কাজলরেখা পর্ব ১৬
তানজিনা ইসলাম
চাঁদনী চুপচাপ বসে আছে ক্লাস রুমে। ক্লাসে গুটিকয়েক শিক্ষার্থী উপস্হিত আছে। অন্যদিনের তুলনায় একেবারেই কম, জমজমাট ভাবটা নেই।এখনো ক্লাস শুরু হতে ঢের বাকি।আজ চাঁদনী একটু তাড়াতাড়িই কলেজে চলে এসেছে।বাড়িতে থাকলে প্রতিনিয়ত ওঁকে একাকী, চুপচাপ বসতে থাকতে হয়। আঁধার তো থাকে না, থাকলেও চাদনী কথা বলে না ওর সাথে। এখানে অবশ্য তার দোষ নেই, চাঁদনী কথা বলে না, তাই ও বলার সুযোগও পায় না। কিন্তু চাঁদনীরই বা কি করার, একটা মানুষ কতক্ষণ নিজেকে নিয়ে খোঁটা শুনতে পারে। ওর যে কথা বলতে ইচ্ছে করে না এমন না, একাকিত্ব কার ভালো লাগে! কিন্তু ওর সেল্ফরেস্পেক্ট ওঁকে কথা বলতে দেয় না।
ওই বাড়িটা চাঁদনীর জন্য আঁধারের বানানো জেলখানা। যেখানে চাদনী বন্দী হয়ে থাকে। জেলের কয়েদিরা যেমন কথা বলার জন্য একটা মানুষ পায় না, কখনো বাইরে বেরোতে পারে না, ওঁদের জীবনে যেমন উপভোগ করার মতো কিছুই নেই চাদনীও তেমন। ওর দম বন্ধ হয়ে আসে ওই জেলখানায়। তবুও চাদনী মানিয়ে নিয়েছে, একটা মানুষ অভ্যস্ত হয়ে যায়। কখনো না কখনো হাল ছেড়ে দেয়। চাদনী হাল ছেড়ে দিয়েছে৷ নিজের জন্য আর কোনোকিছুর আশা নাই ওর।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
বাইরের এই খোলা বাতাসটুকু শ্বাস নেওয়ার জন্য খুব বেশিই প্রয়োজন ওর।
ক্লাসে যে কয়েক শিক্ষার্থী উপস্থিত আছে সবাই হরদম গল্প আর হৈ-হুল্লোড়ে মেতে আছে।ক্লাসের সব বন্ধুমহল খোশগল্পে বুদ।সবাই তাদের জমানো কথা উগ্রে দিচ্ছে তাদের প্রিয় বন্ধু-বান্ধবের কাছে।
চাদনী গালে হাত দিয়ে এতিমের মতো বসে থাকলো। আজ কী ওর বন্ধুগুলো আসবে না? ওরা তো এতো লেইট করে না। খুব তাড়াতাড়িই চলে আসে।ওই চারটা বাঁদর ছাড়া তো আর কোনো বন্ধু নেই চাঁদনীর। ওরা না আসলে একসাথে আসে না, একদিন আগে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে বলে দেয়। এমনকিছু কি কাল রাতে বলেছিলো ওরা,চাদনীর খেয়াল নেই। একবার গ্রুপ চেক করে আসা উচিত ছিলো। পুরো দিনটা আজ বেকার যাবে! চাদনী মন খারাপ করে বসে থাকে। একটু পর রেহান কে আসতে দেখা গেলো। চাদনী কে বসে থাকতে দেখে, ওর পাশে ছেলেদের রো তে একটা টেবিলে বসলো,যেখান থেকে সরাসরি চাদনীর সাথে কথা বলা যাবে। চাদনী মেকি হেঁসে বললো
-“ভেবেছিলাম আসবে না! লেইট হলো যে?”
-“মাঝরাস্তায় গাড়িতে সমস্যা হয়েছিলো।”
-“আচ্ছা। বাকিরা কই? ক্লাস এমন খালি কেন?”
-“এসেছে তো সবাই, দেখিসনি তুই ওদেরকে?”
-“না তো! আমি তো আজ অনেক তাড়াতাড়ি এসেছি। তারপরও তো দেখলাম না কাওকে। অনেক্ষণ ধরে একা একা বসে আছি!ওরা কই?”
রেহান বললো
-“পরশু থেকে কালচারাল প্রোগ্রাম। সবাই কোনো না কোনো কমপিটিশনে পার্টিসিপেট করছে। সবাই প্র্যাক্টিসে গেছে আই থিংক!”
চাদনী ঠোঁট গোল করে ও বোঝালো। বললো
-“তুমি নাম দাওনি?”
