সাথে চিবুক নামিয়ে নিলো গলায়। অয়নের হাতের বাঁধন আরো শক্ত হলো। যেন কবুতরের মতো ক্ষুদ্র মেয়েটাকে গায়ের সাথে ঢুকিয়ে ফেলতে চাইছে। পুরুষালি লম্বা দেহ নামিয়ে এনে ইউশার কাঁধে থুতনি রাখল অয়ন। মেয়েটার শ্বাসরুদ্ধকর দশা হলো এবার। রক্তস্পন্দন অবধি থেমে এলো বোধ হয়! শিউরে উঠল অনুভূতির সবটুকুনি। অয়ন তখনও গাইছে,
“ জানি না এখন তুমি কার কথা ভাবছো!
আনমনে কার ছবি চুপিচুপি আঁকছো!
তুমি কি তারে ভালোবাসবে?
ধরা যদি দেয় সে একপলকে?
দেখবে যখন তারে অবাক চোখে,দু’হাতে নয়ন কি গো রাখবে ঢেকে!
আয়নাতে ওই মুখ দেখবে যখন!”
তারপর নিশ্চুপ সব কিছু। ইউশার ঘন নিঃশ্বাস ছাড়া কোথাও আর কিচ্ছুটি নেই। মেয়েটা ঐ মাদক চোখে-চোখ রাখতে পারল না। একবার নামাল, ফের তুলল। মিনিট কয়েকের এই সুখের সাথে হিমশিম খেতে এমনই করল শুধু। ফের নিচু মুখটা তুলল ইউশা। দর্পণে ফেলে দেখতে চাইল,ওর সেই প্রিয় সুতনু আদলের মালিককে। নিভু দৃষ্টি চমকে উঠল অমনি। চট করে পিছু ফিরল ইউশা। গোটা ঘর ফাঁকা পড়ে আছে। কোথায় অয়ন,কীসের অয়ন! এসব তাহলে কল্পনা? ইউশা চোখ খিচে জিভ কাটল সবেগে। মাথায় চাটি মেরে হাসল নিজেই। লজ্জায় হাঁসফাঁস করে বলল,
“ ছি রে ইউশা ছিহ! অয়ন ভাই এখনো ঠিকঠাক করে সিগন্যালই দিলেন না,আর তুই কোথায় চলে গেলি!”
ইউশার এখন কুণ্ঠায় মরমর দশা। সেই তোড়ে আয়নায় তাকাতেও কষ্ট। ওটাও নিশ্চয়ই ওকে নিয়ে মজা নেবে এখন! ইস,কী বাজে একটা ব্যাপার হয়ে গেল৷ বিকেল বেলা জ্বলজ্যান্ত মানুষ নিয়ে এমন উদ্ভট স্বপ্ন দেখে ফেলল সে? ইউশার বুকের দুরুদুরু ভাবটা ফিরে এলো ফের। ওর এই শাড়ি আর সাজগোজ অয়ন ভাইয়ের হৃদয় ছোঁবে তো? দেখবেন তো ওকে মুগ্ধ হয়ে?
নিশ্চয়ই দেখবেন। অয়ন ভাই ওকে ছাড়া আর কাউকে দেখতেই পারেন না। মেয়েটা স্বতঃস্ফূর্ত চিত্তে তৈরি হলো। উড়ো পাখির মতো ডানা মেলে নামল নিচে। বসার ঘর তখন আলোয় আলোয় সাজানো। টেবিলে দুটো কেক পাশাপাশি রাখা হয়েছে। এই দুটোই ইউশা কাটবে। একটা ওর আরেকটা ওর বোনের। সেদিক চেয়ে বুক ফুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। মেয়ে থাকুক বা না থাকুক দুটো কেক বানাতে মায়ের কখনো ভুল হয়নি।
বাড়িতে অল্পবিস্তর অতিথি আসা শুরু হয়েছে। সময় তখন সন্ধ্যে হওয়ার পথে। বাকিরাও তৈরি প্রায়। ইউশা চারপাশে চেয়ে অয়নকে খুঁজল। চোখ পড়ল আইরিনের দিকে। সোফায় পায়ের ওপর পা তুলে বসে আছে সে। পরনে ওয়েস্টার্ন, হাতে ফোন। দিন-দুনিয়ার কোনো কিছুতেই মনোযোগ নেই। উপায়ন্তর না পেয়ে ওর কাছেই এসে দাঁড়াল ইউশা। জিজ্ঞেস করল ব্যস্ত স্বরে,
“ অয়ন ভাইকে দেখেছ?”
