কাজলরেখা পর্ব ২৩
তানজিনা ইসলাম
-“তুই আমারে ঠকাইলি রে চাঁদ। তুই কেমনে আমার সাথে বেইমানি করলি?আমার চেয়ে ওই ছেলেটা বেড়ে গেছে রে তোর কাছে?তুই একবারো আমার কথা ভাবলি না?একবারো তোর মনে আসলো না আমি কতটা অসহায় হয়ে যেতে পারি, তোকে খুঁজে না পেয়ে।আআাআাা…
তুই ওই ছেলের সাথে, ওই ছেলের সাথে ছি!আজ তুই সব সীমা অতিক্রম করে দিয়েছিস। আমি তোকে ছাড়বো না। এর শাস্তি তোকে পেতেই হবে। তুই নিজের জীবন দিয়েও আমার থেকে মুক্তি পাবি না।”
আঁধার রাগে কাঁপছে। ওর চোখ মুখ রক্তাভ লাল। ক্ষণকাল পরপর লম্বা লম্বা শ্বাস ফেলছে ও। চাদনী মেঝেতে দু-হাত ঠেকিয়ে কোনোমতে নিজেকে সামলে রেখেছে। ওর খোঁপা খুলে গেছে অনেক আগেই। চুলগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মেঝেতে। ড্রইংরুমে পিনপতন নিরবতা আবারো। চাদনীর ঠোঁট কেটে রক্ত গড়িয়ে পরছে।
আঁধারের হাত জ্বলছে। ওর শক্ত হাত লাল হয়ে উঠেছে জোরালো চড়ের বেগে, তাহলে চাদনীর গালের কী অবস্থা হয়েছে তা আঁধার ভাবতে পারছে না।চায়ছেও না ভাবতে। ওর শুধু মনে পরছে চাঁদনী আর রাতের একসাথে দাঁড়ানোর দৃশ্যটা। তারউপর চাদনী সেজেগুজে ছিলো, শাড়ি পরা অবস্থায়।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
যতবারই দৃশ্যটার কথা মনে পরছে, ততবারই জেদ উঠছে।মস্তিষ্কে প্যানিক করছে। আঁধার নিতে পারছে না।এতোগুলো থাপ্পড় মারার পরও রাগ কমছে না কোনোমতেই। কোনোভাবেই ও নিজেকে শান্ত করতে পারছে না। ও যে কতগুলো থাপ্পড় মেরেছে চাঁদনীর গালে সেটা ও নিজেও জানে না।একেরপর এক থাপ্পড় দিয়েছে শুধু, চাদনীর দিকে একবারো তাকায়নি।
চাদনী বহু কষ্টে শ্বাস ফেলছে। ওর শরীরের অবস্থা নাজুক।গালদুটো টমেটোর মতো লাল হয়ে আছে। যেনো গাল ফেটে রক্ত পরবে।আঁধারের পাঁচ আঙ্গুলের দাগ বসে গেছে।
চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কিছু মুখের উপর পরেছে।
আঁধার এগিয়ে গিয়ে চাঁদনীর দুকাধ চেপে ধরলো। ঝাঁকিয়ে বললো
-” শাড়ি কোথায় পেয়েছিস? কোথায় পেয়েছিস? বল আমাকে। বল। কে দিয়েছে তোকে এই শাড়ি?উত্তর দে! খোল এটা। খোল। আমি সহ্য করতে পারতেছি না। যে ড্রেস পরে গিয়েছিলি, সেই ড্রেস গায়ে নেই কেন? কোথায় সেটা?চুপ করে থাকিস না, উত্তর দে। কী করে এসেছিস তুই?বল আমাকে। আমার ভয় লাগছে চাদনী, কী করেছিস তুই? আমার বিশ্বাসের এই দাম দিলি!”
