কাছে আসার মৌসুম পর্ব ৩৪
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
বাবা আর্মির উঁচু র্যাংকের অফিসার ছিলেন। শুনেছিলাম,মায়ের সাথে ওনার বিয়েটা পারিবারিক ভাবে হয়। দাদুভাই পছন্দ করেছিলেন মাকে। বাবাও বিয়েতে কখনো অমত করেননি। তখন আমাদের এই সৈয়দ ভবন পুরোপুরি তৈরি হয়নি। দিদুন,দাদাভাই মফস্বলে থাকতেন। শহুরে আলো-বাতাস দাদাভাই খুব একটা পছন্দ করতেন না । কিন্তু মা চেয়েছিলেন আমাদের ঢাকার ভালো স্কুলে পড়াশোনা করাতে। গ্রামে তো অমন সুযোগ সুবিধা নেই। তাই জমি কিনে বাড়ি বানানো শুরু হলো। সেসময় শুধু নিচতলা তৈরি হয়েছে। মোট তিনটে শোবার ঘরের একটাতে আমি,সায়ন,অয়ন, একটাতে বাবা -মা আরেকটা ঘর ছিল ছোটো মা আর চাচ্চুর। চাচ্চু এখানকার একটা ব্যাংকে চাকরি করতেন। বাবা বাড়ি আসতেন বছরে দুবার। কিংবা লম্বা কোনো ছুটিতে। কিন্তু আস্তে আস্তে কী হলো জানি না। বাবার ঐ আসাটা কমে যাওয়া শুরু হলো! ঈদ যেতো,কোরবানি আসতো, পূজো কাটতো আমরা ফোন করতাম!
“ বাবা আসবে না?”
শুনতাম এ মাসে অনেক ব্যস্ততা, আসা হবে না। বাবা সব থেকে বেশি আদর করতেন সায়নকে। মোস্ট পলাইট বয় ছিল ও। বাবা যা বলতেন,কোনোদিনও ওকে অবাধ্য হতে দেখিনি। অন্যদিকে আমি ছিলাম একটু বাউন্ডুলে,বেখেয়ালি আর অনেক বেশি দুরন্ত! মা আমার যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে যেতেন। সারাদিন ক্রিকেট,বন্ধু আর হৈচৈ করে বেড়াতাম। বাড়ি এলে বাবা বকতেন, ধমকাতেন! কিন্তু লাভের লাভ হতো না। অয়ন তখন আরেকটু ছোটো ছিল। আমি আর সায়ন পিঠাপিঠি, বয়সের গ্যাপ এক বছরের মতো! সায়ন এত নরম ছিল! ছেলে অথচ ওর গলার স্বর আমি কখনো উঁচু হতে শুনিনি। যেখানে ও বড়ো ভাই,সেখানে উল্টে আমি ওকে শাসাতাম,মারতাম। আবার প্রচণ্ড ভালোবাসতাম!
থামল ইয়াসির। একটু দম নিয়ে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ ও আমার জীবনের প্রথম বন্ধু,আমার বেস্টফ্রেন্ড! যাকে মেরে রক্ত বের করে দিলেও কোনোদিন মাকে গিয়ে নালিশ দেয়নি। উলটে বলতো,পা পিছলে পড়ে গেছি।”
সেবার সায়নের খুব জ্বর হলো! বাড়িতে তখন আমি,মা আর ও। ছোটো মা তখন অন্তঃসত্ত্বা। পাঁচ মাসের পরপরই ওনার মা, ওনাকে নিজের কাছে নিয়ে গেছিলেন। এদিকে আমাদের স্কুলে ভ্যাকেশন শুরু হলো। । দিদুন ফোন করে চাচ্চুকে বললেন, আমাদের সাথে নিয়ে যেতে। কিছু দিন থেকে আসব গিয়ে। কিন্তু সায়নের শরীরের অবস্থা ভালো না। ও যেতে পারবে না দেখে, আমিও যাইনি। চাচ্চু অয়নকে নিয়ে গেলেন। ওখান থেকে ছোটো মায়েদের বাড়ি কাছাকাছি খুব।
এদিকে সায়নের জ্বর নিয়ে মা অস্থির প্রায়। কিছুতেই কমছিল না। ডাক্তার জানালেন,ওর ডেংগু পজেটিভ। খবর পেয়ে অনেক মাস পর বাবা ছুটে এলেন বাড়িতে। কিন্তু হুট করে আমি আবিষ্কার করলাম,আমাদের এই বাবা আর আগের বাবার মধ্যে কোথাও একটা বিস্তর তফাত। খুব অল্পতেই মায়ের সাথে বাবার খিটমিট শুরু হলো। সামান্য ভুল পেলে,ভাতের দানায় চুল পেলেও রাগারাগি করতেন। যা এর আগে আমি কখনো দেখিনি।
সেদিন, সন্ধ্যা বেলা হুট করে বাড়িতে চ্যাঁচামেচি শুরু হলো। বাবা-মা ঝগড়া করছেন! সায়ন আর আমি আঁতকে উঠলাম ব্যাপারটায়। ছুটে গেলাম দুজনে।
যে আমি বোধ হবার পর থেকে কোনোদিন মাকে বাবার সাথে উঁচু গলায় কথা বলতে দেখিনি,সেদিন দেখলাম মা বাবার কলার ধরে বলছেন,
“ কেন ঠকালে আমাকে? নিজের সারাটাজীবন এই সংসারের পেছনে বিলিয়ে দেয়ার প্রতিদান কী এসব ছিল?”
