কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ১২

কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ১২
মিসরাতুল রহমান চৈতী

গাড়ি দ্রুত গতিতে ছুটে চলেছে হাসপাতালের দিকে। ভেতরে নিস্তব্ধতা, কেবল ইঞ্জিনের গম্ভীর শব্দ আর চৈতীর ক্ষীণ নিঃশ্বাস ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। তার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে রাতুলের হাত, যেন এই বন্ধন এক মুহূর্তের জন্যও আলগা হতে দেবে না।
রাতুলের নিস্তেজ মুখের দিকে তাকিয়ে চৈতীর বুকের ভেতর ধকধক করছে। চোখের কোণে জমে থাকা জল রাগ, ভয় আর কষ্টের এক জটিল অনুভূতি নিয়ে নিচে গড়িয়ে পড়ছে।
ড্রাইভার গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিয়েছে। সামনে হাসপাতালের বিল্ডিং দেখা যাচ্ছে। সেখানে আগেই কিছু দলীয় কর্মী, নিরাপত্তারক্ষী এবং সাংবাদিকের দল ভিড় করেছে। সবাই উৎকণ্ঠিত।
গাড়ি থামতেই দৌড়ে এসে দরজা খুলে দিল কয়েকজন।

— “স্যারকে সাবধানে নামান!”
দুইজন দেহরক্ষী রাতুলকে গাড়ি থেকে বের করে দ্রুত স্ট্রেচারে তুলল। ডাক্তাররা আগেই প্রস্তুত ছিল।
— “রক্তক্ষরণ হচ্ছে! দ্রুত ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যান!”
একজন ডাক্তার নির্দেশ দিল।
চৈতীও পেছন পেছন দৌড়ে যাচ্ছে। তার চোখ-মুখে দৃঢ়তা, কিন্তু চোখের গভীরে জমে থাকা অস্থিরতা ধরা পড়ে যাচ্ছে।
হাসপাতালের করিডোরে সাদা পোশাকের নার্সরা ব্যস্ত হয়ে ছুটছে। চারপাশে কেবলই শ্বাসরুদ্ধকর অপেক্ষা। স্ট্রেচারটা দ্রুত অপারেশন থিয়েটারের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— “ম্যাডাম, আপনি এখানে বসুন। আমরা স্যারকে দেখছি।”
একজন নার্স চৈতীকে শান্ত করতে চাইল।
ঠিক তখনই দলের একজন কর্মী ছুটে এলো।
— “ভাবী, বাইরের অবস্থা খারাপ, কিছু সাংবাদিক নিউজ কাভার করতে এসেছে। কিছু প্রতিপক্ষের লোকজনও আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে। আপনাকে সাবধানে থাকতে হবে।”
চৈতীর ঠোঁট শক্ত হয়ে গেল।
— “আপনারা ওদের সামলান, আমি এখন অন্য কিছু ভাবতে পারছি না!”
অপারেশন থিয়েটারের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। লাল আলো জ্বলে উঠলো।
চৈতী দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইলো, পাথরের মতো শক্ত হয়ে। তার হাত দুটো মুঠো করা, চোখের পলকও পড়ে না।
রাতুল কি বাঁচবে?
এই ভয়, এই অস্থিরতা তাকে যেন নিঃশেষ করে দিচ্ছে।
ঘণ্টা দুয়েক পর—
অপারেশন থিয়েটারের দরজা খুলল।
একজন ডাক্তার ধীর পায়ে বেরিয়ে এলো। মুখে ক্লান্তির ছাপ, কিন্তু চোখে স্বস্তির আভা।

— “রাতুল সাহেব এখন স্থিতিশীল। মাথার আঘাতটা গুরুতর ছিল, তবে আমরা সফলভাবে হেমারেজ নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি। আপাতত তাকে পর্যবেক্ষণে রাখা হবে।”
চৈতী এতক্ষণ শক্ত হয়ে থাকলেও এবার যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল।
— “আমি কি ওকে দেখতে পারবো?”
ডাক্তার মাথা নাড়ল।
— “এই মুহূর্তে না, তবে আধাঘণ্টা পর আমরা অনুমতি দেবো। তবে মাথার চোটের কারণে জ্ঞান ফিরে আসতে কিছুটা সময় লাগতে পারে।”
চৈতী কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর ধীরে পেছনে গিয়ে একটা বেঞ্চে বসল। মাথা নিচু করে হাতের তালুতে মুখ চাপা দিল।
বাইরে উত্তেজনা বাড়ছে।
প্রতিপক্ষের লোকজন আর সাংবাদিকরা মিশে এক ধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি করেছে। হাসপাতালের গেটে নিরাপত্তারক্ষীরা সতর্ক অবস্থানে দাঁড়িয়ে, তবুও চারপাশে গুঞ্জন থামছে না।

— “রাতুল সাহেবের অবস্থা কেমন?”
— “এই হামলার পেছনে কারা জড়িত?”
— “এটা কি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র?”
সাংবাদিকরা একের পর এক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে, কিন্তু দলের কর্মীরা পরিস্থিতি সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে।
সমর্থকেরা শ্লোগান দিচ্ছে—
“আমরা রাতুল ভাইয়ের পাশে আছি!”
“এই হামলার বিচার চাই!”
চৈতী করিডোরের একপাশে দাঁড়িয়ে সব শুনতে পাচ্ছে। ওর মনের ভেতর যেন ঝড় বইছে।
হাসপাতালের মূল ফটকের সামনে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে, কিন্তু গুঞ্জন থামছে না।
এদিকে রাতুলের ব্যক্তিগত সহকারী আসিফ একা সব সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। তার কপালে উদ্বেগের রেখা স্পষ্ট।
সে জানে, এখনো অনেকেই জানে না যে রাতুল বিবাহিত। বিয়েটা খুব গোপনে হয়েছিল, হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া কেউ কিছু জানে না।

