কালকুঠুরি পর্ব ১৯

কালকুঠুরি পর্ব ১৯
sumona khatun mollika

যেই মাহার চেহারা মাত্র ৭ বছর বয়স থেকে তার বাবা নিজ হাতে কালো ঝালর দিয়ে ঢেকে দিয়েছিলেন, মাহা এতগুলো বছর ধরে যা কড়ায়গন্ডায় পালন করেছে,, এলাকার কিছু নিকৃষ্ট মানুষ,, টেনে হিচড়ে সেই ঝালর এক মুহূর্তে ছিড়ে ফেলেছে। নিজেকে কেমন অনাবৃত মনে হচ্ছে তার।
সালার সিকান্দার পরিস্থিতি সামাল দিতে বিয়ের কথা বলেছিলেন, কিন্তু জনতা তাও শান্ত হয়নি। তারা এতটাই নিকৃষ্ট যে ডাক্তার ডেকে চেক করিযেছে,, ডাক্তার বলেছে,, না, মাহা গর্ভবতী নয়। সম্পূর্ণ মিথ্যা। মাহবুব তখনো গলা উচিয়ে বলেছে,,

– হলেও আমার কোনো সমস্যা নাই। কারণ আমি মাহাদিবা কে বিশ্বাস করি।
কিন্তু সালার সিকান্দার বললেন,,
– তুমি অনেক ভালো ছেলে, যোগ্য সেনা। মানুষের বিপদে এগিয়েসেছ এটাই অনেক। আমি বলছি সবাই শুনুন,, মফিদ উদ্দিন এর সাথে আমার আগে থেকেই কথাবার্তা ছিল,, আমি সামিরের জন্য মাহাকে চেয়েছিলাম। কালকে সামির ওর সাথে দেখা করতে এসেছিল। ওতো বলছে,, ও বাথরুমে গিয়েছিল। মাহার চাচি হয়ত জানতোনা সামির গিয়েছে। এর আগেও দু একবার এসেছে। আমি পাঠিয়েছি। কি মফিদ উদ্দিন?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মফিদ উদ্দিন ওপর নিচে ঘাড় নাড়ালেন। সালার সিকান্দার জোরে করে নিঃশ্বাস ফেলে ঘাম মুছে বলে,,,
– আমি ভালো না খারাপ সেটা তো আপনাদের অজানা নয়। এটা একটা দুর্ঘটনা ছিল। আজ বিকেলেই বিযে পড়াব। সবাই চলে আইসেন। এখন অনুগ্রহ করে যে যার কাজে যান।

ভীর ঠান্ডা হলো। যেযে যারযার বাড়ি। কয়েকজন এই রহস্য উদঘাটন করতে পারলোনা যে যে সামিরতো নিজের মুখে বলল, বচ্চা থাকতেও পারে। বাড়ি ফিরে থেকে মাহা নিজের ঘরে বিছানায় পিঠ ঠেকিয়ে মেঝেতে বসে আছে। চোখ দিয়ে পানি পরছেনা। চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। সামনে থাকা বাবা-মার ছবিটার দিকে তাকাতে পারছেনা।
তখন ঘরে আসে মাহবুব উদ্দিন। মাহা চোখের পলক ফেলে আবারো একিভাবে বসে থাকে। মাহবুব উদ্দিন সোজা তার সামনে বসে বলে,,

– আমার কথা শুনুন,, আমি জানি আপনি নির্দোষ। নিজেকে এভাবে ধ্বংসের দ্বারে ঠেলে দেবেন না। আপনার আমাকে পছন্দ নাই হতে পারে কিন্তু আমি দাড়িয়ে দাড়িয়ে আপনার ক্ষতি দেখতে পারবোনা। চলুন আমার সাথে,, অনেকদূর চলে যাব। এরা কেও আপনাকে খুঁজে পাবেনা। আপনার ইচ্ছে হলে আমায় বিয়ে করবেন নাহয় নাই করলেন। সত্যি আমি আপনাকে পছন্দ করি। চলুন,,