আইরিনের চোখেমুখে বিরক্তি। ফোন থেকে মুখখানাও তুলল না। জবাব দিলো দ্বায়সারা,
“ না।”
বলার ধরণ শুনেই ইউশার মেজাজ চড়ে আয়। কেন যে জিজ্ঞেস করতে গেল! ভাব খানা দেখো,যেন প্রিন্সেস ডায়না। লাগছে তো ডাইনি মেড্যুসার মতো। উফ,ফুপিদের ফ্লাইট ক্যান্সেল হওয়ার আর সময় পায়নি? নাহলে গতকালই ওনারা পৌঁছাতেন। আর এই যন্ত্রণাটা বিদেয় হয়ে যেত! ধ্যাত।
তুশি হাজির হলো তখনই। যেমন ছিল, তেমনই আছে। সাদা চুরিদার, ওড়নাটা গলায় ঝুলছে কোনোরকম। লম্বা চুলে বেনুনি। ও এসে দাঁড়াতেই ইউশা বলল,
“ এ কী, তোমাকে না তৈরি হতে পাঠালাম?”
“ হয়েছি তো। তোমার দেয়া সবথেকে সুন্দর জামাটা পরেছি।”
“ আরে, এটা তো পুরোনো। আমি না তোমাকে নতুন একটা দিলাম!”
“ ওটাতে গা কুটকুট করছে।”
ইউশা অতীষ্ঠ হয়ে বলল,
“উফ তুশি,জামায় ভারি কাজ থাকলে ওরকম একটু হয়। এক ফোঁটা সাজোওনি দেখছি। একটা টিপ অন্তত পরতে!”
তুশির কণ্ঠে অনীহা,
“ ওসব আমার ভালো লাগে না। সেজে কী করব? আমাকে কে দেখবে?”
তারপর বিড়বিড় করল মনে মনে,
“ বিটকেলটা তো তাকায়ই না। আমাকে দেখলে যদি কানা হয়ে যায় সেই ভয়ে।”
ইউশা বলল
“ আচ্ছা ছাড়ো। অয়ন ভাইকে দেখেছ?”
তুশির নজর ইউশার মাথার পেছনে। উত্তর না দিয়ে মিটিমিটি হাসল। ভ্রু ইশারা করতেই, ঝট করে পিছু ফিরল ইউশা। বিশালাকার টেডিবিয়ারটা দুম করে ওর হাতে ধরিয়ে দিলো অয়ন। গাল টেনে বলল,
“ হ্যাপি বার্থডে এগেইন।”
ইউশা ভড়কে গেলেও,বিস্ময়ের এই ধাত তার ভালো লাগার কাছে কিচ্ছুটি নয়। বুকখানা ভরে এলো মেয়ের। রাতের ওসব দুঃখ-কষ্ট কখন ভুলে গেছে। হাসল গাল ভরে। আহ্লাদী স্বরে বলল,
“ থ্যাংকিউ! এটা খুব সুন্দর।”
অয়ন হাসে। পরপর চোখজোড়া ঘুরে আসে ইউশা বেশভূষার ওপর। অবাক হয়ে বলল,
“ শাড়ি পরেছিস? মাই গুডনেস, সুন্দর লাগছে তো।”
ইউশার স্বর আনমনা। কেমন করে শুধাল,
“ কতটা সুন্দর?”
“ বুড়িদের মতো সুন্দর!”
“ এটা কেমন প্রশংসা?”
ইউশা ঠোঁট ফোলাল। দুজনের খুঁনসুটিতে মাথা নুইয়ে হাসল তুশি। শাড়ি পরা ইউশাকে অয়নের পাশে কী দারুণ লাগছে! মনে হচ্ছে দুজন যেন দুজনের জন্যেই তৈরি। আচ্ছা,বিটকেলটার পাশে দাঁড়ালে ওকেও কি এতটা দারুণ লাগে?
উদাস মেয়েটার দিকে হুট করে এক প্রশ্ন তেড়ে এলো তখনই। কোত্থেকে হন্তদন্ত পায়ে এসে দাঁড়ালেন তনিমা। শশকের ন্যায় ব্যস্ত গতিতে শুধালেন,
“ তুশি,আজ কি তোমার জন্মদিন?”
ব্যস,কথাবার্তা থেমে গেল সবার। ইউশা,অয়নের সাথে সাথে অবাক হলো মেয়েটাও। যেন হতভম্বতার তোড়ে গড়িয়ে পড়ল মাটিতে। মৃদূ স্বরে শুধাল,
“ আপনি কী করে জানলেন!”