আঁধারের চিল্লানিতে চাদনী গায়ের ভর ছেড়ে দিলো। ও উত্তর দেওয়ার মতো অবস্থায় নেই। আঁধার সে অবস্থা রাখেনি ওর, দূরাবস্থা করে ছেড়েছে। চাদনীর নোস ব্লিডিং শুরু হয়।
প্যানিক অ্যাটেকের সমস্যা আছে ওর ছোটবেলা থেকে। স্ট্রেস, মানসিক চাপ এসব চাদনী নিতে পারে না। সেন্সলেস হয়ে যায়। আচমকা এমন আঘাত, ভয় চাদনী নিতে পারনি।আঁধার যত্রতত্র হামলা করেছে ওর উপর। ব্লাড দেখে আঁধারের মনে ভয় ঢোকে।অনেকগুলো চড় পরেছে চাদনীর গালে। ডান বাম, দুহাতে শুধু থাপড়িয়েছে। কিন্তু এতোটাও না যে নোস ব্লিডিং হবে।
আঁধার ওঁকে বুকের সাথে চেপে ধরলো। ওর হৃৎপিণ্ড খুব দ্রুত বেগে লাফাচ্ছে। ও নিজেও ভীষণভাবে হাপিয়ে গেছে। কম ধকল যায়নি ওর উপর। আঁধার জোরে জোরে শ্বাস ফেললো।চাদনীর গালে আলতো চাপড় দিয়ে বললো
-“চাঁদ, এই চাঁদ! চোখ খোল। আমার প্রশ্ন এখনো শেষ হয়নি! উত্তর দে। নয়তো আমার ছটফটানি শেষ হবে না!”
চাদনীর পক্ষ থেকে কোনো উত্তর এলো না। আঁধারের চোখ বেয়ে একফোঁটা জল গড়িয়ে পরলো ওর মুখের উপর। আঁধার হাতের উল্টোপিঠে চোখ মুছলো।
পাজাকোলে তুললো ওঁকে। চাদনীর নিস্তেজ মুখটা ওর বুকের সাথে লেগে যায়। রক্ত লাগে ওর শার্টে। আঁধার অসহায় ঢোক গিললো। ও এভাবে মারতে চায়নি মেয়েটাকে। ওর চাচা কোনোদিন একটা ফুলের টোকাও দেয়নি মেয়েটার গায়ে। সবসময় বুকের সাথে আগলে রেখে বড় করেছে।কিন্তু আঁধারের এমন রাগ লাগছিলো। নিজেকে সামলাতে পারছিলো না। একটা বাইরের ছেলে কেনো ওঁদের সম্পর্কের মধ্যে আসবে? কেন? কেন চাদনী আসতে দেবে? ওকে চাদনী ক্যারেক্টারলেস ডেকেছিলো, ওর অগণিত রিলেশনের কাহিনী শুনে।অথচ ও চরিত্রহীন হয়েও কখনো ওঁদের সম্পর্কের মধ্যে কাওকে ঢুকতে দেয়নি। শাবিহা কেও সাবধান করেছ সবসময়। চাদনী সেটা কেন করবে না?
