কাজলরেখা পর্ব ২২

কাজলরেখা পর্ব ২২
তানজিনা ইসলাম

চাদনী মুখ ফুলিয়ে বসে আছে৷ হাসনা আর বৃষ্টি দু’জন দু’পাশে বসেছে ওর। জানালার পাশে বসেছে সিয়াম। সামনের সিটে বসেছে রেহান তার পাশে ড্রাইভিং সিটে বসে রাত ড্রাইভিং করছে। হাসনা আর বৃষ্টি ফিসফিস করে কি যেন বলছে। চাদনী বুঝতে পারছে, ওরা রাতকে নিয়ে গসিপ করছে। চাদনী বিরক্তিকর শ্বাস ফেললো, এই একটা ছেলের মধ্যে মেয়েরা কী পেয়েছে, আল্লাহ? সিয়াম জানালার পাশে বসে কারো সাথে চোখ চ্যাটিং করছে। সামনে রাত আর রেহান মাঝে মাঝে কথা বলছে। কিন্তু কোনোদিকেই মনোযোগ দিতে পারছে না চাদনী।

ওর ভয়ে পেট মুচড়াচ্ছ। আঁধারের নিষেধ করা সব কাজ একেরপর এক করেই যাচ্ছে ও। প্রথমে কাজল দিলো, তারপর শাড়ি পরলো। এখন বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাচ্ছে, সাথে মরার উপর খরার ঘা হয়ে বন্ধুর ভাইও আছে, যার নাম পর্যন্ত বিষ আঁধারের কাছে। আবার সন্ধ্যার আগে বাড়িও ফিরতে পারবে না। চাদনীর মন কু ডাকছে। আঁধার ভাই মেরে ফেলবে আজকে ওঁকে, সত্যিই মেরে ফেলবে। বা জ্যান্ত কবর দিয়ে দিবে। চাদনী ওদের শক্ত করে মানাও করতে পারছে না, পাছে ওরা কষ্ট পায়। তাহলে তো ওঁদের ভাগের ভালোবাসাটুকুও পাওয়া হবে না চাদনীর। এ একজীবনে নিজের বাবা ছাড়া আর কারো ভালোবাসায় তো পায়নি চাদনী। ওঁদের ভালোবাসাটুকু ওর অমূল্য মনে হয়!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

রেহান সামনে থেকে বলবো
-“আগে কোথায় যাবি তোরা? রেস্তোরাঁ অর পার্ক?”
-“রেস্তোরাঁয় যাওয়া যাক।পুরোদিন খাওয়া হয়নি। খিদে পেয়েছে অনেক।”
হাসনা বললো। রেহান সম্মতি দিয়ে মাথা ঝাকালো।
দুপুরের লাঞ্চ টা করা হয়নি কারোরই। স্বাভাবিক সবারই অনেক খিদে পেয়েছে। রাত একটা থ্রি স্টার রেস্তোরাঁর সামরে গাড়ি থামালো।গাড়ি থামতেই সবাই নেমে পরে। হৈ-হুল্লোড় করে প্রবেশ করে রেস্তোরাঁয়।চাদনী ভয়ের চোটে ওঁদের মজায় ভাগ বসাতে পারে না। ওর বুকে চিন্তার পাহাড়।আজ ওর সাথে কী হবে সেটা ভেবেই মাথা ঘোরাচ্ছে ওর। রাত একটা বড় টেবিল বুক করলো ওঁদের জন্য। কিন্তু ও একবারো কারো দিকে তাকালো না, কারো সাথে কথা বললো না। শুধু গিয়ে বসলো রেহানের পাশে।