দড়জার সামনে কিছু পরার আওয়াজ হলে দুজন তাকিয়ে দেখে কাশেম হালদার দাড়িয়ে। মাহবুব উদ্দিন উঠে দাড়ায়। জিজ্ঞেস করে,,
– চলে যাও এখান থেকে। কেন এসেছ,, সামিরের চাকরগিরি করতে?
অদ্ভুত ব্যাপার, কাশেম গিয়ে মাহার মুখ বরাবর হাঁটু ভেঙে বসে। শুষ্ক একটা ঢোক গিলে বলে,,

-মাহা,, তোমার চে আমি বয়সে হয়ত কিছুদিন বা বছরের এর ছোট। ছোটবেলা থেকে সামির সিকান্দার এর চামচা আমি। মন থেকে করি,, বেইমানি করিনি কখনো। আজ কেন যেন মনে হচ্ছে একটু করি। তোমার ওপর কেমন আজব মায়া জন্মেছে। ধরতে পারো বোন হিসেবে। যদি তুমি চাও চলে যাও।

এাবারে মাহার চোখটা কেমন ভিজে উঠলো। অস্ফুটস্বরে বলল,,
– যেখানেই যাই,, সামির সিকান্দার পিছু ছাড়বেনা। যুদ্ধে যখন নেমেছি, পিছু হটবোনা। আপনারা সমবেদনা পোষণ করেছেন এটাই অনেক।

কাশেম গম্ভীর মুখে সেখান থেকে উঠে চলে গেল। নিসন্দেহে মাহা মাহবুব উদ্দিন কে ফিরিয়ে দিল।
চাচি এসে একটা লাল শাড়ি আর ঘোমটা রেখে চলে গেলে মেধা দৌড়ে এসে মাহাকে জড়িয়ে কান্না করে দিল। মাহা তবুও কাদলনা। ভেতরটা মনে হচ্ছে পাথর হয়ে গেছে। মেধা বলল,
– কেন মেনে নিচ্ছিস? তোর রাজি হতে হবেনা। চল তুই আমার বাড়ি থাকবি।

– আমাকে শাড়ি পড়িয়ে দিবি মেধা, আমি শাড়ি পড়তে পারিনা।
– মাহা!!
– সেভাবে কোনোদিন শাড়ি পড়া হয়নি। ব্লাউজ ও নাই। মায়ের বিয়ের ব্লাউজটা আছে। আমার গায়ে হবে সম্ভবত। একটু বের করে দে।

‎ মেধা বুঝলো মাহা পরিস্হিতির কাছে হার মেনেছে। বিকেল হতে আর কিছু সময় বাকি। দুপুরের কাজা নামাজটা পড়ে মাহা অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে বউ সাজতে শুরু করল। মেধা বেশ সুন্দর করে শাড়ি পড়িয়ে দিল। লালরঙের গহনার বাক্স খুলে মায়ের গহনাগুলো নিজেই নিজের গায়ে জরালো । কোনোরকম সাজ ছাড়া শুধু অলংকারে বউ সেজেছে। মেধা বড্ড অনীহা নিয়ে মাহার মাথায় ঘোমটা তুলে দিল।

নিচে যাওয়ার জন্য ডেকে গেল মধু। সে এমন সাজ দিয়েছে যেন ধুমধাম অনুষ্ঠানের বিয়ে এটা । ড্রইং রুমের মাঝখানে একদল লোক বসে। মাঝখানে পাতলা ঘোমটা দেয়া মাহা। চেহারা দেখাই যাচ্ছে। সময় নাই খুব একটা ব্যাবস্হাও হয়নি। মাঝখানে ফুলের পাতলা পর্দা টাঙানো।
সামিরের চেলাপেলারা এসে সাজিয়েছে। কাশেম মুলত সেই কারণেই এসেছিল।

সিকান্দার বাড়ির প্রায় সবাই উপস্থিত। মেয়েদের মধ্যে শুধু ছোট বাচ্চা ইতি। সিভান এসে সোজা মাহার কাছে চলে গেছে। । ইতি সিয়ামের হাত ধরে দাড়িয়ে। মানুষের ভীর তার খুব অপছন্দ।
সালার সিকান্দার কাজী সাহেবের পাশে বসে। মফিদ উদ্দিন এর অনুমতি নিয়ে বিয়ে শুরু করলে সামির প্রথমেই বাধা দিয়ে আওড়াল,,
– এই দাড়ান,, কাইশসা,, পর্দা সরা,,