সাথে হাউমাউ করে কাঁদছিলেন মা। আমি আর সায়ন অতশত বুঝিনি। ছোটো ছিলাম,শুধু হাঁ করে দেখছিলাম সবটা। বাবা তখন রাগে ফুঁসছেন। তর্কে তর্কে ভাঙচুর অবধি করলেন! সায়ন কাঁপছিল,ওর গরম শরীরটা দুহাতে আগলে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। এক সময় বাবা রাগে হিঁসহিঁস করতে করতে বললেন,
“ মাকে তিনি ভালোবাসেন না। মায়ের প্রতি তার মন নেই,টান নেই। ভালোবাসা পাওয়ার মতো কোনো যোগ্যতাই নেই মায়ের। যেখানে এসব থাকে না সেখানে সংসার হয়?”
কথায় কথা বাড়ছিল। এক পর্যায়ে তিনি রেগেমেগে ঘোষণা দিলেন,
“ আমি জেসমিনকে বিয়ে করব। গোল্লায় যাক এই সংসার!”
অমনি আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। বয়স কম হলেও,অতটাও ছোটো ছিলাম না যে এটুকু বুঝব না। বাবা ব্যাগ নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। একবার তাকালেনও না আমাদের দিকে। মা কাঁদতে কাঁদতে ছুটলেন পেছনে। দুটো কিশোর ছেলের সামনে সব ভুলে জাপটে ধরলেন ওনার পা। অনুনয় করলেন কেঁদে কেঁদে,
“ যেও না। আমার ভুল হয়ে গেছে। আমাদের ছেলেগুলোর কথা অন্তত ভাবো।”
কিন্তু বাবা ভাবলেন না। পা থেকে উচ্ছিষ্ট হটানোর মতো করে মাকে ছাড়ি দিয়ে,বাড়ি ছাড়লেন দ্রুত। আমি শুধু নির্বাক বনে সেই দৃশ্য দেখলাম। মেঝেতে বসে মাথায় হাত দিয়ে মা অনেকক্ষণ গুনগুন করে কাঁদলেন। কী বলে সান্ত্বনা দেবো আমি জানি না! দুভাই শুধু চুপ করে মায়ের পাশে বসে রইলাম!
রাত প্রায় অনেক। মা তখনো কাঁদছিলেন। হঠাৎ সায়নের জ্বর বেড়ে এলো। ওর গোঙানির শব্দে মা কান্না ভুলে গেলেন। ব্যস্ত হলেন জলপট্টি দিতে। আমি তেল গরম করে ওর হাত-পা মালিশ করছিলাম। আচমকা সায়ন গলগল করে বমি করে বিছানা ভাসিয়ে দিলো। বমির সাথে রক্ত দেখে আমাদের বুক কেঁপে ওঠে। তড়িঘড়ি করে রওনা করলাম হাসপাতালে। বাড়িতে তখন পার্মানেন্ট কাজের কোনো লোক ছিল না। শুধু গেইটে দারোয়ান ছিলেন। তখন আমাদের একটা গাড়ি ছিল। সেটাও বেরিয়ে যাওয়ার সময় বাবা নিয়ে গিয়েছেন সাথে। অত রাতে গাড়ি পেতে পেতে একটা যুদ্ধ গেল মায়ের। দারোয়ান চাচা না থাকলে হয়ত তাও পেতাম না! কাছের একটা ক্লিনিকে পৌঁছালাম। কিন্তু এই মাঝরাতে কোনো ভালো ডাক্তার নেই। ফোন করে ডাকতে হবে, আর তার আগে রিসেপশনে একটা ভালো অংক জমা করার কথা বলা হলো ।
অথচ আমার মা তখন শূন্য! হাতে যা টাকা ছিল,তাতে হবে না। মা বারবার অনুরোধ করছিলেন, অন্তত ওকে ভর্তি করার জন্য। টাকা নাহয় পরে দেবেন! কিন্তু শুনছিলেন না ওনারা। বাবার পরিচয় দিলে যেকোনো জায়গায় এক্সট্রা খাতির করা হতো। কিন্তু মা পরিচয় দিচ্ছিলেন না। হয়ত খুব অভিমানে! শেষে আমি পরিচয় দিলাম। তাও বলা হলো কোনো একটা ডকুমেন্টস দিতে যাতে প্রমাণ হবে উনিই আমার বাবা। অথচ মায়ের স্মার্টফোন ছিল না যে ছবি দেখাব। একজন আর্মি অফিসারের বউ হলেও মা খুব সাদামাটা মানুষ ছিলেন তখনো। অতিরিক্ত বিলাসিতা,বাড়তি টাকা খরচা করা এসব আমি কোনোদিন দেখিনি। মাসের জন্য বাবা যতটুকু দিতেন সব আমাদের তিন ভাইয়ের পেছনে ঢেলে দিতেন দুহাতে।
আমি মায়ের ঐ ছোট্ট ফোন থেকে বাবাকে কল করলাম। কিন্তু বাবা ধরলেন না, কেটে দিলেন। কয়েক বার কল দেয়ার পরে মুখের ওপর বন্ধ করে দিলেন ফোনটা। আমি উপায় না পেয়ে চাচ্চুকে ফোন করি। অনেক রাত, চাচ্চু ঘুমোচ্ছিলেন। তাও বিপদ শুনতেই এক কথায় বললেন,
“ আমি এক্ষুনি আসছি।”
কিন্তু নূরনগর তো আর ধারেকাছে নয়। আসতেই অনেক দেরি। মা এসে বললেন,
“ ওকে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যাই চল!”
