কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ৩৬
মিসরাতুল রহমান চৈতী
সুরঙ্গপথে প্রবেশ করতেই চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে গেল।
পিছনে দরজাটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে গেছে, কিন্তু বাইরের শব্দগুলো যেন এখনো প্রতিধ্বনিত হচ্ছে চৈতীর কানে।
তার নিঃশ্বাস দ্রুত হয়ে আসছে।
আসিফ কাঁধে রাতুলকে ধরে হাঁটছে। পথটা সরু, মাটির দেয়ালে শ্যাওলা জমে আছে, বাতাস ভারী আর স্যাঁতসেঁতে। সামান্য এগিয়ে যেতেই দেয়ালের গায়ে রাখা টিমটিমে কিছু লাইট চোখে পড়ল, যা মনে হচ্ছে বহু পুরোনো।
চৈতী মনে মনে ভাবল, এই জায়গাটা কি আগে থেকেই পরিকল্পনা করা ছিল?
পেছনে দৃষ্টি ফেরাতেই তার বুক ধক করে উঠল—
সুরঙ্গপথের প্রবেশমুখে কেউ যেন লাইট ফেলে দিয়েছে! তার মানে, ওরা ধরা পড়েছে!
“আসিফ ভাই!” চৈতী আতঙ্কিত কণ্ঠে বলল।
আসিফ থামল না, এক ঝলকে পেছন তাকিয়ে বলল, “ভাবী, কোনো শব্দ করবেন না! ওরা টের পেয়ে গেছে!”
চৈতীর শরীর হিম হয়ে গেল।
রাতুলের শরীর তাপ ছড়াচ্ছে, তার মুখটা কেমন নিস্তেজ লাগছে।
“আমরা কি পারব?” চৈতী ফিসফিস করে বলল।
আসিফ দাঁত চেপে বলল, “পারতেই হবে!”
সুরঙ্গের পথটা সামনের দিকে একটু বাঁক নিয়েছে। তারা দ্রুত হাঁটতে শুরু করল।
একটু পরেই সামনে একটা সরু লোহার দরজা দেখা গেল।
“ভাবী, দরজাটা একটু চেপে খুলুন!”
চৈতী দ্রুত হাত বাড়াল। দরজাটা বেশ পুরোনো, মরচে পড়ে গেছে, কপাট ধাক্কা দিতেই একটা কর্কশ শব্দ হলো।
ঠিক তখনই—
পেছন থেকে ভেসে এলো দৌড়ের আওয়াজ!
“ওরা আমাদের পেছনে এসে গেছে!”
আসিফ এক মুহূর্তও নষ্ট করল না, রাতুলকে শক্তভাবে ধরে সামনে বেরিয়ে এলো।
বাইরের বাতাস মুখে লাগতেই বোঝা গেল, জায়গাটা একটা গোপন পুরোনো ফাঁড়ির মতো। চারপাশে ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে আছে, কিছু দূরে একটা পুরোনো কাঠের সেতু।
কিন্তু তাদের দুর্ভাগ্য—
সেতুর ওপাশেই দাঁড়িয়ে আছে দু’জন মুখোশধারী লোক!
চৈতীর বুকের ভেতর ধুকপুক শব্দ বেড়ে গেল।
আসিফ থমকে দাঁড়াল, দ্রুত পরিস্থিতি বিচার করল।
পেছনে শত্রু, সামনে শত্রু!
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এখন কী হবে?
রাতুলের শরীর কাঁপছে।
চৈতী দোনোমনা করছিল, কিন্তু হঠাৎ আসিফ ফিসফিস করে বলল—
“ভাবী, আপনার কাছে কি রাতুল ভাইয়ের কোনো লাইটার আছে?”
চৈতী বুঝতে পারল না, কেন জিজ্ঞেস করছে। তবু হাতড়াতে গিয়ে পেল একটা ছোট লাইটার, যেটা রাতুলের পকেটে ছিল।
“আছে!”
আসিফ সেটা নিয়ে দ্রুত নিচের শুকনো পাতাগুলোয় আগুন ধরিয়ে দিল!
চারপাশে অল্প অল্প ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়তে লাগল।
“ভাবী, ঝুঁকে থাকুন! আমি একটা সুযোগ নিচ্ছি!”
চৈতী সাথে সাথে মাথা নিচু করল।
সামনের শত্রুরা ধোঁয়ায় বিভ্রান্ত হয়ে একটু সরে গেল। এই সুযোগে আসিফ রাতুলকে শক্ত করে ধরে কাঠের সেতুর বিপরীত দিক দিয়ে ঝাঁপ দিল!
চৈতী চিৎকার করে উঠল—
“আসিফ ভাই!”
কিন্তু আসিফ জানত, ওদের পালানোর আর কোনো উপায় নেই!
জলদি সরে যেতে হবে!
