কাছে আসার মৌসুম পর্ব ৩১

কাছে আসার মৌসুম পর্ব ৩১
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি

হাসনার এই জ্ঞান হারানোর ব্যাপারটা উৎসব,আয়োজনে মুখরিত বাড়ির পরিবেশ বদলে দিয়েছে। উদ্বীগ্ন,চিন্তিত প্রত্যেকে। সমানে চোখেমুখে পানি ছেটাচ্ছেন তনিমা। রেহণুমা এমনিতে কর্কশ স্বভাবের হলেও,মনের দিক থেকে অতটাও খারাপ নন। বৃদ্ধ এক মহিলা জ্ঞান হারাল,তাও গায়ে নাকি খুব জ্বর! হাতের পায়েস-টায়েস রেখে লাগাতার বাতাস করছেন তিনিও। অয়ন ফিরেছে কিছুক্ষণ হবে! স্টেথোস্কোপ দিয়ে বুকের গতি মাপছিল সে। প্রেসারও দেখেছে। একেবারে নিচের দাগে টিকটিক করছে কাঁটাটা। অয়ন আড়চোখে তুশির পানে চাইল। কেমন উদ্ভ্রান্তের মতো করছে মেয়েটা। দাদির হাতের তালু ঘষছে,কখনো গাল চাপড়ে ডাকছে। দিশেহারার ন্যায় বলছে,

“ দাদি,ও দাদি, দাদি কী হলো তোমার? ওঠো না, দাদি।”
অয়ন ফোস করে শ্বাস ফেলল। সহসা প্রশ্ন ছড়লেন শওকত,
“ কেমন দেখলে!”
“ জ্বর ১০৩। উইকনেস থেকেই জ্ঞান হারিয়েছে।”
“ কিন্তু এতক্ষণ হয়ে গেল, এখনো তো ফিরছে না।”
দূরের চেয়ারে বসেছিলেন
জয়নব। বললেন,
“ বড়ো বউমা,একটু সরষের তেল গরম করে হাত-পায়ে মালিশ করে দেখো। এই বয়সে শরীর এমনিই চলে না। তারওপর জ্বর। বোধ হয় সেজন্যেই…”
তনিমা মাথা নাড়লেন। নতুন কাজের মেয়েটা পাশেই ছিল। নিজেই বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ আমি আনতাছি খালা।”
স্ব-উদ্যোগে রান্নাঘরের পথ ধরল সে। রেহণুমা বললেন,
“ ও অয়ন, এখন কি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে নাকি!”
“ অবস্থা দেখে তো তেমনই মনে হচ্ছে ছোটো মা।”
তুশি আঁতকে উঠল। গতি বাড়ল তার হাঁকডাকের। গা ঝাঁকিয়ে বলল,
“ ও দাদি,দাদি তোমার কী হলো, দাদি। সেমাই খাওয়াবে না আমাকে? ও দাদি!”
ইউশা পিঠে হাত বুলিয়ে বলল,

“ তুশি শান্ত হও। কেঁদো না। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
তুশি শুনল না। শক্তপোক্ত মেয়েটা দাদির শোকে গাল-গলা ভিজিয়ে ফেলেছে প্রায়। ঐ চপচপে মেদুর মুখটা এতক্ষণ বিরক্ত হয়ে দেখছিল ইয়াসির। ধমকে উঠল এইবার,
“ অ্যাই চোর, এত কাঁদছো কেন তুমি? এখানে এত কাঁদার কী আছে?”
তুশি মৃদূ তেতে বলল,
“ দেখতে পাচ্ছেন না আমার দাদি অজ্ঞান হয়ে গেছে? এই সময় কাঁদব না তো কি আপনার সাথে নাচব?”
ইয়াসির তাজ্জব বনে গেল। তড়িৎ ফুঁসে উঠলেন রেহণুমা,
“ আচ্ছা অকৃতজ্ঞ মেয়ে তো তুমি! যে ছেলেটা নিজে গিয়ে তোমার দাদিকে নিয়ে এলো,তার সাথে এমন তেজ দেখাচ্ছো!”
তুশি নাক টানল। হেচকি উঠেছে।
অয়ন বলল,

“ আহ ছোটো মা,থামো প্লিজ! ওর মনের অবস্থা এখন ঠিক নেই। দেখছোই তো।”
ভদ্রমহিলা আর কিছু বললেন না। মুখ বাঁকিয়ে হাতপাখার গতি বাড়ালেন। আপাতত ঘরে এসি চলছে না। হাসনার জ্বর দেখেই বন্ধ করতে বলেছে অয়ন। এই সময় রোগীকে মেশিনের কৃত্রিম বাতাসের চেয়ে, হাতপাখার বাতাস বেশ আরাম দেয়। তারপর পকেট থেকে ফোন বের করল সে।
ব্যস্ত গলায় বলল,
“ আমি বরং অ্যাম্বুলেন্স ডাকি। নিতে যখন হবেই,দেরি করে লাভ নেই।”
তুরন্ত ওর হাতটা চেপে ধরল তুশি।
“ না না। হাসপাতালে না নিয়ে দেখুন না,এমনি সুস্থ হয় কিনা। ওখানে নিলেই তো সুই দেবে। দাদি এসবে খুব ভয় পায়।” তরঙ্গের ন্যায় শান্ত নজরে ঐ জায়গাটা দেখল অয়ন। তার হাতের ওপর তুশির হাত! পরপর মৃদূ হেসে বলল,

“ রিল্যাক্স তুশি, আমি আছি তো। এত চিন্তা কোরো না।”
ইউশাও তাল মেলাল সাথে,
“ সেটাইতো৷ প্লিজ তুমি আর কেঁদো না। নাহলে এখন আমিও কেঁদে ফেলব!”
সোফাসেটের ওই জায়গাটুকুতে তখন মানুষের ভিড়। বাড়ির লোকজনের সাথে অল্পবিস্তর অতিথিরাও রয়েছেন। সকলে উৎসুক হয়ে দেখছেন সবটা।
ইয়াসির এসে চেয়ারে বসল। বীতঃস্পৃহ চোখটা তুশির ওপর তখনো। কেমন ফ্যাচফ্যাচ করে নাক টানছে দেখো! বিড়বিড় করল বিরক্তিতে,