তারপর আবার সেই গাড়ি পাওয়া নিয়ে যুদ্ধ। তখন তো আর এত আধুনিক ব্যবস্থা ছিল না! কোনোরকম একটা বেবিট্যাক্সি ধরে রওনা করলাম ঢাকা মেডিকেলের পথে। সায়নের শরীর আস্তেধীরে আরো খারাপ হচ্ছিল। নাকের ছিদ্রে রক্ত দেখে মা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন। ওর শরীরে হাত রাখলে আমার মনে হচ্ছিল জ্বলন্ত চুলায় হাত দিয়েছি৷ গাড়ির ভেতর ও শুধু বাবাকে ডাকছিল। কখনো জিজ্ঞেস করছিল, মা, বাবা আর আসবে না?
মা জবাব দেননি। কাঁদছিলেন হুহু করে। আমরা ঢাকা মেডিকেলে গেলাম। কিন্তু ডেঙ্গুর প্রকোপে হাসপাতালে অতিরিক্ত ভিড় ছিল তখন। কোনো খালি বেড নেই। যে যেভাবে পারছে,পেশেন্টকে সেভাবে শুইয়েছে। কেউ বেঞ্চে,কেউ মেঝেতে! আইসিউতেও লম্বা সিরিয়াল। ভালো নার্স- ডাক্তার কিচ্ছু নেই। যারা ছিলেন,তারা ঠিক করে দাঁড়িয়ে দুটো কথা বলারও সময় পাচ্ছিলেন না। মা আমাকে মেঝের এক কোণে বসালেন। সায়ন আমার কোলে মাথা রেখে শুলো। ওর কাঁপুনি দেখে আমি নিজের ছোট্ট গেঞ্জিটা খুলে ওর গায়ে প্যাঁচিয়ে দিলাম। বারবার হাতের তালু ঘষছিলাম,মাথায় হাত বোলাচ্ছিলাম।
অসহায়ের মতো কেঁদে কেঁদে আল্লাহকে ডাকছিলাম। মা তখন পাগলের মতো ছুটছিলেন। একটা যদি ব্যবস্থা করা যায়! হঠাৎ সায়নের শ্বাস বেড়ে গেল। বাড়ল ওর কাঁপুনি। কেমন হাঁপানির রোগীদের মতো জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে খামচে ধরল আমাকে। ওর চোখমুখ দেখে আমার বুক কেঁপে ওঠে। চিৎকার করে মাকে ডাকি। মা ছুটে আসেন। ওর হাত-পা মালিশ করেন। আচমকা চোখদুটো বড়ো বড়ো করে শরীর ছেড়ে দিলো সায়ন। এতক্ষণ আগুনের মতো গরম হাত-পা নিমিষেই কেমন বরফ হয়ে এলো। মা থমকে গেলেন। কিছুক্ষণ নিস্তব্ধের ন্যায় চেয়ে থেকে ‘আল্লাহ’
বলে আছড়ে পড়লেন ওর গায়ের ওপর। আমি তখনো বোকার মতো তাকিয়ে ছিলাম। বুঝে উঠতে পারছিলাম না,আমার আমার বন্ধু, আমার ভাই, আমার সায়ন আর নেই। আমি উদ্ভ্রান্তের মতো গাল চাপড়ে ডাকলাম। রাগ দেখালাম, শাসালাম, কিন্তু সায়ন সাড়া দিলো না। একটা বারের জন্যেও না!”
ইয়াসির থামল। ডুকরে উঠল তুশি। ভেজা গলায় বলল,
“ তারপর?”
ইয়াসির ফিরে চাইল ঘাড় ঘুরিয়ে। তুশির চোখ-গাল ভিজে শেষ। অবাক হয়ে বলল,
“ কাঁদছ কেন?”
“ বলুন না,তারপর কী হলো?”
ফোস করে শ্বাস ফেলল ইয়াসির। বলতে শুরু করল,
“ বাবা পরেরদিন সকালে এলেন। সায়নের লাশ তখন বসার ঘরের মেঝেতে খাটিয়ায় বরফ দিয়ে রাখা। মায়ের জ্ঞান নেই সেই ফজর থেকে। রুমে অচেতন হয়ে পড়েছিলেন তিনি। আত্মীয়দের কয়েকজন ছিলেন ওনার কাছে। বাবা যখন সায়নকে ছুঁতে আসেন,আমি ক্ষিপ্ত বাঘের মতো ঝাপিয়ে পড়ি। ছোটো ছোটো হাতে বাবার বুকে ধাক্কা দিয়ে বলি,ওকে ধরবে না। তুমি আমাদের কেউ না। তোমার জন্যে ও মরে গেছে।
বাবা থামলেন না। আমাকে জড়িয়ে ধরেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন উলটে। পরিবারের সবাই তখন বাবার ওপর রেগে ছিল। দাদুভাই, দিদুন,এমনকি চাচ্চুও। সবাই মিলে বাবাকে অনেক কথা শোনাল। দাদুভাই তো বলেই ফেললেন,
“ সুন্দর সংসারটা এভাবে ধ্বংস করতে নেমে গেলি। কেন এসছিস তাহলে? বাকি ছেলেদুটো মরলে নাহয় আসতি।”
একেকটা বিষবাক্যে বাবা প্রায় বিধ্বস্ত হয়ে পড়লেন। লাশ হয়ে শুয়ে থাকা সায়নের পা দুটো বুকের সাথে চেপে আর্তনাদ করে কাঁদলেন শুধু। ক্ষমা চাইলেন চ্যাঁচিয়ে চ্যাঁচিয়ে। কিন্তু এই ক্ষমার কী মানে,সায়ন তো আর আসবে না।
ছোটো মা তখন খুব অসুস্থ,আবার ভারি শরীর! আসতে না পারলেও ফোন করে করে কান্নাকাটি করছিলেন। দাফনের কাজে ওনার পরিবার এসেছিল অবশ্য। মায়ের জ্ঞান ফিরল বিকেলে। আমি চাইছিলাম না,আমার মায়ের কাছে বাবা কোনোভাবে যাক। কিন্তু আমার কথা শোনা হবে,ওই বয়স তখন আমার ছিল না। বাবা মায়ের কাছে গেলেন। চৈতন্য ফিরেছে বলে, মাফ চাইলেন কেঁদে কেঁদে।
এর মাঝে চাচ্চু হঠাৎ আমাকে ডেকে বললেন,কোনোভাবে বাবার ফোনটা লুকিয়ে এনে দিতে।
আমি কিছু একটা করে এনে দিলাম। আমার সামনেই জেসমিন লিখে সেভ করা নম্বরটা নিজের ফোনে তুললেন তিনি। তারপর বাবার ফোনটা আমাকে দিয়ে বললেন,আবার জায়গায় রেখে আসতে। আমি যাওয়ার নাম করে লুকিয়ে থাকি, চাচ্চুর কথাগুলো শুনব বলে। কারণ জেসমিন নামটা যে বাবার মুখে শুনেছিলাম সেদিন!