“ ফ্রিজে কেক দেখলাম। ওপরে ‘হ্যাপি বার্থডে তুশি’ লেখা। বুয়াকে জিজ্ঞেস করতেই বলল,সার্থ নাকি এনেছে!”
তুশির চোখ শৃঙ্গে। অবিশ্বাসের তোপে ঠোঁট ফাঁকা হয়ে গেল। ইয়াসির ওর জন্যে কেক এনেছে? এর মানে তখন হাতের ওই কেকটা ওর জন্যেই ছিল! হৃদয়ের গভীরে এক অন্যরকম দোলায় নড়ে উঠল মেয়েটা। একটা কেক পৃথিবীর সেরা উপহার নাহলেও,তুশির মনে হলো এটাই ওর শূন্য জীবনে ছুড়ে দেয়া এক টুকরো নরম-কোমল আলো। মানুষটার তবে মনে ছিল ওর জন্মদিনের কথা! আচমকা কেমন অবান্তর স্বপ্ন আর প্রশ্নের ছটায় ভেতরটা ছেঁয়ে গেল তুশির। ইয়াসির কেন জন্মদিন মনে রেখেছে? কেন কেক এনেছে? কেন এত আগ্রহ তার! শুধু কি এসব দায়িত্ব বোধ! কোনোভাবে ওই পাথুরে মনের খোলশ চিড়ে নিলে,ভেতরে তুশি নিজেকে দেখতে পাবে না তো!
মেয়েটার ধ্যান ছুটল ইউশার বাহু ধরে ঝাঁকানোতে। কেমন অধৈর্য গলায় জিজ্ঞেস করছে,
“ এই তুশি,কী হলো? তোমার আজ সত্যিই জন্মদিন!”
অয়নেরও একই প্রশ্ন,বিমূর্ত সে নিজেও।
“ তোমার জন্মদিন,বলোনি কেন আমাদের?”
তনিমা বললেন,
“ সেটাই তো। কেন বলোনি?”
ইউশা বলল,
“ আমাকে অন্তত একবার জানাতে পারতে। কাল রাতে যখন ঘরে এলে তখনো বললে না।”
তুশির জবাব এলো নিভু স্বরে,
“ কাল রাতে তোমাকে বলতেই গিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি কাঁদছিলে দেখে…”
ইউশা খুব আক্ষেপ করে বলল,
“ ইস! কেন কাঁদলাম আমি?
আমি না কাঁদলে তুমি জানাতে। আজকে
তাহলে আমরা সেম সেম জামা পরতাম!”
টেবিলের ওখানে তোমার নামও লেখা হতো।”
তুশি কিছু বলতেই যাচ্ছিল,কথা শুরুর আগেই চট করে জড়িয়ে ধরল ইউশা,
“ শুভ জন্মদিন তুশিরানী! আমাদের কত মিল দেখেছ? তিলও একই জায়গায়,আবার জন্মদিনটাও একই তারিখে। ২৮ এপ্রিল!”
তুশি হাসল। ততক্ষণে রান্নাঘর থেকে পায়েস নিয়ে ছুটে এসেছেন তনিমা। উদ্বেগ নিয়ে বললেন,
“ নাও দেখি হাঁ করো, হাঁ করো।”
তুশির অপেক্ষায় না থেকেই জোর করে এক চামচ পায়েস মুখে তুলে দিলেন তিনি। আইরিন আর টিকতে পারল না এখানে। বিরক্তিতে গা জ্বলে যাচ্ছে। নাকমুখ কুঁচকে ঘরে চলে গেল।
তুশি পায়েস খেতে খেতে মুগ্ধ চোখে হাসল। কাল রাত থেকে করে আসা ওর সকল মন খারাপ একটা ফানুসের মতো উড়ে গেল সূদূরে। কে বলল ওর কেউ নেই? এই যে এরা,তনিমা,ইউশা এরা ওর কত আপন! অয়ন জিজ্ঞেস করল,
“ আচ্ছা তুশি, ভাইয়া তোমার জন্মদিনের কথা কী করে জানল? আর জানলেও আমাদের কাউকে জানায়নি কেন?”
