কাজলরেখা পর্ব ২০
তানজিনা ইসলাম
ড্রইংরুমে সোনালী রঙের আলো জ্বলছে। উপরে বিশাল, রাজকীয় ঝাড়বাতি।
ডাইনিং টেবিলে বসে আছে রেহান।আজ ওর মনটা খুব উৎফুল্ল। আজ প্রথমবার রাত ওঁদের সাথে ডিনার করবে।
রাত ওঁদের সাথে ডিনার করে না।হয় ও রুমে খায়, নয়তো বাইরে থেকে খেয়ে আসে। দেখে বোঝায় যায় না,রাত এ বাড়ির একজন সদস্য। অথচ এ বাড়িতে রাত মাইনে রাখে সবচেয়ে বেশি। রেহানের অনেকদিন ধরে ইচ্ছে করছিলো, রাতের সাথে খেতে। ও অনেকবার রাতের সাথে কক্ষে গিয়ে খেতে চেয়েছিলো, ওর মায়ের ভয়ে পারেনি। শাবিহা আর রেহান অনেক রিকুয়েষ্ট করার পর রাজি করিয়েছে রাতকে, একসাথে বসে খাওয়ার জন্য। কয়েকজন সার্ভেন্ট অবিরত কিচেন থেকে ডিশ নিয়ে আসছে, সেগুলো সাজিয়ে দিচ্ছে টেবিলের উপর। রেহান খুব তাড়াতাড়ি এসে বসে পরেছে টেবিলে। সবাই আসতে সময় নিচ্ছে।
শাবিহা কে আসতে দেখা গেলো। শাবিহা যেই ওর পাশের চেয়ারে বসতে যাবে, রেহান দু’হাতে চেয়ার আজলে নিয়ে বললো
-“না।এখানে না। এটা আবরার ভাইয়ার।আবরার ভাইয়া আমার পাশে বসবে। তুমি অন্য কোথাও বসো।”
শাবিহা ওর মাথায় গাটা মেরে অন্য চেয়ারে গিয়ে বসলো।রেহানের উঁকিঝুঁকির মাঝেই রাতকে আসতে দেখা গেলো চপ্পল পায়ে সিড়ি বেয়ে নামলো ও।
টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই রেহান ধরফরিয়ে বললো
-“ভাইয়া, এখানে এখানে।”
রেহানের পাশের চেয়ার টেনে বসলো রাত। একটু পর কবিতা এহসান এলেন সেখানে। রাত মিষ্টি করে হাসলো তার দিকে তাকিয়ে। তিনি শ্লেষাত্মক হেঁসে বললেন
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-“কেমন আছো তুমি? অনেকদিন পর দেখা হলো।
রাত ঠোঁটের হাসি বিস্তৃত করে বললো
-“ভালো ছিলাম এতোক্ষণ।আপনাকে দেখার পর খারাপ হয়ে গেছি।”
-“এইদিক দিয়ে তোমার সাথে আমার খুব মিলে যায়। আমার পেটের ছেলে না হয়েও তোমার আর আমার ভাবনা একদম খাপে খাপ।”
দুজনের মুখে কি অমায়িক হাসি!দেখে মনে হবে দু’জন শুভাকাঙ্ক্ষীর কতোদিন পর দেখা হয়েছে, খুশি যেন ধরে না!অথচ দৃষ্টিতে শত্রুতা বিনিময় হয় তাঁদের।
রেহানের মায়ের খোঁচা ভালো লাগলো না।রাতকে নিয়ে কেও খারাপ কিছু বললেই ওর অসহ্য লাগে। ও উদগ্রীব স্বরে বললো
-“চুপ করো না আম্মু। ভাইয়ার সাথে এরকম করছো কেন তুমি?”
-“বড়দের মাঝে কথা বলছিস কেন? থাপ্পড় দেব, বেয়াদব!”