শুনতে পেলাম,খুব আজেবাজে ভাষায় চাচ্চু ওনাকে গালাগালি করছেন। হুমকি দিয়ে বলছিলেন,
“ রক্ষিতা হওয়ার এত শখ তো বাজারে যা। আমার ভাইয়ের পেছন ছেড়ে দে। আর কখনো যদি আমার পরিবারের দিকে তুই চোখ তুলেও দেখিস,আমি তোকে খুন করে ফেলব।”
আমি অবুঝ ছিলাম না। সব বুঝে গলাটা কেমন তেতো হয়ে গেল। নিজের মাকে ছেড়ে যার বাবা অন্য নারীতে মন দেয়,সেই সন্তান বোঝে তার মনের ওপর দিয়ে কী যায় তখন!
এরপর কিছু দিন কাটল। বাবা সারাদিন হত্যে দিয়ে মায়ের কাছে পড়ে রইলেন। দেখাশোনা করা থেকে সব নিজের হাতেই করছিলেন তিনি। দিদুন আমাকে আর অয়নকে গ্রামে নিয়ে যেতে চাইলেন। মায়ের এই অবস্থায় আমাদের দেখাশোনা কে করবে! কিন্তু আমি কিছুতেই মাকে রেখে যাব না। এবারেও অয়ন গেল। মা তখন চুপ করে থাকতেন। কখনো ফ্যালফ্যাল করে সায়নের ছবির দিকে চেয়ে থাকতেন শুধু। কখনো ওর জামাকাপড় নিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতেন। বাবা তখন আদর্শ স্বামী বনে গেলেন। নিজ হাতে মাকে খাওয়ানো , মাকে সময় দেয়া সব করতেন তিনি। মাঝেমধ্যে টের পেতাম বাবার ফোন বাজছে। বিশেষ করে রাতে। বাবার ফিসফিস করে কথা বলা, শুনতে পেতাম আমি। কখনো শুনতাম,
“ তুমি কেন বুঝতে চাইছ না,সম্পর্কটা আর এগিয়ে নেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমাকে যারা মাথায় করে রাখত,আমার সেই পরিবার আজ আমার দিকে আঙুল তুলছে,জেসমিন। আমি এসব নিতে পারছি না। আমার পরিবার ছাড়া আমি শূণ্য। আমি আমার সংসারটা আর নষ্ট করতে চাইছি না জেসমিন। এক ছেলেকে হারিয়েছি,আমি মনে করি আমার পাপেই ও মরেছে,আমি এই পাপ আর বাড়াতে চাই না।”
আমি বাবার কাছে কম যেতাম। তবে মনে মনে খুশি হচ্ছিলাম ব্যাপারটায়। তখন বেশিরভাগ সময় আমার চাচ্চুর সাথে কাটতো। হঠাৎ সেদিন বিকেলে চাচ্চুর কাছে খবর এলো,ছোটো মাকে ইমিডিয়েট হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। অফিস থেকে রওনা করার পথে বাবাকে ফোন করে জানিয়ে দিলেন তিনি। বাবা কী করে যাবেন,বুঝতে পারছিলেন না। মা পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি,আবার আমিও আছি। যাওয়া হলো না সেজন্য। তবে বলে দিলেন,কিছু লাগলেই জানাতে।
ছোটো মায়ের যে টুইন বাবু হবে আমরা আগে থেকে জানতাম। সনোলজিস্ট যেদিন বললেন, ছোটো মা সেদিন বাড়ি এসেই আমাকে বললেন, দুই বাবুর দুটো নাম রাখার জন্যে। আমি নিজের নামের সাথে মিলিয়ে রাখলাম,
ইউসা আর ইনায়া।
তুশির ঠোঁট জোড়া কাঁপল। ভাবল,
“ ওর নাম তবে ইনায়া?”
