কালকুঠুরি পর্ব ১
sumona khatun mollika
২০১৬মে,
— আরেএ,,এই যে,কে?? কে আপনি?? আমার হাত ছাড়ুন বলছি,, নইলে কিন্তু আমি চেঁচাবো।।
– চুপ করে চলো আমার সাথে।
সামনে থেকে একটা অজানা ছেলে এসে টেনে নিয়ে যাচ্ছে মাহা কে । আরো কয়েকজন ছেলে। প্রাইভেট শেষে বাড়ি ফিরছিল মাহা আর তিশা। তিশাদের বাড়ি আগে আসে মাহাদের পরে। বেশ আরেকটু হেটে যেতে হয় একা। তাদের এক সিনিয়র মাহাকে বেশ পছন্দ করে। বেশিরভাগ দিন মাহাদের পিছু নেয়। আজ নেই।
মাঝরাস্তায় ৫ কি ৬ টার মতো বখাটে ছেলেরা স্মোক করছিল। তাদের মধ্যে দুটো ছেলে মাহার পিছু করছে বেশ কিছু সময় ধরে। হাবভাব বেশ সুবিধা মনে হচ্ছিল না। তাছাড়া তাদের মধ্যে একটা ছেলে, কিছুদিন আগে একটা মেয়ে কে তুলে নিয়ে খুন করেছিল।
মাহা বেশ দ্রুত পা চালালেও তাদের চোখ এড়াতে পারলোনা। ছেলেদুটো প্রায় তার কাছাকাছি চলে এসে মাহার হাত ধরে টানাটানি করতেই,, একটা অচেনা অজানা যুবক এসে সামনে দাড়ালো। বখাটে দুজন হাত ছেড়ে দিতেই,, যুবকটি মাহার হাত ধরে টেনে দ্রুত পায়ে সামনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মাহা তখনি যে ভয় পেয়েছিল! আবার এই ছেলেটার কান্ডে আরো ভয় লাগছে। গলির কিছু সামনে আসতেই,, মাহা ঝাকি দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিল। লাল শর্ট পরা, কুনুই পর্যন্ত হাতা গুটানো,, ডিজাইন করে কাটা চুল তাতে আবার দুটো বিট দেয়া,, অন্যান্যদের ছাপরি লাগে। তবে তাকে বেশ সুট করেছে। রঙচটা জিন্সের প্যান্ট পরা। মোটামুটি চকচকে গায়ের রঙ।উজ্জ্বল শ্যামলা চোখে কালো সানগ্লাস। হাতে ঘড়ি।
সে ঘুরে তাকাতেই মাহা বলল,,,
— কে আপনি?? হাত ধরে টেনে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিলেন?
— তোমাকে বাচানোর চেষ্টা করছিল। ছেলেগুলো ভালো নয়। একা একা চলাচল কোরোনা এই পথে। জনমানবহীন রাস্তা, দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এমনিতে কাওকে বাচাইনা তবে,,
— কিন্তু কে আপনি এলাকায়তো আগে দেখেছি বলে মনে হয়না।
— আবু সালার সিকান্দার এর ছেলে,, এই রাস্তায় কমি আসা হয়।
— আবু সালার সিকান্দার মানে!! আপনি মেয়র এর ছেলে? সিয়াম সিকান্দার?
— না,, সামির সিকান্দার। ছোট ছেলে,, সামির সিকান্দার।
— ওহ। সাহায্যের জন্য ধন্যবাদ।
— বাড়ি যাও।
জ্বি বলে মাহা সামনের দিকে হাটা দিল,, সামির আবার পিছু ডেকে জিজ্ঞেস করল,,,
— ও বোরখাওয়ালী মেডাম শোনো মেয়ে?? তোমার নাম কি?