– বিয়ের সময় পাত্রপাত্রি পর্দার এপাশে ওপাশে থাকে। চেহারা দেখেনা।
কথাটা বলতেই সামির বিরক্তি নিয়ে বলে,,
– মনে হচ্ছে আগে কোনোদিন চেহারা দেহিনাই। এই সরা।
কাশেম পর্দা সরাতেই মাহার চেহারা দৃশ্যমান হলো। সামির চোখ বাকিয়ে বলল,,
– অর চেহারা দেখা যায় কেন,, এসব ফকিন্নি মার্কা পোশাক কে দিয়েছে? মুখ ঢাক,,

কারো কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে সামির ভরা সমাবেশে মেধাকে বলে,,
– এইযে,, সোনার ময়না কাইলানী,, তোমার সখীর চেদারাখান ঢাকো,, কানে কথা ঢুকেনা?
মাহার চাচি এগিয়ে গিয়ে মাথার ঘোমটা টেনে গলা পর্যন্ত নামিয়ে দিল। চেহারাটা পর্দার আড়ালে ঢেকে গেল।
কাজী সাহেব জিজ্ঞেস করল,,
– দেনমোহর কত বাধবো? আগে থেকে তো কথাবার্তা নেই।

সালার সিকান্দার বললেন ২ লক্ষ ১ টাকা বাঁধেন।
সমির গাল চুলকে বলল,,
– দেনমোহর না দিলে কি হবে? কেন দিতে হয়? বাধ্যতা নাকি?
কাজী সাহেব জ্ঞানী ব্যক্তি জ্ঞানের জবাব দিলেন,
– দেনমোহর নারীর অধিকার। দেনমোহর পরিশোধ করলে তারপর স্ত্রীয়ের কাছে যাওয়া বৈধ হয়।

সামির মুখচোখ বেকিয়ে জবাব দিল,
– মানে বেডির দাম নাকি? আমার কাছেতো তার কোনো দাম নাই। বাধ্যতা যেহেতু তাইলে লেখেন ৫ টাকা ৫ পয়সা। লস প্রজেক্টে ইনভেস্ট করতে আমি ইচ্ছুক নই।

সাফিন সামিরের দিয়ে গম্ভীর হয়ে তাকিয়ে বলল,,
– বেশি ভ্যাট না বকে ভদ্রলোক এর মতো বসে থাক। আজারা কথা বলা বন্ধ কর। কিন্ডারগার্টেন এর বাচ্চা নস তুই।

-হ্যা কিন্তু,,,,,,,,
হঠাৎ করে মাহা বলে উঠলো,
– আমাকে দুই মিনিট সময় দেওয়া যাবে?
সবাই বিরক্তি প্রকাশ করলেও সাফিন সিকান্দার বলল,
– নিতে পারো। কোনো সমস্যা হতেই পারে। যাও।
মাহা মেধাকে সাথে করে নিজের ঘরে চলে গেল। ঘরের দড়জা লাগিয়ে ঠিক দেড় মিনিট পর দড়জা খুলে বেরিয়ে এলো । মেধার হাতে একটা লাল কাপড়ে মোড়ানো কিছু একটা।

নিজ জায়গায় এসে বসে মেধার হাত থেকে বস্তু টা নিয়ে সামনের টেবিলে রেখে বলল,,
– আপনার দেনমোহর দেয়ার প্রয়োজন নেই। আমি আপনাকে দেনমোহর দিচ্ছি। বলতে পারেন আপনার দাম। কাজী সাহেব আপনি আমার হিসেবে ৫ টাকাই লিখুন।

‎সামনের থেকে কাপড়ে মোড়ানো বস্তু টা খুলতেই
দৃশ্যমান হলো এক বান্ডিল হাজার টাকার নোট। খুব সম্ভব ১ লক্ষ টাকাতো হবেই। তা দেখে চাচি, মধু আর মুহিব একে অপরের দিকে তাকাতাকি করতেই বোঝা গেল,, মাহা এত টাকা কোথায় পেল তা তাদের জানা নেই।