খাবার অর্ডার না দিয়ে সবাই কথাকাটাটি করছে। ওয়েটার ম্যেনু কার্ড হাতে নিয়ে দাড়িয়ে আছে। অনেক্ষণ ধরেই এদের কাহিণী দেখছে সে। কেউই কারো চেয়ে কম যায় না, একজন বলছে একটা খাবে।রাত গালে হাতে দিয়ে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে৷ চাদনী হেডডাউন দিয়ে বসে আছে। বাকি চারজন কথা কাটাকাটি করছে৷ রেহান বলছে সবাইকে একই ডিশ খেতে। এক্সট্রা কিছু খেতে ইচ্ছে করলে অর্ডার দিবে। কিন্তু বাকিরা মানছে না৷ বৃষ্টি বিরিয়ানি খেতে চেয়েছিলো সিয়াম ওঁকে ভুটকি ডেকেছে। এই নিয়ে কে কী খাবে সেই নিয়ে মারামারি লেগেছে।
রাত অতিষ্ঠ হয়ে রেহানকে উদ্দেশ্য করে বললো

-“যার যা লাগে অর্ডার দিতে বল। বিল আমি দিব।”
-“বিল দেওয়া নিয়ে সমস্যা না ভাই। সমস্যা হলো ওদের মতামত কখনো মিলে না। একজন উত্তরে গেলে আরেকজনকে দক্ষিণে যেতেই হবে।”
মুখ কালো করে বললো রেহান। চাদনী হামি তুলে বললো
-“তুই কিছু অর্ডার দে তো রেহান। খেয়ে বাড়ি যাই। এদের কাহিণী আর নিতে পারছি না।”
রেহান ম্যেনু না নিয়ে আবারো কথা-কাটাকাটিতে যোগ দিলো। চাদনী ম্যেনু কার্ড নেওয়ার জন্য হাত বাড়ালো, তখন-ই রাতও হাত বাড়ালো কার্ড নেওয়ার জন্য।দু’জনের হাত স্পর্শ হতে মুহুর্তেই দুজনে ছিটকে সরিয়ে নিলো হাত। চাদনী মাথা নুইয়ে ফেললো।রাত এতোক্ষণে গম্ভীর স্বরে বললো

-“শোনো, তোমরা ঝগড়া করো না। যথেষ্ট হয়েছে তোমাদের চিল্লাচিল্লি। সবাই দেখছে তোমাদেরকে। যার যেটা খেতে ইচ্ছে করে অর্ডার দাও, এখানে তো এতো মতবিরোধের প্রয়োজন নেই।”
বৃষ্টি আর হাসনা বললো না কিছু। নিশ্চুপ অর্ডার দিলো। চাদনীর দিকে তাকিয়ে বললো
-“তুই কী নিবি?”
-“তোরা যা খাবি!”

হাসনা অর্ডার দিলো সবার জন্য। মুহুর্তেই খাবার এসে টেবিলের কানায় কানায় ভর্তি হয়ে গেলো। হাতে গোণা কয়েকটা ডিশ ছাড়া প্রায় সব মেনুই অর্ডার দিয়ে ফেলেছে ওরা। রাত কি এক বলে ফেলেছে বিল ও দিবে, সে হিসেবে যা পেরেছে অর্ডার দিয়েছে ওরা।
সবার খাওয়া যখন শেষের দিকে, বৃষ্টি রেহান কে কনুই দিয়ে গুঁতো দিয়ে বললো
-“তোর ভাইয়ের সাথে ছবি তুলতাম। বল না।”
-“তোরা গিয়ে বল। কিছু বলবে না।”
-“নাহ। তুই বলবি।”
রেহান নাক কুঁচকে বললো
-“আমি কী বলতাম?”
-“বলবি, ভাইয়া আমার ফ্রেন্ডরা তোমার সাথে ছবি তুলতে চায়ছে!”
রেহান রাতকে ডেকে বললো
-“ভাইয়া ওরা ছবি তুলবে।”
রাত নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে তাকালো। রেহান বুঝলো না, রাত রাগ করলো কি-না, আজ একটু বেশিই বিরক্ত করে ফেলছে ও ছেলেটাকে।
হাসনা দাড়িয়ে বললো

