কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ৩৪

কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ৩৪
মিসরাতুল রহমান চৈতী

বাইরের বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। রাত যত গভীর হচ্ছে, নীরবতা ততই ভয়ের মতো মনে হচ্ছে। পুরোনো বাড়ির ভেতরে শুধু নিঃশ্বাসের শব্দ—একটা গভীর, ভারী শ্বাস, আরেকটা উত্তেজনায় দ্রুত ওঠানামা করছে।
চৈতীর হাত শক্ত হয়ে আছে, রক্ত থামানোর জন্য কাপড় চেপে ধরে রেখেছে। তার চোখের পাতা কাঁপছে, ঠোঁট শুকিয়ে আসছে, কিন্তু সে দম নিল গভীরভাবে।
রাতুল একদম চুপ, চোখ আধখোলা। মাঝে মাঝে ব্যথায় কুঁকিয়ে উঠছে, কিন্তু কিছু বলছে না।
চৈতী কিছুক্ষণ পর আস্তে করে বলল, “আসিফ আসবে, তাই তো?”
রাতুল চোখ খুলল, কষ্ট হলেও ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটল। “আসবে…
ঠিক তখনই, পুরোনো কাঠের দরজার বাইরে একটা হালকা শব্দ হলো।
চৈতী চমকে উঠে রাতুলের দিকে তাকাল।
রাতুল চোখ খুলল, ফিসফিস করে বলল, “লাইট বন্ধ করো।”

চৈতী দ্রুত উঠে গিয়ে লাইট বন্ধ করল। পুরো ঘর মুহূর্তেই অন্ধকারে ডুবে গেল। শুধু জানালার ফাঁক দিয়ে আসা চাঁদের আলোয় রাতুলের মুখের ছায়া স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
বাইরে আবার শব্দ হলো। এবার একটু ভারী, যেন কারও পায়ের চাপ।
চৈতীর শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে।
রাতুল হাত বাড়িয়ে আস্তে করে তার কব্জি চেপে ধরল। “শান্ত থাকো।”
চৈতী কোনোমতে মাথা নেড়েছে, ঠিক তখনই দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হলো।
কেউ এসেছে।
কিন্তু কে?
চৈতী নিঃশব্দে রাতুলের পাশ ঘেঁষে দাঁড়াল, তার কাঁধের ওপর রাতুলের রক্তমাখা হাত রাখা।
দরজার ওপাশ থেকে কেউ ধীরে ধীরে বলল—
“ভাই… দরজা খোলুন।”
আসিফ?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

চৈতী নিঃশব্দে রাতুলের পাশে দাঁড়াল। কণ্ঠটা পরিচিত হলেও সন্দেহ কাটছে না।
রাতুল আসিফের নম্বরে কল দিল।
বাইরে থেকেই ফোনের রিংটোন বাজল।
রাতুল ধীরে বলল, “দরজা খোলো।”
চৈতী দ্রুত দরজা খুলতেই দেখল—
আসিফ আর এক ডাক্তার, দুজনেই কালো বোরকা পরে এসেছে।
চৈতী বিস্মিত চোখে তাকাতেই আসিফ দ্রুত মুখ খুলে বলল, “ভাবী, বেশি দেরি করা যাবে না, ডাক্তার ভাইয়া আগে ভিতরে ঢুকুক।”

চৈতী দ্রুত সরে দাঁড়াল, আর ডাক্তার ভিতরে ঢুকতেই দরজা আটকে দিল।
আসিফ গভীরভাবে রাতুলের দিকে তাকিয়ে বলল, “ভাই, আপনার কী অবস্থা?”
রাতুল ঠোঁট শক্ত করে বলল, “বেঁচে আছি, আপাতত এটুকুই যথেষ্ট।”
ডাক্তার ইতিমধ্যেই ব্যাগ খুলে কাজ শুরু করে দিয়েছে।
চৈতী আসিফের দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে বলল, “আপনি আসতে পেরেছেন, এইটাই সবচেয়ে বড় কথা।”
আসিফ মাথা নেড়ে বলল, “ভাবী, ঝুঁকি নিয়ে আসতে হয়েছে। এখানে বেশি সময় থাকা যাবে না।”
ঘরের মধ্যে টানটান উত্তেজনা।
চৈতী ঘরের লাইট অন করে দিলো।
ডাক্তার তার ব্যাগ থেকে একে একে সব জিনিস বের করা শুরু করলো।
রাতুলের হাতে আর পা থেকে গুলি বের করতে শুরু করলো।
ঘরের ভেতর শুধু চাপা শ্বাসের শব্দ।
চৈতী নিঃশ্বাস বন্ধ করে রাতুলের পাশে বসে রইল, চোখের কোণে আতঙ্ক জমে আছে।
আসিফ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরে কান খাড়া করে রেখেছে।
ঘরের পরিবেশ থমথমে, কেবল ডাক্তার নিঃশব্দে তার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
রাতুল ব্যথায় মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ করছে, কিন্তু একটা শব্দও বের করছে না।
চৈতী অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