চৈতী আর দেরি করল না। নিজের ভয় দূরে সরিয়ে নিয়ে ওদের পেছন পেছন দৌড় দিল!
পেছনে শত্রুরা এখনো হাঁকডাক করছে, কিন্তু ওরা কোনোমতে গা বাঁচিয়ে একটা ধ্বংসপ্রাপ্ত পুরোনো ভবনের দিকে ঢুকে গেল।
আসিফ চৈতীকে ইশারায় থামতে বলল।
শত্রুরা এখনো তাদের খুঁজছে, কিন্তু ওরা এই মুহূর্তে নিরাপদ!
রাতুল এখনো নিস্তব্ধ, তার শরীর নিস্তেজ হয়ে আসছে।
চৈতী থরথর করে কাঁপছে, তবু কষ্ট করে বলল—
“আমরা কি বেঁচে গেলাম?”
আসিফ গভীর শ্বাস ফেলল।
“এখনো না, ভাবী! কিন্তু আপাতত কিছুটা নিরাপদ।”
পেছন থেকে হালকা একটা গোঙানোর শব্দ এলো।
চৈতী চমকে পেছনে তাকাল।
সাথে থাকা ডাক্তার, যার সাহায্য প্রয়োজন ছিল, তিনি মাটিতে পড়ে কাতরাচ্ছেন।
আসিফ দৌড়ে কাছে গিয়ে দেখল—
তার ডান পায়ের গোড়ালিটা কেমন অস্বাভাবিকভাবে বেঁকে গেছে!
“উফফ!” ডাক্তার যন্ত্রণায় চোখ বন্ধ করে ফেললেন।
চৈতী হুড়মুড় করে কাছে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসল, “আপনার কি খুব ব্যথা করছে?”
ডাক্তার কষ্ট করে বললেন, “পা… আমার পা বোধহয়… ফ্র্যাকচার হয়ে গেছে!”
আসিফ বিরক্ত মুখে দাঁত চেপে বলল, “এই অবস্থায় আমরা বেশিক্ষণ এখানে থাকলে বিপদ হবে!”
“কিন্তু উনাকে কি ফেলে যাবো?” চৈতী আঁতকে উঠল।
আসিফ এক মুহূর্ত চুপ করে থাকল, তারপর বলল, “না! কিন্তু আমাদের দ্রুত কিছু একটা করতে হবে!”
ডাক্তার কষ্ট করে বললেন, “তোমরা আগে যাও, আমি…”
“আপনার বাঁচতে হবে!” চৈতী দৃঢ় কণ্ঠে বলল।
তারপর নিজের ওড়না ছিঁড়ে শক্ত করে ডাক্তারের পায়ের চারপাশে পেঁচিয়ে দিল, যেন ওটা একটু হলেও স্থির থাকে।
“আসিফ ভাই, আমরা ওনাকে এভাবে টেনে নিতে পারবো না?”
আসিফ মাথা নাড়ল, “কষ্ট হবে, কিন্তু করতে হবে!”
চৈতী রাতুলের দিকে তাকাল। তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে, চোখ বন্ধ হয়ে আসছে।
একজন আহত, আরেকজন অচেতন—এই অবস্থায় কীভাবে বের হবে তারা?
পেছন থেকে শত্রুদের আওয়াজ আসছে!
আসিফ শক্ত কণ্ঠে বলল, “ভাবী, ধরুন! আমাদের এখনই বের হতে হবে!”
চৈতী আর এক মুহূর্তও দেরি করল না!
বাইরের দিকে ছুটে যেতে হবে, নয়তো সবাই শেষ!
অন্ধকার সুরঙ্গপথের শেষ প্রান্তে এসে, তারা সবাই এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেল। চারপাশে এক ধরনের চাপা, ভারী বাতাস ভেসে আসছিল। গন্ধটা খুবই ঘৃণিত—ধুলোচাপ, ময়লা আর পুরোনো কাঠামোর মিশ্রিত গন্ধে যেন পুরো জায়গাটা আচ্ছন্ন হয়ে ছিল। চৈতী বুকের মধ্যে গভীর শ্বাস টেনে নিল, যেন এত সময় ধরে যে সংকট তারা পেরিয়েছে, তা একরকম বিশ্বাস করতে পারছিল না।
অনেক কষ্টে, একে একে দরজাটা খুলে বেরিয়ে আসল তারা। কিন্তু বাইরে বেরিয়েই দেখা গেল, আরও বড় বিপদ অপেক্ষা করছে। ডাক্তার পায়ের ব্যথায় হাঁটতে পারছিল না, আর রাতুলের তো কোন জ্ঞান নেই। তাদের অবস্থা খুবই খারাপ।
কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ৩৫
ঠিক তখনই, অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে দশজন লোক তাদের ঘিরে ধরল।
সলে কি চূড়ান্ত বিপদ অপেক্ষা করছে সামনে? জানতে হলে সাথে থাকুন।
