কাজলরেখা পর্ব ৩৪
তানজিনা ইসলাম
চাদনী জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে।ট্রেন স্টেশন ছেড়ে এসেছে অনেক আগেই।এই জায়গাটিতে বসে আঁধারের দাঁড়িয়ে থাকা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলো চাদনী। আঁধার অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলো, কে জানে কেন! যতক্ষণ আঁধার কে দেখা যাচ্ছিলো, ততক্ষণ পর্যন্ত তাকিয়ে ছিলো চাদনী। আঁধার ওর তাকিয়ে থাকা দেখতে পায়নি।তবুও চাদনী বাইরে থেকে চোখ সরায়নি। ওর চোখ বেয়ে টুপ টুপ করে জল গড়াচ্ছে।বারংবার হাত দিয়ে মুচ্ছে ও। বাতাসের তোড়ে চুলগুলো উড়ছে। বিষাদে পরিপূর্ণ হৃদয়, একটা মানুষের সাথে থেকে যাওয়ার আকাঙ্খা। কিন্তু যতবারই তার মুখের বিষবাক্য, কালির ড্রাম, নিজের মুখ আয়নায় দেখেছিস, আমার লেভেলে আছিস তুই, তোর জন্য কতোবার আর লোকসমাগমে অপমানিত হবো আমি, এসব মনে পরে যায়, তখন সে মানুষটার অপমানের কারণ আর হতে ইচ্ছে করে না। কতকাল আর মানুষটাকে অপমান করতো ও? কতবার বন্ধুমহলে, প্রতিবেশীদের কাছে কালো বউ নিয়ে লজ্জিত হতো?
চাদনীও তো একটা মানুষ, আর যায় হোক মানুষের চামড়া গায়ে তো, ফসকা পরে যায়। সে ফসকা সারতে বহু যুগ পেরিয়ে যায়। কেও তাকে নিয়ে অপমানিত বোধ করছে, নিচু হচ্ছে, তার পরিচয়টা পর্যন্ত কারো সামনে দিতে লজ্জা পাচ্ছে এ আক্ষেপ, অসহায়ত্ব এই ছেড়ে চলে আসার অসহায়ত্বের চেয়ে কম নয় বরং বেশি। ও ইট পাথরের শহরে এক বুক স্বপ্ন নিয়ে ও সংসার করতে এসেছিলো কারো টেকেন ফর গ্রান্টেড হতে নয়। যতোবার ইচ্ছে ওঁকে ভালোবেসে তুলে নেওয়া যায় আর ইচ্ছে হলেই খেলনার মতো ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া যায়। চাদনী এতোটা ফেলনা হতে আসেনি।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আকিব শিকদার কেবিন বুক করেছিলেন দু’জনের জন্য। তবে কেবিনটা নিয়ে কিছু একটা সমস্যা হয়েছে।আরেকজন যাত্রী কেবিনটা নিয়েছিলো। কালেক্টর ভুলবসত দু’জন যাত্রী কে একই কেবিন দিয়ে দিয়েছে। যদিও সে যাত্রী এখনো এসে পৌঁছায়নি। আসবে কিনা সেটাও জানা নেই। তবে সে যদি আসে তবে তাকে কেবিনের ভাগ দিতে হবে। আর কোনো কেবিন খালি নেই। সে খুব ক্ষমতাশীল, প্রভাবশালী এসব বলে বলে কালেক্টর বেশ চিন্তায় পরেছেন। আকিব শিকদার বাইরে কথা বলতে গেছেন তার সাথে। একা তিনি কেবিনে থাকলে সমস্যা ছিলো না। আরেকজনকে নাহয় ভাগ দেওয়া যেতো। কিন্তু এখন চাদনী আছে৷ যাত্রী ছেলে! একটা ছেলের সাথে এখন কেবিন শেয়ার করবে তারা! এই নিয়ে ভীষণ বাকবিতন্ডা লেগেছে।
চাদনী অন্যমনস্ক হয়ে বসেছিলো। তক্ষুনি হুড়মুড়িয়ে আকিব শিকদার ঢুকলেন। চাদনী ওনার উপস্থিতি টের পেয়ে তড়িঘড়ি করে চোখ মুছলো। স্বাভাবিক হয়ে বসার চেষ্টা করলো। আকিব শিকদার ওর পাশে জায়গা করে বসলেন। চাদনী জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলো তার আগে আকিব শিকদার উদ্বিগ্ন স্বরে বললেন
-“কাদছিলে আম্মা?”