আর এই মুহূর্তে প্রেসের সামনে চৈতীকে নিয়ে আসা মানেই অপ্রত্যাশিত ঝামেলা ডেকে আনা।
আসিফ বারবার চৈতীকে নিরাপদ রাখতে চাইছে।
কয়েক ঘণ্টা পর্যবেক্ষণের পর অবশেষে ডাক্তাররা রাতুলকে কেবিনে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নিল।
আস্তে আস্তে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলেও বাইরে এখনো উত্তেজনা কমেনি। সাংবাদিকদের ভিড়, সমর্থকদের শ্লোগান— সব মিলিয়ে চাপা উত্তেজনা চারপাশে ছড়িয়ে আছে।
এদিকে, আসিফ কোনো ঝুঁকি নিতে চাইছিল না।
সে তার সব যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে চৈতীকে নিরাপদে রাখার ব্যবস্থা করলো। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিশেষ অনুমতি নিয়ে নিশ্চিত করলো যে, চৈতী রাতুলের সাথেই কেবিনে থাকতে পারবে।
চৈতী কিছু না বলে শুধু আসিফের দিকে একবার তাকালো। চোখের ভাষায় কৃতজ্ঞতা মিশে ছিল।
রাতুলের পাশেই বসলো সে।

তার হাতটা আলতো করে ধরে রাখলো, যেন এই স্পর্শেই সব আশঙ্কা মিলিয়ে যায়।
রাতুলের চোখ ধীরে ধীরে খুলল।
চারপাশটা ঝাপসা লাগছে, মাথাটা ভারী। শূন্য দৃষ্টিতে সে ছাদটা দেখছে, যেন বুঝতেই পারছে না কোথায় আছে।
ঠিক তখনই একটা নরম স্পর্শ অনুভব করল হাতে।
চৈতী।
ওর হাতটা শক্ত করে ধরে বসে আছে চৈতী, চোখ-মুখে উৎকণ্ঠা, তবে গভীরে স্বস্তিও আছে।
রাতুলের কপালের পাশে হাত রেখে ধীর স্বরে ডাকল, “এমপি আহাম্মেদ …!”

রাতুল তাকালো তারপর হাসলো কিঞ্চিৎ পরিমানের হেসে বললো–”মিসেস চৈতী আহাম্মেদ” চিন্তা করবেন না আমি ঠিক আছি। আমার জন্য এতো চিন্তা এতো উৎকন্ঠা দেখে ভালো লাগলো আমার প্রেমে পরে যাননিতো।
বড় বড় চোখ করে তাকালো চৈতী রাতুলের দিকে তারপর কন্ঠে শক্ত করে বললো– মানুষ আমি। তাই আপনার জন্য আমার কষ্ট হচ্ছিলো।
কি সৌভাগ্য আমার? আমার মতো নিকৃষ্ট মানুষের জন্য আপনি কষ্ট পান।
আপনার মনে হয়না আপনার রেস্ট এর দরকার চুপচাপ রেস্ট করুন।
এদিকে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে একবার ভেতরের দিকে তাকাল আসিফ। চৈতীর দিকেও দ্রুত এক ঝলক নজর বুলিয়ে নিল, যেন নিশ্চিত হতে চায়— সে ঠিক আছে কি না। তারপর মোবাইল কানে দিল।

— “হ্যাঁ, ভাই… আপাতত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। তবে বাইরের অবস্থা ভালো না। সাংবাদিকরা একেবারে হুলস্থুল শুরু করে দিয়েছে… চৈতী ভাবীর ব্যাপারটা যেন এখনই লিক না হয়, সেটা দেখতে হবে।”
কথা বলতে বলতে ওর কপালে চিন্তার রেখা আরও গভীর হলো। বাইরে দলের কিছু কর্মী সাংবাদিকদের সামলানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু প্রতিপক্ষের কিছু লোকজন সুযোগ নিচ্ছে গুজব ছড়ানোর।
এদিকে, কেবিনের ভেতর থাকা রাতুল সব শুনতে পাচ্ছিল। দুর্বল কণ্ঠে ডাক দিল, “আসিফ, ভিতরে আয়।”
আসিফ দ্রুত ভেতরে ঢুকল, রাতুলের সামনে এসে দাঁড়াল। কপালে স্পষ্ট দুশ্চিন্তার ছাপ।
— “ভাই, আপনি ঠিক আছেন?”

কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ১১

রাতুল হালকা মাথা নেড়ে বলল, “আছি। তবে কাজ আছে, সবাইকে বলে দে, এমপি রাতুল আহাম্মেদের জ্ঞান ফিরেছে। আপাতত কারও সাথে কথা বলতে রাজি নই। সুস্থ হয়ে ইনশাআল্লাহ্ প্রেস কনফারেন্স করবো।”
তারপর গভীর দৃষ্টিতে আসিফের দিকে তাকিয়ে বলল, “আর তোর ভাবীকে খুব সেফলি বাড়িতে পাঠাবি। কাকপক্ষীও যেন টের না পায়!”
আসিফ মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মতি জানাল। এখনো অনেক কিছু সামলাতে হবে, কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো চৈতীকে নিরাপদে রাখা।

কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ১৩