ইয়াসির ফের বলল,
“ চাচ্চু অনেক খুশি ছিলেন সেদিন। ফোন করে বললেন, এই খুশিতে এসেই আমাকে আমার প্রিয় সাইকেল কিনে দেবেন। আমিও ভাবলাম, এক সায়নকে নিয়ে গিয়ে সৃষ্টিকর্তা হয়ত আমাদের দুটো ফুল উপহার দিয়ে গেলেন। ওরা ফিরে এলে মাও আবার আগের মতো হয়ে যাবে। কিন্তু হলো না! দীর্ঘশ্বাস ফেলল ইয়াসির। বলল,
সেই মাঝরাতে আবার একটা হাহাকার ছুটে এলো বাড়িতে। জানতে পারলাম, দুটো বাবু থেকে একজন চুরি হয়ে গেছে। হাসপাতালের কোনো এক আয়াকে সন্দেহ করছে সবাই। চাচ্চু কাঁদছিলেন,গলা কাঁপছিল। ছোটো মা তখন পোস্ট অপারেটিভ কেয়ারে। হুশ আসেনি। ভাইয়ের আহাজারিতে বাবা আর বসে থাকতে পারলেন না। আশ্চর্যের বিষয়, সন্তান হারিয়ে স্তব্ধ হয়ে যাওয়া আমার মাও তড়িঘড়ি করে রওনা করলেন সাথে । হাসপাতালে পুলিশ এলো। চাচ্চু খুব অনুরোধ করছিলেন, ছোটো মায়ের জ্ঞান ফেরার আগে বাবুটাকে খুঁজে দেয়ার জন্যে। বাবার হাত ধরে বলছিলেন,
“ আমি কী জবাব দেবো,ভাইজান? তুমি অন্তত কিছু করো।”
ব্যাপারটা নিয়ে বাবাও খুব তৎপর হয়ে পড়লেন। আর্মির মেজরের কেস,সকলে একটু বেশিই তটস্থ। পরিবারের সবাই চিন্তায় অস্থির। আমি বাবার সাথে সাথে ছিলাম। কোনো খবর যদি পাই, সেই আশায়। হঠাৎ বাবার ফোন বাজল। লক্ষ্য করলাম, স্ক্রিন দেখে বাবার মুখভঙ্গি বদলে গেছে। লাইন কেটে দিলেন তিনি। ফোন আবার বাজল। বাবা আবার কাটলেন। পরপরই টুং করে ম্যাসেজ বাজল একটা। তাতে কী লেখা ছিল আমি জানতাম না। তবে বাবা তাড়াহুড়ো করে ফোন নিয়ে এক কোণে গিয়ে দাঁড়ালেন। এরপরই দেখলাম বাবা আর নিজের মাঝে নেই। কথাবার্তা শেষ করে কেমন নিষ্প্রাণ শরীরের মতো এসে দাঁড়িয়ে রইলেন শুধু। এতক্ষণ পুলিশকে ধমকানো,তাগিদ দেয়া, এদিকে সেদিকে কল করে লোক লাগানো মানুষটা আচমকা কেমন চুপ করে গেছে। কথা নেই,শব্দ নেই। মুখের দিকে তাকানোও যাচ্ছে না। অয়ন কাছে গিয়ে ডাকল,
“ বাবা!”
কেমন নির্জীব চোখে চাইলেন তিনি। ও কেঁদে কেঁদে জিজ্ঞেস করল,
“ বাবুটাকে পাওয়া যাবে তো?”
বাবা জবাব দিলেন না। আমার সন্দেহ গাঢ় হলো। সব গিয়ে বর্তাল বাবার ফোনে। কে ফোন করেছিল,কী এমন বলেছিল বাবাকে! জানার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলাম। ওৎ পেতে রইলাম একটা বার ফোনটা হাতে পাওয়ার জন্যে। তারপর ঐ রাত কাটল। বাচ্চাটাকে কোথাও পাওয়া গেল না। খবরটা ছোটোমাকে দেয়া হলো একদিন পরে। যা ভয় পাচ্ছিল সবাই,তাই হয়েছে। আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লেন তিনি। ইমিডিয়েট ঢাকায় নিয়ে আসা হলো। প্রায় বিশ দিন লেগে গেল ওনার সুস্থ হতে। মা নিজেকে,নিজের দুঃখকে ভুলে ছোটো মায়ের দেখাশোনা করছিলেন। আর ইউশা তখন ওর নানুর কাছে থাকতো।
ছোটো মা শুধু কাঁদতেন। বুক চাপড়ে চাপড়ে বলতেন আমার বাচ্চাটাকে কেউ এনে দাও। বিশেষ করে যখন ইউশাকে কোলে নিতে যেত,কান্না বাড়তো ওনার। শুধু হাহুতাশ করে বলতেন,
“ আপা,আমার ওই মেয়েটারও তো এখন খিদে পেয়েছে তাই না? ও নিশ্চয়ই কাঁদছে। ওকি ওর মাকে খুঁজছে না আপা? আমার মেয়েটাকে কোথায় পাব আপা? কে এনে দেবে,কী করলে এনে দেবে! আপা ও বেঁচে আছে তো!”
ইয়াসির ফের তুশির পানে চাইল। চিবুক গলায় নামিয়ে ফোঁপাচ্ছে মেয়েটা।
একটু থেমে বলল,
“ আমার কাছে বাবার ফোন পাওয়ার সুযোগ এলো ঘটনার এক সপ্তাহ পর। বাবা ওয়াশরুমে ছিলেন। ফোন টেবিলে। আমি ছো মেরে নিয়ে দৌড়ে নিজের রুমে চলে এলাম। ইনবক্সে ঢুকে দেখলাম,ওই তারিখের কোনো ম্যাসেজ নেই। এমনকি জেসমিন নামটাও সেভ নেই ফোনে। বুঝলাম, বাবা সব ডিলিট করে দিয়েছেন। তারপর পাগলের মতো সারা ফোন ঘাটলাম আমি। সৌভাগ্য বলব না দূর্ভাগ্য জানি না,তারপর….
ইয়াসির থেমে গেল। কৌতূহলে মুখ তুলল তুশি।
“ তারপর?”