-“না তো কাঁদবো কেন?”
-“মিথ্যা কেন বলছো? বাবার থেকে কিছু লুকাতে পারবে না তুমি! তুমি বলো, তুমি যেতে চাও না? মন পুড়ছে তোমার? এখানে আসার সময় আমার জন্য কাঁদতে কাঁদতে এসেছো? এখন যাওয়ার সময় কার জন্য কাঁদছো?”
চাদনী কিছুক্ষণ বিমর্ষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো আকিব শিকদারের দিকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো
-“অনেকদিন ছিলাম তো। সবকিছুর কথা খুব মনে পরবে। আমার অনেকগুলো বন্ধু হয়েছিলো!”
-“নতুন বন্ধু? না, সে ছোটবেলার সিনিয়র বন্ধু?”
-“নাহ… চাদনী দুপাশে মাথা নাড়লো। বিষাদ কন্ঠে আওড়ালো
-“সে কখনো আমার বন্ধু ছিলো না। কোনো কালো মেয়ে তার বন্ধু হতে পারে না। মায়া টা একপাক্ষিক ছিলো বাবা৷সে আমারে তার নখের যোগ্যও মনে করে না। আমাকে নিয়ে সে ভীষণ সমস্যায় পরতো।”
আকিব শিকদার কপালে ভাজ ফেলে তাকালেন।উদগ্রীব হয়ে বললেন
-“মানে? আঁধার কী করেছে তোমার সাথে? তোমাকে কী বলেছে ও?”
-“উহু। কিছুই করেনি। সে তার সব দায়িত্ব পালন করেছে। তবুও, তার কিছুটা না, না অনেকটা। অনেকটা লজ্জা তো ছিলো আমাকে নিয়ে। সে বেস্ট কাওকে ডিজার্ভ করতো। সুন্দরী, শিক্ষিতা। এটলিস্ট আমার মতো কালির ড্রাম আর গাইয়া না। তুমি কেনো ওই সুন্দর ছেলেটার সাথে তোমার কালো মেয়ের বিয়ে দিলে বলো? আমার জন্য কী আর ছেলে পাওয়া যেতো না?কেন যোগ্যতা থেকে বেশি পাইয়ে দিতে গেলে। এখন তো আমি একূল অকূল দুই কূলই হারালাম। না পাওয়ার যন্ত্রণা তো আমি সহ্য করে নিতাম। কিন্তু পেয়ে হারানোর যন্ত্রণা আমি কীভাবে সইবো?”
আকিব শিকদার কথার খেই হারিয়ে ফেললেন। চাদনী জড়িয়ে ধরলো ওনাকে। ফুপিয়ে কেঁদে বললো
-“আমার খুব কষ্ট হচ্ছে জানো। খুব, খুব কষ্ট হচ্ছে। কীসের জন্য হচ্ছে বুঝতে পারছি না। আঁধার ভাইকে ছেড়ে চলে এসেছি বলে! না তোমার কাছে ফিরতে পারার খুশিতে! আমার ভাগ্যটা তো এমন না হলেও পারতো। আল্লাহ আমাকে একটু ফর্সা রং দিলেই পারতো। অন্তত আমার সংসারটা তো বেঁচে যেতো। দেখো কি বোকা আমি! ওই সংসারের জন্য কেঁদে ভাসাচ্ছি যেটা আমার ছিলোই না কখনো! কিন্তু ফর্সা হলে অন্তত ওই সংসার টা আমার হতো। আমার স্বপ্ন আমার আশা ভেঙে যেতো না। আল্লাহ আমাকে শ্যামলা কেন বানালেন? কেন এতো দুঃখ দিলেন আমার কপালে? আমাকে কেন সে ভালোবাসলো না? কেন বাবা কেন? বলো, বলো উত্তর আছে তোমার কাছে!”
