কালকুঠুরি পর্ব ২৪
sumona khatun mollika
ফজরের আযানে চারপাশে মুখরিত হয়ে ওঠে। আঁধারের বুক ফেড়ে ধিরে ধিরে নতুন দিনের সূচনা হতে থাকে। নামাজ শেষ করে বিছানায় গিয়ে বসে মাহা। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সামিরের ঘুমন্ত চেহারার দিকে।
ঘুমন্ত মানুষ কে কি নিষ্পাপ দেখা যায়! মাহা মনে মনে ভাবে,, সেদিন যদি সামিরের বদলে মাহবুবের সাথে বিয়ে হতো, তবেকি দিনগুলো এমন হতো? বা সামির যদি ভালো মানুষ হতো,, একটা সচ্চরিত্রবান লোক হতো, বিয়ের দুর্ঘটনাটাকে কি ভুলে যেতাম?
না যেতাম না। অসম্ভব, সামির মাহাকে মিথ্যা কলঙ্কে কলঙ্কিত করেছে,, এটার ক্ষমা কিভাবে সম্ভব! আর যাইহোক সামির যে মাহাকে ভালোবাসে না কাল রাতের চে বড় প্রমাণ আর কিইবা হতে পারে যদি একবিন্দুও ভালোবাসত, সামির মাহার সাথে জবরদস্তি করতনা।
মেঝের দিকে তাকিয়ে একমনে এসব ভাবছিল মাহা হঠাৎ খেয়াল হলো সামির চোখমুখ খিচিয়ে ফেলছে। ফ্যান চলা সত্বেও তিরতির করে ঘামছে। ঠোঁট দুটো কাঁপছে। সম্ভবত দুঃস্বপ্ন দেখছে।
মাহা তাকে ডাকলোওনা কিছুইনা৷ চুপচাপ উঠে চলে গেল।
বেলা গড়িয়ে ঘড়ির কাটা যখন ১১ টা ছুই ছুই, কাশেম এসে বলল,,,
– ভাই চলেন,, ভার্সিটি থেকে ঘুরে আসি।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সামির ঝট করে মানা করে দেয়।৷ কাশেমও কথা বারায়না, চেলাপেলা সঙ্গে করে বেরিয়ে যায়। । সাথির শশুর বাড়ি থেকে লোক এসেছে
তারা ইতিকে ফেরত নিয়ে যেতে চায়। সালার সিকান্দার বাদে সবাই সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিল।
সাথির শশুর ভয় দেখালেন মামলা করবেন। মাহা আচমকা উঠে দাড়িয়ে বলল,,
– অপরাধ ক্ষমা করবেন। মামলার ভয় দেখাতে আসবেন না, মামলা চাইলে আমরাও করতে পারি। আপনাদের চে ভয়াবহ মামলা করব। নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা , বহন করতে পারবেন তো?
– তুমি চুপ করো, দেখছনা আমরা কথা বলছি,, মাঝখানে বাহাত ঢুকানোর তুমি কে?
– আপনারচে শক্তিশালী পজিশনের অধিকারী। ও এ বাড়ির বউ। আপনাদের বাড়ির বউয়ের সন্মান নেই। মর্যাদা নেই কিন্তু আমাদের আছে।
নুসরাতের এহেন জবাবে সিয়াম ভিষণ নারাজ হলেও সাফিন কিচ্ছুটি বললনা। ওরা যখন আবারো মামলার ভয় দেখালো,, এবারে সাফিন শান্ত কণ্ঠে তীর ছুড়ে মারলো,,
– যান মামলা করুন, লয়্যার হায়ার করুন, পুলিশি কাহিনি করুন, আমাদের জেলে দিন,, কিন্তু শুধু একটা কথা মনে রাখবেন,, আমরা সিকান্দার রা জেলে যাওয়ার আগে, আপনাের বাড়ির পিপড়াদের পর্যন্ত সাদা কাপড়ে শুইয়ে রেখে যাব। এটা আমার জবান,, মেয়র আবু সাফিন সিকান্দার এর জবান।
প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে সাফিন নিরব ঘাতকের ভূমিকা পালন করে। ধীর সরু তীক্ষ্ণ মেধার চালে সাফিন বরাবরি বাজিমাত করে দেয়ার রেকর্ড বানিয়ে ফেলেছে। তাছাড়া সাফিনের ভয়াবহতা সেই কতবছর আগেই দর্শন করেছে এরা। কথায় আছে আগে দর্শনধারী পরে গুণ বিচারি,,, সাফিনের দর্শনই যখন এত ভয়াবহ ছিল, গুণ নিশ্চয়ই এক লেবেল আপে হবে।
সামির নিজের ঘরেই আছে। নিচে আসেনি। সাথি বা ইতি কাওকে ফেরত পাঠানো হলোনা। ইতি টুকটাক করে হেঁটে মাহার কোলে নিজের ঠাই করে নিল। মাহা তাকে আদুরে কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,,
– মাথার ব্যাথা কমেছে মা?