ঝাঁঝালো স্বরে, রেহান মুখ কালো করে বসলো।
সাদিক এহসান এলেন সবার শেষে।রাত মাথা তুললো না।একপ্রকার অগ্রাহ্য করলো তাকে। এ বাড়ির সব মানুষের সাথে ও কথা বলে। এমনকি শাবিহা আর রেহানের মায়ের সাথে পর্যন্ত। দু’জন দু’জনকে খোঁচাখুঁচি করে। শুধু এ একটা মানুষের সাথে ওর কথা বলা মানা। কতো বছর তাঁদের মধ্যে শব্দ বিনিময় হয় না, রাতের মনে নেই।
সবাই খাচ্ছে। আজ যা যা রান্না হয়েছে, সব রাতের ফেবারিট ডিশ। এসব যে সাদিক এহসান স্পেশালি রান্না করতে বলেছেন ও খাবে বলে, সেটাও জানা ওর। তবুও রাতের এসবের দরকার নেই। কারো ভালোবাসার দরকার নেই ওর। যখন ওর ভালোবাসার দরকার ছিলো, তখন কেও ভালোবাসেনি ওঁকে। এখন এসব আলগা পিরিতের কোনো মানে নেই। টেবিল জুড়ে চামচের টুংটাং শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ শোনা যায় না।রেহান কিছু বলতে চায়লো। কিছুক্ষণ আইঢাই করলো। ও অনেকদিন ধরেই সাদিক এহসান কে একটা কথা বলতে চাচ্ছে, সময় বা সুযোগ কোনোটাই হচ্ছে না। নিরবতা ভেঙে রেহান ডাকলো
-“বাবা।”
সাদিক এহসান ওর দিকে তাকিয়ে বললেন
-“কী বাবা?”
-“আইফোন সেভেন্টিন লঞ্চ হয়েছে। আমার লাগবে।”
শাবিহা পাশ থেকে বললো
-“কয়েকদিন আগেই না সিক্সটিন প্রোম্যাক্স নিলি। এখন আবার সেভেন্টিন লাগবে। বিলাসিতা একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে না?”
রেহান ঠোঁট উল্টে বললো
-“ওটা তুমি নিয়ে নিও। বাট এখন আমার সেভেন্টিন লাগবে, একদম নিউ। পরে যখন সবার হাতে হাতে থাকবে, তখন ফিল পাওয়া যাবে না।”
-“মানে তোকে ফুটানি দেখাতেই হবে?”
-“এরকম কেন করতেছো তুমি?”
ওঁদের কথার মাঝে বাগড়া দিলেন সাদিক এহসান। বললেন
-“ছোট ভাইয়ের সাথে ঝগড়া কেন করছো শাবিহা? রেহান, কালকে পেয়ে যাবা! আজ রাত টা অপেক্ষা করো!”
-“থ্যাঙ্কিউ বাবা!”
রেহান চকচকে দৃষ্টিতে তাকালো রাতের দিকে। উৎফুল্ল হয়ে বললো
-“ভাইয়া, তুমি কিনে ফেলেছো আইফোন সেভেন্টিন? আমি কিন্তু তোমার আগে পেয়ে যাচ্ছি।
-” তুমি তো সবকিছুই আগে আগে পেয়েছো রেহান। সবকিছুই পেয়েছো তুমি। তোমার সাথে আমার তুলনা চলে না। তোমার বাবা আমাকে কোনোদিন একটা চকলেট কিনে না দিলেও, তুমি চাওয়া মাত্রই তোমার জন্য ল্যাম্বরগিনি কিনে দিবে। আইফোন সেভেন্টিন তো খুব ছোট্ট একটা জিনিস!”
রেহান মাথা নুইয়ে ফেললো।রাতের রাগ হলো নিজের উপর। রেহানের মন খারাপ করে দেওয়া, রাতের ভালো লাগে না৷
ও কখনো শাবিহা আর রেহান কে আলাদা চোখে দেখে না। নিজের ছোট ভাইকে হিংসা করার মতো নিচু মানসিকতা আর একটাও নাই। কিন্তু তবুও কোথাও যেন একটা ঈর্ষা থেকেই যায়। যা ও পায়নি কোনোদিন, সেটা আরেকজন পাচ্ছে। রেহানকে ওর বাপ পারে না মাথার উপর নিয়ে বসে থাকতে। অথচ ওর বয়সে রাতের সাথে কি কি করেছে! রেহানের মনটা খারাপ হয়ে গেছে। ওর মায়ের ধমকে যতটা না কষ্ট পায়নি, ততটা কষ্ট পেয়েছে রাতের খোচায়।ভালোবাসার মানুষগুলোর একটা ছোট্ট কথাও বুকে গিয়ে হিট করে খুব খারাপ ভাবে।
রাত ব্যাকুল দৃষ্টিতে তাকালো রেহানের দিকে। ওর মুখটা করুন। মাথা নিচু করে বসে আছে। রাতের খারাপ লাগলো। ওর সরল ভাইটা! এ বাড়িতে ওঁকে সবচেয়ে বেশি যে ভালোবাসে সে হয়তো রেহানই। একটা মানুষকে ভালোবাসা রেহানের কাছ থেকে শিখতে হবে। রেহান ওর প্রিয় মানুষগুলকে জানপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসে। কেন যে ও কষ্ট দিয়ে ফেলে ছেলেটাকে। রাত ডাকলো
-“রেহান, রাগ করলি?”