আকিব শিকদার চাদনীকে জড়িয়ে ধরার শক্তি পেলো না। চাদনী হিচকি তুলে কাঁদছে। কান্নার তোড়ে কাঁপছে ওর শরীর। ওর কলিজা এফোড় ওফোড় হয়ে যাচ্ছে। আঁধার কে ও কখনো নিজের ভালোবাসাটা দেখানোর সুযোগ পায়নি। এতো অবজ্ঞার পর, সেটা দেখানো হলে চাদনী ছ্যাচড়ার পদবি পেতো। ভালোবাসা দেখানোটা তখন ভালোবাসা হতো না, হতো ছ্যাচড়ামো। আকিব শিকদার ওর মাথার উপর হাত রাখলেন। ওনার বুক কাঁপছে মেয়ের চিন্তায়। আঁধার আর চাদনীর মাঝে যে কখনো স্বাভাবিক সম্পর্ক ছিলো সেটা ওনার জানা কথা। অন্তত চাদনীর কথার টোনে সেটা বুঝতে পারতেন তিনি। কিন্তু চাদনী যে আঁধার কে এতোটা ভালোবাসতো সেটাতো কখনো টের পাননি তিনি। মনে হয়েছিলো দিন গড়াতে, দু’টো মানুষ একসাথে থাকতে থাকতে তাঁদের মধ্যকার সম্পর্কটা গাঢ় হবে। আঁধার হয়তো কোনো একদিন মেনে নিবে চাদনী কে। কিন্তু চাদনী নিজেই তো থাকতে চাচ্ছে না। যেখানে আঁধার ওঁকে আসতেই দিচ্ছিলো না। আকিব শিকদার বিমূঢ় স্বরে আওড়ালেন
-“চাদ! তুমি আঁধারের সাথে থাকতে চাও না?”
চাদনীর কান্না থেমে গিয়েছিলো। এমন প্রশ্নে আরো ব্যকুল হয়ে পরলো ও। আকিব শিকদারের দিকে উদগ্রীব, বিমর্ষ চোখে চেয়ে বললো
-“চাই তো। থাকতে চাই। কিন্তু.. সে তো চায় না!”
-“আঁধার তোমাকে আসতে দিচ্ছিলো না চাদনী!”
-“তো? এতে কী প্রমাণিত হয়? সে খুব ভালো অভিনেতা বাবা। খুব সুন্দর অভিনয় করে। তার অভিনয়ের জালে ফেসে যাবা তুমি! যখন মায়া বেড়ে যাবে, তখন তোমাকে ছুঁড়ে ফেলে দেবে।তুমি বলো,কালো হওয়া তো আমার অপরাধ ছিলো না। আমি শেষ হয়ে গেছি বাবা। আমি মরে গেছি। আমার যে দেহটা দেখছো তুমি, সেটা শুধু মাটির শরীর।এখানে হৃদয় নামের আর কিচ্ছু বাকি নেই। আমি আর ফিরবো না কখনো। তুমি বলো, আমাকে আর ফিরতে দিবে না। আমার সংসার করা হলো না,বাবা। এই একজীবন আমি ওই একটা মানুষটার নামে কাটিয়ে দেবো। আমার জীবনে আর কেও আসবে না। তবুও এই অপমান এই গ্লানি আমাকে তার কাছে ফিরতে দিবে না। আমি প্রতিদিন তার কথার আঘাতে মরেছি। এখন থেকে প্রতিনিয়ত তাকে ছাড়া মরবো।তবুও থাকবো না তার সাথে। একজন ভালো অভিনেতা ভালো প্রেমিক হতে পারে, স্বামী হতে পারে না। আমি তার খেলার পুতুল ছাড়া আর কিচ্ছু না। জানো কিছু কিছু মানুষ আমাদেরকে ছেড়ে দিতে চায়। কিন্তু তারা নিজ তাগিদে ছাড়ে না। কিন্তু তারা আমাদের সাথে এমন ব্যবহার করে, যাতে আমরা তাদেরকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হই।তখন কষ্টটাও আমাদের হবে আর দোষটাও। এই যেমন এখন দু’টোরই ভাগীদার আমি হলাম।”