-“একটা সেলফি তুলি ভাইয়া, সবাই মিলে?”
-“তুলো!”
হাসনা হাসলো। সবাই মিলে গ্রুপ ছবি তুললো কয়েকটা।হাসনা একা একটা ছবি তুলতে গেলো রাতের সাথে। রাত বসে থাকলো। কিছুই বলে না ওঁকে। এরপর বৃষ্টি ছবি তুললো, তারপর সিয়াম। সবাই একক ছবি তুললো ওর সাথে।রেস্টুরেন্টে বসা কয়েকজন মেয়ে উঠে এগিয়ে এলো রাতের সাথে ছবি তোলার জন্য। চাদনী গালে হাত দিয়ে দেখে ওঁদের কাহিণী। রেহান জানে চাদনী ছবি তুলবে না। মেয়েটা ওর অন্য দুই বন্ধু থেতে আলাদা। বেগানা, হারাম, হালাল নিয়ে একটু বেশিই ভাবে।তবুও সবাই যেহেতু ছবি তুলছে তাই বললো

-“তুই ছবি তুলবি না দোস্ত?”
-“নট ইন্টারেস্টেড!”
উদাস স্বরে বললো চাদনী। কিন্তু কথাটা শুনে ফেললো
রাত। বাঁকা দৃষ্টিতে দেখলো ও চাদনী কে। চাদনী চুপ করে গেলো। রাতের সবচেয়ে অ্যাটরেক্টিভ জিনিস হলো ওর চোখজোড়া।গভীর চোখের কুচকুচে কালো মণির দিকে তাকিয়ে যেকেও বিহ্বল হয়ে যাবে। চাদনী তাকিয়ে থাকলো কিয়ৎক্ষণ। চোখের পাপড়িগুলো বড় বড়। ছেলেদের চোখের পাপড়ি সাধারণত এতো ঘন থাকে না।চাদনী চোখ সরিয়ে নিলো। রেহানের দিকে তাকিয়ে বললো

-“তোর ভাইয়ের চোখগুলাে এমন কেন?”
-“কেমন?”
-“কেমন জানি! ভয়ঙ্কর!”
-“তাকাস না। সে অসীমতায় হারায় যাবি!ওই গভীরতায় যে তলিয়ে যায়, সে আর ফিরে আসতে পারে না।”
চাদনী অবুঝ দৃষ্টিতে তাকালো। রেহান বোকা বোকা হাসলো। ব্যাখ্যা দিয়ে বললো
-“আমার ভাইয়ের চোখদুটো অনেক সুন্দর রে চাদনী! যে চোখে দুঃখ বেশি থাকে সে চোখের সৌন্দর্য শব্দে বর্ণনা করা যায় না। মায়ায় পরে যাবি রে!”
-“এতো সহজ না।”
-“হুম। তোর ক্ষেত্রে কথাটা ঠিক আছে। তুই খুব কঠিন। ভাইয়ের মতো!”

আঁধার রাগে বোম হয়ে বসে আছে। বিগত দু’ঘন্টা ধরে ও টানা কল করে যাচ্ছে চাঁদনী কে। অথচ মেয়েটার কল রিসিভ করার কোনো নামই নেই।মাগরিবের আজান দিচ্ছে। এতোবার মানা করা সত্বেও মেয়েটা ঠিকই সন্ধ্যা পর্যন্ত বাইরে থাকলো। আবার কলও ধরছে না৷ অবজ্ঞা করছে ওঁকে। আঁধার কিছুক্ষণ ড্রইংরুম জুড়ে পায়চারি করলো। ওর পিছু পিছু চ্যাম্প হাঁটে। সেও বেশ চিন্তিত চাদনী কে নিয়ে। আঁধারের উল্টাপাল্টা চিন্তা মাথায় আসছে। এমনিতেই ও বেশি নেগেটিভ চিন্তা ভাবনা করে। চাদনী কল কেন ধরছে না? মেয়েটা তো এতো দায়িত্বহীন না। আঁধার প্রতিদিন ওঁকে কলেজে যাওয়ার জন্য রিকশায় তুলে দেয়। চাদনী একবার কলেজে পৌঁছে কল করে ওঁকে, আবার ছুটির পর কলেজ থেকে বেরিয়ে একবার কল দেয়। আঁধার নিজেই ওঁকে এসব বলেছে, যাতে ওঁকে চিন্তা করতে না-হয়। চাদনী আর যায় হোক, এসব অমান্য করেনি কখনো।