এতো রাতে ওই ছেলেটার সাথে দেখে, মাথা ঠিক রাখতে পারেনি।
আজ আর চাদনীকে ওর নিজের রুমে নিয়ে গেলো না, নিয়ে গেলো আঁধারের রুমে। বেডে শুইয়ে, নাকের রক্ত রুমাল দিয়ে মুছলো। বুড়ো আঙুল দিয়ে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেখলো। অয়েনমেন্ট লাগিয়ে দিলো গালে, ঠোঁটে।
সবকিছু কেমন যেন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। ওঁদের মধ্যকার সম্পর্কটা আঁধার ঠিক করতে চাচ্ছে। যখনই আঁধার নিজেদের সম্পর্কের কোনো প্রোগ্রেস চাচ্ছে, চাদনীর
বিটলামি শুরু করছে।
বিছানার বিপরীত পাশে হাঁটুতে থুঁতনি ঠেকিয়ে বসলো আঁধার। অনেকটা সময় চেয়ে থাকলো, চাদনীর নিস্তেজ মুখের দিকে। ওর একটা প্রশ্নের উত্তরও পাওয়া হয়নি। শাড়ি কোথায় পেলো মেয়েটা? ও যে ড্রেস পরে গিয়েছিলো সে ড্রেস গায়ে নেই কেনো? কোথায় বদলালো? এতটা সাহস কখন থেকে হয়ে গেছে চাদনীর? ওর বন্ধুগুলো এসব সাহস দিচ্ছে ওঁকে? গেছে এক পোশাক পরে, এসেছে অন্য পোশাকে।
আঁধার এগিয়ে গিয়ে ওর গালে হাত রাখলো। চাদনীর পরণে লাল পাড়ের সাদা শাড়ি। সুন্দর লাগছে ওঁকে। অনেকটা সুন্দর লাগছে৷ আঁধার একবার চাদনীকে বলেছিলো ওঁকে সাদা কাপড়ে মানায় না। শ্যামলা রঙটা আরো ফোটে। আসলেই ফুটতেছে। তাতে আরো বেশি আকর্ষণীয় লাগছে ওঁকে। কাজলচোখে, চোখবন্ধ অবস্থায় একটা কালো গোলাপের মতো স্নিগ্ধ লাগছে। অথচ আজ প্রথমবার চাদনীর সৌন্দর্যে রাগ হচ্ছে ওর। বুক জ্বলতেছে। কার আকর্ষণ পাওয়ার জন্য চাদনী এতো আকর্ষণীয় করে সেজেছে? কার জন্য এতো তোড়জোড় ওর? আঁধারের জন্য তো না। ওর জন্য কখনো সাজেনি চাদনী। আঁধার মাথার চুল খামছে বসলো। রিংটোনের আওয়াজে ধ্যানভঙ্গ হলো ওর। নাম্বার না দেখে রিসিভ করলো আঁধার। ভেসে এলো আকিব শিকদারের চিন্তিত কন্ঠ
-“আঁধার, চাঁদের খোঁজ পেয়েছো?”
-“পেয়েছি!”
আঁধারের গলা কাপে।
-“কোথায় চলে গেছিলো ও? কল কেন ধরছিলো না আমার? এতো রাত পর্যন্ত বাইরে ছিলো কেন? আজ ওঁকে অনেক বকা দিব আমি।”
-“ও বকা খাওয়ার মতো অবস্থায় নেই চাচ্চু।”
আকিব শিকদার থমকালেন। আঁধারের রাগ সম্পর্কে খুব ভালো ধারণা তার আছে। চাদনীর জন্য হঠাৎই তার চিন্তা খুব বেশি বেড়ে গেলো, উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললেন তিনি
-“চাদনীর কী হয়েছে আঁধার? কী করেছো তুমি ওর সাথে?”