আকিব শিকদারের বুকের উপর পরে কাঁদছে চাদনী। অনেকদিন পর বাবার বুকটা পেয়েছে সে কাঁদার জন্য। আঁধার ওঁকে কখনো দুঃখ ছাড়া হাসার কারণ দেয়নি। আবার কখনো কাঁদতেও দেয়নি। কাঁদার সাহারা হিসেবে নিজেকে দিবে তো দূরের কথা। কাঁদলেই ধমকাতো। ওর না-কি চাদনীর কান্না পছন্দ না। অথচ কাঁদার সব কারণ নিজেই বানিয়ে দিতো।
অনেক টা সময় অতিবাহিত হয়ে গেলো। চাদনী আকিব শিকদারকে ছেড়ে সোজা হয়ে বসলো। চোখের জলে চোখ ফুলে গেছে ওর। পাহাড়সম দুঃখ ও নিজের হৃদয়ে চেপে রেখেছিলো। ওই ফ্ল্যাটে নিজের এক চিমটি কষ্ট বা আবেগ ও আধার কে দেখায়নি। বলতে গেলে পাথর হয়ে থাকতো। অথচ ভেতরে ভেতরে কেমন যে লাগতো ওর! ও যে কতটা ভালোবাসার কাঙাল ছিলো কখনো তো বুঝলো না ছেলেটা। কতটা তড়পাতো ও আধারের ভালোবাসা পাওয়ার জন্য, আঁধার কখসো দেখতে চায়নি। নিজের আবেগ জাহির করে গেছে সবসময়। বেলা শেষে ওঁকে দোষ দিয়ে গেছে। কেও বুঝলো না ওঁকে। কেও না।
ট্রেনের দরজা থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে, দেওয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে দাড়িয়ে আছে রাত। খুব দ্রুত ট্রেন চলছে।
হাঁপাচ্ছে ও। শেষ মুহুর্তে এসে ট্রেন ধরতে পেরেছে। ওর গায়ে একটা ব্ল্যাক হুডি। মাথায় হুডির ক্যাপ কপাল পর্যন্ত টেনে দেওয়া। মুখের মাস্ক খুলে হাতে নিলো রাত। চোখ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস টেনে নিলো। হুডির সাথে আবার মাস্কও পরতে হয়েছে ও। মাস্ক পরার অভ্যাস নেই ওর। শুধু কেও যাতে চিনে না ফেলে এজন্য এতো পন্থা অবলম্বন।
পরিস্থিতি ভালো না।নির্বাচনের আগে তো একটুও না। রাজনৈতিক দলগুলো উন্মাদ হয়ে পরেছে ওর পিছনে। কি একটা অবস্থা! বেরিয়ে যে, বডিগার্ড ছাড়া ট্রেনে উঠবে সে শান্তিটুকুও নেই। সুহাশ অনেক আসতে চেয়েছিলো। ছেলেটা ওর পাশ ছাড়ে না কখনো।সারাক্ষণ ওর পায়ে পায়ে হাঁটে।ওর আগে ছেলেটা এসে দাঁড়িয়ে ছিলো, সেই বিকেল থেকে। অথচ ওর বাড়ি থেকে বেরোতে এতোটা দেরি হয়ে গেলো।
রাত হাঁটা ধরলো। কেবিন খুঁজতে থাকলো নিজের।তাড়াহুড়োয় ভুল বগিতে উঠে পরলো কি-না কে জানে! ভাগ্যবশত কালেক্টরের সাথে দেখা হয়ে গেলো ওর।
-“এক্সকিউজ মি? এই কেবিনটা কোনদিকে! আমি আসলে বুঝতে পারছি না!”