“ এ নাকি আবার স্ট্রং! দাদি অজ্ঞান হতেই কেঁদেকেটে ভাসিয়ে ফেলছে, এ আবার নাকি কুস্তিও জানে!”
সাইফুল এতক্ষণে নিচে এলেন। দাঁড়ালেন ভাইয়ের পাশে। সোফায় ঘেরা জটলা দেখে বললেন,
“ কী হয়েছে ভাইজান?”
“ তুশির দাদি এসেছিল। এসেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে।”
“ সে কী, এখন কী অবস্থা?”
বলতে বলতে ওই পথে তাকালেন তিনি। হাসনার চোখ বন্ধ। মাথা তুশির কোলে। অথচ শীর্ণ মুখখানা দেখেই কেমন করে কপাল কুঁচকে ফেললেন সাইফুল।
অয়ন হাসপাতালে কল করে অ্যাম্বুলেন্স পাঠাতে বলল। তনিমা গরম তেল অনেক আগেই হাসনার হাত-পায়ে মালিশ করতে নিয়েছেন। এর বেশ কিছুক্ষণ পর নড়েচড়ে উঠলেন বৃদ্ধা। চোখের পাতা পিটপিট করতে দেখে,তটস্থ হয়ে তাকাল সবাই। তুশি অধৈর্য চিত্তে ডাকল,

“ দাদি, দাদি! দাদি শুনছো? এই যে আমি দাদি,দেখো আমাকে। এই তো আমি।”
হাসনাকে দেখে মনে হলো, বন্ধ চোখ আলাদা করা যেন সবথেকে কষ্টের। আস্তেধীরে সময় নিয়ে তাকালেন তিনি। তুশি চোখ মুছল। এতক্ষণে তার প্রাণ ফিরল যেন। নাতনীর চটচটে চেহারা দেখে অবাক হলেন হাসনা! তুশিতো সহজে কাঁদে না। আজ কাঁদছে কেন? ইস, ওনার জন্য বুঝি! মেয়েটা এত ভালোবাসে তাকে! হাতটা বাড়িয়ে বললেন,
“ আমারে এট্টু বওয়াবি, বু?”
তুশি আর তনিমা ধরে ধরে হাসনাকে শোয়া থেকে বসালেন। কুশান রাখলেন পিঠের কাছে। কিন্তু বৃদ্ধার মুখের হাসি, মনের শান্তি দীর্ঘক্ষণ রইল না। রেহণুমাকে দেখেই দপ করে নিভে গেল আবার৷ ভদ্রমহিলা শুধালেন,
“ এখন কেমন লাগছে আপনার? ঠিক আছেন! এই শরীর নিয়ে এতটা পথ কেন এসেছিলেন বলুন তো। আপনার নাতিকে তো আর আমরা খেয়ে ফেলছিলাম না।”

ইউশা হতাশ চিত্তে মাথা নাড়ল দুপাশে। এত কিছুর মধ্যেও মায়ের ত্যাড়া কথা গেল না। কিন্তু, হাসনা নিরুত্তর। ঢোক গিললেন চোখ নামিয়ে। তুশি টের পেলো তার মুঠোয় ধরে রাখা দাদির হাতটা কাঁপছে খুব। উদ্বীগ্ন হয়ে বলল,
“ দাদি, এত কাঁপছো কেন তুমি? শীত করছে দাদি?”
হাসনার চোরা নজর তখনো রেহনূমাতে ঘুরছে। টলমলে দেহেও কপালে দরদর করছে ঘাম। ফ্যাসফ্যাস করে বললেন,
“ এট্টু পানি!”
তুশি উঠতে নিলে তনিমা ব্যতিব্যস্ত বললেন,
“ আমি নিয়ে আসছি।”
ইয়াসিরের কপাল বেঁকে বসল। চোখ ছোট করে লক্ষ্য করল কিছু। তুশির দাদি বারবার ছোটো মাকে দেখছে কেন? চেহারায় এত ভয়ই বা কীসের!

তনিমা পানি দিলে ঠকঠকে আঙুল বাড়িয়ে ধরলেন হাসনা। মুখে তুললেন কোনোরকম। মাঝে বার-কয়েক ভীত চোখে দেখলেন রেহনূমাকে। ইয়াসিরের খটকার দোরে এবার জোরালো টোকা পড়ল। ঠোঁট কামড়ে উঠে দাঁড়াল সে। ঠিক তক্ষুনি তাজা বিস্ফোরণের মতোই প্রশ্ন ছুড়লেন সাইফুল,
“ আচ্ছা, আপনাকে আমার এত চেনা চেনা কেন লাগছে বলুন তো! কোথায় যেন দেখেছি!”
হাসনা পানিটা মুখে নিয়েছিলেন সবে,অমনি তা তালুতে পৌঁছে গেল। কেশে উঠলেন বুক কাঁপিয়ে। আঙুল খসে গ্লাস পড়তে নিলে, তড়িঘড়ি করে হাত পেতে ধরে ফেলল তুশি। উৎকণ্ঠিত আওড়াল,
“ তোমার কি আবার শরীর খারাপ করছে দাদি?”

হাসনা জবাব দিলেন না। আঁচল দিয়ে মুখের ঘাম মুছলেন। আমতা-আমতা করে বললেন,
“ আমারে? আমারে ক্যামনে দ্যাকবেন? আমি তো বস্তিতে থাহি,ওসাব জাগায় কি আপনেরা যান!”
“ না না সত্যিই ভীষণ চেনা লাগছে। মনে হচ্ছে…”
ভাবতে গিয়েই সচকিত হলেন সাইফুল। সবেগে বললেন,
“ আপনি নূরনগর হাসপাতালের সেই আয়া না?”
হাসনার বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল। ফুসফুসের কোণায় আটকে পড়ল শ্বাস। রেহণুমা বিস্মিত হয়ে বললেন,
“ নূরনগর হাসপাতাল! যেখানে আমাদের মেয়েরা হয়েছে?”
সাইফুলের গলার জোর বাড়ল,