আঁধার কিছু বললো না। আঁকিব শিকদার বললেন
-“আঁধার, আমি মানছি চাদনী খুব জেদি। ওঁকে কখনো শাসন করিনি আমি। কিন্তু আমার একটা মাত্র মেয়ে আঁধার, ওর বয়স তো বেশি না।শুধু মাত্র বড় ভাইয়ার কথা রাখতে তোমার সাথে বিয়ে দিয়েছি আমি ওঁকে। এটা দেখা সত্বেও তুমি ওর সাথে বিয়ের দিন কীরকম খারাপ ব্যবহার করেছো। বাবা হিসেবে বড্ড হেয় হয়ে গেছি আমি। নিজেকে নিজে মাফ করতে পারতেছি না। ওর জন্য ভীষণ মন পুড়তেছে আমার। আমি শান্ত থাকতে পারছি না। আমার কীরকম যে লাগছে, কয়েকদিন ধরে। আমি বুঝতে পারছি তুমি ওঁকে সামলাতে পারছো না, বা চাইছো না।আমি আজকে রওনা দিচ্ছি ঢাকার পথে। আমার খুব চিন্তা হচ্ছে বিশ্বাস করো। ওঁকে নিয়ে আসবো! পরে যা হওয়ার হবে। ও আরেকটু বড় হোক। যখন থেকে ও নিজের ভালো মন্দ বুঝতে পারবে, তখনই আমি নিশ্চিন্ত হতে পারবো।”
আঁধার খুব শান্ত গলায় বললো
-“না। এসো না। তোমার চেয়েও বেশি ভালোভাবে সামলাতে পারবো আমি ওঁকে। বাচ্চাদের আদরের পাশাপাশি শাসনও করতে হয়। তুমি করোনি, ইট’স ইউর ফলট।বাট তুমি ওঁকে নিয়ে যেতে পারবে না। আমি ওঁকে যেতে দেবো না।”
-“কিন্তু চাদনী…
-“চাদনী ঠিক আছে। কিচ্ছু হয়নি ওর।”
-“আচ্ছা, একবার কথা বলাও ওর সাথে আমার৷ কোথায় ছিলো এতোক্ষণ ও। কেন আমার কল রিসিভ করছিলো না?”
আধার উত্তর না দিয়ে, অভিযোগ করে বললো
-“তোমার মেয়ে একটা কথা শোনে না আমার। এতো অবাধ্য।
এতো জেদি।ওঁকে বলবা আমার কথা যাতে একটু শোনে। এই ইট পাথরের শহরটা বড্ড খারাপ। তোমার মেয়ের সরলতা ওরা নষ্ট করে দেবে।”
-“আমি বলবো। ওর সাথে একবার কথা তো বলাও।”
-“ঘুমাচ্ছে ও!”
-“এই অসময়ে?”
-“হুম। কালকে কল দিতে বলবো। চিন্তা করো না। এভরিথিং ইজ ওঁকে।”
আঁধার কল কেটে দিলো।এভরিথিং ইজ নট ওঁকে।কিচ্ছু ঠিক নেই।ভেতরে ভেতরে কি চলছে তা শুধু ওই জানে।ওর মন কু ডাকছে। মনে হচ্ছে চাদনীর হয়তো জ্বর উঠবে। আঁধার অপেক্ষা করলো চাঁদনীর জ্ঞান ফেরার।চাদনী খুব ভয় পেয়ে, প্যানিক করেছে। ছোটবেলায় একবার এমন করেছিলো ওর সাথে। আঁধারের ইম্পরট্যান্ট একটা প্র্যাক্টিকাল খাতায় উল্টাপাল্টা একেছিলো চাদনী৷ তখন নিতান্তই চাদনীর বয়স আট। আঁধার ওঁকে ধাক্কা দিয়েছিলো। নিচে পরে কোমরে ব্যাথা পেয়েছিলো চাদনী। হাত কেটে রক্ত পরেছিলো।১০৪ ডিগ্রি জ্বর উঠেছিলো সেদিন রাতে ওর। আঁধার খুব বকা খেয়েছিলো ওর বাবা থেকে। কিন্তু আঁধারের রাগ হয়নি সেদিন আর। হয়েছিলো অপরাধবোধ। ওর দাদি আর মেঝোমা বাচিয়েছিলো ওঁকে, সাইড নিয়ে বলেছিলো চাদনী ওর ইম্পরট্যান্ট খাতায় হাত দেবে কেন? এরকম দস্যি মেয়ের এমন শাস্তিই হওয়া উচিত।