অতীতের সেই বিদঘুটে দৃশ্য ইয়াসিরের সামনে ভেসে উঠল। কানে বাজল সেসব জঘন্য ফোনালাপ…
শওকতের ফোনে অটো কল রেকর্ডার চালু ছিল। হয়ত এটুকু ডিলিট করতে ভুলে গেছিলেন ভদ্রলোক। ইয়াসির তারিখ ঘেটেঘুটে একটা নম্বর দেখল। দশ মিনিটের কথোপকথন। কাঁপা আঙুল নেড়ে প্রেস করল সেখানে। ভেসে এলো শওকতের চাপা স্বর,
“ সমস্যা কী তোমার? কেটে দেয়ার পরেও এতবার কল করছো কেন?”
ওপাশের রিনরিনে নারী স্বর বলল,
“ ইস,খুব ব্যস্ত বুঝি?
বাচ্চাটাকে তাহলে আর খুঁজেই পেলে না।”
“ তুমি এসব কী করে জানো?”
“ সেটাতো বড়ো কথা নয়। বড়ো কথা হলো এখন তোমার কেমন লাগছে? পরিবার পরিবার করে আমাকে ছেড়ে গেলে এখন পরিবারের এই দূর্ভোগ,দূর্দশাগুলো উপভোগ করছো নিশ্চয়ই?”
শওকত রেগে বললেন,
“ বিপদের সময় এসব কেমন মজা জেসমিন? তুমি জানো সাইফুলের ওপর দিয়ে কী যাচ্ছে! ওর একটা বাচ্চা মিসিং এখনো।”
“ একটা বাচ্চা? এমা,বাচ্চা কি দুটো ছিল নাকি! ইস,ভুল হয়ে গেল তাহলে।”
“ ফোন রাখো।”
“ আরে রে শোনো তো… এত রাগ কীসের শওকত? আগে তো ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলতে,এখন দু মিনিটও দিচ্ছো না।”
“ জেসমিন ফোন রাখো। মানুষকে জ্বালানোরও একটা সীমা থাকে। আমার পরিবারের কী অবস্থা আন্দাজ আছে তোমার?”
“ থাকবে না কেন, অবশ্যই আছে। বাচ্চা হারালে সবার-ই কষ্ট হয় শওকত। সবার মনের ওপর দিয়েই ঝড় যায়। আমারো এমন হয়েছিল। যখন তুমি নিষ্ঠুরের মতো বলে দিলে আমাদের বাচ্চাটাকে অ্যাবোর্ট করে ফেলতে!”
ইয়াসিরের চোখ কেঁপে উঠল,
‘বাচ্চা!’
“ তোমার জন্যে বাবা আমাকে জোর করে নিয়ে অ্যাবোর্ট করিয়ে দিয়েছেন। আমার প্রথম সন্তান ছিল শওকত। কী ক্ষতি করেছিলাম আমি তোমার? কেন আমার সাথে এমন করলে! তোমার ভাই আমাকে ফোন করে যা নয় তাই বলেছে সেদিন। আমি তোমার রক্ষিতা? বলো, রক্ষিতা আমি? আমি তো রক্ষিতা হতে চাইনি,শওকত। আমি তোমার স্ত্রী হতে চেয়েছিলাম। স্বপ্ন দেখেছিলাম তোমাকে নিয়ে। কিন্তু তুমি সেই স্বপ্ন পায়ে পিষে দিয়েছ। ইউজ করেছ আমাকে। যদি শুরুতেই বলে দিতে, তোমার স্ত্রী জীবিত,আমাদের সম্পর্ক এতদূর গড়াতই না। তুমি ঠকিয়েছ আমাকে। তোমার স্ত্রী দুটো ছেলে রেখে মারা গেছেন তাই না! এসবই বলেছিলে তো। দিনের পর দিন আমাকে ব্যবহার করে,আমার শরীরটাকে ব্যবহার করে, পরিবারের দোহাই দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিয়েছ আমাকে। তোমার জন্যে আজ বাবাও পরিবারের কেউ আমার পাশে নেই। প্রত্যেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে,প্রত্যেকে।”
“ এই এক গান আর কত গাইবে? যা হয়েছিল সব আমাদের সম্মতিতে। আমি তো তোমাকে জোর করিনি। আর এসব কথা বলার কী আর সময় নেই? আমার বাড়ির লোকেদের এখন…”
জেসমিন হাসল,মাঝপথেই বলল,
“ খারাপ অবস্থা,তাইতো? অবস্থা তোমাদের আরো খারাপ হবে সৈয়দ শওকত ইসলাম। জেসমিন আরাকে তুমি চেনো না। আমাকে ঠকিয়ে তুমি আমার জীবন, আমার বাচ্চার জীবন নিয়ে খেলেছ, তোমার ভাই আমাকে নোংরা ভাষায় গালাগালি করেছে,তোমাদের আমি এক দণ্ড শান্তি দেবো না। সবে শুরু করলাম, এবার দেখবে কী হয়!”
শওকতের গলার স্বর বদলে গেল এবার। সতর্ক কণ্ঠে বললেন,
“ কী করেছ তুমি জেসমিন!”
জেসমিনের স্বর উৎফুল্ল,
“ উহু,প্রশ্নটা হবে কী করিনি। কারণ,আমিই তো সব করেছি। তোমার ভাই ওইদিন আমাকে খুব শাসাচ্ছিল জানো। এই করবে সেই করবে। অথচ কিছু করার আগেই বেচারাকে গুটিতে আমি মাত দিয়ে দিয়েছি। এখন নিশ্চয়ই গুনগুন করে কাঁদছে? ইস, মায়া হচ্ছে ওনার জন্যে। প্লিজ গিয়ে বলো যেন না কাঁদে। কারণ, যে ভাইয়ের জন্য অচেনা এক মহিলার সাথে উনি অত জঘন্য ভাষায় হম্বিতম্বি করল, ওনার বাচ্চা তো সেই নিয়ে গেছে। ওনার ভাইয়ের একমাত্র প্রেমিকা!”
