কাজলরেখা পর্ব ২৪

কাজলরেখা পর্ব ২৪
তানজিনা ইসলাম

সুনসান, নীরব পরিবেশ! বাইরে পাখির কিচিরমিচির ডাক শোনা যাচ্ছে।চাদনী গভীর ঘুমে ডুবে আছে, ওর চোখের পাতা ভারী! গভীর ঘুম ভাঙলো ওর।
পিটপিট করে চোখ মেললো চাদনী।ওর মুখটা কিছুটা ঠান্ডা। অথচ শরীর উষ্ণ।ঘুমের রেশ কাটেনি এখনো ওর।নিজেকে ধাতস্থ করতে একটু অপেক্ষা করলো চাদনী। ব্ল্যাঙ্কেটে মোড়ানো ওর শরীর।চাদনী নিজের মুখের উপর হাত বোলালো।ঠান্ডা বরফ হয়ে আছে! ঠোঁটের কোণে চিনচিনে ব্যাথা! চারিদিকে ঘুটঘুটে আঁধার। চাদনী যেন তলিয়ে যাচ্ছে অতল সমুদ্রে।মৃদু ঠান্ডাও লাগছে!এসি চলছে হয়তো!

শুকনো ঢোক গিললো চাদনী।ঠাওর করতে পারলো না,এখন কোথায় আছে ও!নিজের অবস্থান সম্পর্কে অজ্ঞাত চাদনী।মাথাটা ভার হয়ে আছে ভীষণ। শরীরে একটু শক্তি নেই।চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে তাকালো চাদনী। জানালার উপর পর্দা টানানো, ফাঁকফোকর দিয়ে কোনোমতে একটুআধটু আলো উঁকি দিচ্ছে। চাদনী বুঝতে পারলো না ওর অবস্থান। নিভুনিভু আলোয় কোনোমতে বোঝা যাচ্ছে এটা ওর কক্ষ না।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

চাদনী চোখ বন্ধ করে ভাবে, আগের ঘটনা মনে করতেই ধরফরিয়ে উঠতে গেলে টের পেলো একটা পুরুষালি হাত সাপের মতো আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে আছে ওঁকে।চাদনী হাত সরাতে চায়লো, কিন্তু হাতের মালিক অন্য হাতে শক্ত করে সে হাত চেপে ধরলো ওর।চাদনী হকচকিয়ে গেলো। আঁধার ওঁকে টেনে নিজের বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। চাদনীর দুর্বল শরীর। এখনো জ্বর কমেনি। ও আঁধারের সাথে পেরে উঠবে না সেটা ওর জানা কথা, তাই ছোটার চেষ্টাও করলো না।

-“ঘুম হয়েছে? কতক্ষণ ধরে ঘুমাচ্ছিলি!”
চাদনী উত্তর দিলো না। আঁধার উঠে গিয়ে জানালার পর্দা সরিয়ে দিলো। ঘুম ঘুম চোখে আবারো বিছানার উপর এসে বসলো। চাদনীর কপালে হাত ঠেকিয়ে বললো
-“এখনো অনেক জ্বর।”

আঁধারের ব্যবহার কতটা স্বাভাবিক। এমন করছে, যেন কিছুই হয়নি। চাদনী অবাক দৃষ্টিতে তাকালো। মুহুর্তেই ওর বুকে পাহাড়সম দুঃখ এসে জমা হলো। ছেলেটা ওঁকে মানুষ বলে মনে করে না। ওর ব্যাথা লাগে না, কষ্ট হয় না, ও শুধু্ আঁধারের রাগের ভাগিদার হওয়ার জন্য জন্ম নিয়েছে৷ ওঁকে মেরে ফেললেও ও টু শব্দ করতে পারবে না। চাদনীর মন ভয়ে কুঁকড়ে আছে। কথা পর্যন্ত বেরোচ্ছে না মুখ দিয়ে। এতোটা ট্রমাটাইজ কখনো হয়নি ও। কখনো ওর বাবার কাছে ধমক পর্যন্ত খায়নি, মার তো দূরের কথা। সেখানে আঁধারের ব্যবহার কতটা পৈশাচিক ছিলো কাল রাতে। জানো*য়ারের মতো মেরেছে ওঁকে। অথচ এমন ব্যবহার করছে, যেন সব স্বাভাবিক ঘটনা ঘটেছে। ওঁকে মারাটা আহামরি কোনো ব্যাপারই না।যেন ও ফাসির আসামি। একবার নিজেকে জাহির করার সুযোগ পর্যন্ত পায়নি ও।
চাদনীর ঠোঁট শুকনো, মুখ কালো৷ আঁধার বোধহয় বুঝলো, চাদনীর মনের অবস্থা। গালে হাত দিয়ে বললো

