কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ২৮

কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ২৮
মিসরাতুল রহমান চৈতী

রাতুল আর আসিফ একটা ঘরে বসে আছে। টেবিলের উপর একটা বড় ম্যাপ ছড়িয়ে রাখা। ওরা গভীর মনোযোগে ম্যাপটা দেখছে।
তাদের পরিকল্পনা স্পষ্ট — পতিতালয়টা ভেঙে সেখানে একটা আশ্রম কেন্দ্র গড়ে তুলবে। ম্যাপের দাগগুলো ধরে ধরে তারা জায়গাটা চিনিয়ে নিচ্ছে, যেন ঠিকঠাক মতো আশ্রমের কাঠামো দাঁড় করাতে পারে।
ঘরটা নিস্তব্ধ, শুধু তাদের স্বপ্নের নকশা আঁকার শব্দই যেন বাতাসে ভাসছে।
আসিফ ধীরে ধীরে মাথা তুলে রাতুলের দিকে তাকিয়ে বলল, “ভাই, এইটা তো নাহিদ হাসনারে। এইটা ভাঙ্গা কি সহজ হবে? এমনিতেই এই পতিতালয় আমরা বন্ধ করে দেওয়াতে সে আমাদের উপর তীব্রভাবে রেগে আছে। এতো সহজে কি ভাঙ্গতে দিবে?”

রাতুল এক মুহূর্ত চুপ থেকে একটু হাসল। তার চোখে আত্মবিশ্বাসের ঝলক। সে শান্ত গলায় বলল, “মেঘ দেখে করিস নে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে। অন্ধকারের পরেই আলো আসে। এই আলোটা খুঁজতে খুব সহজ হবে না, অনেক সংগ্রাম লাগবে। কিন্তু আমি জানি, আমরা এই আলোর দেখা পাবো।”
ঘরে যেন মুহূর্তের জন্য নীরবতা নেমে এল। টেবিলের উপর রাখা ম্যাপটার দিকে তাকিয়ে ওরা দুজনই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল — যত বাধাই আসুক, এই পতিতালয়ের জায়গায় আশ্রম গড়বেই তারা। অন্ধকার সরিয়ে আলো আনবেই।
আসিফ কিছুক্ষণ চুপ থেকে মাথা নিচু করে বসে রইল। তারপর ধীরে গলায় বলল, “ভাই, কাজ শুরু হবে কবে থেকে?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

রাতুল ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে বলল, “আসিফ, শুভ কাজে দেরি কিসের? কাল থেকেই কাজ শুরু হবে।”
আসিফ এবার একটু সংকোচ নিয়ে বলল, “যদি বাঁধা আসে, তাহলে কী করবো?”
রাতুল চুপচাপ আসিফের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর চেয়ার থেকে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। তার চোখে কোনো ভয় নেই, বরং একরকমের তীব্র আগুন জ্বলছে।
“বাঁধা?” রাতুল একটু থেমে হাসল। “বাঁধা উড়িয়ে ফেলবো না… আমরা ওদের চোখে চোখ রেখে দাঁড়াবো। ওরা জানুক, আমরা ভয় পাই না। ওরা যদি আমাদের ভাঙতে আসে, আমরাও দাঁতে দাঁত চেপে লড়বো।”
আসিফ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর মাথা তুলে বলল, “ভাই, যা হবে, একসাথে সামলাবো।”
রাতুল এগিয়ে এসে আসিফের কাঁধে হাত রাখল। “তাহলে তৈরি থাক। কাল নতুন সূর্য উঠবে। সেই সূর্যটা আমাদের জন্য উঠবে, যারা মুক্তি চায়, তাদের জন্য উঠবে।”

ঘরের বাতাস ভারী হয়ে গেল, যেন একটা ঝড় আসার আগের নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। কিন্তু সেই নিস্তব্ধতার ভেতরেও রাতুল আর আসিফের চোখে ঝলক দিচ্ছিল এক অসম লড়াইয়ের অদম্য সাহস।
ঠিক আছে ভাই আমি এখন আসি। কাল দেখা হবে আল্লাহ্ হাফেজ বলে চলে গেলো আসিফ।
রাতুল ফোঁস করে শ্বাঃস নিলো।
ঠিক তারপর ধীরে পা এ সে রুমে দিকে গেলো গিয়ে দেখলো চৈতী জানালা দিকে বাহিরে তাকিয়ে আছে৷
রাতুল রুমে ঢুকে একটু কেশে তার উপস্থিত বুঝালো।
ঘাড় ফিরিয়ে রাতুলের দিকে তাকিয়ে বললো,, কিছু বলবেন?
রাতুল একটু চুপ থেকে বললো – “চৈতী তোমাকে দেওয়া কথা রাখতে চলেছি কাল পতিতালয় ভাঙ্গা হবে আর তুমি দাঁড়িয়ে থেকে দেখবে।”