– মামিমা তোমার মুখটা খোলো,, আমি একটা তুমু দেব।
– চলো ঘরে গিয়ে দেবে।
– তলো,,,
তাদের ওপরে উঠে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে সাথি নুসরাতকে বলল,,
– ছুড়ি আসলেই আল্লাহ ভক্ত। কেন যে অর সাথে এমন হইল! আমিও কাইল থেনে পদ্দা করুম। ওর মতো ঢ্যাকা পদ্দা করতে পারুমনা, কিন্তু চেষ্টা করুম।
ইনায়াও নিজের ঘরে চলে গেল। রুমে ঢোকার পর মাহা নিকাব খুলতেই ইতি হামলে পরে তার গালে কসে একটা চুমু দিয়ে বলল,
– তুমি কুব ভালো। আল মামাও কুব ভালো।
সামির টেবিলে বসে আঁকাআকি করছিল। ঘাড় ঘুরিয়ে সেদিকে দেখতেই তার হিংসা হতে লাগল, নিজেই মনে মনে আওড়াল,
– বাঙ্গির বাচ্চাটাকে দেখ হামলে পরে আমার বউরে চুম্মা দিতেছে, আমিও এখনো এমনে জাইত্তা ধইরা চুম্মা খাইনাই,
ইতি চলে যাওয়ার পর মাহা ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাড়িয়ে চুল আঁচড়াতে থাকে। সামির তার দিকে এগিয়ে গিয়ে ন্যাকা সুরে বলে,
– এদিকে ঘোরো আমিতো তোমাকে মন ভরে চুমুই খেতে পারিনি। এখন আমি মন ভরে তোমাকে চুমু খাবো,,
– না।
– কেন কেন আফটারঅল তুমি আমার বিয়া করা বউ!
– জোর করে বিয়ে করা যায় কিন্তু মন পাওয়া যায় না। আমি মন থেকে কখনোই আপনাকে স্বামী বলে মানি না।
– আরে শুনো নাই,, ইন্ডিয়া থেকে গরু আনার সময় পেছনে সীল মাইরা দেয়! আমিও ওমন তোমারে সীল মাইরা দিছি। যেখানেই যাবা সবাই বলবে সামির বাঙ্গির বউ,, আরে কাছে এসো।
বলেই সামির মাহার হাত ধরে হ্যাচকা টান মারতেই মাহা অন্য হাত দিয়ে হুট করে সামিরের গালে চড় বসিয়ে দিল।
সামির জোর করে মাহার থুতনি চেপে মাহার অধর আয়ত্ব করে ফেলল,, জোরেসোরে বুকের ওপর ধাক্কা মেরে নিজের থেকে দুরে সরালো সামিরকে।
সামির নিজে নিজেই পাগলের মতো হাসতে লাগল, হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাবে যেন। বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ওপরের দিকে তাকিয়ে বলল,
– তোমার ঠোঁট টাও কিন্তু নোনতা সোডিয়াম ক্লোরাইড , হাহাহা।
– বেযাদব একটা লোক!