আঁধার সেদিন বুঝেছিলো বাড়িতে চাদনীর মূল্যটা। যার পুরোটাই শূন্য। বাড়ির কেউই ওঁকে তেমন কদর করে না। আকিব শিকদার সেদিন ব্যবসায়িক কাজে বাইরে ছিলো। চাদনীর খেয়াল রাখেনি কেও।ও জ্বরে কাতরাচ্ছিলো, কেও ওঁকে দেখতেও যায়নি। আঁধারের মা শুধু খাবার খাইয়ে, ঔষধ খাইয়ে দিয়েছিলো। এটুকু তার দায়িত্ব ছিলো। এরপর তিনিও নিজের সাংসারিক কাজে চাদনীর তেমন খেয়াল রাখতে পরেনি। আঁধার সে রাতে পুরো রাত চাদনীর পাশে বসে ছিলো। হয়তো অপরাধবোধে বা কিছুটা মায়া! আঁধার ওর মাথায় জলপট্টি দিয়েছিলো। ওর হাত ধরে জানিয়েছিলো, এই বাড়িতে ওর বাবা ছাড়া আরেকটা মানুষ ওঁকে নিয়ে চিন্তা করার মতো আছে। ও শুধু চাদনীকে একটু সাহারা দিতে চেয়েছিলো।চাদনী ছোটবেলা থেকেই ভীষণ উইক!কিছু হলেই অসুস্থ হয়ে পরে।নাজুক অবস্থা হয়ে যায়।
পরেরদিন যখন আকিব শিকদার ঘরে ফিরলেন চাদনী কে হসপিটালে ভর্তি করানো হলো। কারণ বাড়িতে এমন কেউই ছিলো না যে চাদনীর দেখা শোনা করবে। উনি আঁধার কে কিছুই বলেননি, কিন্তু মনে মনে বড্ড কষ্ট পেয়েছিলেন। আঁধার সেসময় এতো ভয় পেয়েছিলো, এরপর থেকে আঁধার কখনো আর চাদনীকে মারেনি। উল্টাপাল্টা কিছু বলেনি।বাট চাদনী প্রচুর কথা শুনতো ওর মেঝোমা আর দাদী থেকে।
আঁধারের চিন্তা ভাবনা গুলো খুব নেগেটিভ। পজিটিভ চিন্তা ও করতে পারে না বললেই চলে। তিল কে তাল বানিয়ে সেটা নিয়ে রিয়েক্ট করে ও। তারউপর ওর হুটহাট রাগ। নিজের রাগের উপর মাঝে মাঝে নিজেই বিরক্ত হয়ে পরে ও। কেও ওর কথা না শুনলে ও রেগে যায়, কাওকে কিছু বোঝাতে না পারলে ও রেগে যায়, কষ্ট পেলে মানুষ কাঁদে কিন্তু আঁধারের রাগ উঠে। মানুষের আছে টাকার গরম, বাড়ির গরম, গাড়ির গরম, আইফোনের গরম আর আঁধারের আছে শুধু মাথা গরম। এই হিট খাওয়া মাথাটা নিয়ে বড্ড সমস্যায় আছে আঁধার। কোনদিন যে রাগের চোটে মাথাটা কেটে ফেলে দিবে, ও নিজেও জানে না।
আঁধারের ভয় সত্যি করে দিয়ে চাদনীর ধুম জ্বর উঠলো। জ্বরের মাত্রা এতোটাই ছিলো যে, আঁধার ওর হাত ধরেই ওর ভেতরের উষ্ণতা অনুভব করতে পারছিলো। আঁধার ভীষণ চিন্তিত হয়ে পরলো। রাত বাজে এগারোটা। এখন ও চাদনীকে হসপিটালে নিয়ে যাবে কী করে? আঁধার উপর থেকে নিজেকে যতই স্ট্রং দেখাক, ভেতরে ভেতরে ও বড্ড ভিতু।এ শহরে চাদনীর মতো ওর নিজেরও কেও নেই। ওর বন্ধুরা এখন যে যার কাজে ব্যস্ত। ব্যস্ত না হলেও চাদনীর জন্য ও কারো সাহায্য এমনিতেও নিতো না। ওর চাচাকে বড় মুখ করে বলেছে না আঁধার, চাদনীর সব দায়িত্ব নেবে, সামলাতে পারবে ওঁকে। কথা রাখতে না পারলে কেমন হয়।