“ হ্যাঁ। ওই রাতে যে আয়া ডিউটিতে ছিলেন,এনার সাথে তার খুব মিল।”
হাসনার চোখমুখ ফ্যাকাশে হয়ে আসছে। তুশি বলল,
“ কিন্তু আমার দাদি তো হাসপাতালে কাজ করে না। লোকের বাড়ি কাজ করে। আর ঐ জায়গাটা কোথায়? আমরা তো শুরু থেকে ঢাকাতেই থাকি। আপনার বোধ হয় কোথাও ভুল হচ্ছে।”
ইউশা বলল,

“ বাবা, পৃথিবীতে সাতজনকে একই রকম দেখতে হয়। তাই হয়ত তুমি গুলিয়ে ফেলেছ।”
“ না না। এতটাও ভুল হওয়ার কথা না। আমার তো একবার কাউকে দেখলে মনে থাকে। আমার স্পষ্ট মনে আছে একজন আয়া ছিলেন ওখানে। ঠিক ওনার মতোই দেখতে ছিলেন উনি। আম্মা,ভাইজান, আপনাদের মনে নেই পরে যখন আমার মেয়ে চুরি হলো ঐ আয়াকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। সবাই সন্দেহ করছিল ওই আয়াই চুরি করেছে। ভাইজান আমি ফোনে বলছিলাম আপনাকে। মনে নেই আপনার?”
শওকত বিভ্রান্ত চিত্তে জিভে ঠোঁট ভেজালেন। জয়নব বললেন,
“ আমার মনে আছে। কিন্তু চেহারা ভুলে গেছি। অনেক বছর আগের কথা তো!”
হাসনার মুখে রক্ত নেই। যুক্তিতর্ক খণ্ডাবেন,কণ্ঠে সেই জোরটাও যেন আসছে না। তুরন্ত, আচমকা উদয় হওয়া দূতের ন্যায় বৃদ্ধার সামনে এসে দাঁড়াল ইয়াসির। তীক্ষ্ণ,কঠোর গলায় শুধাল,

“ কী জানেন আপনি?”
হাসনার বুকে ধ্বস নামল। ভেতরটা কেঁপে উঠল গতিতে। হাঁসফাঁস করে বললেন,
“ আমি, আমি কী জানমু? কিছু জানি না আমি! কিছু জানি না।”
ইয়াসিরের স্বরে নম্রতা নেই। না আছে একটুখানি প্রশ্রয়। প্রস্তরের ন্যায় শক্ত মুখে বলল,
“ আপনি বলবেন,না আমি লেডি কনস্টেবল ডাকব?”
তুশি আশ্চর্য হয়ে বলল,
“ আপনি আমার দাদির সাথে এমন করছেন কেন?”
ইয়াসির ধমকে উঠল,

“ চুপ! চুপ করে বসে থাকো তুমি।”
শওকতের মেজাজ খারাপ হলো। বিড়বিড় করে বললেন,
“ শুরু হয়ে গেছে এর পুলিশগিরি! যাকে তাকে যখন তখন আসামী বানিয়ে দেয়!”
তনিমা বললেন,
“ আহ সার্থ, কী করছিস কী? উনি আমাদের বাসার মেহমান।”
ইয়াসির চড়া কণ্ঠে বলল,
“ কিন্তু আমার তো মনে হচ্ছে অন্য কিছু। আচ্ছা ছোটো মা,ওই হাসপাতাল থেকে তোমাদের মেয়ে চুরি হয়েছিল না? কোনোভাবে সেই চুরির সাথে এই মহিলাই জড়িত নয় তো!”
হাসনার চেহারা লাশের মতো সাদা হয়ে গেল। চোখ যেন ঠিকড়ে আসার যোগাড়। কিন্তু চটে গেল তুশি। দুম করে উঠে ইয়াসিরের মুখোমুখি দাঁড়াল। কড়া কণ্ঠে বলল,
“ দেখুন! আপনি আমাকে যা ইচ্ছে হয় তাই বলেছেন,আমি মেনে নিয়েছি। কিন্তু আমার দাদিকে নিয়ে কোনো উল্টাপাল্টা কথা নয়।”

এই চোটপাট ইয়াসিরের ওপর তেমন প্রভাব ফেলল না। ঠিক তুশির কপালে দু আঙুল ঠেকিয়ে এক ধাক্কা মারল,সঙ্গে সঙ্গে ধপ করে আগের জায়গায় বসে পড়ল মেয়েটা। চাইল হতবুদ্ধি হয়ে। ইয়াসির ভণিতাহীন বলল,
“ এতদিনে নিশ্চয়ই বুঝেছ,ইয়াসির আবরার কারো কথায় চলে না,কারো কথা শোনে না। তোমাকে একবার চুপ করতে বলেছি, সো কিপ ইয়র মাউথ শাট।”
শওকত খুব কষ্টে মুখে তালা ঝুলিয়েছেন। কিছু বলতে গেলেই এ ছেলে এমন এমন কথা শোনাবে!
জয়নব সহ বাকিরা অবাক চোখে দেখছেন সবটা। বিভ্রমে ডুবেছেন তারাও। হচ্ছে কী এখানে? এত চ্যাঁচামেচি শুনে আইরিন নেমে এসে দাঁড়াল। ইয়াসির বলল,
“ বলুন,আপনি কবে থেকে জড়িত এসবে? কটা বাচ্চা চুরি করেছেন এ অবধি? কে কে যুক্ত আপনার সাথে? বলুন!”
ধমকাচ্ছে সে। হাবভাবে পুলিশি জেরা। তুশি ফের কিছু বলতে গেলে হাতটা চেপে ধরল ইউশা। মাথা নেড়ে অনুনয় করল, চুপ থাকতে। অয়ন বলতে যায়,

“ ভাইয়া আমার..
ইয়াসির হাত তুলে থামাল। বলল,
“ এখানে একজন পুলিশ অফিসার একজন চোরের বয়ান নিচ্ছে অয়ন। এই মূহুর্তে তোদের সবার চুপ থাকা উচিত “
হাসনার শ্বাসরুদ্ধকর দশা হলো। বুকের গতি ফ্যাসফ্যাসে। প্রলাপ করছেন বারবার,
“ আমি কিছু জানি না। আমি কিছু করিনাই।”
ঘাড় নাড়ল ইয়াসির,
“ বেশ,আমি তবে থানায় ফোন করছি। জিপ আসুক,বাকি প্রশ্ন চৌদ্দ শিকের ভেতরে হবে।”
হাসনা আর্তনাদ করে বললেন,