-“এই তুমি তুমি করবি না তো! আমরা সবাই তোকে তুই তুই করে বলি। অথচ তুই আমাদের তুমি বলিস।এটা কোনো কথা হইলো বেডা?”
-“বেডা?”
-” আমি তো হাসনা আর বৃষ্টিকেও ছেলেদের মতোই ট্রিট করি।আর ওরা আমাদেরকে মেয়েদের মতো ট্রিট করে৷ ভাই-ব্রাদারদের মধ্যে জেন্ডারের পার্থক্য কীসের?”
চাদনী ফিক করে হাসলো। রেহান গম্ভীর স্বরে বললো
-“তুই বল!”
-“আচ্ছা থাম।”
-“এই তো!বাইরে যাবি?”
-“কেন?”
-“আমরা দু’জন তো পার্টিসিপেট করলাম না। ওঁদের সাথেই না-হয় থাকলাম। চল, বাইরে ঘুরি।”
-“টিচার আসবে না?”
-“নাহ! কাউন্সিলররা নিজেদের স্টুডেন্ট নিয়ে ব্যস্ত।ক্লাস হবে না!”
চাদনী সংশয়ে পরলো। তবে রেহানের প্যানপ্যানানি তে টিকতে না পেরে বেরোলো ক্লাস থেকে। সিড়ি বেয়ে নামছিলো দু’জন। চাদনী আগে আগে নামে,রেহান পিছু পিছু। সিড়ি বেয়ে যত ছেলে উঠছিলো, সবার সাথেই রেহান হাই,হ্যালো করছিলো। চাদনী অবাক হয়ে দেখে। এই ছেলের কতো বন্ধু! সিনিয়রদের সাথে পর্যন্ত বন্ধুর মতো আচরণ করছে। একটা ছেলের সাথে কথা বলার জন্য সিঁড়িতেই দাঁড়িয়ে পরলো রেহান। চাদনী ওর অপেক্ষা করলো না, ওঁকে লক্ষ্য করে উপর দিকে চেয়ে চেয়ে নিচে নামলো। পিছু ফিরে হাঁটতে গিয়ে, অসাবধানতা বসত পা মুচড়ে ধুম করে নিচে পরে গেলো। আআআআআ করে চিল্লানি দিয়ে নিচে পরে গেলো চাদনী, মেঝেতে পরা থেকে বাঁচতে গিয়ে,
শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো সামনো আসা একজনের বলিষ্ঠ হাত।
চাঁদনীর চিল্লানি শুনে রেহান নেমে এলো, সাথে ওর সাথে কথা বলা ছেলেটা। চাদনী মেঝেতে পরলো না, কিন্তু ওর পা মুচড়ে ব্যাথা পেলো ঠিকই। ভয়ে চোখ খিঁচে নিলো চাদনী। গোড়ালি খুলে যাওয়ার মতো ব্যাথা অনুভব করলো, মনে হলো। অসম্ভব ব্যাথায় চোখের সামনে পুরো দুনিয়া অন্ধকার হয়ে গেলো ওর।
রেহান নেমে এসে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকালো চাঁদনীর দিকে। তারপর ওর আঁকড়ে ধরা মানুষটার দিকে তাকিয়ে বললো
-“ভাইয়া।”
রাত ছোট ছোট চোখ করে তাকালো৷ রেহান মুখে হাত দিলো৷ মনে পরলো কলেজে তো ওর পরিচয় দেওয়া মানা! চাদনী রাতের হাত ধরে ছিলো। নিজেকে বাচাতে এমনভাবে আষ্টেপৃষ্টে ওর হাতটা ধরলো যে, নখ দেবে গেলো রাতের হাতে। রেহান ধরলো না ওঁকে। ভাগ্যবসত হাসনা আর বৃষ্টি তখন সিড়ি দিয়ে আসছিলো,হয়তো ওঁদের খুঁজতেই। রেহান ডাক দিয়ে নিয়ে এলো ওদের। ওঁরা এসে চাদনী কে ধরলো।অথচ চাদনী কোনোমতে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই রাত
ধমকে বললো
-“চোখ হাতে নিয়ে হাঁটো? এক্ষুনি কতবড় একটা অঘটন ঘটতো জানো তুমি!”