রেহান ডানে বায়ে মাথা নেড়ে বললো
-“তোমার উপর রাগ করতে পারি আমি!”
-“কালকে ঘুরতে যাবি?”
-“তোমার সাথে!”
-“অবশ্যই! আমি এ সুযোগ কি করে মিস করি!”
-“ঠিক আছে তাহলে। আমরা দুই ভাই কাল ঢাকা শহরে ঘুরবো!”
রেহান উৎফুল্ল হয়ে মাথা ঝাকালো।শাবিহা তড়িঘড়ি করে বললো
-“আমি কি দোষ করেছি? আমি যাবো না? আমাকে এভাবে সাইড করে দেওয়া হচ্ছে কেন?”
-“গার্লস নট এলাউড!”
রাত বললো। রেহান মুখ বাকিয়ে বললো
-“আপুকে নিবা না ভাইয়া। খালি আমাকে গা*লি দেয়।”
-“আমার ভাইকে গালি দেস কেন তুই? ওরে এমনিতেও নিবো না, চুন্নি একটা!”
রেহান খুশিতে জড়িয়ে ধরলো ওঁকে। শাবিহা কপাল চাপড়ালো।
মাঝখানে চাদনী দু’দিন কলেজে যায়নি, পায়ের ব্যাথার জন্য। এখন ঠিকভাবে হাঁটতে পারছে ও। বাধ্যগত কাল কলেজে যেতেই হবে। কাল কলেজে কালচারাল প্রোগ্রাম। গানের প্রতিযোগিতায় নাম দেওয়া নিয়ে যে কেচ্ছাই না হয়েছিলো, তাও প্রিন্সিপালের সামনে। এরপর যদি ও এবসেন্ট থাকে, ওঁকে না কলেজ থেকে বের করে দেয়। চাদনী ওর বন্ধুদেরকে অনেকবার সরি বলেছে। বলেছে এসব ঘুমের ঘোরে বলেছে ও। অতিরিক্ত ব্যাথায় ওর মাইন্ড খারাপ ছিলো, কি বলেছে নিজেও জানে না।
চাদনী অনেক কষ্টে মানিয়েছে ওদেরকে। এক একজনের কি রাগ ওর উপর! বিশেষ করে হাসনা আর বৃষ্টি বেশি রেগে ছিলো ওর উপর। রেহান আর সিয়ামের গন্ডারের চামড়া, ওরা কোনো কথায়ই গায়ে মাখায় না। তবে হাসনা ওঁকে একটা শর্ত দিয়েছে। ও চাদনীর সরি এক্সেপ্ট করবে যদি চাদনী কালচারাল প্রোগ্রামের দিন শাড়ি পরে আসে। চাদনী নবীন বরণের দিনও শাড়ি পরে আসেনি৷ তখন না-হয় ওরা বন্ধু ছিলো না। এখন তো ওরা বন্ধু। প্রোগ্রামে হাসনা আর বৃষ্টি আবার ম্যাচিং করে শাড়ি পরবে, চাদনীকেও মাস্ট পরতে হবে। চাদনী বলেছে ওর শাড়ি নেই। ওঁকে বাড়ি থেকে শাড়ি পরে যেতে এলাউ করবে না। হাসনা বলেছে তাহলে ওরা আর কথাই বলবে না চাদনীর সাথে। চাদনী পরেছে মাইনকার চিপায়। শেষমেশ না পেরে বলেছে, ওকে ওর বাড়ি থেকে শাড়িও কিনে দিবে না।
হাসনা আর বৃষ্টি প্রস্তাব দিয়েছে ওঁদের সাথে শপিংয়ে যেতে। ওরা ফ্রেন্ড হয়েছে কতোদিন, কখনতো একসাথে ঘুরতে যাওয়া হয়নি ওঁদের। চাদনী রাজি হয়ে গেছে। ওদেরকে আর মিথ্যা বলতে ইচ্ছে করেনি। আজ যেভাবেই হোক ও বাইরে যাবেই। ওরও তো বাইরে যেতে ইচ্ছে করে, ঘুরতে ইচ্ছে করে। একটা মানুষের কতোক্ষণ বাড়িতে বন্দী হয়ে থাকতে ভালো লাগে!