“ ও আল্লাহ না না,আমারে জেলে দেবেন না। আমি কিছু করিনাই।”
“ তাহলে বলুন,বাচ্চা চুরি করে কোথায় পাচার করেন? এটা কোনো চক্র,না অন্য কিছু? বলুন!
বাজ আছড়ে পড়ার মতো দরাজ ধমক! ভয়ে-আতঙ্কে,উদ্বিগ্নতায় ঝরঝর করে কেঁদে উঠলেন হাসনা। কথায় তার সীমাহীন আহাজারি,
“ আমি চুরি করতে চাইনাই! অভাবে পইরা আমার মাতা ঠিক আছিল না। চাইনাই আমি চুরি করতে।”
হাসনার কথা,কিংবা এই হাহুতাশ হয়ত শুনল না কেউ। আকাশ ভেঙে মাটিতে থুবড়ে পড়ার মতো বিস্ময় নিয়ে চেয়ে রইল সবাই।
তুশি নিস্তব্ধ হয়ে বলল,
“ দাদি!”

হাসনা ঝুম বৃষ্টির মতো কাঁদছেন। তারপর, ঝাপসা চোখজোড়ায় এক প্রস্থ অনুশোচনা নিয়ে তলিয়ে গেলেন অতীতে….
মফস্বল! এখানকার দশ গ্রামের মধ্যে মোটামুটি উন্নত হাসপাতালের নাম-নূরনগর কেয়ার হাসপাতাল( ছদ্মনাম)। সেই ১৬৬৯ সালে তৈরি। রংচটা দেওয়াল,মরিচা ধরা জানলার গ্রিল আর স্যাঁতস্যাঁতে মেঝে এখানকার নিয়মিত দৃশ্য। আর না আছে শহুরে আধুনিক কোনো সুবিধা।
হাসনা এখানে কাজ করছেন,প্রায় বছর ছয়েক গড়াবে৷ মধ্যবয়স,পড়াশোনা করেননি। এক পরিচিতের মাধ্যমে আয়ার কাজটা কোনোমতে পেয়েছিলেন তিনি।
তখন এপ্রিল মাস। গরম আর রোদ্দুরের বুকে টানা তিনদিন বৃষ্টি হচ্ছে অথচ। গতকাল রাতে এক রোগীর বাবু হয়েছে। বখসিস দিলে বাচ্চার ময়লা কাঁথা আয়ারাই ধুয়ে দেন। আবার শুকিয়ে-টুকিয়ে নিজেরাই রেখে যান কেবিনে। সন্ধ্যায় বৃষ্টি নামতেই হাসনা করিডোরের বারান্দায় কাপড় তুলতে এলেন। রিসেপশনে তখন এক নতুন পেশেন্ট এসেছে। পেটটা অতিরিক্ত উঁচু! গলা কাটা মুরগীর মতো ছটফট করছিলেন নারীটি। বাবা-মায়ের অবস্থা চিন্তায়,ছোটাছুটিতে ততোধিক খারাপ।

হাসনা আগ্রহ দেখালেন না। কাপড় নিয়ে যেতে যেতে শুনলেন,
“ অবস্থা একদম ভালো নয়। ইমার্জেন্সি ডেলিভারি করতে হবে।”
হাসপাতালে আয়া তিনজন। একজন ছুটি নিয়েছেন পরশুদিন। আজকে রাতের ডিউটি হাসনার। ওটি তৈরির কাজ এগিয়ে দেয়া সহ ব্যথায় কাতরাতে থাকা রোগীকে তৈরি করলেন তিনি। রোগীর তখন মরমর অবস্থা!
বাচ্চা হওয়ার পর ফের তার ডাক পড়ল ওটিতে। গিয়ে দেখেলন,জমজ বাচ্চা হয়েছে। তাও আবার আলাদা আলাদা চেহারা। বাচ্চার গায়ের নোংরা পরিষ্কারের সময় দীর্ঘশ্বাস ফেললেন হাসনা। একেবারে ছোটো,গায়ে মাংসও নেই। ওজনও কম। আহারে! মনে হয় মাস ফুরাবার আগেই হয়ে গেছে। নার্সের মধ্যে শিউলি ছিলেন সেদিন। বাকিরা অন্য ডিউটিতে। দুটোর একটাকে শিউলি কোলে নিলেন,অন্যটাকে তিনি। পরিবারের লোকজন বাইরেই দাঁড়িয়ে। রোগীর বাবা-মা,তার স্বামী আর একটা দশ-এগার বছরের বাচ্চা ছেলে দাঁড়িয়ে। সাথে আরেক মধ্যবয়সী নারী আছেন।চিন্তায়,উত্তেজনায় প্রত্যেকের মুখ বিবর্ণ। ওনাদের দেখেই পুরুষ লোকটি শুধালেন,

“ আমার স্ত্রী কেমন আছে?”
শিউলির মুখ থমথমে। হাস্যহীন বললেন,
“ ভালো!”
ভদ্রলোক হাত পাতলেন বাচ্চাদের নিতে। কিন্তু দিলেন না তিনি।
“ এখন কোলে দেয়া যাবে না। আপনারা বাচ্চার মুখ দেখে রাখুন। ওদের এক্ষুনি এন আইসিউতে শিফট করতে হবে। শ্বাস ঠিকঠাক পড়ছে না। দেরি করা যাবে না। শুধু আপনাদের এক ঝলক দেখাতে এনেছি।”
উজ্জ্বল মুখগুলো শুকিয়ে গেল অমনি। মধ্যবয়সী রমণী আর্তনাদ করে উঠলেন,
“ সে কী! তাহলে, তাহলে বউমা এখন কেমন আছে?”
“ দেখুন, অবস্থা সব দিকেই খারাপ। বুঝতেই পারছেন,প্রি ম্যাচিউর্ড বেবি। কতরকম কমপ্লিকেশনস যে হয় এদের বলে বোঝানো যাবে না।” পাশের কিশোর হয়ত এত-শত বুঝল না। ছোটো ক্যামেরাটা নিয়ে বলল,