তুশির মাথায়ও একই কথা। হঠাৎ মনে পড়ল,সেদিন রাতে ইয়াসির ভর্তির জন্যে ওর জন্মতারিখ জিজ্ঞেস করেছিল। কী আশ্চর্য, অত দিন আগের কথাই তবে উনি মনে রেখেছিলেন? তুশির সদ্য গজিয়ে ওঠা সন্দেহ যেন বিশ্বাসে রূপ নিলো এবার। তবে কি বিটকেলটাও ওকে ভালোবাসতে শুরু করেছে? তাহলে কীসের মুক্তির কথা বলে গেল তখন!
ইউশা বলল,
“ ভাইয়ার কিন্তু কেক আনার কোনো দরকারই ছিল না। মা তো দুটো করে কেক বানিয়েই রাখে। ও থেকেই নাহয় তুশি একটা কাটতো!”
রেহনূমা পাশ থেকে যাচ্ছিলেন। মেয়ের কথায় পা জোড়া থামল৷ ধমকে উঠলেন অমনি,
“ ইউশা! তোর মুখ কিন্তু আজকাল বেশি চলছে। । ও আমার মেয়ের কেক কাটবে কেন?”
তনিমা বললেন,
“ আহ ছোটো, এভাবে বলছিস কেন? ও তো তোর মেয়ের মতোই!”
ভদ্রমহিলা কড়া কণ্ঠে বললেন,
“ না আপা। এসব চোর-ছ্যাচর আমার হতে যাবে কেন? দয়া করে এসব বলো না।”
তারপর দুমদাম পায়ে চলে গেলেন তিনি। মেজাজ খারাপ হলো অয়নের। কপাল কুঁচকে ওনার যাওয়ার পথে চেয়ে রইল সে। তিতিবিরক্ত আওড়াল,
“ ছোটো মায়ের তুশিকে নিয়ে এক্সাক্ট সমস্যাটা কী?”
তনিমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে রইলেন। শুকনো মুখে তুশির পানে এক পল দেখল ইউশা। হাতটা ধরে বলল,
“ মায়ের কথায় কষ্ট পেও না প্লিজ!”
মলিন হাসল তুশি। বলল,
“ বোকা,গরিবরা কখনো এত সহজে কষ্ট পায় না।”
তনিমা প্রসঙ্গ কাটাতে হাত বাড়িয়ে এসে জড়িয়ে ধরলেন ওকে। উচ্ছ্বসিত আওড়ালেন,
“ শুভ জন্মদিন তুশি। অনেক সুখী হও মা। দীর্ঘজীবী হও।”
শওকত বাইরে থেকে ঢুকলেন তখনই। কথাটা শুনতে পেয়েই অবাক চোখে বললেন,
“ সে কী,আজ তুশির জন্মদিন নাকি! আমার মেয়ের জন্মদিন আর আমি জানি না?”
ভদ্রলোক চটপটে পায়ে এগিয়ে এলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“ শুভ জন্মদিন, শুভ জন্মদিন। অনেক বড়ো হও জীবনে।”
তুশি হাসল।
শওকত পরপরই পরনের পাজামার পকেট হাতালেন। জিভ কেটে বললেন,
“ যাহ,মানিব্যাগ তো ওপরে। এখন হাতে অনেক কাজ! তোর গিফট পরে দেবো কেমন?
ইউশা বলল,
“ চাচ্চু,আর আমার গিফট?”
“ হ্যাঁ হ্যাঁ মা তোমাকেও দেবো।”
সবার কথার মধ্যে অয়নের নজর তুশির ওপর আটকে। মেয়েটা হাসছে। চঞ্চল কার্নিশ, ঠোঁটের কোণে উজ্জ্বলতা তার। যেখানে সাজানো কোনো সৌন্দর্য নেই,না আছে কৃত্রিম কোনো কিছু। অথচ প্রতিবার অয়ন খেই হারায়,খুইয়ে ফেলে নিজেকে। এই হাসিটা সারাজীবনের জন্যে নিজের কাছে গচ্ছিত রাখা জরুরি নয় কি! পরপর মেঝের দিকে চোখ ফেলল অয়ন। ইয়াসির বলেছিল,তুশিকে ডিভোর্স দেবে শীঘ্রই। উকিলের সাথে কথাবার্তা চলছে। ওসব কতদূর কী এগোলো জানতে হবে। ভাইয়া আজ ফিরুক,সময় করে জিজ্ঞেস করবে অয়ন! মনের ভাবনা দমিয়ে চোখমুখ স্বাভাবিক করল সে। বলল,
“ তুশি,তোমার তো আমার কাছেও একটা গিফটা পাওনা আছে। বলো,কী চাই!”