– চড়ওয়ালী একটা মহিলা !
মাহা চোখমুখ বেকিয়ে বাইরে চলে যায়। সামির আবারো দেয়াল টপকে বাইরে চলে যায়। এটাই যেন তার মূল রাস্তা। বাড়ির গেটটা বেকার! হঠাৎ হটাৎ গেট ব্যাবহার করে সে। এমনকি তার চেলাপেলারাও তাকে পলো করে দেযাল টপকানো টাই রাস্তা বানিয়ে নিয়েছে।
বাইরে গিয়ে গলির মোড়ে দাড়াতেই কাশেম কে দেখতে পেল। গলা উচিয়ে ডাকল,,,
– এ,, কাইশসা বাঙ্গির নাতি এদিক আয়!!
-ভাই আপনেনা কইলেন বের হবেন না।
– পরে ভাবলাম আমি না বের হলে তুই কাইলানীর পিছে পিছে ঘুরবি,, তর নাম খারাপ হইব। আর যদি আজ ও বাইরে না আসে তাহলে তো তোরা অনাথের মতো ঘুরবি। তাই তোদের কথা চিন্তা করে চলে আসলাম।
কাশেম ঘাড় কাত করে সামিরের দিকে তাকিয়ে বলে,,
– ভাইকি আবার থাবড়া খাইছেন?
সামির বামগালে হাত দিয়ে বলে,,
– কেলো করেছে,, বোঝা যাচ্ছে?
– নইলে কইলাম কেমনে।
– শাল্লার বাঙ্গিমারা জিন্দেগী! কাওরে কবিনা। নাইলে তরে এক্কেরে,,
– বলবনা। বলবনা। বলবনা যে ভাই বউয়ের হাতে কোব খাইয়া আইছে।
– বাঙ্গির নাতি!!
কাশেমকে তাড়তে তাড়তে ক্লাবে পৌছে যায় দুজন। সিকান্দার বাড়িতে,,,
মাহা রান্নাঘরে জরিনার সাথে কথা বলছিল। তখনি আওয়াজ ভেসে আসে সাফিনের গলা,,
– শুয়োরের বাচ্চা জানডা জ্বালায় খাইলো! আমার কাছে তোর সাথে নাগরদোলায় দোল খাওয়ার সময় নাই। কিসের এত ঘোরাঘুরি ! চুপচাপ যাইয়া পড়তে বস, ভালো না লাগলেও বই নিয়ে বসে থাকবি। পড়িস বা না পড়িস তাও বই নিয়ে বসে থাকবি।
মাহা মুখ বেঁধে বাইরে এসে দেখল সিভান মাথা নিচু করে সাফিনের সামনে দাড়িয়ে চোখের পানি বিসর্জন দিচ্ছে আর সাফিন তাকে যাতাই বলে গালাগাল করছে।
– ফারদার আর কখনো এসব ন্যাকামি করবিনা। মেচি মাইনসের মতো মেউ মেউ স্বভাব আমার খুব অপছন্দ। তোর ঘোরাঘুরি বন্ধ। সদর দড়জার বাইরে পা রাখতে পারবিনা তুই। নয়ত ঠ্যাং ভেঙে গুড়িয়ে দেব। চোখের সামনে থেকে সর, সঙের মতো দাড়িয়ে আছিস কেন?
মাহা এগিয়ে গিয়ে সিভানের গাড়ে হাত রেখে বলল,,
– আপনি ওকে এসব কি বলছেন মেয়র সাহেব? ও একটা ছোট বাচ্চা। এত ভারি ভারি শব্দ দিয়ে ওকে আঘাত করছেন কেন?
– চুপচাপ নিজের চরকায় তেল মারো, আমি অবশ্যই তোমার থেকে কথা শিখবনা।
– শিখতে হবে। যদি নাও শিখেন অন্তত এটুকু শিশু বাচ্চার সাথে এমন আচরণ করবেন না। এমনিতেও ওর মা নেই । আপনি ওর মাকে ছিনিযেছেন। এখন ওর শৈশব টাকে ছিনিয়ে নিতে চান?