-“এই চাঁদ, কথা বলবি না আমার সাথে? ভয় পেয়েছিস?”
চাদনী সরিয়ে দিলো আঁধারের হাত, একটু দুরে গিয়ে বসলো৷ চঞ্চল দৃষ্টি ঘুরিয়ে তাকালো আশেপাশে! ভীষণ অগোছালো একটা রুম দেখে বুঝতে বাকি রইলো না এটা কার কক্ষ। ওর সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে চাদনী জিজ্ঞেস করলো

-“আমাকে এই রুমে এনেছো কেন?”
-“কাল রাতে তুই অনেক অসুস্হ ছিলি! জ্বর ছিলো অনেক তোর। ইভেন এখনো আছে!”
-“তো? জ্বর হলেই বা কী? আমাকে আমার রুমে দিয়ে আসবা না? নিজে আসার মতো অবস্থায় তো ছিলাম না।”
-“তোকে কোলে করে নিয়ে এসেছি, সেটার জন্য ধন্যবাদ না দিয়ে জেরা করছিস! কি অকৃতজ্ঞ তুই চাঁদ!”
-“হু, আসলেই তো! একটা ধন্যবাদ তোমার প্রাপ্য। তুমি আমাকে একেবারে মেরে ফেলোনি। আধমরা করে হলেও, বাচিয়ে রেখেছো। পৃথিবীটা আরেকবার দেখার সুযোগ করে দিয়েছো। ধন্যবাদ তোমাকে।”
আঁধার মলিন হাসলো ওর দিকে। ঢোক গিলে বললো

-“আমি তোকে মারতে চাইনি।”
-“সেটা না বলে, এটা বলো মেরে ফেলতে পারোনি বলে দুঃখ লাগছে।”
-“নাহ!” দু’পাশে মাথা নাড়লো আঁধার।
-“আমার ভালো লেগেছে তোকে মারতে? তুই জানিস না, আমি রাগতে সামলাতে পারি না। রেগে যাওয়ার মতো কাজ করিস কেন! আমার দিকটা একবারো দেখবি না। আমি তো তোর খারাপ চাই না চাদনী। একটা কল অন্তত তুই ধরতে পারতি আমার। আমি তখন কি অবস্থায় ছিলাম আমি তোরে বুঝাইতে পারবো না। তুই কখনো আমাকে বুঝিসনি। আমার এখনো সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া বাকি কিন্তু!

চাদনী হাঁটুতে থুঁতনি ঠেকিয়ে বসলো। আঁধারের কথা কানে তুললো না। আঁধারের সাথে কথা বলতে বা ওর কথা শুনতে ভালো লাগছে না ওর। বুকের মধ্যে এখনো কেমন যেন করছে। কাল রাতটা দুঃস্বপ্নের মতো ছিলো ওর কাছে।
আঁধার চাদনীকে নিজের দিকটা বোঝানোর চেষ্টা করলো না। পুরোরাত ও সেবা করেছে চাদনীর। আলো ফোটার আগ পর্যন্ত ওর বালিশের কাছে বসেছিলো।
পুরো রাত চাদনীর পাশে বসে ওর কপালে জলপট্টি দিয়েছে, এসব দুঃখের কথা বলবে না ও চাদনীকে। ও কখনো চাদনীর সামনে ভালো সাজার চেষ্টা করেনি। চাদনীর সামনে জ্যান্টালম্যান হয়নি। ও কখনো ওর ভালোবাসাটা দেখায়নি। ও সারাজীবন চাদনীর কাছে খারাপ ছিলো, প্রচন্ড খারাপ ব্যবহার নিয়ে গেছে ও চাদনীর কাছে। চাদনী ওঁকে কোনোদিন মাফ করতে পারবে না। না করুক, আঁধার ওর ক্ষমা চায় না, ভালোবাসাও চায় না। আঁধার শুধু চায় চাদনী ওর সাথে থাকুক, ওর সব কথা শুনে চলুক।

চাদনীর মাথা ব্যাথা করছে প্রচন্ডভাবে। চুল টেনে ধরে মাথা নিচু করে বসলো ও।হঠাৎই নিজের দিকে চোখ পরতেই আঁতকে উঠলো।একি ওর শাড়ি বদলে গেলো কী করে?ওতো কাল শাড়ি পরেই এসেছিলো এখানে। ড্রেস তো গায়ে ছিলো না।চকিতে আঁধারের দিকে তাকিয়ে, ভয়ার্ত স্বরে আওড়ালো
-“একি!এই ড্রেসটা কখন পরলাম আমি!আমার শাড়ি কই?”
-“জ্বালিয়ে দিয়েছি!”
-“জ্বালিয়ে দিয়েছো?কেন?তার মানে ড্রেসটাও তুমি পরিয়ে দিয়েছো?”
-“হু, আমিই তো পরিয়ে দেবো। আর তো কেও নেই এখানে। তোর নেতা নিশ্চয়ই আসবে না তোর শাড়ি বদলাতে!”
আঁধার তাচ্ছিল্য করে বললো। চাদনী আঁতকে তাকালো ওর দিকে।বললো
-“কী বলছো নিজে জানো? আর কতোভাবে ছোট করবে তুমি আমাকে!এটা কেন করলে তুমি? আমার অচেতন অবস্থায় শাড়ি বদলে দিলে। আবার সেটা বলছোও। তোমার লজ্জা করছে না?”
আঁধার ভাবলেশহীন ভাবে বললো