পিছে ঘুরে মাহা বলল,,
— মাহাদিবা ফারনাজ মাহা।
সামির মাথা দোলাল। মাহা উল্টো ঘুরে চলে গেলে সামিরো বাকা হেসে উল্টো পথে পা বাড়ালো।
তারপর সোজা বাইক ছুটিয়ে রোড নাম্বার ১৩ তে চলে গেল। আলিশান এক আধুনিক ও পুরোনো আমলের মিক্স বাড়ির প্রাঙ্গন পেরিয়ে বাইক দাড় করিয়ে,,সানগ্লাস মাথায় তুলে ঠোটের সিগারেট টা আঙুলে ধরে, চাবি ঘুরাতে ঘুরাতে বাড়ির ভেতরে ঢুকে সোজা সিড়ির দিকে পা বাড়ালো। ,,,
ফর্সা ছিমছাম পাতলা গড়ন এর সুন্দরি এক মেয়ে ছুটে এলো তার নাম ইনায়া। সামিরের এর চাচাতো বোন। মনে মনে সামিরকে ভিষণ পছন্দ করে সে। সামির তাকে দেখে ভ্রু নাচিয়ে অট্টহাসি দেয়।
— কিরে ইনু ??
— কোথায় গেছিলে সামির ভাই?
— লাইন মারতে। যাবি সাথে?
— আপনি নিলেতো জাহান্নামেও যাবো।
— ঢং!! যা ভাগ, এক গ্লাস পানি নিয়ায় যাহ।
তার ওপরে উঠে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে মুখে একরাশ হাসি নিয়ে।
গোসল সেরে বেরিয়ে সামির আয়নার সামনে দাড়িয়ে চুলগুলো মুছতে মুছতে বাকা হেসে নিজেই নিজেকে জিজ্ঞেস করল,,
— আসলেই কি আমি এতো ভালো!! বাব্বাহ!! মেয়েটার চোখদুটো দেখতে ভারি সুন্দর ছিল। জোড়াভুরুও না ছাড়াভুরুও না। বাঙ্গিমারা ভুরু হাহা। মাহা।
মাহা যেহেতু পর্দা করে, তার চেহারা কেও সহজে দেখতে পায়না ।
ইনায়া নিজের ঘরে ,, ফোনে সামির এর ছবি বের করে,, বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে পরে। ছোট পিঠ অবধি রেশমি চুলগুলো ছরিয়ে যায় বিছানায়। ছবিটাতে হাত বুলিয়ে গান গায়,,
রুক্ষ এলোমেলো চুলগুলোয়,
মনটা চাই যেনো,হাত বুলোয়,
দু’হাতে আদর করি,মুখটাকে,
হৃদয়ে বেঁধে রাখি সুখটাকে ।
তোমাকে দেখি শুধু না ফেলে পলক
হেই যুবক ।
রং চটা জিন্সের প্যান্ট পরা,
জ্বলন্ত সিগারেট ঠোঁটে ধরা,
লাল শার্ট গায়ে তার বুক খোলা,
সানগ্লাস কপালে.আছে তোলা,
রাখনা কেন ঢেকে ঐ দুটি চোখ,
হেই যুবক ।
হায়,, হায়,, ,, সামির সিকান্দার, কবে আপনাকে নিজের করে পাব! আরতো সহ্য হয়না ইশশহ!!
মাহা বাড়িতে ঢুকতেই তার ওপর হামলে পরে চাচি আছমা বেগম। কটু কথায় গরম করে তোলে আবহাওয়া।
— এই বান্দী মাগি!! বাইরে কোন ভাতারের সাথে ভাব মারাতে গেছিলিরে! কলেজ কখন ছুটি হয়!! কাল থেকে আর কলেজ যেতে হবেনা তোকে। যা গিয়ে ৫ মিনিটে বাসনগুলো ধুয়ে দিবি। নয়ত আজ তোকে গেলাব দাড়া।