“ আমি ওদের একটা ছবি তুলি?”
শিউলি বললেন,
“ দূর থেকে৷ ছোঁয়া যাবে না কিন্তু।”
“ আচ্ছা।”
ছেলেটা ছবি তুলল। এরপরই চলে গেলেন তিনি। হাসনা পিছু পিছু চললেন। শিউলির কোলের বাবুটা একেবারে আধমরা হয়ে আছে। তার কোলেরটা অন্তত চোখ খুলছে একটু পরপর।
আস্তেধীরে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হলো। হাসনা পুরোনো কর্মী বলে বেশ বিশ্বস্ত এখানকার। শিউলি এন আইসিউয়ের বাইরে এসে বললেন,
“ আমার আজ শরীরটা এত খারাপ লাগছে। আবার ডিউটি পড়েছে এখানে। এত ঝামেলা ভালো লাগে না। তুই আমার সাথে সাথে থাকিস।”
হাসনা বললেন,

“ শরীর খারাপ ক্যা? বিস্টিতে বিজছেন?”
“ হ্যাঁ, কাল বিকেলে। ঠান্ডা লেগেছে। চা এনে দিতে পারবি?”
“ দেন।”
ব্যাগ খুলে টাকা দিলেন তিনি। হাসনা সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় মুখোমুখি এক ভদ্রলোক পড়ল। ওপরে উঠছিলেন তিনি। সবেগে শুধালেন,
“ খালা, বাচ্চারা কেমন আছে এখন?”
“ আমি কইতারি না। আমারে কী ওনে ডুকতে দেয়নিহি?”
লোকটার মুখখানা পাংশুটে দেখাল। ছোট্ট শ্বাসে বললেন,
“ ওহ!”
হাসনা বললেন,
“ সন্ধাত্তে কতডি কাম করলাম আপনেগো। বখশিশ দেলেন না!”
“ দেবো খালা। মন মেজাজ ভালো নেই। যাওয়ার আগে ঠিক দিয়ে যাব।”
“ আইচ্ছা।”

হাসনা নেমে এলেন। চায়ের দোকান হাসপাতালের গেটের বাইরে। প্রায় মধ্যরাত অবধি খোলা থাকে এটা। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। মাথায় ছাতা মেললেন হাসনা। চা নিয়ে ফেরার ফাঁকেই,আচমকা অদূর হতে একটা নারী কণ্ঠ ডাকে,
“ এই শোনো!”
ফিরে চাইলেন তিনি। গেট ছাড়িয়ে আরেকটু ওপাশে একটা সাদা গাড়ি দাঁড়িয়ে। জানলার কাচটা তরতর করে নামতেই, বড়ো সুশ্রী একটা মুখ বেরিয়ে এলো বাইরে। পরপরই নেমে দাঁড়ালেন নারীটি। ওপাশ থেকে তড়িৎ গতিতে এসে মাথার ওপর ছাতা ধরলেন ড্রাইভার। নারীটি হাত নাড়তেই বিভ্রান্ত চিত্তে এগিয়ে এলেন হাসনা। একপল আপাদমস্তক দেখলেন তার। পরনে জর্জেটের শাড়ি,চোখে কালো চশমা। গা থেকে কী যে সুঘ্রাণ আসছে!

“ কিছু কইবেন?”
নারীটির চোখ হাসপাতালের দিকে। শুধালেন,
“ আজ রাতের ডিউটি তোমার?”
“ যে।”
“ কত বেতন পাও এখানে?”
“ ক্যান?”
“ আগে উত্তর, তারপর প্রশ্ন!”
কথায় যেন বড্ড ধার! একটু গুটিয়ে গেলেন হাসনা। বললেন,
“ তিনাজার।”
নারীটি কেমন বিদ্রুপ করে হাসলেন। পরপরই ব্যাগ থেকে হাতিয়ে আনলেন একটা মোটা টাকার বাণ্ডিল। হাসনার ভ্রু তালু ছাড়িয়ে গেল। এত টাকা!
সেই চকচকে চোখের দিকে চেয়ে বললেন তিনি,
“ এখানে পুরো ত্রিশ হাজার আছে। যদি আমার একটা কাজ করে দাও,তবে এই পুরো টাকাই তোমার।”
হাসনা হাঁ করে বললেন,

“ আমার! কী কাম করতে হইব?”
নারীটি সানগ্লাস খুললেন। গোলকধাঁধার মতো অন্যরকম দুটো চোখ। ফোন ঘুরিয়ে একটা ছবি দেখিয়ে বললেন,
“ এর বউ আজ এখানে ভর্তি হয়েছে। এতক্ষণে বাচ্চাও হয়েছে বোধ হয়। দেখেছ একে?”
হাসনা চিনে ফেললেন। একটু আগেই তো সিঁড়িতে দেখা হলো। ঘাড় নাড়তেই বললেন,
“ ঐ বাচ্চাটা আমার চাই।”
আঁতকে উঠলেন হাসনা,
“ বাচ্চা নিয়া কী করবেন?”
অমনি জ্বলন্ত চোখে চাইলেন তিনি,
“ সেই কৈফিয়ত তোমাকে দেবো না। যেটা বলেছি,করতে পারবে কিনা বলো! নয়ত আমি অন্য কাউকে…”
বলতে বলতে বাণ্ডিল নাড়ছিলেন নারীটি। টাকার কচকচে শব্দটা হাসনার মাথায় ঝিম ধরিয়ে দিলো। হড়বড় করে উঠলেন,

“ পারমু,পারমু।”
নারীটি হাসলেন।
“ গুড, যাও তবে। হসপিটালের পেছন দিয়ে যে সরু রাস্তা গিয়েছে,আমি সেখানে অপেক্ষা করব। রাত শেষ হওয়ার আগে আসবে। আর হ্যাঁ, কাকপক্ষীও যেন টের না পায়!”
হাসনা মাথা নেড়ে হাঁটা ধরলেন। কাপের চা তখন শরবত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু একটা কথা বুঝতে পারছেন না,বাচ্চা তো দুটো হয়েছে উনি একটার কথা বললেন কেন?
চায়ে চুমুক দিতেই নাক কুঁচকে ফেললেন শিউলি,
“ কী চা এনেছিস, এতো পুরো পানি হয়ে গেছে। এ চা খেলেও যা,না খেলেও তাই।”
“ বিষ্টি পরে, আমার কী দোষ?”