-“না তো! লজ্জা কেন করবে? ইচ্ছে করে তো করিনি। তোকে অনেকবার ডেকেছিলাম, বাট তোর এতোটাই জ্বর ছিলো যে তুই সেন্সলেস ছিলি। আমার কী করার ছিলো বল!”
-“কিছু করতে না। কে বলেছে তোমাকে করতে। আমার অচেতন অবস্থার সুযোগ নিয়েছো তুমি। ছি!আমি তোমার থেকে এটা আশা করি নাই।”
-“সুযোগ নেওয়া বলতে কি বোঝাচ্ছিস তুই!সুযোগ নেওয়ার জন্য তোর অচেতন অবস্থায় তোর কাছে যাওয়ার দরকার নাই আমার। চেতনা থাকা অবস্থায়, কাছে গেলেও কিছুই করতে পারবি না। আমি যা করি সামনাসামনি করি বুঝছোস! আর সুযোগ নিলে এমন প্যাটের প্যাটের করার মতো অবস্থায় থাকতি না।সে অবস্থা রাখতাম না আমি তোর।”
চাদনী এবার কেঁদেই দিলো৷ অস্হির স্বরে বললো

-“তোমার কথাগুলো শুনতে আমার খুব খারাপ লাগছে, বিশ্বাস করো।আমি মানতে পারতেছি না।যতই তোমার সাথে আমার বিয়ে হোক না কেন, তারপরও তুমি একটা ছেলে। আজ পর্যন্ত কোনো ছেলে আমার হাতটুকু ধরতে পারে নাই আর তুমি?”
-“আমি আর অন্য ছেলে এক? নিজেই বলছিস বিয়ে হয়েছে আমাদের, আবার নিজেই কান্না করছিস আমি ছুঁয়েছি বলে। জাস্ট শাড়িটা বদলে দিয়েছি চাদনী। তোকে ছোঁয়ার সম্পূর্ণ অধিকার আমার আছে।তোর খারাপ লাগলেও আমার কিছু করার নেই। ট্রাস্ট মি আমি কিছুই দেখিনি!”
চাদনী কাঁদতে কাঁদতে বললো

-“কেন? তুমি কানা ছিলা সে সময়? তোমার সাথে এমন কেও করলে তোমার কেমন লাগতো? কেও যদি অনুমতি ছাড়া তোমার শরীরে হাত দিতো তখন তুমি বুঝতা কেমন লাগে!”
-“আমার সাথে এমন কেও করলে আমার ভালোই লাগতো। খুশি হোতাম। বাট অবশ্যই মেয়ে হলে। তোর মতো এভাবে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতাম না।”
-“আসলে তুমি আমাকে মানুষ বলে মনে করো না। আমার জন্য তোমার মনে এক আনা সম্মান নাই। তাই আমার ইজ্জতের পরোয়া করলে না তুমি।”
-“চাদনী ইয়ার। একটা সিম্পল বিষয় নিয়ে এভাবে রিয়েক্ট কেন করছিস তুই?

কাজলরেখা পর্ব ২৩

চাদনী ঘৃণিত দৃষ্টিতে তাকালো আঁধারের দিকে। আধারের চোখেমুখে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই। ওর মনে হচ্ছে এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। একজন স্বামী তার স্ত্রীর শাড়ি বদলে দিতেই পারে। এখানে তো অপরাধের কিছুই নেই। কিন্তু চাদনী মানতে পারছে না। আঁধার ওরে মানেই না বউ হিসেবে আবার কালকে গায়ে হাত তুলেছে। এসব না হলেও চাদনীর মাইন্ডসেট হয়নি এখনো স্বামী সংসার নিয়ে। তবুও ও আঁধারের সাথে তর্ক করতে পারবে না, আঁধারের চোপা খুব জোড়ালো৷ প্রতিটা কথা দম্ভ, অহংকারে মোড়ানো। আজ পর্যন্ত কেও ওর সাথে তর্কে জিততে পারেনি। আধার জিততে দেয়নি। ওর কাছে ও-ই সবসময় ঠিক, পার্ফেক্ট। বাকি পুরো দুনিয়া ভুল।

কাজলরেখা পর্ব ২৫

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here