বাপমা হারা মাহা কে বড্ড ভয়াবহ নির্যাতন করে চাচি আর চাচাতো বোন টা। চাচা বিদেশ থাকে। বাড়ির সবার খোজ নিলেও মাহার খোজ নেয় মাসে একবার কি দুইবার। মৃত্যুযাত্রী ভাইকে কসম কেটেছিলেন যে মাহাকে পড়াশোনা করাবেন। তাই জবরদস্তি তাকে সহ্য করে সবাই। চাচাতো ভাই মুহিব টা একটু অন্যরকম। সে অনেক আগে থেকে মাহাকে ভালোবাসে। অপেক্ষা শুধু মাহার ইন্টার পাশের তারপর জোর করে হলেও মাহাকে বিয়ে করতে চায় মুহিব। মাহার প্রতি মুহিবের আচরণও খুব সুন্দর। মুহিব থাকলে চাচির অত্যাচার কিছুটা কমে।
থালা বাসনগুলো ধুয়ে,, কাপড়গুলো কেচে ছাদে শুকোতে দিয়েসে,, ঘরবাড়ি মুছে গোসল শেষে এসে পাতিলের তলার পোড়া ভাত আর ঘাটাঘুটা তরকারি দিয়ে খেয়ে ঘরে গিয়ে পড়তে বসে মাহা। তার জীবনের লক্ষ্য এখন একটাই তাকে যেইভাবেই হোক ল নিয়ে পড়তে হবে। বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে হবে। চোখের জল মুছে আবারো পড়ায় মন দেয় মাহা। বাইরের কোনোকিছু মনে থাকেনা। সামির সিকান্দার এর কথাও মনে রইলোনা। ,,
কেটে যায় ৯ মাস।মিড টেস্ট পরীক্ষার ফলাফল দিয়েছে আজ। বরাবরের মতোই মাহা ফাস্ট হয়েছে। হঠাৎ বাইরে শোরগোল শুনতে পাওয়া গেল। একদল ছেলে তুমুল মারামারি করছিল। সেই মুহূর্তে সিয়াম সিকান্দার সেখানে পৌছতেই সব বন্ধ হয়ে যায়। কিছু সময়ের মধ্যেই সে পরিস্থিতি সামলে ফেলে। সে মাহাদের সিনিয়র। সুদর্শন চেহারা। মিষ্টভাষা দেখে মাহার তাকে খুব ভালো লাগে। তবে সে কখনো সিয়াম কে নিয়ে বেশি ভাবেনা। তার মতো মেয়ের সিয়ামের মত ছেলেকে নিয়ে ভাবা উচিৎ না।
সিয়াম সিকান্দার তার বাবার সবচে আদরের সন্তান। এলাকার সবার পছন্দের। মাহা কেন বাদ যাবে।
সিয়াম এসে তাকে প্রথম হওয়ার শুভেচ্ছা জানিয়ে যায়। মাহা এক পলকে তাকিয়ে রয়। সামনাসামনি কখনো দেখেনি সিয়ামকে সেভাবে। তবুও সে বুদধিমতি। তার জীবনের একটাই লক্ষ্য যেকরেই হোক সে লঅ নিয়ে পড়বে। বাবা মায়ের স্বপ্ন পুরণ করবে। একদিন না একদিন ঠিক চাচির অত্যাচার থেকে মুক্তি পাবে।
রাজশাহী ভার্সিটির শিক্ষক সহ সবাই মাহাকে বেশ পছন্দ করে। এই যুগের হয়েও মেয়েটা কিসুন্দর শালীন ভদ্র আর স্মার্ট।। হঠাৎই মাহার চোখ যায় ভার্সিটির সাবাস বাংলাদেশ স্মৃতি স্তম্ভের সামনে।
একদল বখাটে মতো ছেলের দল বাইকের ওপর বসে জুনিয়র দের রেগ দিচ্ছে। একজনকে কানে ধরিয়ে উঠবোস করাচ্ছে । কয়েক জনকে মুর্তির মতো করে দাড় করিয়ে রেখেছে। মাহা বেশ বিরক্ত হয়। সে না দেখার ভান করে চলে যেতে লাগলে,,,, বাইকের ওপর বসে থাকা সামির নামের ছেলেটা তাকে ডেকে বলে,,
– হ্যালো,, ও বোরখাওয়ালী ম্যাডাম,?