আজ এতোবার ফোন দেওয়ার পরও কল ধরছে না। আঁধারের এবার চিন্তা হয়। ওইদিন চাদনী সন্ধ্যায় ফিরে এসেছিলো, আঁধার খুব ঝেড়েছিলো ওকে। এখন তো সন্ধ্যা পার হয়ে যাচ্ছে। আঁধার গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পরলো চাদনীকে খুঁজতে। ওর কলেজের সামনে এসে দেখলো গেইটে তালা দেওয়া।আঁধার ওখানে দাড়িয়ে আরো কয়েকবার কল দিলে চাদনীকে৷ রিং হয়, তবে রিসিভ হয়না। কলেজ এরিয়ার অলিগলি, দোকান কোথাও খুঁজতে বাকি রাখলো না আঁধার। সবখানে ও খুঁজতে থাকে, ওর শ্যাম রঙের অপ্রিয় হয়েও প্রিয় একটা মুখ। যাকে ভালো বাসা আর কষ্ট দেওয়া নিয়ে নিজের সাথেই সবসময় দ্বন্দে থাকে আধার। আঁধারের অস্হির লাগে। বুকের মধ্যে কেমন যেন করে। হৃৎপিণ্ড লাফানোর গতি ও বাইরে থেকে শুনতে পায়। ভয়ে শ্বাস প্রশ্বাসের গতি ধীরে হয়। আধারের মনে পরে না কখনো ও এতোটা ভয় পেয়েছে। তবে আজ ওর বুক কাঁপছে। ভীষণভাবে খারাপ লাগছে ওর।

চাদনী কোথায় চলে গেলো? কোথায় চলে গেছে মেয়েটা? বাড়ি আর কলেজের রাস্তা ছাড়া তো আরর কিছু চেনেও না ও। এতো বড় অচেনা শহরে মেয়েটা কোথায় চলে যেতে পারে। আঁধার রাস্তার পাশে গাড়ি থামালো। স্টিয়ারিং এর উপর কপাল ঠেকালো।
ওর চাঁদটা খুব সরল! খুববব। ওর ইন্ট্রোভার্ট, অবুঝ একটা মানুষ। মানুষকে সহজে বিশ্বাস করে ফেলে। অতো মারপ্যাচ বোঝে না! ওর সরল চাদটাকে কেও একটু ভালোবেসে কথা বললেই মেয়েটা গলে যায়। আঁধার এখন কোথায় খুঁজবে ওঁকে। আঁধার হন্যহয়ে আশেপাশে খুঁজলো।
অসহায় গলায় আওড়ালো

-” চাঁদ!কোথায় চলে গেছিস বাচ্চা!কোথায় হারিয়ে গেছিস আমাকে ছেড়ে?আর কোথায় কোথায় খুঁজবো আমি তোকে?তোর কলেজ এরিয়ার অলিগলি কোথাও তো খুঁজতে বাকি রাখলাম না। কেন কল ধরছিস না আমার? কষ্ট দিই, তাই প্রতিশোধ নিচ্ছিস? সব কষ্ট একেবারেই দিয়ে ফেলছিস আমাকে! আল্লাহ! আমার ভয় লাগছে। ও তো এ শহরের কিছুই চেনে না। আমি ওকে কোথায় খুঁজবো আল্লাহ? ওঁকে একটু এনে দাও আমার কাছে। আমি আর কক্ষনো কিচ্ছু বলবো না ওঁকে। একটুও কষ্ট দেবো না। শুধু একবার ফিরিয়ে দাও।”