আধার এর একজন ডক্টর ফ্রেন্ড আছে ফারহান নামে। সে একজন মেডিকেল স্টুডেন্ট।আঁধার তাকে কল করলো। সে জানালো তার আসতে একটু সময় লাগবে, কিন্তু সে অবশ্যই আসবে। আঁধার অপেক্ষা করে।
চাদনীর শাড়ি টা বড্ড ফুটছে ওর চোখে। মেয়েটাকে জাগাতে হবে, এটলিস্ট শাড়িটা বদলাতে হবে ওঁকে।
যতই ওর ফ্রেন্ড ট্রিটমেন্ট করতে আসুক। তবুও চাদনীকে শাড়ি পরা অবস্থায় একটা ছেলের সামনে ছেড়ে দিতে পারছে না ও।
আঁধার ডাকলো চাদনীকে। মেয়েটার সেন্স নেই। পুরো শরীর অসার হয়ে আছে। আঁধার ভাবলো নিজেই ওর শাড়ি বদলে দেবে। আবার দু’পাশে মাথা নেড়ে না জানালো।ওর বিবেক ওঁকে বাঁধা দিচ্ছে। আবার ভাবছে, আঁধার তো ওর বাইরের কেও না। এখানে বিবেকের তাড়নার কী আছে? চাদনীর উপর ওর সম্পূর্ণ অধিকার আছে। হ্যাঁ, কখনো ও অধিকার খাটায়নি বা সে অবস্থা রাখেনি ওটা আলাদা বিষয়। আঁধার নিজেকে বুঝ দিলো।
চাদনীর আঁচল ধরতেই আঁধারের হাত কাঁপলো। ভেতর থেকে একটা সত্বা তীব্র প্রতিবাদ করে বাঁধা দিয়ে বললো ‘তুমি ওঁকে বউ বলে মানো না! তুমি কোন সাহসে অধিকারের বুলি আওড়াচ্ছো? তাকে যদি শাড়ি পরা অবস্থায় তোমার বন্ধু দেখেও তাতে তোমার কী?”
আঁধার উত্তর দিলো ‘আমার কী মানে? আমারই তো সবকিছু।বউ মানি না, এটা তো আমি চাদনীকে বলি, কিন্তু আমি আমাকে কী করে এ মিথ্যে বিষয়ে মানাবো।৩ কবুল বলার পুরাে চাঁদনীটাইতো আঁধারের হয়ে গেছে। চাঁদনীর শরীর, মন,ফুসফুস, কিডনি, লিভার সবই তো আঁধারের। ওর সাথে আমার বিয়ে হয়েছে, ও আমার বউ। ও আমার। শুধু আমার। আর কারো না। আর কারো হতে পারে না। ওর মন, দেহ, সবখানে আমার অধিকার আছে। ওর শরীরের উপর পুরো কব্জা টাই আমার। তুমি আমাকে বাঁধা দিতে পারো না।
সে আবার প্রতিবাদ করলো ‘তার যখন ঘুম ভাঙবে, তখন সে অবশ্যই তোমার থেকে কৈফিয়ত চায়বে। তখন তুমি কী বলবে তাকে?যে মানুষটাকে তুমি নিজের পরিচয়ে অন্যদের সামনে পরিচয় পর্যন্ত করতে পারো না, তাকে তুমি ছুঁতে পারো না। একজন স্বামী হলেও তার অনুমতি ছাড়া তার দেহে হাত দেওয়ার অধিকার তোমার নেই। একটা মেয়ের শরীরে উপর শুধু তার অধিকার থাকে, তার অনুমতি ব্যাতিত তার স্বামীরও না! অন্তত এখানে তুমি নিজের জেদ রচিও না।’