শওকত স্তম্ভিতের ন্যায় আওড়ালেন,
“ জেসমিন,বাচ্চা তুমি চুরি করিয়েছ?”
“ শুধু চুরিই করাইনি। মারতে পাঠিয়ে দিয়েছি। এতক্ষণে বোধ হয় কাজ শেষও হয়ে গেছে। বললাম না সবে শুরু? আমার বাচ্চাটা যখন বাঁচেনি শওকত,তোমার পরিবারের একটা বাচ্চাকেও আমি বাঁচতে দেবো না। তোমার ছেলেদেরও আমি শেষ করে দেবো। আই প্রমিস ইউ,ধরে ধরে শেষ করে দেবো আমি সবাইকে…”
ইয়াসির এর বেশি শুনতে পারেনি। ঠকঠক করা হাত থেকে ফোনটা ঝুপ করে পড়ে গেল নিচে। বুক জ্বলছে,চোখের সামনে লালচে অন্ধকারে তলিয়েছে সব। তক্ষুনি ছুটে এসে দরজায় দাঁড়ালেন শওকত। ভদ্রলোকের শক্ত চোয়াল বদলাল,মেঝেতে পড়ে থাকা ফোন,আর ইয়াসিরের ছলছল চোখের আগুন দেখে। অতটুকু ছেলে, অথচ ঘাবড়ে গেলেন শওকত। পড়ে থাকা ফোনটা তখনো বাজছে। ভেসে আসা কথোপকথন শুনে ভদ্রলোকের মুখ বিবর্ণ হলো। পাংশুটে দেখাল চোখদুটো। ওপাশ থেকে ধীরুজ পায়ে হেঁটে এসে বাবার মুখোমুখি থামল ইয়াসির। শওকত হাঁ করতে গেলেন, পূর্বেই ঘৃণায় উগলে পড়ল ছেলেটা। মেঝেতে এক দলা থুথু ফেলে বলল,
“ ছিহ!”
বাড়িতে তখন সবাই আছে। ইয়াসির ছুটে বেরিয়ে যেতেই, শওকত আতঙ্কে ফ্যাকাশে হয়ে গেলেন। ছেলেটা যদি গিয়ে সবাইকে সব কথা বলে দেয়! ত্রস্ত পিছু নিলেন ওর। অথচ, ইয়াসির নিচে নামেনি। ওপরের সিঁড়িগোড়ায় এসে দাঁড়িয়ে গেল হঠাৎ। তখন দুপুর বেলা একসাথে খেতে বসেছে সবাই। ইউশাকে কোলে নিয়ে চেয়ারে বসেছিলেন রেহনূমা। তনিমা পাশে দাঁড়িয়ে তাকে মুখে তুলে খাওয়াচ্ছেন । অয়নের থালায় এটা সেটা বেড়ে দিচ্ছেন সাইফুল। দাদুভাই,দিদুন প্রত্যেকে ছিল। বাড়ির দেওয়ালগুলোয় তখনো দুটো সন্তান হারিয়ে যাওয়ার বিষণ্ণতা লেগে! অথচ এসবের মাঝেও সকলের এই মিল এই ভালোবাসা,এই আন্তরিকতা থমকে রাখল কিশোরকে। নিচে আর এলো না ইয়াসির। অসহায় চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে, ফের ছুটে ঢুকে গেল কামরায়। তার দোর চাপানোর শব্দ পৌঁছে গেল খাবার ঘরে। সবার সাথে সাথে এক চোট কেঁপে উঠলেন শওকতও।
কয়েক পাঁক বেগ বদলে নেওয়া হাওয়া ইয়াসিরকে ফের বর্তমানে আনল। গৌড় বর্ণের যুবকের মুখে এখন ঘোর অমানিশা। আর্দ্র স্বরে বলল,
“ একটা ছেলের কাছে, তার বাবা আইডল, তার আদর্শ হয়। আমিও আমার বাবাকে আইডল হিসেবে জানতাম। ভাবতাম, বড়ো হয়ে বাবার মতো অফিসার হবো। দেশের সেবা করব। অথচ আমার সেই বাবা এক মেয়েকে মিথ্যে কথা বলে,আমার জীবিত মাকে মৃত বানিয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলল। যার গর্ভে বাবার অবৈধ সন্তা…
ইয়াসির চোখ খিচে থামে। ফের বলে,
“ অতটুকু বয়সে নিজের বাবার এমন কুৎসিত চরিত্রটা জানার পর,আমার সারা শরীর ঘৃণায় রিরি করছিল। যে সময়টায় ছোটো মা উদগ্রীব হয়ে প্রহর গুণতেন মেয়ের একটা খবর পাবার আশায়! চাচ্চু প্রতি সপ্তাহে নূরনগরের থানায় চক্কর কেটে আসতেন, সেখানে সব জেনেও আমি কাউকে কিচ্ছু বলতে পারিনি। কী করে বলতাম? ওই লোকটা যেমনই হোক,যাই হোক উনি তো আমার বাবা। সব জানার পর আমি যেভাবে ওনাকে থু দিয়ে এলাম,বাড়ির সবাই নিশ্চয়ই তাই করবে? যে চাচ্চু ভাই অন্তপ্রাণ,যে ছোটো মা ভাসুরকে শ্রদ্ধায় মাথায় করে রাখেন,আমার মা এতকিছুর পরে যখন স্বামীর একটু যত্ন পেতে শুরু করলেন, এসব জানলে যে প্রত্যেকে ঘৃণা করবে তাকে। সবার সম্পর্কে ভাঙন ধরবে । আমাদের এতদিনের একসাথে থাকা, আমাদের পরিবার, সব ভেঙে যাবে,সব। তাই চুপচাপ নিজের মাঝে দাফন করলাম সত্যিটা।
কিন্তু দিন যত যাচ্ছিল,এই অপরাধ বোধ, এই ঘা কুড়ে কুড়ে খেতে শুরু করল আমাকে। যখন দেখতাম ইউশার জন্মদিন এলেই ছোটো মা পাগলামো করছেন। ছোটো চাচ্চু খবর নিতে ক্লান্ত হচ্ছেন না,ভাতের থালায় আঙুল নাড়তে নাড়তে চোখের জল মুছছেন,আমার মা সায়নের শোকে রুম অন্ধকার করে গুনগুণ করে কাঁদতেন, আর আমার বাবা তার প্রেমিকার অন্যায় নিজের স্বার্থে চুপ করে গিলে ফেলেছেন,তখন আমার আমাকেই সবথেকে বড়ো কালপ্রিট মনে হতো। মনে হতো কেন আমি কাউকে কিচ্ছু বলতে পারিনি?”