, দুটো মেয়ে গিয়ে ঘিরে ধরে ,, বলে,,
– নিজে হেটে যাবে না কোলে নেব? বেশি খুঁতখুঁত কোরোনা। ভাই প্রতিদিন এখানে বসেনা। আজ এই বছরের পঞ্চমবার।
গাযে হাত তুলতে মানা করে, মাহা বাধ্য মেয়ের মতো যায়। মনে পরে এতো সেই,, কি যেন নাম,, সামির সিকান্দার। মেয়রের ছেলে। বড্ড অবাক হয় মাহা এইতো সেদিন বাচিয়েছিল আর আজ!! মাহার ভুরু একটু কাছাকাছি দেখে মনে হবে জোড়া ভুরু তবে জোরা নয়। ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত কালো পর্দায় ঢাকা মাহার শুধু চোখ আর ভুরু টুকুই বের হয়ে থাকে।
তার পাশে থেকে কাশেম নামের এক ছেলে বলল,,
– মুখ খুলো,, থোবড়াডা একটু দেখাও।
সামির সানগ্লাস নাচিয়ে রাজশাহীর ভাষায় বলল,,
– আবে অয় কাইশসা,, মুখ দেইখে কি কইরবি বে,, ঝালর তুললে যদি বোম টোম বাইর হয়? চিন্তা কইরেছিস?
– কথা তো ঠিকি বুইলছো ভাই।
সানগ্লাস চোখে দিয়ে সামির বলল,,
– এই ছুড়ি,, বড় ভাইদের সালাম দিতে হয় জানোনা? দাড়ায় আছো কেনে সালাম করো,,
– পা ছুয়ে সালাম করতে হয়না।
– তুমি পর্দা করো?
– জ্বি।
– খুব ভালো। তোমার পর্দা চিরস্থায়ী হোক। জান্নাতবাসী হও। আচ্ছা টুক করে একটু নিকাবটা তোলো, যাতে জান্নাতে গিয়ে তোমাকে চিনতে পারি।
পেছনে দাড়িয়ে থাকা চেলারা সব হোহো করে হাসতে লাগলো।
– আচ্ছা,, তাইলে এক কাম কর,, কাইশসা,, গান বাজা..
– জ্বি ভাই
– নাচো,, যে সুন্দর গোল জামা, নাচলে সুন্দর বাঙ্গির মতো ফুলে উঠবে ভাল্লাগবে দেখতে,, নাচো।
– আমি কোনো ডান্স আর্টিস্ট নই যে নাচব। এখানে বসে রেগিং করছেন? বাড়িতে মা বোন নেই?
– আছে! আছেতো,, মা বোন আছে বউ নেই । বউ হয়ে যাও। হবে বউ? দেনমোহর দেব।
– এমনভাবে বলছেন যেন দেনমোহর বাচ্চাদের চকলেট?
– বাববাহ,, মুখের বুলিতো পপকর্ন রে বাবা ।
এগিয়ে গিয়ে মাহার হাত ধরে সামনে টেনে বলল
– তোমাকে নাচতেই হবে জুনিয়র ছুড়ি , নাচো ।
অতগুলো ছেলের মাঝে মাহা ঠাস করে সামিরের গালে চড় মেরে দিল। সবাই হা করে তাকিয়ে রইর। সামির ঘাড় ঘুরিয়ে বলল,
– ওয়াও,, ভালোই সাহস তোমার। জানো আমি কে?
সেই মুহূর্তে মুহিব ডাক দিল। এগিয়ে গেলে সামির বলর,,
– মুহিব না?
– হ্যা ভাই। ভালো আছেন?
– বোকাচোদারা কেমন আর থাকবে। কে বে এটা?
– চাচাতো বোন।
– বুঝিয়ে বলে দিস,, আমার পরিচিত। দেখাশোনা হতেই থাকবে।
– মাহা,, এটা সামির সিকান্দার ভাই। কেমিস্ট্রিতে মাসটার্স করছে। আবু সালার সিকান্দার এর ছোট ছেলে। আর,, ক্ষণস্থায়ী ছাত্র লীগের সভাপতি।
মাহা কোনো জবাব না দিয়ে চলে যায়। সামির মুহিবের ঘাড়ে হাত দিয়ে বলে,,
– বাড়িঘর আছে? এখনো পুড়ে নাই? এরকম আগুন কি দিয়ে পাইলছিস বে?
মুহিব কিছু বললনা। সামির তাকে যেতে দিল। এক পলকে তাকিয়ে রইল সেদিকে। গালে হাত দিয়ে বলল
– মালটার হাতে পাওয়ার আছে মাইরি।
কাশেম ডেকে বলল,,
– ভাই চলেন,, বড় ভাই ডাইকছে।