এই প্রথমবার ট্রেনে উঠলো রাত। প্রথমবারেই সব উল্টাপাল্টা হচ্ছে ওর সাথে।
কালেক্টর টিকেট হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ ভেবে বললো
-“আসুন আমার সাথে।”
আবার থেমে বললো
-“এটা তো একজনে বুক করে ফেলেছে স্যার!”
-“হুয়াট? এটা আমি বুক করেছি। টিকেট আছে আমার কাছে।”
-“সরি স্যার। এই কেবিনটা নিয়ে একটু সমস্যা হয়েছে। ভুলবসত একটা কেবিন দু’জন কে দিয়ে দেওয়া হয়েছে!”
রাত কিছুক্ষণ গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো তার দিকে।
-“ঠিক আছে, অন্য কেবিন ম্যানেজ করে দিন।”
-“অন্য কেবিন খালি নেই। আমি সিট ম্যানেজ করে দিচ্ছি আপনাকে!”
রাতের রাগ লাগলো অসম্ভব। আশ্চর্য! ও কেবিন বুক করেছে না। কোনোদিন ট্রেনেই চড়েনি ও। সিটে করে কী করে যাবে?
গম্ভীর স্বরে বললো
-“আপনি আমাকে কেবিন দেবেন? না, আমি অথোরিটির সাথে যোগাযোগ করবো?”
-“স্যার প্লিজ একটু বুঝেন!”
-“আপনি আমাকে বুঝেন। কেবিন ছাড়া আমার যাওয়া সম্ভব না।”
-” আচ্ছা, আপনি শান্ত হোন।আপনি দেরি করে এসেছেন, যারা আগে এসেছে তাদের কেবিনটা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের সাথে কথা বলতে হবে আমাকে।”
-“ঠিক আছে। আমাকে যেকোনো একটা কেবিন দিলেই হচ্ছে।”
-“কেবিন নিয়ে কী সমস্যার সমাধান হয়েছে?”
আকিব শিকদার তাকালেন চাদনীর দিকে। চাদনী বাইরে তাকিয়ে আছে,ও ভাবেই প্রশ্ন করেছে। অনেক্ক্ষণ তাদের মধ্যে কোনো কথা হয়নি।
-“সে যাত্রী যদি আসে, আমাদের কেবিন শেয়ার করতে হবে।”
চাদনী দ্রুত ফিরলো আকিব শিকদারের দিকে। বিমূঢ় স্বরে বললো
-“একটা ছেলের সাথে কেবিন শেয়ার করতাম! ছয় ঘন্টা? বাবা সিরিয়াসলি! আমার প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে। আমি বসে যেতে পারবো না।”
-“চিন্তা করো না। আমি ব্যবস্হা করছি। নিশ্চিন্তে ঘুমাও।”
-“তুমি একটু কেয়ারফুলি কেবিন বুক করবা না!”
-“আমি কোনোদিন ট্রেনে চড়েছি, আম্মা? আর কেয়ারফুলি আমি কেন বুক করবো! এটা যারা টিকেট কনফার্ম করেছে তাদের দোষ।”
-“ধুর! এর চেয়ে ভালো গাড়ি করে চলে যেতাম। ট্রেনে চড়ার অভিজ্ঞতা নিতে গিয়ে যে এমন হবে কে জানতো!”
-“তুমি চিন্তা করো না। আমরা কেবিন শেয়ার করবো না!”
-“হুম।”
দরজায় ঠকঠকানির আওয়াজ শুনে আকিব শিকদার দরজা খুলে বাইরে গেলেন।কালেক্টর বড্ড অনুনয় করে বললো
-“স্যার, অন্য সে যাত্রী এসেছেন।যিনি এ কেবিনটা বুক করে ছিলেন। জানি আমাদের দোষ! তারপরও যদি একটু স্যাক্রিফাইজ করেন!”