ডাক্তার দ্রুত গজ আর ব্যান্ডেজ বের করে ক্ষতস্থান বাঁধতে শুরু করল। রাতুল চোয়াল শক্ত করে শুয়ে থাকল, যেন ব্যথা সহ্য করতে অভ্যস্ত।
চৈতী পাশে বসে একদৃষ্টিতে দেখছে। তার হাত এখনও কাঁপছে, তবে সে নিজেকে সামলে নিয়েছে।
ডাক্তার কাজ শেষ করে উঠে দাঁড়াল। “রক্তপাত আপাতত বন্ধ হয়েছে, তবে উনাকে সম্পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে।”
আসিফ দ্রুত বলল, “এই জায়গা কি নিরাপদ? বেশি দেরি করা ঠিক হবে?”
চৈতী এবার তাকাল, তার গলায় আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট।
রাতুল আস্তে করে চোখ খুলল। কণ্ঠ ক্লান্ত কিন্তু স্পষ্ট, “এখনই সরা সম্ভব না। আমি জানি, ওরা এখনও শহর তল্লাশি করছে। এখানেই থাকতে হবে কিছুক্ষণ।”
আসিফ কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। তারপর নিচু স্বরে বলল, “আপনি যা বলবেন, তাই হবে ভাই। তবে আমরা সাবধান থাকব।”
চৈতী উঠে গিয়ে জানালার পর্দা ঠিক করে দিল। বাইরে এখনো সব শান্ত, কিন্তু সে জানে না কতক্ষণ এই শান্তি থাকবে।

রাতের নিস্তব্ধতা যেন আরও গাঢ় হয়ে আসছে।
রাত একটু গভীর হতেই চারপাশের নিস্তব্ধতা আরও প্রকট হয়ে উঠল। বাইরে কোনো শব্দ নেই, শুধু মাঝে মাঝে বাতাসের হালকা শোঁ শোঁ শব্দ শোনা যাচ্ছে।
চৈতী একবার জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকিয়ে নিল, চারপাশে এখনো কোনো সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়ছে না। তারপর ফিরে এসে রাতুলের পাশে বসল।
রাতুল চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে, নিঃশ্বাস ধীর হলেও কপালের ঘাম বলে দিচ্ছে ব্যথা সে সহ্য করছে।
ডাক্তার পেছন থেকে আস্তে বলল, “আমি ইনজেকশন দিয়ে দিয়েছি, কিছুক্ষণ পর ব্যথা একটু কমবে। কিন্তু উনাকে বিশ্রাম দিতে হবে।”
আসিফ মাথা নাড়ল। “ভাবী, আপনি একটু বসুন, আমি বাইরে গিয়ে পরিস্থিতিটা দেখে আসি।”
চৈতী ইতস্তত করল, তারপর আসিফকে লক্ষ্য করে বলল, “আপনি সাবধানে যাবেন।”
আসিফ বাইরে বেরিয়ে গেল।
ডাক্তার তার ব্যাগ গুছিয়ে নিতে নিতে বলল, “আমি যেতে পারব?”
চৈতী একবার রাতুলের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি অপেক্ষা করুন, আসিফ ভাই ফিরে এলে বের হবেন। একা যাওয়া নিরাপদ নয়।”

ডাক্তার মাথা নাড়িয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
চৈতী ধীরে ধীরে রাতুলের দিকে তাকাল, তার কপালের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, “আপনি কেমন আছেন?”
রাতুল চোখ খুলল না, শুধু মৃদুস্বরে বলল, “এখনো বেঁচে আছি।”
চৈতীর বুকের ভেতর কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল।
বাইরে তখন হঠাৎ এক পশলা বাতাস উঠল, জানালার পর্দা দুলে উঠল।
কিন্তু সেই বাতাসের সাথে যেন অন্য কিছু মিশে আছে…
একটা অজানা শঙ্কা যেন ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করল।
চৈতী বসা থেকে উঠে আসিফের কাছে গিয়ে বললো, “ভাইয়া, এক কাজ করুন। আমাদের গাড়িটা ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে ফেলুন। ঘরে তো পর্দা টানো আছে, তাই ঘরের আলো বাইরে যাবে না। আজ রাতটা এইখানেই থাকতে হবে, বাহিরে কখন কোন বিপদ উৎপেতে থাকে, তা বলা যায় না। আর ডাক্তারকে বলবেন, আজ রাতটা এইখানেই থাকতে।”

ডাক্তার কোন উত্তর না দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
আসিফ মাথা নেড়ে বলল, “ঠিক আছে, ভাবী। আমি ব্যবস্থা করছি।” তারপর দ্রুত বাইরে চলে গেল।
চৈতী এসে রাতুলের পাশে বসল। রাতুল চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল, তবে তার মুখে ব্যথার ছাপ স্পষ্ট ছিল। চৈতী তার কপালে হাত রেখে বলল, “এখন কেমন আছেন?”
রাতুল নরম গলায় বলল, “এখনো বেঁচে আছি।”

কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ৩৩

আসিফ বাহিরে এসে গাড়িটা ঝোপের আড়ালে রেখে বাড়ির ভিতরে ফিরে এসে দরজাটা বন্ধ করে দিল।
আসিফ চুপচাপ একবার ঘরটি চেক করে দেখল। বাইরে এখন শান্ত, কিন্তু আতঙ্কের ছায়া এখনও তাদের মধ্যে ভর করে আছে। আসিফ চৈতীকে একবার দেখে মাথা নেড়ে বললেন, “সবকিছু ঠিক থাকবে। তবে সতর্ক থাকতে হবে।”
চৈতী আসিফের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকাল, তার চোখে ক্লান্তি আর উদ্বেগের মিশ্রণ। “তবে এখন আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। আর কিছু করার নেই।”
ঘরটি এবার পুরোপুরি নীরব হয়ে গেল। একে অপরের শ্বাসপ্রশ্বাস ছাড়া আর কিছু শোনা যাচ্ছিল না। প্রতিটি মিনিট যেন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।

কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ৩৫