রাতুলের কথা শুনে চৈতী জানালার দিকে তাকিয়ে আছে যেনো অন্ধকার রাতটা কাটার অপেক্ষা।
রাতুল এক ধাপ এগিয়ে এলো, তবে তাদের মাঝে কিঞ্চিৎ পরিমাণের দূরত্ব বজায় রেখে। দুজনের মাঝে চুপ থাকা যেনো এক অদৃশ্য প্রতিযোগিতা, যেখানে শব্দের প্রয়োজন নেই, শুধু অনুভূতির গভীরতা যথেষ্ট। সঙ্গত কারণেই, এই নীরবতা বেশ কিছু সময় ধরে ভেঙে না পড়লো। অবশেষে রাতুল নিজেকে সংবরণ করে চৈতীকে বললো, “চৈতী, তোমার হাত দুটো ধরতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে, তোমার অনুমতি পেলে খুব শান্তি পাবো।”

চৈতীর কোনো প্রশ্ন ছিল না। তার হাতটি কিছুক্ষণ অস্থিরতা কাটিয়ে, নিজ থেকে রাতুলের দিকে বাড়িয়ে দিলো। এই এক স্নিগ্ধ প্রস্তাবনা, হাতের স্পর্শে তাদের দূরত্ব মুছে যেতে লাগলো, যেনো পৃথিবীটা তাদের চারপাশে থেমে গেছে।
রাতুল সেই হাতটি ধরতে গিয়েই অনুভব করলো, তার ভিতরে যেনো এক তীব্র ঝড় বয়ে যাচ্ছে, প্রতিটি রক্তরেখা যেনো সাড়া দিচ্ছে। চোখ বন্ধ করে, সে সেই মুহূর্তটাকে নিজের মনের অন্দরে আঁকতে চাচ্ছিল, যেনো পৃথিবী থেকে সরে গিয়ে তার চারপাশের কেবল একটি ছবি ছিল, যা শুধু সে আর চৈতী ছাড়া আর কেউ দেখতে পাবে না।
একটি গম্ভীর শ্বাস নিয়ে রাতুল বললো, “চৈতী, তোমার আগমনটা ছিলো আমার জীবনে শেষ ধ্বংসের প্রান্ত, যেনো এক নিষ্ঠুর সমাপ্তি। তোমার উপস্থিতি ছিলো সেই চৈত্র মাসের কাল বৈশাখীর ঝড়ের মতো—যার তীব্রতায় পুরো পৃথিবী বিপর্যস্ত হয়ে যায়। তোমার চোখের মাঝে যে দৃষ্টি ছিলো, তাতে আমার পাপী সত্ত্বা বিলীন হয়ে গিয়েছিল, যেনো এক মৃদু স্রোতের ধাক্কায় পাথরও গলে যায়।”

কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ২৭

রাতুল থেমে গিয়ে, এক নিঃশ্বাসে বললেন, “কোন গোপনে, আমি আমার মনটাকে হারিয়ে ফেলেছি—আমি বুঝতেও পারিনি। যদি আমাকে জিজ্ঞেস করো, প্রেম মানে কি? আমি শুধু একটিই বলবো—’তুমি’। তুমি আমার জীবনের নিঃশব্দ রাগ ছিলে, কিন্তু তুমি আমার মধ্যে শান্তির গানও গেয়েছিলে। হাজার ক্লান্তির মাঝে, যখন তোমাকে ভাবি, তখন মনে হয় সব কিছু থেমে গেছে। প্রতিটি নিঃশ্বাস যেনো তোমার নাম ছাড়া আর কিছুতে পূর্ণ হয় না। তুমি সেই অপূর্ণ ভালোবাসা, যা কখনো পুর্ণ হবে না, কিন্তু তার মধ্যে এক গভীর প্রশান্তি রয়েছে।”
রাতুলের কথা যেনো সময়ের সীমানা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। প্রতিটি শব্দ ছিলো এক গভীর আবেগ, এক অদৃশ্য, শক্তিশালী বন্ধন, যা শুধু তারা দুজনেই অনুভব করতে পারছিল। চৈতীর চোখের মাঝে, রাতুলের একমাত্র প্রেম—ভালবাসা—স্মৃতি হয়ে, অনন্তকাল ধরে স্মরণীয় হয়ে রইলো।

কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ২৯