হতাশ চিত্তে কাপ রেখে দিলেন শিউলি। হাসনা কাচের এপাড় থেকে উঁকি দিয়ে বাচ্চা দুটোকে দেখলেন । এখান থেকে কোনটা নেবেন বুঝতে পারছেন না এখনো।
ঘডিতে রাত বারোটা ছাড়িয়েছে। মফস্বলে এই রাতই যেন অনেক! ততক্ষণে ডিউটি শেষ করে বিদেয় নিয়েছেন অনেকে। হাসপাতালে এখন কোনো বড়ো ডাক্তার নেই। হাসনা এক পল সতর্ক নেত্রে করিডোরটা দেখলেন। রোগীর বাড়ির লোক ছিল চারজন,আর একটা বাচ্চা ছেলে ছিল সাথে। তার মধ্যে তিনজনকে দেখা যাচ্ছে না। রোগীর স্বামীও তো নেই। এই সুযোগ!
পেছন ফিরে দেখলেন ভেতরের টেবিলে বসে ঝিমোচ্ছেন শিউলি। হাসনা দরজায় মুখ বাড়িয়ে বললেন,

“ আপা,শইল কেমন লাগে অহন?”
“ ভালো না রে। একটু ঘুমোতে পারলে ভালো হতো!”
“ তাইলে ঘুমান। আমি এদিক দ্যাকতাছি।”
“ না থাক।”
“ আরে আসেন তো। আরাম কইরা এক ঘন্টা সোপায় ঘুমান। কিছু লাগলে আমি দেখমু। আর কেউ আইলেও আপনেরে উঠাই দিমু।”
শিউলি বললেন,
“ পারবি?”
“ হ।”
উঠে এলেন তিনি। সচেতন কণ্ঠে বললেন,

“ ভেতরে যাস না। স্যার বারবার বলে গেছেন হাইজেন মেইনটেইন করতে। এখানে বসেই খেয়াল রাখিস।”
“ আইচ্ছা।”
শিউলির মূল ডেস্ক যেখানে,তার পাশের দু সিটের সোফার ওপর কাত হয়ে শুয়ে পড়লেন তিনি। হাসনা বিজয়ী হাসলেন। অপেক্ষা করলেন ঘুম গাঢ় হওয়ার। হাসপাতালে পেশেন্টদের জন্যে আলাদা কম্বল,বালিশ রাখা থাকে। চপল পায়ে সেখান থেকে একটা কম্বল নিয়ে এলেন তিনি। এদিক-ওদিকটা ভালো করে দেখে, আস্তে করে ঢুকলেন ভেতরে। যে বাচ্চাটা টুকটাক নড়ছিল,কোলে নিলেন সেটাকে। তারপর পা টিপে টিপে বেরিয়ে এক ছুটে বেরিয়ে গেলেন বাইরে।
সরু রাস্তার বুকে সেই সাদা গাড়িটা সত্যিই দাঁড়িয়ে আছে। পাশে আরো একটা মাঝারি সাইজের মাইক্রো। হন্তদন্ত পায়ে এসে দাঁড়ালেন হাসনা। নারীটি গাড়ির ভেতরে বসে। জানলার কাচ নামানো। ওনাকে দেখে হাসলেন। প্রসন্ন চিত্তে বললেন,

“ এসেছ তাহলে! তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম।”
হাসনা হাঁপাচ্ছেন। ফিসফিস করে বললেন,
“ অনেক কষ্টে আনছি। দরা পড়লে আমি শ্যাষ।”
“ পড়বে না। এখানে সিসিক্যামেরা নেই। মুখে স্বীকার না করলে কোনো প্রমাণ নেই তোমার বিরুদ্ধে।”
হাসনার এসব জানা। যদিও তিনি অন্য চিন্তা করেছেন। চুপচাপ বাচ্চা এগিয়ে দিতে গেলে শক্ত চিবুকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন নারীটি। আঙুল তাক করে দেখালেন,
“ ওর কাছে দাও।”
সামনের থেকে এক হাট্টাগাট্টা লোক এগিয়ে এলেন। হাসনা কোলে দিতেই,গায়ের ওপর বাণ্ডিল ছুড়ে মারলেন নারীটি। তর্জন দিলেন ভারি স্বরে,

“ যাও এবার।”
মাথা নেড়ে হাঁটা ধরলেন হাসনা। শুনতে পেলেন তক্ষুনি,
“ ধারেকাছে কোথাও নদী আছে?”
পুরুষ কণ্ঠ বলল,
“ আছে ম্যাডাম।”
“ফেলে দিয়ে এসো।
তুরন্ত,হাসনা থমকে দাঁড়ালেন। বিকট চোখে ফিরে চাইলেন পেছনে। নারীটির গাড়ির ইঞ্জিন চালু হয়েছে। যেতে যেতে বললেন,
“ কাজ শেষ করে আমাকে জানাবে।”

হাসনার বুকে ভূমিকম্প নামল। ফেলে দেবে মানে! কী ফেলবে? বাচ্চাটাকে নাতো!
ততক্ষণে পুরুষ দুজন কম্বলে প্যাঁচানো বাচ্চা নিয়ে মাইক্রোতে উঠে গেছে। ইঞ্জিনের শব্দে হাসনা ছিটকে পড়লেন ধ্যান থেকে। পরপরই মনে হলো,এই বাচ্চা তিনি চুরি করেছেন। পাপ তো এমনিই কিছু কম নেই,তাই বলে খুন! এ যে মহাপাপ। একটা নিষ্পাপ শিশুর খুন হবে জেনেও, কীভাবে চুপ করে থাকবেন তিনি?
সঙ্গে সঙ্গে ছুটলেন হাসনা। ভাগ্য সহায় থাকায় সামনে বেবিটেক্সি পড়ল। হাত নাড়া মাত্র দাঁড়াল সামনে। ড্রাইভার মুখ বের করে শুধালেন,