-‘এটা জেদ না। এটা আমার অধিকার। চাদনী কে কখনো আমি নিজের জেদ হিসেবে দেখিনি। ও আমার কাছে শুধু ই আমার নিজের একটা জিনিস। শুধু স্ত্রী বলে পরিচয় না দেওয়া, এটাই যদি সমস্যা হয়, তাহলে আমি পুরো দুনিয়ার সামনে বলে দেবো চাদনী আমার বউ।যার উপর একচ্ছত্র অধিকার শুধু আমার। আমার সাথে ওর বিয়ে হয়েছে। একটা বাইরের ছেলের সাথে ও যখন তখন ক্যাফিটোরিয়ায় বসতে পারে না। একটা বেগানা পুরুষের সাথে শাড়ি পরা অবস্থায়, রাস্তায় পাশাপাশি দাড়াতে পারে না।কেও চায়লেই ওঁকে আমার থেকে কেড়ে নিতে পারে না।
ও আমার! শুধুই আমার। ওর দেহ, মন ওর সবকিছুতেই শুধু আমার অধিকার আছে। আমি সেটা সবাইকে জানিয়ে দেবো৷ আমি ওর শাড়িটা জ্বালিয়ে দেবো। কিন্তু ওর গায়ে থাকা অবস্থায় তো সেটা সম্ভব না তাই না৷ তাহলে সেটা কেন অপরাধ হবে? ভেতর থেকে আর কোনো উত্তর এলো। আঁধার নিজের সাথে নিজের দ্বন্দ্বেই হাপিয়ে গেলো। ও বললো
-“তুমি কিছু বলো আমাকে?আমার কী করা উচিত? চাদনীর কী খুব বেশিই খারাপ লাগবে?”
উত্তর আসে না। আঁধার চাদনীর রুমে গিয়ে ওর ড্রেস নিয়ে এলো। শাড়ি বদলে কাপড় পরিয়ে দিলো ওঁকে। গলা পর্যন্ত ব্ল্যাঙ্কেট টেনে দিয়ে এসি ছেড়ে দিলো। চাদনীর কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বিরবির করে আওড়ালো
-“সরি! বাট এটা দরকার ছিলো৷ শাড়িটা আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। তুই রাগ করলেও আমার কিছু করার নাই। আমি কিছুই দেখিনি।”
আধার আগুন ধরিয়ে দিলো চাদনীর শাড়িতে। শাড়িটা যখন দাউ দাউ করে জ্বলা আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেলো, তখন আধারের ভেতরের আগুন নিভলো। কলিজায় পানি এলো ওর।
ডক্টর ফারহান যখন এলো, তখন রাত প্রায় বারোটা। সে অনেক দূর থেকে শুধু আঁধারের কলে চলে এসেছে৷ আঁধারের সাথে এক জায়গায় না পড়লেও ওর খুব ক্লোজ ফ্রেন্ড। চাদনীকে দেখে অবাক হলো সে ভীষণ। আঁধারের সাথে একা ফ্ল্যাটে একটা মেয়ে থাকছে।সে ভেবেছিলো আঁধারের হয়তো কিছু হয়েছে তাই জরুরি তলব করেছে তাকে। কিন্তু একটা মেয়েকে আশা করেনি সে।কিউরিওসিটি রাখতে না পেরে বললো
-“কে ও?”
-“কে হতে পারে?”
-“উমমম.. তোর বেটার হাফ!”
-“হাফ না। পুরোটাই আমার। আধার হাফ করে কিছু নেয় না।”
হাসলো সে। অভিযোগ করে বললো
-“বিয়ের দাওয়াতও দিলি না।”
-“হুট করে হয়ে গেছে। কেউই দাওয়াত পায়নি।”
-“তাহলে রোমিও, শেষমেশ বাঁধা পরলি। ক্লাসের একটা সুন্দরী মেয়েকেও তো মুরগী বানাতে বাকি রাখিস নি!ভাবীও খুব সুন্দরী!”