শওকত বললেন,
“ হ্যাঁ বল,তোর কী চাই! তুই আজ যা চাইবি আমি তোকে সেটাই দেবো।”
নিস্পন্দ চোখজোড়া ঝট করে তুলল তুশি।
“ সত্যি দেবেন?”
অয়ন বলল,
“ অবশ্যই,বলেই দেখো না।”
তুশি জিভে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
“ আমি মানে,একবার দাদিকে দেখতে চাই!
কতদিন দেখিনি! যদি একটু দেখা করার ব্যবস্থা হতো!”
তনিমা বললেন,
“ কিন্তু তুশি, সার্থ যদি শোনে খুব রাগ করবে। শত হলেও তুমি ওর স্ত্রী,ওর ওপর দিয়ে আমরা এত বড়ো সিদ্ধান্ত নিই কী করে!”
অয়ন শক্ত গলায় বলল,
“ কীসের সিদ্ধান্ত মামুনি? ভাইয়া তো আর এই সম্পর্কটা মানে না। তাহলে এসবে ওকে টানছো কেন? ও তুশিকে এ বাড়িতে এনেছে, রেখেছে, পড়াচ্ছে ব্যস ওর দায়িত্ব এই অবধি। এখানে ওসব স্বামী-স্ত্রী শব্দ আসছে কেন? তুশি যখন চাইছে,তখন ওর দাদির সাথে ওকে আমি দেখা করাব।”
তুশি বলল,
“ কিন্তু উনি যে আমাকে বাইরে যেতে মানা করেছেন। ওনার কথা অগ্রাহ্য করে আমি যাই কী করে?”
অয়ন ধরে নিলো এটা তুশির কৃতজ্ঞতাবোধ, আর ইয়াসিরের প্রতি ভয়। তাছাড়া বড়ো ভাইয়ের কথা অমান্য করা তারও উচিত হবে না। একটু ভেবে বলল,
“ তাহলে এক কাজ করি,তোমার দাদিকে এখানে নিয়ে আসি। তুমি আমাকে তোমাদের বস্তির ঠিকানা দাও। বাবা,তুমি কী বলো?”
শওকত একটু ভেবে বললেন,
“ এটা করা যায়। তোমার ভাই তো বাড়িতে নেই এখন। ইউনিফর্ম পরে বের হলো দেখলাম। ফিরতে তাহলে সময় লাগবে। ততক্ষণে ওর দাদির সাথে ওকে দেখা করিয়ে আবার নাহয় ফেরত পাঠানো যাবে।”
তনিমা শঙ্কিত কণ্ঠে বললেন,
“ কিন্তু সার্থ জানতে পেরে যদি রাগারাগি করে? বাড়িতে আমি আর কোনো নতুন অশান্তি চাই না। অন্তত আজকের দিনে তো নয়ই। এমনিই ছোটো আর সাইফুলের মনের অবস্থা ভালো না। মায়েরও মন-মেজাজ খারাপ রোকসানার আসা ক্যান্সেল হয়ে যাওয়াতে। এর মধ্যে তুশিকে নিয়ে আবার…”
অয়ন বলল,
“ কিচ্ছু হবে না মামুনি। ভাইয়া এনাফ মাচিউর্ড। আমার মনে হয় না এত সামান্য ব্যাপার নিয়ে রাগারাগি করার মতো কাজ করবে। তুশি, তুমি আমাকে ঠিকানা দাও,আমি যাচ্ছি।”
তুশির মনে ভয়। ইয়াসির যদি সত্যিই রাগ করে? আবার এতদিন পর দাদিকে দেখার লোভটাও সামলে রাখতে পারল না। দোনামনা করে বলে দিলো,
“ কারওয়ান বাজারের ওভার ব্রিজের ডান পাশ দিয়ে যে গলি গিয়েছে? ওখান থেকে দু মিনিট হাঁটলেই বস্তি পড়বে। ২৭ নম্বর ঘরটা আমাদের।”
কাছে আসার মৌসুম পর্ব ২৯
অয়ন মাথা নাড়ল। তারপর দাঁড়াল না আর। যুদ্ধ জিততে যাবার মতো করে বাড়ি ছাড়ল তাড়াহুড়ো পায়ে। ইউশা শুকনো মুখে চেয়ে রইল সেদিকে। তার ভেতরেও একই আশঙ্কা। মেজো ভাইয়া যদি রেগে যান! তুশির জন্যে অয়ন ভাই অশান্তি করতে এমন মেতে উঠলেন কেন?