চাদনী আঁধারের কক্ষে যায় না বললেই চলে। আঁধারই এসে এসে ওর রুমে কব্জা করে বসে থাকে। চাদনী চলে যেতে বললেও যায় না। চাঁদনীর লজ্জা লাগলো আঁধারের কক্ষে যেতে। ওর রুমে আঁধার আসলে, চাদনী ওঁকে উল্টাপাল্টা বলে বের করে দেয়। এখন কই করে নির্লজ্জের মতো ওর রুমে যাবে। চাদনী এসব ভাবতে ভাবতেই আঁধারের রুমের দিকে হাটা দিলো।
আঁধার কারো সাথে চ্যাটিং করছিলো। কিছুক্ষণ পরপর অট্টহাসছে। চাদনী গিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকালো৷ আঁধার ওঁকে দেখতেই বললো
-“আররে! কে এসেছে আমার রুমে! আপনি আপনার পায়ের ধুলো আমার রুমে দিয়েছেন, তাতো আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না।”
চাদনী স্বাভাবিক গলায় বললো
-“কথা আছে তোমার সাথে!”
-“আমার সাথে তোমার কী কথা থাকতে পারে? তুমি তো আমার সাথে কথা বলতে পছন্দ করো না!”
আঁধার ভ্রু নাচালো। চাদনী বললো
-“একবার আপনি, একবার তুমি, একবার তুই। যেকোনো একটা ডাকলে সুবিধা হয়!”
-“তোর অসুবিধে করতেই তো আমার বেশি ভালো লাগে।বোস!”
চাদনী দাঁড়িয়ে থাকলো।আঁধার ওর কব্জি ধরে বসালো ওঁকে ওর পাশে। চাদনী দুরত্ব রেখে বসলো। বললো
-” হাসতেছো কেন এভাবে?”
-“হঠাৎ একটা কথা মনে পরলো।”
-“আচ্ছা!”
-“কী কথা জিজ্ঞেস কর? এতো উদাস কেন তুই আমার ব্যাপারে?”
-“বলো!”
-“বলি তাহলে হ্যাঁ! জানিস ফার্স্ট ইয়ারে না একটা মেয়ে আসছে। ওর সাথে একবার কথা বলেছিলাম শুধু। এরপর থেকেই পিছে পিছে ঘুরতেছে। কোত্থেকে আমার আইডি পেয়েছে কে জানে! মেসেজ দিয়েছে। খুব বোকা বোকা মেসেজ!”
-“সবাই তো আর তোমার মতো চালাক না!”
চাদনীর কন্ঠে স্পষ্ট ব্যাঙ্গ। আঁধার ভাব নিয়ে বললো
-“তা ঠিক বলেছিস।”
-“তুমি না শাবিহা আপুকে ভালোবাসতে! এখন আবার আরেকজনের কথা বলছো কেন?”
-“রিলেশনে তো অনেকজনের সাথেই ছিলাম আমি!”
-“কয়জনের সাথে?”
-“গুণিণি কখনো!”
চাদনী অতিষ্ঠ হয়ে বললো
-“সিরিয়াসলি? কয়টা লাগে তোমার আঁধার ভাই?এদিকে ঢাকায় এসে জেনেছি তুমি শাবিহা আপুকে ভালোবাসতে। আবার বাড়ির সবাই জানে তুমি অর্পিতা আপুকে ভালোবাসো। তার নামের পাশে লাভ ইমোজি দিয়ে নাম্বার সেভ করেছো। আবার আজতে আরেকটা মেয়ের কথা মনে করে হাসতেছো?তুমি একচুয়ালি ভালোটা কাকে বাসো বলবে আমাকে?”
