কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ৪৩
মিসরাতুল রহমান চৈতী
বিকাল হয়ে এসেছে । সব কাজ শেষে ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাড়িতে ফিরে রাতুল। ঘরে ঢুকেই দেখে চৈতী গভীর ঘুমে। মুখে প্রশান্তি, শরীরে একটা দুর্বলতা ছড়িয়ে আছে যেন। তাকে না ডেকে ধীর পায়ে আলমারির দিকে এগিয়ে যায়, জামা নিয়ে সোজা ওয়াশরুমে।
ফ্রেশ হয়ে ফিরে এসে বিছানায় বসে চৈতীর কপালে একটা হালকা চুমু খায়।
– চৈতী…
চৈতী ধীরে চোখ মেলে তাকায়, একটু ঘুম জড়ানো গলায় বলে,
– আপনি এসেছেন?
– হ্যাঁ, অনেক কথা বলার ছিল তোমার সঙ্গে…
তবে কথা শেষ হওয়ার আগেই দরজায় টোকা পড়ে। একজন সার্ভমেন্ট মাথা নিচু করে বলল,
– স্যার, নিচে পুলিশ আর কিছু রিপোর্টার এসেছে।
রাতুলের মুখ থমকে যায়। চোখ দুটো কঠিন হয়ে ওঠে। সে দ্রুত ফোনটা বের করে কল দেয় আসিফকে।
– এখনই বাসায় চলে আয়, জরুরি।
তারপর চৈতীর দিকে তাকিয়ে বলে,
– তুমি ঘরে থাকো। দরজা বন্ধ করে বসে থাকো।
কিন্তু চৈতী চুপচাপ মাথা নাড়ে, তবু ঘরে থাকে না। ওড়নায় মুখ ঢেকে ধীরে ধীরে পেছন পেছন নেমে আসে নিচে।
রাতুল নিচে গিয়ে পুলিশ অফিসারের সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– কী ব্যাপার অফিসার? হঠাৎ এত মিডিয়া, এত পুলিশ?
পুলিশ অফিসার গম্ভীর মুখে বললো,
– আমাদের কাছে তথ্য আছে, আপনি একজনকে খুন করেছেন এবং সেই ডেড বডি আপনার গাড়ির ডিকিতে লুকানো রয়েছে। সাথে ড্রাগসও। আমরা ওয়ারেন্টসহ এসেছি।
রাতুল থমকে যায়। মুহূর্তেই চারপাশ ঘিরে নেয় ক্যামেরার ফ্ল্যাশ, মিডিয়ার চিৎকার।
পুলিশ তার গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়।
গাড়ির ডিকি খুলে…
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
একটা কালো ব্যাগ। আর তার পাশেই প্লাস্টিক মোড়ানো কিছু প্যাকেট।
প্যাকেট খুলতেই সাদা পাউডার—ড্রাগস। আর কালো ব্যাগের ভেতর এক যুবকের নিথর দেহ।
চৈতী আড়াল থেকে দেখছিলো সব। মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায়।
রাতুল কিছু বলছিলো না। সে শুধু এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো ওই ডেডবডি আর ড্রাগসের দিকে।
পুলিশের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রাতুলের দিকে একের পর এক মাইক্রোফোন এগিয়ে আসছে।
প্রেস রিপোর্টারদের প্রশ্নে কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে—
– আপনি কি সত্যিই খুন করেছেন?
– ড্রাগসের পেছনে কি আপনার রাজনৈতিক হাত আছে?
– মৃত লোকটি কে?
– আপনি কি চৈতী ম্যাডামের নামও টানবেন এতে?