“ কই যাইবেন?”
“ ওই গাড়িডার পিছ লন। যত্ত ট্যাকা লাগে দিমু। তাত্তাড়ি করেন।”
মাইক্রো একদম নদীর তিরে এসে ভিড়ল। সুনসান জায়গায় সাই সাই বাতাসের শব্দও যেন গায়ে কাঁটা ফোটার মতো। একদিকে জনবসতি,অন্যদিকে জঙ্গল। মোটা মতো লোকটা বাচ্চা কোলে নিয়ে নামলেন নিচে।
নদী তখন উত্তাল! ঢেউয়ের তোড় সাংঘাতিক। তার মধ্যে বাচ্চাটাকে ছুড়ে ফেলতে গিয়েও থমকালেন তিনি।
বললেন,

“ এত্ত ছুডো বাইচ্চা ক্যামনে মারি ক তো কালু! হাত কাঁপতাছে।”
“ আমারো ভালো লাগতাছে না। কিন্তু ট্যাকা নিলে কামতো করন লাগব।”
“ মইলা মানুষ কত্ত রহম হয় দেখছোস! ক্যামনে এইটুক বাচ্চা মারতে কইল। আবার কমিশনারের মাইয়া,কাম না করলেও তো ধরব আমগোরে।”
“ এক কাম করি ওস্তাদ,বাইচ্চা এইহানে রাইখা যাই। একদম কূল পাড়ে। যে ঢেউ আইতাছে, নিজেই ভাসাইয়া লইয়া যাইব। আমাগো মারোনও লাগল না। আবার কামও হইল। কী কন!”
“ এইডা ভালো বুদ্দি!” কোল থেকে নামিয়ে বাচ্চাটাকে তীরে রেখে দিলেন তিনি। ফোস করে শ্বাস ফেলে ফের উঠে গেলেন গাড়িতে।
দশ সেকেন্ডের মাথায় চিলের মতো ছো মেরে বাচ্চাটাকে কোলে তুললেন হাসনা। থামলেন না,ছুটলেন ঝড়ের মতো। কালুর চোখ পড়ল এক পাশের ভিউ মিররে। চ্যাঁচিয়ে উঠল,

“ ওস্তাদ ওই বেডি বাইচ্চা লইয়া যাইতাছে।”
“ ধর ধর বেডিরে ধর।”
বেবি টেক্সি দাঁড়িয়ে ছিল ওপাশে। কিন্তু ওদের নেমে আসতে দেখে দিকদিশা খুইয়ে ফেললেন হাসনা। উন্মাদের ন্যায় ছুটে ঢুকে গেলেন জঙ্গলে। ওরা দুজন পেছন পেছন কিছু পথ এসে থামল। চেয়ে দেখল চারিপাশ। অন্ধকার ছাড়া কোথাও কিচ্ছুটি নেই। বড়ো বড়ো বাঁশের ঝাড়ের ফাঁক গলে ধেয়ে আসা ব্যাঙের ডাকে, আরো ভূতুড়ে লাগছে সব। কালু বলল,

“ কই গেল ওস্তাদ? কোন দিক যামু অহন!”
“ যাওন লাগব না। এই রাইত বিরাতে জঙ্গলে যাইয়া জন্তুজানোয়ারের খাওন হমু নাকি। ল,ফিইরা যাই। যাইয়া কমু,বাইচ্চা মারছি। ওই মইলা তো আর দেখতে আইব না। সব দোষ তর,তুই ক্যা কইলি বাইচ্চা থুইয়া আইতে?”
কালু মিনসে গলায় বলল,
“ আমি তো আপনের ভালোর লইগা কইছিলাম।”
“ চুপ। কথা না কইয়া তাত্তাড়ি ল,কুনজায়গায় সাপকোপ আছে। ছুবল দিলে এক্কেরে শ্যাষ।”
কালু মাথা নাড়ল। দুজন ফেরার পথে রওনা করল সহসা। এতক্ষণে মোটা গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলেন হাসনা। বুকে হাত দিয়ে শ্বাস ফেললেন স্বস্তির। চারপাশের অন্ধকার দেখে, এক পল চাইলেন বুকে প্যাঁচানো বাচ্চার পানে। এখন একে নিয়ে কী করবেন তিনি!
কথা শেষ করে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন বৃদ্ধা। বিলাপ করে বললেন,

“ আমি জানি আমি পাপ করছি। কিন্তু বিশ্বাস করেন,আমি ইচ্ছা কইরা এই কাম করিনাই। আমার ট্যাকার খুব দরকার আছিল তহন। আমার একটা মাত্র পোলা,কত ধার-দেনা কইরা সৌদি পাঠাইছিলাম। যাওয়ার সময় কইছিল,আম্মা আমি বিদেশ যাইয়া সব দেনা শোধ দিমু। পারেনাই! একদিন খবর পাইলাম, কাম করতে গিয়া মেশিনের তলায় পড়ছে। ট্যাকার অভাবে লাশটা পযন্ত পাইনাই আমি। আমার স্বামী নাই। ওই একটাই পোলা। চিন্তা করছি, ওই মহিলারে বাচ্চা দিয়া আমি হাসপাতালে যাইয়া বসমু। চ্যাঁচামেচি করমু একজন বাচ্চা নিয়া গেছে। ভান করমু,আমি দেখছি ধরতে চাইছি কিন্তু পারিনাই। আর অন্যদিকে ওই ট্যাকা দিয়ে পোলার লাশ আনামু দ্যাশে। কিন্তু, যহন আমি তুশিরে মারার কতা হুনছি,আমি থাকতে পারিনাই। আমার আল্লাহ আমারে টিকতে দেয়নাই। ওরে বাঁচাইয়া,আমি খুব চিন্তায় পইরা গেছিলাম। জানতাম,আমারে না পাইয়া সবাই খুঁজব। বাড়ি পযন্ত আইব। যদি পুলিশে দিয়া দেয়? ফাঁসি অয় আমার! সেই ডরে আমি ওরে লইয়া ঢাকা পলাই আসলাম। ভাবলাম,ওরও এহন কেউ নাই,আমারও কেউ নাই। তারপরতে বুকে আগলাইয়া মানুষ করলাম ওরে।”