রাতের আঁধারে, রঙ বেরঙের লাইট দিয়ে সাজানো পার্কটাকে আরো বেশি সুন্দর লাগছে। মানুষে গিজগিজ করছে সবখানে। রাতেও পার্কে এতো মানুষ হয়, চাদনীর জানা ছিলো না। তবে আজ খুব ইনজয় করেছে ও বন্ধুদের সাথে। দোলনায় চড়েছে, স্লাইডে পিচ্ছিল খেয়েছে, ছবি তুলেছে। বাচ্চাদের মতো খেলেছে। আজকের সন্ধ্যাটা সারাজীবন মনের মধ্যে ফুটে থাকবে ওর।পুরোদিনটাই আজ অসম্ভব সুন্দর গেছে। আর এসব করতে করতে কখন যে রাত হয়ে গেছে ও টেরই পায়নি। সাথে এটাও ভুলে গেছে, একটা মানুষ উদগ্রীব হয়ে বাড়িতে ওর জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে। সে খুব বেশিই পজেসিভ চাদনীকে নিয়ে।

একটু কিছু উল্টাপাল্টা হলেই তার খুব চিন্তা হয় চাদনীকে নিয়ে।
পার্ক থেকে বেরিয়ে ওরা একটু ক্যাফিটোরিয়ায় বসলো কফি খাওয়ার জন্য। দোকানটা পার্কের পাশেই, নিউ লঞ্চ হয়েছে। চাদনী কী মনে করে, মাত্রই ফোনটা বের করলো।দেখলো ওর মোবাইল সাইলেন্ট আর আঁধারের নাম্বার থেকে ২৮০ টা কল এসেছে। টানা কল এসেছে শুধু। এক সেকেন্ডও বিরতি ছিলো না।চাদনীর মনে হলো ওর পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেছে। এই দুনিয়ায় আর নেই ও৷ এক্ষুনিই আজরাইল এসে ওর জান কব্জা করে নিয়ে যাবে।
মুহুর্তেই আরেকটা কল এলো। চাদনী কল রিসিভ করলো।

-“কোথায় তুই? কল ধরছিলি না কেন?”
আঁধারের কন্ঠ খুব শান্ত, স্বাভাবিক।অথচ চাদনীর ভয়ে কন্ঠ রোধ হয়ে এলো। কোনমতে উত্তর করলো
-“আমি, আমি আসলে….
-“তোর কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমি। কিন্তু তুই নাই। এড্রেস দে কোথায় আছিস তুই!”
-“আমি চলে আসবো আঁধার ভাই। বেশি দেরি হবে না।আমার বন্ধুদের সাথে ঘুরতে এসেছি! চলে আসবো একটু পর।”
-“আর কতো দেরি হতে বলছিস তুই? রাত আটটা খুব তাড়াতাড়ি? তোকে আসতে হবে না, আমি আসছি। তুই এড্রেস দে। ”

চাদনীর ভয়টা আরো বেড়ে গেলো। কি বলবে বুঝতে না পেরে কলটা কেটে দিলো ও। আটটা বেজে গেছে। অথচ ও টেরও পায়নি। এটা একটু বেশিই বাড়িবাড়ি হয়ে গেলো আজকে। আঁধার যে আজ কী করবে ওর সাথে। যা করবে বাড়িতেই করুক। এড্রেস দিলে এখানে এসেই না, উল্টাপাল্টা কিছু করে বসে।ওর বন্ধুদের সামনে নির্ঘাত ইজ্জত চলে যাবে ওর। কফি এখনো আসেনি। চাদনী উঠে দাড়ালো। হড়বড়িয়ে বললো
-“আমাকে যেতে হবে। আমি চলে যাচ্ছি!”
-“কফি টা খেয়ে যা!”
হাসনা কতো সুন্দর করে বললো! অথচ চাদনী ঝাঁঝালো স্বরে বললো