আঁধার মুখ বিকৃত করে বললো
-“ধুর! আমি আসলো কাউকেই ভালোবাসি না। আর অর্পিতা! হ্যাঁ, মানছি ও সুন্দর ছিলো। পার্ফেক্ট ছিলো সবদিক দিয়ে। হাত ফসকে পালিয়ে যাওয়ায় আফসোসও হয়েছিলো। বাট ওই মেয়ে এত্তো গায়ে পরা ছিলো। ভালোবাসা টাসা কিছু ছিলো না। গেলেই খালি ঘেঁষাঘেঁষি করতো। বাড়ির সবাই মনে করতো আমাদের মধ্যে লুতুপুতু প্রেম ছিলো। আসলে এমন কিছুই না।বিয়ের শপিং করতে গিয়েছিলাম তখন আমার মোবাইল নিয়ে নিজের নাম এভাবে সেভ করে দিয়েছে। যেদিন কল করেছিলো,ওই যে ট্রেনে। ওইদিনই ব্লক মেরে দিয়েছি।”
আঁধারের চোখেমুখে বিরক্তি। চাদনী বললো
-“আর শাবিহা আপু?”
-“ওর জন্য রিয়েল ফিলিংস ছিলো!”
-“রিয়েল ফিলিংস থাকলে শুধু একটু ভুল বোঝাবুঝি তে এভাবে ফেলে চলে যাওয়া যায়। এভাবে আরেকজনের সাথে বিয়ের পিড়িতে বসে যাওয়া যায়?”
-“আঁধারের জন্য সম্ভব! ও আমার ইগো হার্ট করেছে। জানিস ওঁকে আমি কতোবার আমাকে বিয়ে করে নেওয়ার জন্য বলেছিলাম, পরিবারের দোহাই দিয়ে এড়িয়ে গেছে সবসময়। শেষে কি করলো, আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিলো। আমি কি ওর জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকতাম? মেয়ের অভাব ছিলো এ দেশে? আমি নিজের ইগো জাহির করার জন্য সবাইকে ছেড়ে দিতে পারবো!”
চাদনী চুপ থাকলো ক্ষণকাল। একটু পর উদগ্রীব স্বরে বললো
-“আমাকেও ছেড়ে দাও তাহলে। আমি তো তোমার ইগো কম হার্ট করি না!”
-“তোকে ছেড়ে দিলে তুই খুশি হবি?”
-“খুববব!”
-” এভাবে বলতে পারলি চাদনী! নাহ, তোকে ছাড়বো না আমি। তোর সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেছে। এ জিনিসটা কে হেলা করতে পারি না আমি। তোকে আঁটকে রাখার, তোর উপর অধিকার দেখানোর যে মজাটা আছে, ওটা আলাদাই। !
চাদনী শ্লেষাত্মক হাসলো। ক্রুদ্ধ স্বরে বললো
-“বেগানা পুরুষের কথা বললে না-কি গুণাহ হয়! এই যে তুমি একটা বেগানা নারীর কথা ভেবে নির্লজ্জের মতো হাসতেছো তোমার গুণাহ হচ্ছে না? না, সব হাদিস আমার ব্যাপারে?”
-“বুঝতে পেরেছিস দেখে ভালো লাগছে।”
-“ফালতু কথা রাখো।”
-“রাখলাম!”
চাদনী ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বললো
-“আমি একটু বাইরে যাবো!”
-“বাইরে কেন যাবি?”
চাদনী আইঢাই করলো! জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললো
-“আমার ফ্রেন্ডরা শপিং করতে যাচ্ছে। আমাকেও যেতে বলছে ওদের সাথে। আমি যাই?”
আঁধার নাকোচ করে বললো
-“কোনো দরকার নেই। তোর কী কী লাগবে আমাকে লিস্ট করে দে, আমি এনে দেব।”
চাদনী অনুনয় করলো
-“প্লিজ যাইতে দাও। জিনিসগুলো আমাকে চয়েস করে কিনতে হবে। আর আমি ওঁদের কে বলে ফেলেছি আমি যাবো। প্লিজ দাদাভাই। আমি কোথাও যাই নাই। আমার বাড়ি টু কলেজ, কলেজ টু বাড়ি করতে আর ভালো লাগে না। এ বন্দীত্ব আমার আর সহ্য হয় না। যাইতে দাও।”
আঁধার ওর দিকে না তাকিয়েই বললো
-“আমি নিয়ে যাবো। কোথায় কোথায় যেতে ইচ্ছে করতেছে বল।”
-“ওঁদের সাথে গেলে সমস্যা কী?”
-“না, মানে না। কথা একবারে বুঝোস না?”