হাসনা চোখ মুছে রেহনূমার দিকে চাইলেন। বললেন,
“ আপনে বিশ্বাস করেন,আমি কহনো আপনের মাইয়ার এক ফোডা অযত্ন করিনাই। নিজে না খাইলেও ওরে খাওয়াইছি। নিজে ছেড়া ত্যানা পিন্দা ওরে ভালোডা পিন্দাইছি। ওরে কুনোদিন বুজতে দিনাই ও আমার রক্তের কেউ না। কী বু,তুই ক আমি মিথ্যা কইতাছি?”
তুশি উত্তর দিলো না। বাকরুদ্ধের মতো ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল শুধু।
গোটা বসার ঘরে এতগুলো মানুষ! বাড়ির লোক থেকে অতিথিরাও। অথচ কারোর একটা শব্দও নেই। প্রত্যেকে স্তব্ধের ন্যায় সব কথা শুনলেন। বিমুঢ় বনে দেখলেন হাসনাকে। সাইফুলের ঠোঁট কাঁপছে। টালমাটাল হাত-পা। চোখে জল নিয়ে থেমে থেমে বললেন,
“ এর মানে, এর মানে, তুশি…
তুশিই আমার মেয়ে?”
জয়নব বিমূর্ত বনে বললেন,

“ আমার নাতনী তাহলে তুশি? অথচ এতদিনে আমরা কেউ বুঝলাম না!”
ইউশা ঠোঁট নাড়ল জড়ের ন্যায়,
“ তুশিই আমার সেই বোন!”
হাসনা কাঁদতে কাঁদতে মাথা নাড়লেন। হাত জোড় করে বললেন,
“ আমারে আপনেরা মাফ কইরা দেন। আমি অসহায়! এই বয়সে আমারে জেলে দিয়েন না।”
তার কান্না বোধ হয় কারো মাথা অবধি ঢুকল না। সবার কথার মাঝেই তিরের মতো ছুটে এলেন রেহনূমা। দুহাতে তুশির মুখটা তুলে এলোপাথাড়ি চুমু খেলেন- গালে,কপালে-মাথায়। শেষে বুকের সাথে শক্ত করে চেপে ধরলেন মাথাটা। হেচকি তুলতে তুলতে বিড়বিড় করলেন,

“ আমার মেয়ে,
আমার মেয়ে,
ও আমার মেয়ে!”
অথচ তুশির রা নেই। এক ফোঁটা নড়ন নেই চোখের পাতায়। একটা প্রাণহীন পাথর হয়ে বসে রইল শুধু।
ইউশা-তনিমা সবাই কাঁদলেও, বুক ফুলিয়ে হাসল অয়ন। তুশি চাচ্চুর মেয়ে। এর মানে একদম ওদের আপনজন! ছেলেটা হাস্যোজ্জ্বল মুখেই কিছু একটা ভাবল। তারপর দুমদাম পায়ে বাড়ি ছাড়ল আবার।
কিন্তু, চোখ বুজে শ্বাস ফেলে চ সূচক শব্দ করল ইয়াসির। হাসনাকে ওসব কথা ও আন্দাজে বলেছিল। বৃদ্ধার চোখমুখের ভয় আর সাইফুলের কথার জোরে। কিন্তু কেচো খুড়তে সাপ বের হবে কে জানতো! এই চোর এ বাড়ির মেয়ে হলে তো এখন গোটা গল্প পালটে যাবে। এখন থেকে সারাজীবনের জন্য এখানেই থাকবে মেয়েটা। উফ!
সবার এত কান্নাভেজা আনন্দের মাঝে শুধু নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে ছিলেন শওকত। ভদ্রলোকের চোখেমুখে এক অহেতুক শঙ্কা। বারবার জিভে ঠোঁট চুবিয়ে কেমন থম ধরে রইলেন তিনি।

সাইফুল চশমা খুলে চোখের জল মুছলেন। হারিয়ে যাওয়া মেয়ের জন্যে এতকাল রেহনূমার আহাজারি স্বচক্ষে দেখেছেন তিনি। প্রতিটা রাত নারীর হাহাকারে কেটেছে। তিনিও কি কম শোকে ছিলেন? এক মেয়েকে দেখলেই তার বুক পুড়ে যেত। মনে পড়ত অন্য মেয়ের কথা। পৃথিবী সত্যিই গোল! নাহলে যে মেয়ের জন্যে বাড়ি সুদ্ধ সবাই হাহুতাশ করে বেড়াতো,সেই মেয়ে কিনা নিজে থেকেই তাদের কাছে এসেছে? তাও আবার তার ভাইজানের ছেলের বউ হয়ে! ভদ্রলোকের কপালে ভাঁজ বসল হঠাৎ। সচেতন কণ্ঠে বললেন,
“ কিন্তু ভাইজান,আমার তো কোনো শত্রু নেই। তাহলে কে আমার মেয়েটার সাথে এমন করতে চাইছিল বলুন তো! ঐ মহিলাই বা কে!”

কাছে আসার মৌসুম পর্ব ৩০

প্রশ্নের উত্তর এলো না। তবে মন্থর বেগে বাবার পানে ঘাড় বাঁকা করে চাইল ইয়াসির। নীরস,ক্ষুরধার চাউনি তার শান্ত খুব। শওকতও ফিরলেন একই সময়। ইয়াসিরের চিকণ চোখদুটোয় যেন ধিক্কার,ঘৃণার সাথে দূর্বোধ্য ক্ষুব্ধতা এসে মিশেছে। শওকত চেয়ে থাকতে পারলেন না। অপরাধবোধের সাথে, ঘাবড়ে যাওয়ার চিহ্নটাও মুখের রেখায় কিলবিল করে উঠল। ঢোক গিললেন তিনি। ইয়াসির একটা টু শব্দ করল না। শুধু চেয়ে রইল,নিষ্প্রাণ শিলার মতো। ছেলের চোখের ঐ তপ্ততায় শওকতের মুখটা নিচু হলো ক্রমে। গলার খাঁজে মাথা নুইয়ে নিলেন তিনি। অথচ কেউ কিছু জানল না,বুঝল না। শুধু ঘরের ছায়ায় ছড়িয়ে পড়ল, দৃষ্টির সাথে দৃষ্টির এক নীরব লড়াই।

কাছে আসার মৌসুম পর্ব ৩২