-” চুপ কর।বলেছিলাম আসবো না। জোর করে নিয়ে এলি। এখন বাড়ি থেকে ফোন দিচ্ছে আমাকে। আটটা বেজে গেছে, আরো দেরি করতে বলছিস তুই! তোর কফি তুই গেল!”
হাসনা মুখ ফুলিয়ে বসলো। রেহান বললো
-“একা যাবি? এখান থেকে তো গাড়িও পাবি না।”
-“কার সাথে যাবো তো! বাইরে দাঁড়িয়ে দেখি, যে করেই হোক আমাকে যেতে তো হবে।”
-“এই, তুই তো রাস্তাঘাট চিনিস না। তারউপর রাত হয়ে গেছে, একা একা যাবি কী করে। শোনা, না একটু বোস। আমরাও একটু পর বেরিয়ে যাবো। তোকে গাড়ি করে পৌছে দেবো চাদনী, বেশি সময় লাগবে না।”
-“লাগবে না। আমি দেখি গাড়ি পাই কিনা! একটু কেন, এক সেকেন্ডও দাঁড়াতে পারবো না আর!”
রাত কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো

-“তুমি একা যেতে পারবে না আমার যতটুকু মনে হচ্ছে। তোমাদের কে দায়িত্ব করে নিয়ে এসেছি আমি, একা ছাড়তে পারছি না!”
-“কিন্তু আমাকে এখনই বাড়িতে যেতে হবে ভাইয়া।”
-“পাঁচ মিনিট দাঁড়াও,আমি ক্যাব বুক করছি!”
-“ভাইয়া লাগবে না।”
-“একা যেতে পারবে না, কথাটা বোঝো। এতো রাতে একা ছাড়তে পারছি না আমি তোমাকে। তোমাদের রেহানের সাথে নিয়ে না এলে আমি এতো মাথা ঘামাতাম না!”
রাত এসব মুখে বলছিলো, সাথে সাথে ক্যাও বুক করছিলো চাদনীর। চাদনী গা ছেড়ে দাঁড়ালো। রাত দাড়িয়ে বললো -“এসো আমার সাথে, এক্ষুনি ক্যাব চলে আসবে।”
চাদনী রাতের সাথে ক্যাফিটোরিয়ার বাইরে বেরোলো। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করলো ক্যাব আসার। ঠান্ডা হাওয়া লাগাতে, শাড়ির আঁচল দিয়ে নিজের গায়ে জড়িয়ে নিলো।

অথচ ও জানতেও পারলো না, একজোড়া অগ্নি দৃষ্টি অবলোকন করছে ওঁদের। কাচ দেওয়ালের বাইরে থেকে আঁধার তাকিয়ে আছে নির্নিমেষ। ওর চোখদুটো অসম্ভব রকমের লাল। নাক ফুলাচ্ছে বারংবার। ঠোঁট কাঁপছে অবিরত। ও যদি পারতো, এই ক্যাফেটোরিয়ায় আগুন লাগিয়ে দিতো, জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিতো। ওর চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কপালের উপর ছিটিয়ে আছে।বিগত দু’ঘন্টা ধরে হন্যে হয়ে খুঁজেছে ও চাদনী কে। চাদনী জানতে পারবে, ওর পাঁজরে কী টনটনে ব্যাথা হচ্ছিলো? পা কাপছিলো, দাঁড়াতে পর্যন্ত পারছিলো না!এতোটা হাঁপিয়ে গেছে ও, যে নিশ্বাস পর্যন্ত বেজে বেজে বের হচ্ছে। আর সে মেয়ে এখানে…! আঁধার আবারো স্টিয়ারিং এর উপর কপাল ঠেকালো। এ রাগটা কমানো দরকার। বুকের ভেতর দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। এ আগুনের তাপ চাদনী সহ্য করতে পারবে না। ভস্ম হয়ে যাবে। আঁধার এতোটাও হার্ট করতে চাচ্ছে না চাদনীকে।
রাত চাদনীকে ক্যাবে তুলে দিয়েছে। গাড়ি ছাড়ার আগে বলেছে