চাদনীর মনটা খারাপ হয়ে গেলো। ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকালো ও। কতো আশা করে এসেছিলো বলতে। আঁধার সব ভাবনায় পানি ঢেলে দিলো।
চাদনী উঠে দাঁড়ালো। জেদী গলায় বললো
-“আমি যাবোই।তুমি আমাকে আটকাতে পারবা না!”
-“তুই জাস্ট বের হয়ে দেখ, আমি তোর সাথে কি করি! আমি তোকে কষ্ট দিতে চাইছি না চাদনী। রুমে যা।”
-“কী করবে তুমি? এবার যদি তুমি আমাকে আরেকটা উল্টাপাল্টা কথা বলো আমি সব বাবাকে বলবো!”
আঁধার চোখ পাকিয়ে তাকালো ওর দিকে। বিমূঢ় স্বরে বললো
-“চাচ্চুর ভয় দেখাচ্ছিস! তুই হয়তো জানিস না আমি কাওকে ভয় পাই না। আমি যেটা বলবো সেটাই শুনতে হবে তোকে বুঝোছিস! কথা অমান্য করবি না। আমার সাথে কোনোদিক দিয়েই জিততে পারবি না তুই।”
চাদনীর ঠোঁট কাঁপছে। ও খুব খারাপ কিছু বলে কষ্ট দিতে চায়ছে আঁধারকে। কিন্তু মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। চাদনী ধুপধাপ পা ফেলে বেরিয়ে গেলো।
আঁধার কিছুক্ষণ রুমে বসে বকাবকি করলো ওঁকে। এই মেয়ে একবারে কথা কেন শোনে না? কেন আঁধার কে একটু মানে ও?
আঁধার একটু পর রুমে গেলো ওর! চাদনী তখন মন খারাপ করে বসে আছে। কেঁদে কেটে গাল, ওড়না ভিজিয়ে ফেলেছে। আঁধার এসেই বললো
-“কী লাগবে চাঁদ আমাকে বল। আমি এনে দিব!”
-“কিছু লাগবে না!” বাজখাঁই কন্ঠে বললো চাদনী।
আঁধার নরম স্বরে বললো
-“প্লিজ বল। আমি এনে দিব তো৷ তোকে এতো স্বাধীনতাও দিতে পারবো না আমি। কলেজে যাস ওটা আলাদা কথা। বাট কলেজের রাস্তা চাড়া আর কিছু চিনিস না তুই। দু’দিনের পাতানো বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাবি, ওঁদের সাথে তোকে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকবো আমি, এতো কুল আমি না। আমার টেনশন হবে বোঝ না একটু।”
-“সবকিছু আমাকেই কেন বুঝতে হবে?
আঁধার এগিয়ে গিয়ে দু’হাতে ওর গাল চেপে ধরলো। অতিষ্ঠ হয়ে বললো
-“বল না! বল না, কি লাগবে। আমি এনে দিব তো। তুই চায়লে তোকে সহ নিয়ে যাবো শপিংয়ে।”
-“যাবো না আমি।”
-“কী লাগবে বল।”
-“সবসময় চেপে ধরো কেন, ছাড়ো।”
-“আগে বল,তারপর ছেড়ে দিব। তোকে ছাড়তে আমার ভালো লাগে না, বুঝোস না!”
চাদনী তাকালো আঁধারের দিকে। আঁধার প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। চাদনী বুঝলো, আঁধারের পছন্দমতো উত্তর না দেওয়া পর্যন্ত চাদনী ছাড়া পাবে না।
ঠিকাছে, শপিংয়ে যাওয়া না গেলেও শাড়ি তো পাওয়া যাবে, চাদনী ভাবলো। চাঁদনী ভাঙা গলায় বললো
-“একটা শাড়ি!”
-“শাড়ি? শাড়ি কেন?”
-“আমি গানের প্রতিযোগিতায় পার্টিসিপেট করেছি। আমার দু’জন ফ্রেন্ড ম্যাচিং করে শাড়ি পরে যাবে। আমাকেও পরতে বলেছে। আমি তো নবীনবরণেও শাড়ি পরে যাইনি।”
আঁধার ছেড়ে দিলো ওর গাল। সোজা হয়ে দাড়িয়ে, মলিন স্বরে বললো
-“গানের প্রতিযোগিতায় নাম দিয়েছিস, একবার বললিও না।”
-“তোমার সাথে আমার স্বাভাবিক কথা হয়? যখনই কথা হয় তখনই খোঁচা মারো আমাকে। আমার আর কিচ্ছু বলতে ইচ্ছে করে না।”
-“ঠিক আছে। বাট তুই তো শাড়ি পরতে পারিস না!”