তুশি ধড়ফড়িয়ে শুধাল,
“ আর জেসমিন,জেসমিনের কী হয়েছিল?”
“ জানি না। ওইটুকু বয়সে ওনার খোঁজ নেয়ার মতো ক্ষমতা আমার ছিল না। যখন একটু বড়ো হলাম সোর্স লাগিয়েছিলাম একবার। ওনার বাবা রিটায়ার্ড কমিশনার ছিলেন। পুরো পরিবারের সবাই নিউইয়র্কে সেটেল্ড। কেবল জেসমিন থাকতেন এখানে। ইঞ্জিনিয়ারিং-এর স্টুডেন্ট ছিলেন তিনি। তাই মেয়ে কী করত,কী না করতো ওনারা জানতেন না। খোঁজ নেয়ার পর জানতে পারি,শী কমিটেড সুইসাইড।”
তুশি সুইসাইড মানে বোঝে। আঁতকে বলল,
“ সে কী!”
“ হুঁ। আমাদের পরিবারকে শেষ করে দেয়াটা ওনার হুমকি ছিল। যাতে বাবা ফিরে যান। কিন্তু বাবা ফিরলেন না! উলটে ওনার সাথে যোগাযোগ করার সব রাস্তা বন্ধ করে দিলেন। হয়ত এই অবজ্ঞা নিতে পারেননি তাই…”
আর ঠিক এই কারণেই আমি আমার বাবাকে ঘৃণা করি। বউ,সন্তান থাকা সত্ত্বেও একটা মেয়েকে মিথ্যে বলে, দিনের পর দিন বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে তাকে সর্বশান্ত করে দেয়া মানুষটাকে আমি নিজের সবটুকু দিয়ে ঘৃণা করি।
জেসমিনের তো দোষ নেই,সব দোষ ওনার। ওনার এই ব্যাভিচার,এই পাপের জন্য কতগুলো জীবন শেষ হয়ে গেল। একটা বাচ্চা তো পৃথিবীতে আসার সুযোগই পেলো না। কতগুলো মা তার সন্তান হারিয়েছে। কতগুলো মেয়ে তাদের বেঁচে থাকার সুখ হারিয়েছে। এরপরেও ওই লোকটাকে আমি কী করে বাবা ডাকব? আমি ওনার সন্তান ভাবলেই তো আমার নিজের প্রতি ঘৃণা হয়। তাই আমি ওনাকে কোনোদিন ক্ষমা করব না। কোনোদিন না!”
চাঁদের আলোয় তুশি স্পষ্ট দেখল,ইয়াসিরের চোখের কোণ বেয়ে একটা জলের ধারা নামছে। মেয়েটা নিজেও কাঁদছিল। অথচ প্রিয় পুরুষের চোখের পানিতে ভেতরটা কেঁপে উঠল সজোরে। অধৈর্য হাতে পানিটা মুছে দিলো তুশি। অস্থির চিত্তে বলল,
“ কাঁদবেন না,কাঁদবেন না।”
ইয়াসির সুদূর থেকে চোখ এনে পাশ ফিরে চাইল। ফেলল তুশির মেদুর মুখে। মেয়েটার নরম দৃষ্টিতে অগাধ মায়া, ভরসা অনেক। কয়েক সেকেন্ড নিশ্চুপ চেয়ে রইল সে। তারপর কিছু একটা হয়ত হলো। আচমকা হুড়মুড় করে তুশিকে জড়িয়ে ধরল ইয়াসির । এত দ্রুত, এত জোরে, রীতিমতো তুশির শীর্ণ বুকের ভেতর তার মাথা ঢুকে যায়। অপ্রস্তুতি, আর হকচকানোয় দোলনার কাঠের গায়ে হেলে পড়ে মেয়েটা।
কাছে আসার মৌসুম পর্ব ৩৩
বলিষ্ঠ দুহাত দিয়ে তুশির পাতলা শরীরটাকে ইয়াসির এত আষ্ঠেপৃষ্ঠে ধরেছে,রীতিমতো ওর শ্বাস নেয়াও দুষ্কর হয়ে এলো। কিন্তু টু শব্দও করল না তুশি। কাঁপা কাঁপা হাতদুটো তুলে ইয়াসিরের পিঠে রাখল সে। পরপর খুব শক্ত করল বাঁধন। আজকের এই লুটপাট হওয়া জ্যোৎস্নায় প্রথম বার দুটো শরীর মিশল একে অন্যের সাথে। এরপর কী হবে,কে জানে!