চাদনী এ পর্যায়ে চোখ পিটপিট করে তাকালো। ও এতোক্ষণ রাতকে দেখেইনি। রাত নাক ফোলাচ্ছে ওর দিকে তাকিয়ে৷ ফর্সা মুখ লাল হয়ে আছে রাতের। ওর পিছনে কয়েকজন ছেলেপিলে মুখ লটকে দাঁড়িয়ে আছে। একে তো পায়ের ব্যাথায় চাঁদনীর অবস্থা খারাপ, হাসনা আর বৃষ্টি কোনোমতে ধরে রেখেছে ওঁকে। তারউপর সামনের জন ধমকাধমকি করছে ওর উপর। যেখানে ওর কোনো দোষই নেই। নিতান্তই চাদনী নিজেকে বাঁচাতে চেয়েছিলো। ঠোঁট কামড়ে কান্না আঁটকে বললো
-“সরি ভাইয়া আমি দেখতে পাইনি!”
-“অন্ধ তুমি?”
ডানে বায়ে মাথা নাড়ে চাদনী। রাতের খুব রাগ লাগছে৷ কলেজে এসেছে পর থেকে একটা না একটা মেয়ে বিরক্ত করছে ওঁকে। এত্তো ছ্যাচড়া মেয়ে গুলো! এই মেয়ে তো ডাইরেক্ট গাঁয়ের উপর পরলো এসে। চাদনী ভয়ে ভয়ে তাকালো রাতের দিকে। বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাত। বোঝায় যাচ্ছে চাদনীর উপর খুব বিরক্ত সে। রেহান এগিয়ে এসে ধরফরিয়ে বললো
-“ভাইয়া ও ইচ্ছে করে করেনি। অসাবধানতা বসত সিঁড়ি থেকে পা মচকে পরে গিয়েছিলো! আপনি প্লিজ ওঁকে বকবেন না!”
-“চুপপপ! একদম সাফাই গাইবে না!সে বাচ্চা?”
শাসিয়ে বললো রাত। রেহান কিছু বলার মতো পেলো না। রাত রাগী দৃষ্টিতে চাদনীর দিকে তাকিয়ে বললো
-“ছেলে দেখলেই গায়ে পরতে মন চায়?”
নিষ্ঠুর অপমানে চাদনী কেঁদেই দিলো। অসহায় স্বরে বললো
-” আমি তো ইচ্ছে করে করিনি। আমার কি দোষ!আপনি আমাকে এভাবে অপমান করছেন কেন?”
রাত আমলে নিলো না ওর কথা! তিরতিরে মেজাজে চিবিয়ে বললো
-“আবার মুখে মুখে কথা বলছো তুমি?একেতো লাফালাফি করতে গিয়ে আমার গায়ের উপর পরেছো। আবার উত্তর দিচ্ছো, সাহস তো কম না! নেক্সট টাইম যাতে তোমাকে আমার আশেপাশেও না দেখি! যাওওও, এখানে থেকে! গেট লস্ট!”
চাদনী কেপে উঠলো ধমকে। বৃষ্টি হাত বুলিয়ে দিলো ওর পিঠে। রাতের নজর বর্তালো এবার চাঁদনীর পায়ে। কেডস পরে আসেনি আজকে ও। ফল স্বরূপ বুড়ো আঙুলের নখ উল্টে গেছে। র*ক্ত ঝড়ছে সেখান থেকে।রাত গম্ভীর দৃষ্টিতে রেহানের দিকে তাকিয়ে বললো
-“তােমার বন্ধুর পায়ে বেন্ডেজ করাতে হবে। ইনফেকশন হয়ে যাবে নয়তো।”
বাধ্যের মতো মাথা ঝাকালো রেহান। সবাই চাদনী কে ধরে প্রস্হান নিলো সেখান থেকে। রাতের হাতে জ্বালাপোড়া করছে।মেয়েটার নখের আঁচড় বসে গেছে হাতে। রাত কপালে ভাজ ফেলে তাকালো। নাকমুখ কুঁচকে বললো
-“ছ্যা*হ! বদনাম করে দিলো আমাকে।”
পেছন থেকে সুহাশ বললো
কাজলরেখা পর্ব ১৫
-“ভাই, আমাদের প্রিন্সিপালের অফিসে যেতে হবে!”
-“হুম চল। আমি জিজ্ঞেস করবো তার থেকে, ওনার কলেজের মেয়েগুলো এতো ছ্যাচড়া কেন? আসছি পর্যন্ত বিরক্ত করছে আমাকে! সামনে নির্বাচনের জন্য কিছু বলতেও পারছি না, সহ্যও করতে পারছি না। ছিহ! মেয়ে আমার একটুও পছন্দ না!”
-“ছেলে পছন্দ ভাই?”
বলেই সুহাশ তড়িঘড়ি করে মুখে হাত দিলো। রাত ভয়ঙ্কর দৃষ্টিতে তাকালো ওর দিকে।