-“ইউটিউব দেখে পরবো কোনোরকম। তবুও আমি শাড়ি পরে যাবো। ওদেরকে কথা দিয়ে ফেলেছি।”
আঁধার উদ্বিগ্ন স্বরে বললো
-“শাড়ি পরলে তোকে সুন্দর লাগবে না।আর শাড়ি সামলাতেও পারবি না তুই। বিশ্বাস কর কাজের বেটি রহিমার মতো লাগবে তোকে।”
-“লাগুক! তবুও আমি ওদের সাথে ম্যাচ করতে চাই।”
-“শাড়ি না চাঁদ। আমি তোরে শাড়ি পরে বাইরে যাইতে দিব না। তোর জন্য আমি ড্রেস কিনে আনি?”
-“ড্রেস না শাড়ি।”
আঁধার শাসিয়ে বললো
-“শাড়ি পরতে পারবি না তুই। অন্য কিছু বল। অন্য যা কিছু চায়বি সব এনে দিব। বাট শাড়ি না। শাড়ির ভুত মাথা থেকে ফেল, নয়তো কালচারাল প্রোগ্রামেও যায়তে দিব না একদম।”
চাদনী ফুসতে ফুসতে তাকালো। আঁধার বেরিয়ে গেলো কক্ষ ছেড়ে।আঁধারের ছোটবেলার একটা কথা মনে আছে। আঁধারের বয়স তখন কত হবে, এই চৌদ্দ-পনেরো। ও যে চাদনীকে এখন ক্ষ্যাপায় এমন না৷ আঁধার ছোটবেলায়ও চাদনীকে কালির ড্রাম বলে ক্ষেপাতো। একবার হয়েছিলো কি, পুতুল খেলার সময়, চাদনী একটা লাল শাড়ি পরে বউ সেজেছিলো। কি যে সুন্দর লেগেছিলো সেদিন চাদনীকে! আঁধারের একটা ক্লোজ ফ্রেন্ড সেদিন বাড়িতে এলো, চাদনীকে দেখে খালি বলছিলো, তোর বোনটা কি সুন্দর আঁধার। কি কিউট তোর বোনটা! আঁধারের এখনো মনে পরলে হিংসায় বুক জ্বলে। চাদনী ওর কাছে না থাকলে সেটা আলাদা ব্যাপার। কিন্তু ওর সাথে থাকলে চাদনীর উপর কারো ছায়াও সহ্য করতে পারে না।আঁধার খুব হিংসাত্মক এই বিষয়ে। কেন যেন ও চাদনীর ব্যাপারে এসব মানতেই পারে না।আঁধার নিজের সফ্ট কর্ণার টা বোঝে।
কাজলরেখা পর্ব ১৯
ও তো অবুঝ বাচ্চা না। ছোটোবেলা থেকে ও চাদনীর সাথেই বড় হয়েছে, চাদনীর জন্য ওর আবেগটা সবচেয়ে বেশি। ওই যে শুধু ইগোর জন্য আবেগটা দেখাতে পারে না। বলদ মেয়েটা বোঝেও না। এই যে আঁধার যখন বাড়িতে থাকে, তখন সারাক্ষণ চাঁদনীর পাশ ঘেষে বসে থাকে৷ চাদনী ওঁকে কতো কি বলে,পিঞ্চ মারে, রুম থেকে পর্যন্ত বেরিয়ে যেতে বলে, নির্লজ্জ বলে, ক্যারেক্টারল্যাস বলে। আঁধার সত্যিই নির্লজ্জের মতো ওর কাছাকাছি থাকে তবুও। ওর পায়ে পায়ে ঘোরে, এতো কথা শোনার পরও। অন্য মেয়ে হলে ও ফিরেও তাকাতো না। কারো সাহসও হতো না ওঁকে এভাবে অবজ্ঞা করার। কতো মেয়েকে নিজের জন্য কাঁদিয়ে ছেড়েছে ও। চাদনী কেন বোঝে না ওর মূল্যটা। চাদনীর বোঝা উচিত। চাদনীর একটু ভালোবাসা উচিত আঁধারকে।