-“সাবধানে যেও। পৌঁছে রেহান কে একটা কল করো, কেমন!”
চাদনী ঘাড় কাত করে সম্মতি। গাড়ি ছেড়ে দিলো। একসময় আঁধারের অ্যাপার্টমেন্টের সামনে পৌঁছেও গেলো। চাদনী দোয়া ইউনুস পড়তে পড়তে লিফটে উঠলো। ফ্লাইটের বেল বাজানোর আগে বুকে থুতু ছিটিয়ে নিলো। বেল বাজার সঙ্গে সঙ্গেই দরজা খুলে যায়। আঁধারের পরণে শার্ট আর জিন্স প্যান্ট। দেখে বোঝা যাচ্ছে বাইরে থেকে এসেছে বেশি দেরি হচ্ছে না।

আঁধার দরজা থেকে সরে দাঁড়ালো। চাঁদনী কে প্রবেশ করার জন্য জায়গা করে দিলো। চাদনীর মুখ দিয়ে কথা বের হয় না। আঁধার চাদনীর দিকে তাকালো। ওর আদল অনুভুতিহীন। চাদনী ভয়ে ভয়ে তাকালো ওর দিকে। আঁধার একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ওর মুখে রাগের লেশ মাত্র নেই, না আছে কোনো চিন্তা। শুধু উপর থেকে নিচ পর্যন্ত স্ক্যান করছে ওঁকে। চাদনী নিজের দিকে তাকিয়ে বুঝলো কতো বড় ভুল করে ফেলেছে ও। শাড়িটা পরেই চলে এসেছে। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে, জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে তুতলে বললো

-“আঁধার ভাই…
ব্যাস, আর একটা শব্দ উচ্চারণ করার সময় বা সুযোগ কোনোটাই হলো না ওর। ঝঙ্কার তুলে চড় পরলো চাদনীর গালো।চাদনী অবাক দৃষ্টিতে তাকালো আঁধারের দিকে। জীবনে প্রথমবার আজ মার খেয়েছে চাদনী, প্রথমবার কেও ওর গায়ে হাত তুলেছে। চাদনীর দৃষ্টি টলমলে হয়, আখিতে অশ্রুরা ভীড়ে নিমিষেই।ঠোঁট ফুলিয়ে কিছু বলতে চায়লো, কিন্তু কিছু বলার সুযোগ দিলো না আধার,তার আগেই ঠাস করে আরেকটা চড় বসালো চাদনীর গালে।পুরুষালী খরখরা হাতের শক্ত পোক্ত দু’দুটো চড় খেয়ে মাথা ঘুরে উঠলো চাঁদড়নীর । আঁধার আরেকটা চড় বসালো। চাদনী এবার তাল সামলাতে না পেরে ধুপ করে মেঝেতে পরে যায়। একবার, দুবার, তিনবার,চারবার কয়বার যে চাদনীর গালে আঁধারের শক্ত হাতের চড় পরলো তা আঁধার নিজেও গুণতে পারলো না।
রাগে হিতাহিত জ্ঞান শূণ্য হয়ে আঁধার শুধু চড় মারলো ওঁকে।শক্ত,ঝাঁঝালো গলায় চিড়বিড়িয়ে বললো

কাজলরেখা পর্ব ২১

-“রাত বিরেতে বেডা নিয়ে ঘুরতে যাস! শাড়ি পরে কাকে দেখাতে গিয়েছিলি? আমার কী অবস্থা হয়েছিলো,জানোস? আমি তোর চাকর? ফোন কেন ধরলি না? শাড়ি কেন পরলি? কেন পরলি বল? মানা করেছিলাম না? বলেছিলাম না সন্ধ্যার আগে বাড়ি আসবি, আমার চিন্তা হয়। কাজল কেন দিয়েছিস? কার জন্য দিয়েছিস? কার জন্য এতো সাজগোছ তোর? ওই ছেলেটা কে হয় তোর? কে হয় তোর ওই ছেলেটা? এতো রাত পর্যন্ত ওই ছেলের সাথে কী করছিলি তুই? উত্তর দে! উত্তর দে আমাকে। আমি খুন করে ফেলবো আজকে তোকে!”
ফুঁসতে ফুঁসতে, চিল্লিয়ে বলতে থাকলো আধার।অথচ চাদনীকে একটা প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সুযোগও দিলো না ও।

কাজলরেখা পর্ব ২৩

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here