রাতুল কিছুই বলছে না। তার চোখ যেন সুনশান একটা নির্জনতা পেরিয়ে কোথাও স্থির হয়ে গেছে। ঠিক তখনই আসে আসিফ।
চারদিকের হট্টগোলের মাঝে ভেসে আসে আসরের আজান।
একটা কষ্টের ঢেউ যেন বুক চিরে উঠে আসে রাতুলের ভিতর থেকে।
পুলিশেরা এসে ওর হাতে হাতকড়া পরায়।
আসিফের দিকে তাকিয়ে রাতুল শান্ত গলায় বলে ওঠে—
– আসিফ… আজ থেকে তোর বোন, আমার বিবি। আমি চলেছি যুদ্ধের বাইরে। ওর যুদ্ধটা এখন শুরু… তোর হেফাজতে রেখে যাচ্ছি ওকে। অস্ত্র ধরা থেকে তলোয়ার চালানো—সব শিখাবি ওকে।
ও একটু আধটু গাড়ি চালাতে পারে, কিন্তু তুই ওকে শেখাবি যুদ্ধের মতো করে চালাতে। যাতে দরকার হলে ও একাই লড়তে পারে।
আর মনে রাখিস… পতিতালয়ের কাজ যেন থেমে না থাকে।
আসিফ কিছু বলছিল না। ওর চোখে জল। চৈতী পেছনে দাঁড়িয়ে সব শুনছিল, ঠোঁট কাঁপছিল ওর, চোখে বিস্ময়ের সাথে একগাল নীরব আর্তি।
রাতুল চৈতীর দিকে এগিয়ে গেল।
– বিবিজান, একটা অনুরোধ করবো… কপালে একটা চুমু দিতে চাই। অনুমতি দেবে?
চৈতী কিছু বলল না। শুধু ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলো রাতুলের দিকে।
রাতুল ওর কপালে একটা চুমু একে দিয়ে ধীরে বললো,
– সাবধানে থেকো… তুমি এখন আমার যোদ্ধা।
তারপর পুলিশের ইশারায় ধীরে ধীরে পা বাড়ায় রাতুল।
হাতকড়া পরা, মুখে নির্লিপ্ত এক শান্তি… মাথা উঁচু করে, পা মিলিয়ে সে এগিয়ে যায় পুলিশের পেছনে।
আসিফ আর চৈতী দাঁড়িয়ে থাকে।
চৈতীর ওড়না বাতাসে একটু দুলে ওঠে।
রাতুলের পেছনে পেছনে হাতকড়া পড়ে চলে যাওয়ার দৃশ্যটা এখনো চৈতীর চোখের সামনে ভেসে আছে।
চারপাশে ক্যামেরার ফ্ল্যাশ, মাইক্রোফোনের ঝড় আর মানুষের কোলাহল—সবকিছু যেন ওর কানে বয়ে যাচ্ছে একটা বজ্রপাতের মতো।
রাতুল গাড়িতে উঠে চলে যেতেই সাংবাদিকদের চোখ ঘুরে পড়ে চৈতীর দিকে।
এক ঝাঁক রিপোর্টার যেন ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ওপরে।
– আপনি কি জানতেন রাতুল মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত?
– মৃত লোকটি কে আপনাদের চেনা?
– আপনিও কি এর সাথে কোনোভাবে যুক্ত?
– আপনার বিয়েটা কি ছিল শুধুই একটা নাটক?
চৈতী কিছু বলছে না। ঠোঁট কাঁপছে, বুক ধকধক করছে, কিন্তু মুখে কোনো শব্দ নেই।
চোখে জল এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে কপালের পাশ।
ঠিক সেই সময় আসিফ ভিড় ঠেলে এগিয়ে এসে চৈতীর হাত ধরে বলে ওঠে—
– আর না! ব্যস! এভাবে কাউকে ধ্বংস করে ফেলবেন না আপনারা!
চৈতীকে শক্ত করে ধরে টেনে নিয়ে আসে ঘরের ভেতরে।
পেছনে থেকে ক্যামেরার ফ্ল্যাশ আর চিৎকার ভেসে আসছিল,
– ম্যাডাম প্লিজ, একটা উত্তর দিন!
– আপনি চুপ করে আছেন কেন?
আসিফ দরজাটা বন্ধ করে দেয় শক্ত করে।
সব শব্দ যেন এক ঝটকায় থেমে যায়।
ভেতরে তখন নিঃস্তব্ধতা।
চৈতী দাঁড়িয়ে আছে দরজার পাশে।
ওর দেহ যেন নিস্তেজ হয়ে পড়েছে।
চোখ দিয়ে ধীরে ধীরে টপ টপ করে পানি পড়ছে মেঝেতে।
আসিফ বললো–
কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ৪২
“ভাবী চিন্তা করবেন না আপনি একা নন আমরা সবাই আছি।”
চৈতী তাকালো আসিফের পানে তার চোখে শুধু একটাই প্রশ্ন —এই লড়াইয়ের শেষ কোথায়?