-“কটাক্ষ করছিস?”
-“সত্যিই সুন্দর। তোর যে রেসিসম দেখেছি আমি, বাপরে। কীভাবে আমারে চশমিশ বলে বলে খেপাতি। চোখে কম দেখতাম সেটা আমার দোষ ছিলো?”
-“না তো!”
-“এই পিচ্চি টাকে বিয়ে করেছিস ক্যান? দেশে আর মেয়ে ছিলো না?”
-“চাচাতো বোন। বাড়ি থেকে ধরে বেঁধে জুড়ে দিয়েছে।”
-“ভালোই। বাট শি ইজ কিউট।”
-“অতো প্রশংসা তো করতে বলিনি বাপ!”
চেকআপ করতে গিয়ে চাদনীর গালের দাগগুলো চোখে পরলো ফারহানের।আঁধারের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো
-” এভাবে দাগ হয়েছে কী করে? এই তুই মেরেছিস মেয়েটাকে?”
-“আমারে পছন্দ করে না , ইগো হার্ট করে কথা বলে।”
-“ইগো নিয়া তুই কবরে যাবি, দেখিস!”
-“অবশ্যই।”
-“তুই একটুও বদলালি না ভাই। একটা মানুষ এতোটা নিষ্ঠুর কেমনে হয়? মেয়েটারে কীভাবে মেরেছিস!”
-“কাহিণী না জেনে প্যাকপ্যাক করিস না। যেটার জন্য ডেকেছি সেটা কর। সেন্সলেস হয়ে গেছে।সেন্স কীভাবে ফিরবে বল!”
-“তোর সাথে থেকে যে এভাবে অক্ষত আছে সেটাই রক্ষে। কত্তবড় শয়তান তুই। তুই আমার বন্ধু না হলে এক্ষুনি নারী নির্যাতনের কেস করে একটা ডায়েরি লিখাতাম আমি।”
-“নারীবাদীদের মতো কথা বলিস না তো ভাই। ওরে কিভাবে সুস্থ করবো, সেটা বলে বিদায় হ এখান থেকে।”
-“তুই একটা ফালতু বিশ্বাস কর। তোর সাথে কোনো মানুষ থাকতে পারে না!”
-“পারে না, আমি জোর করে রাখি।”
ডক্টর ফারহান চলে যাওয়ার আঁধার বসলো চাদনীর শিয়রে।মেয়েটা আজ রাতে উঠবে না আর। আজকের রাতটা বড্ড চিন্তার আঁধারের জন্য। ও মুখ কালো করে চাদনীর চুলে হাত বুলালো। জল পট্টি দিতে দিতে ডাকলো
-“এই চাঁদ, চোখ খোল না এবার। আর কতক্ষণ! তুই রাগ করেছিস আমার উপর? বাট রাগ টা তো আমার করার কথা তাই না। আমার বউ রাত বিরেতে অন্য ছেলের সাথে ঘুরে বেড়ায়।
কাজলরেখা পর্ব ২২
এটা মেনে নেওয়া যায়, বল! তুই পারতি মানতে? আমি যদি এভাবে রাত বিরেতে অন্য একটা মেয়ের সাথে দাঁড়িয়ে থাকতাম,তোর কল রিসিভ না করে। তোর সহ্য হতো? আমি সবাইকে ছেড়ে দিয়েছি রে চাদনী, শুধু তোর জন্য। আমি তো এখন আমার ইম্পর্ট্যান্ট ক্লাস ছাড়া তেমন বাইরেও যাই না। বাড়িতে থাকি বেশিরভাগ সময়।
তুই আমার জন্য তোর একটা দিন সেক্রিফাইজ করতে পারলি না? জানিস আমার কেমন অবস্থা হয়েছিলো? পাগল পাগল লাগছিলো আমার। তুই একটা স্বার্থপর।”