হবু বউমার থেকে এমন যথাযোগ্য অপমান হয়ে সালার সিকান্দার মুখ বেঁকিয়ে ফেললেন। সাফিন সামিরকে বলল,,
– এখন? অপমান হয়ে ভালো লাগছে?
সামির উঠে দাড়িয়ে কাজীর হাত থেকে খাতা টেনে নিয়ে গুনে গুনে ৫ এর পেছনে ৫ টা শূন্য বসিয়ে পিছে ১ টাকা লিখে দিল। খাতা ফেরত দিতেই কাজী সাহেব আবারো বিয়ে পড়াতে আরম্ভ করলেন।

যথাযথ নিয়ম মেনে ৩ কবুলে দুজনার বিয়ে হয়ে গেল। মাহা নিজের মুখ থেকে ৩ টি শব্দ বের করতেই মাহবুব উদ্দিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। মুহিব মুখ বাঁকা করে দাড়িয়ে রইল ।
বাড়ি থেকে যাওয়ার সময় অজান্তে মাহার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পরল। নিজের ওপরি রাগ হতে লাগল, কেন পরল চোখের পানি,, বাবা থাকলে হয়ত বকতো। কান টেনে বলত,, তোর মুখ দেখা যাচ্ছে,, মা বলত,, চেহারা ঢাক বাবা রেগে যাবে। ভাইটা বেঁচে থাকলে হয়ত মন ছোট করে কাঁদত। হাত ধরে গাড়িতে তুলে দিত।

মেধা তাকে বলল,,
” যাই হোক ভুলে যাসনা। তোর বাবার ইচ্ছে তুই মেজিস্ট্রেট হবি। পড়াশোনা ছাড়িসনা। নিজের যত্ন নিস। ”
মেধাকে চোখের পানি ফেলতে দেখে কাশেম এগিয়ে গিয়ে গাড়ির দড়জা খুলে ডান হাত এগিয়ে দিল। মেধার চোখে পানি থাকলেও। মন থেকে বড্ড খুশি হলো। একটু আগে সে কাশেম কে বলেছিল,,
” কাশেম ভাই,, মাহার এই তল্লাটে নিজ বলতে কেও নাই। আমি জানি মুহিব ভাই এগিয়ে যাবেনা। মায়ের আদেশের অপেক্ষা করবে। আপনি নিজের হাতটা একটু বাড়িয়ে দেবেন,, ভাই হিসেবে ”

কাশেম কোনো জবাব দেয়নি। মেধা ভেবেছিল কাশেম সামিরের ভয়ে এগোবে না। কিন্তু কাশেম তার কথা রেখেছে।
কাশেমের এহেন কান্ডে সামিরসহ সকলে অবাক। সিয়াম খুব একটা নজর দেয়নি। কারণ কাশেমতো সামিরের আদেশ ছাড়া শ্বাসও নেয়না। সামির সানগ্লাস নামিয়ে একবার দেখে সোজা গাড়িতে উঠে বসল। আপাতত এই গরমের মধ্যে আর ঝামেলা করতে মন চাচ্ছে না।

মাহা কাশেমের হাত ধরেই গাড়িতে বসেছে। ত্যাড়ামি করেনি। তবে এইযে মাহা কাশেমের হাত ধরেছে এটা নিয়েও ৩০ সেকেন্ডের মাথায় সমালোচনা শুরু হয়ে গেছে।
গাড়ি ছুটিয়ে কদমতলীর মোড় পর্যন্ত আসতেই কোথা থেকে তাদের ওপর হামলা হয়ে যায়। চারপাশে সশব্দে গান বাজতে শুরু করে। চারদিকে সাদা ধোঁয়ায় ছেযে যায়। কাশতে কাশতে দু চার মিনিটের মাথায় ধোয়া সরে যেতেই দৃশ্যমান হয় সব ঠিকঠাক শুধু মাহা গায়েব।

কালকুঠুরি পর্ব ১৮

সবাই দৌড়াদৌড়ি করে চারপাশ দেখেও মাহাকে খুঁজে পায়না।
সামির রেগে বোম হয়ে যায়। কাশেম, রনি, বান্টি সকলে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। টানা দেড় ঘন্টা খুজেও কেও মাহাকে খুঁজে পায়না। শুধু নিচে পরে থাকা মাহার ঘোমটাটা তুলে সামির ড্রাইভারকে নামিয়ে গাড়ি ছুটিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। সালার সিকান্দার থানায় কল করে। বাকিরা সবাই বাড়ি ফিরে যায়।

কালকুঠুরি পর্ব ২০

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here