-“আমি কোনো স্যাক্রিফাইজ করতে পারবো না, দুঃখিত। যদি আমি একা হতাম, ওনার সাথে কেবিন শেয়ার করতে আমার কোনো সমস্যা ছিলো না। কিন্তু ভেতরে আমার মেয়ে আছে। এবং আমার মেয়ের সেফটির কথা ভেবেই আমি কেবিন নিয়েছিলাম।সেখানে একটা যুবক ছেলেকে আমি আমাদের সাথে রাখতে পারিনা।”
রাত বুকের সাথে দু-হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে ছিলো। বিরক্তিতে সর্বাঙ্গ তেতে আছে ওর। এতটা জঘন্য দিন, আজকের দিনটা। কিচ্ছু ঠিকঠাক হচ্ছে না। রাতও তাল মিলিয়ো সাফসাফ জানিয়ে দিলো
-“আমিও কারো সাথে কেবিন শেয়ার করতে পারবো না!”
আকিব শিকদার তাকালেন ওর দিকে। লম্বা একটা ছেলে। কপাল পর্যন্ত হুডির ক্যাপ টানা। চোখে মুখে গম্ভীর ভাব।
কালেক্টর বেশ সমস্যায় পরে গেলেন। মানুষ কেবিন নেয়ই প্রাইভেসির জন্য। নয়তো সিটই নিতে পারতো। এখন উনি আরেকটা কেবিন কোত্থেকে এনে দিবেন।
আকিব শিকদার ফট করে বললেন
-“তুমি একা একটা ছেলে, তোমার কেবিন লাগছে কেন? সিটে করে যাও, তোমার কিসের প্রাইভেসি!”
রাত কপালে ভাজ ফেলে তাকালো। আজব তো! এখন কিসের প্রাইভেসি ওনাকে বলতে হবে! তবুও বেয়াদবি না করে, স্বাভাবিক স্বরে বললো
-“আমার ট্রেনে চড়ার অভ্যাস নেই আঙ্কেল। আর প্রতিটি মানুষেরই নিজস্ব কিছু প্রাইভেসি থাকে। এখানে তো জেন্ডারের পার্থক্য নেই। মেয়েদের প্রাইভেসি থাকতে পারে, ছেলেদের থাকতে পারে না?”
আকিব শিকদার কিছি বললেন না। কালেক্টর হাল ছেড়ে দিয়ে বললো
-“কে কেবিনে থাকবেন, সেটা আপনারাই ডিসাইড করে নিন।”
চলে যেতে নিলে রাত বাঁধ সাধলো।শ্লেষাত্মক স্বরে বললো
-” আমাকে একটা জায়গা করে না দিয়ে আপনি গা-ছাড়া ভাবে চলে যাবেন তাতো হতে পারে না! আপনার চাকরির চিন্তা করুন। এতোটা ভোগান্তি তো আমি ডিজার্ভ করি না।”
কালেক্টর মাথায় হাত দিয়ে বললো
কাজলরেখা পর্ব ৩৩
-“আপনারা একটু কম্প্রোমাইজ করেন না ভাই। তাহলেই তো হয়।কেবিন শেয়ার করলে কী সমস্যা?”
আকিব শিকদার বললেন
-“অনেক সমস্যা! আপনাকে বলতে হবে।”
-“আঙ্কেল কেবিনটা আমিও বুক করেছি।”
-“সো হুয়াট! তুমি আগে আসতে পারোনি।”
-“কিন্তু আমার কাছে এ কেবিনের টিকেট আছে।”
-“কিন্তু আগে আমরা এসেছি।”
-“আশ্চর্য! আপনি বারবার একই কথা বলছেন কেন!”
রাতের মন চায়লো কালেক্টরের মাথা ফাটিয়ে দিতে। অনেকটা সময় একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকার পর অবশেষে আকিব শিকদার হার মানলেন। রাতও বাধ্য হলো কেবিন শেয়ার করতে। নয়তো ছয় ঘন্টা সিটে বসে যাওয়া সম্ভব না।