– আমরাও মা ছাড়া বড় হয়েছি। আমাকে কষ্ট শেখাতে এসোনা। আর সিভান তুই,, আর কখনো আমার পথ চেয়ে বসে থাকবিনা। জীবনে চলতে গেলে একা চলা শিখতে হয়। গিয়ে পড়তে বস। নাহলে আমি তোকে আবাসিক স্কুলে ভর্তি করে দিয়াসবো।
কথাগুলো বলে সাফিন নিজের রুমে চলে যায়। সিভান মাথা টা উচু করে চোখ মুছে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বলে,,
– কিছু মনে কোরোনা। এগুলো রোজকার কারবার।
– সিভান? ঘুরতে যাবে আমার সাথে? আমারো মনটা ভালো নেই। যাবে?
সিভান মাথা দোলাল যার অর্থ হ্যা।
বেলা গড়িয়ে বিকেল হলো। ইনায়া টিউশন পড়তে গেছে। সাথি নিজের ঘরে ঘুমাচ্ছে। সুফি বেগম রান্নাঘরে জরিনাকে সাহায্য করছেন। মাহা বোরকা পরে নিকাব বেঁধে রেডি। সিভান আর ইতি হাত ধরে দাড়িয়ে আছে। মাহা নিজের পার্সটা চেক করে দেখল একদম ফাকা। যাকিছু আছে সব ব্যাংকের কার্ডে৷ যে টাকাটা বাইরে ছিল সামিরকে দিয়ে দিয়েছে বিয়ের দিন। বাচ্চাদুটোকে বাইরে নিয়ে গিয়ে খালি মুকে কিকরে ফেরত আনবে! এটা ভেবে মাহার খুব আফসোস লাগতে থাকে।
সামিরের শার্টটার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভেবে শার্টের পকেট থেকে ১০০ টাকার একটা নোট বের করে নিল। ।
তারপর সাথিকে বলে এসে দুজনের হাত দরে বেরিয়ে যায়। বাড়ির দড়জা পর্যন্ত পৌছতেই সামিরের মুখোমুখি হয়ে যায়। । সামির বলে,,
– এই বাঙ্গি ভাঙা বিকালে কোথায় চুরি করতে যাচ্ছ ৩ জনা?
– মামাই ঘুততে যাতথি, তুমিও যাবে?
– এ কাকা তোমার যাওয়ার দরকার নেই। আমরাই ঘুরে আসি।
– ঠাং ছ’টা ভেঙে পদ্মায় ভাসিয়ে দেব। এখানেই দাড়া আমি আসছি।
বলেই সামির দুই সেকেন্ডের মাথায় গাড়ি নিয়ে আসে। সিভান আর ইতি উঠে বসলে মাহা পিছু ডেকে বলল,,
– তোমরা আমার সাথে গুরতে বের হয়ে গাড়িতে উঠে যাচ্ছ কেন?
-আরে কাকি সুন্দরী, পায়ে হেটে গলির মোড় পর্যন্তই যেতে পারবে। চলে এসো।
– তাহলে তোমরা যাও।
সমির গাড়ির দরজা খুলে বলল,,
– গাড়িতে উুঠুন ম্যাজিট্রেট আফুজান্স। আরে উঠুন উঠুন।
কালকুঠুরি পর্ব ২৩
মহার হাত ধরে জোড় করে গাড়িতে ওঠালো। তারপর বলল,,
– মেরেছ চটকনা তাই বলেকি তুমি প্রেম দিবানা? আমার দিলতো পাগল তুমি হেইডা বুজোনা? ডিপজরের মা,,
মাহা নিকাবের আড়ালে মুখটা বেকিযে অন্য দিকে তাকায়। সিভান আর ইতি মুখ চেপে হাসতে থাকে। সামির বাঁকা হেসে গাড়িতে উঠে গাড়ি ছোটাতে শুরু করে৷ গাড়ি ছুটিয়ে সোজা পদ্মা পাড়ে চলে যায়।
