কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ৯
মিসরাতুল রহমান চৈতী
দীর্ঘদিন ধরে নারীর সঙ্গ পাওয়া কোনো পুরুষ হঠাৎ করে সেই সঙ্গ হারালে এক অদ্ভুত শূন্যতা তাকে গ্রাস করে—ঠিক তেমনি এক বিষাদের অনুভূতি রাতুলকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। শরীরটা যেন একেবারে অবশ হয়ে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে সব ইচ্ছেগুলো ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।
সে বুঝতে পারছে না কী করবে। চোখ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস নিতে থাকে, যেন নিজের ভেতরের সব উত্তাপকে ঠান্ডা করতে পারবে। কিন্তু মন যেন কোনোভাবে স্থির হচ্ছে না। হঠাৎ করেই সে চোখ মেলে তাকালো—চেনা আশ্রয়ের খোঁজে পা বাড়ালো মায়ের রুমের দিকে।
নিজের রুমে থাকলে কোনো অঘটন ঘটে যেতে পারে, আর সেই ভয়টাই তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। চৈতীর প্রতি করা প্রতিটি প্রতিশ্রুতি, প্রতিটি কথা তার মনে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। সে কোনোভাবেই ওয়াদা ভাঙবে না।
মায়ের ঘরে ঢুকে ফ্লোরে বসে বিছানায় মাথা ঠেকিয়ে যেন মায়ের স্নেহের উষ্ণতায় নিজেকে হারিয়ে ফেলল। এই শূন্য মুহূর্তেও মায়ের উপস্থিতি তার মধ্যে এক ধরনের শান্তি নিয়ে আসলো। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল।
ওয়াশরুমে গিয়ে ওযু করল, যেন সব পাপ, ক্লান্তি আর অশান্তি ধুয়ে ফেলতে পারে। ফিরে এসে ফ্লোরে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজে দাঁড়াল।
এখন একমাত্র নামাজই পারে তাকে সঠিক পথ দেখাতে। সৃষ্টিকর্তার কাছে মাথা নত করে, সব কষ্ট, দুঃখ আর ভয় তাঁর কাছে সমর্পণ করল। যেন এই অন্ধকারের ভেতর থেকে আলোর একটি ক্ষীণ রেখা বেরিয়ে আসে, আর সেই আলোয় তার সমস্ত গ্লানি মুছে যায়।
“আল্লাহ তুমি আমার মনটাকে শান্ত করো, যেন আমি আমার প্রতিটি ওয়াদা রাখতে পারি…” — রাতে এই প্রার্থনার মধ্যেই হারিয়ে গেল রাতুল, এক নতুন ভোরের আশায়।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
নামাজ শেষ করে রাতুল ধীরে ধীরে জায়নামাজ গুছিয়ে রাখলো। তার চোখে এখনো ক্লান্তির ছাপ, কিন্তু মনে একটুখানি শান্তি নেমে এসেছে। মায়ের ঘরে বসে কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে উঠে দাঁড়াল। জানালার পাশের চাঁদের আলো ফিকে হয়ে আসছে, ভোরের আভাস যেন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে আকাশে।
রাতুল মনে মনে ভাবলো, “চৈতীর জন্য আমাকে আরও শক্ত হতে হবে। আমি হারতে পারি না।”
রাতুল কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকল, যেন নিজেকে পুরোপুরি প্রস্তুত করার চেষ্টা করছে। তার মন থেকে সব দুশ্চিন্তা, ভয় এবং অস্থিরতা দূর করতে, একমাত্র পথ ছিল তওবাহ এবং আল্লাহর দিকে ফিরে আসা।
একটু পরে, রাতুল উঠে গিয়ে তবজি নিয়ে বসে পড়লো। তার ঠোঁটে ছিল যিকিরের শব্দ, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” (আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই)। এক এক করে এই শব্দগুলো তার কানে প্রবাহিত হচ্ছিল। প্রতিটি শব্দ তার মনকে গভীর শান্তি ও শক্তির সঙ্গে ভরিয়ে দিচ্ছিল। তার ভিতর থেকে সব অশান্তি, ভীতি, এবং পৃথিবীর বোঝা যেন একে একে ঝরে পড়ছিল।
“আল্লাহ, তুমি আমার জন্য পথ দেখাও, আমাকে আমার প্রতিশ্রুতি রাখতে সাহায্য করো,”— এই প্রার্থনাটি রাতুলের ঠোঁট থেকে বারবার উচ্চারিত হচ্ছিল। যেন তার সমস্ত কষ্ট, তিক্ততা, আর সংকট আল্লাহর কাছে সমর্পণ করছে।
বয়সের ভার, কষ্টের বোঝা, সব কিছু যেন এক মুহূর্তে হালকা হয়ে গেল। তার মনে শান্তির এক নতুন প্রভাত শুরু হয়েছিল। চৈতীকে বাঁচানোর, তার সঙ্গে থাকার, তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার শক্তি এখন তার ভেতর ছিল।
যিকির শেষ হওয়ার পর, রাতুল ধীরে ধীরে মাথা তুলে তাকালো। তার চোখে এখন কোনো ভয় বা বিভ্রান্তি ছিল না। বরং তার চোখে ছিল দৃঢ় সংকল্প, অটুট আত্মবিশ্বাস। আজ থেকে নতুন পথের সূচনা, চৈতীর জন্য তার সবকিছু অর্পিত।
সবার আগে, তাকে এখন প্রস্তুত হতে হবে। এই শান্তির মধ্যে, এক গভীর শক্তির অনুভূতি ছিল যা তাকে সঠিক পথে চালিত করবে।
রাতুল জায়নামাজে বসে কোরআন শরিফ তেলাওয়াত করতে শুরু করলো। কতদিন পর সে এই তেলাওয়াত করছে, তা সে নিজেও জানে না। তবে, আজকের এই মুহূর্ত যেন তার হৃদয়ে এক নতুন অনুভূতির জন্ম দিয়েছে। প্রতিটি আসমানী অক্ষর তার কানে প্রবাহিত হচ্ছিল, এবং প্রতিটি আয়াত তার মনকে গভীর শান্তি আর শক্তি দিয়ে পূর্ণ করছিল। মনে হচ্ছিল, যেন তার সমস্ত শঙ্কা আর ভয় কোরআনের কথা শুনে ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে।
এটি ছিল রাতুলের আত্মার পূর্ণতা। যে শান্তির মধ্যে সে ডুবে ছিল, তাতে সে বুঝতে পারছিল, তার সব দুঃখ, ক্লান্তি এবং অস্থিরতা আল্লাহর কাছে সমর্পিত হয়েছে। আজকের এই তেলাওয়াত, তার জন্য এক নতুন জীবন শুরু হওয়ার মুহূর্ত ছিল।
পাশের রুমে চৈতী ঘুমাচ্ছে। যদি সে দেখতো তাহলে হয়তো সে ছুটে এসে তার ভালোবাসাটা গ্রহণ করে নিতো। কিন্তু সে তো জানতেও পারলো না।
সারা রাত জেগে আল্লাহর ইবাদত করতে করতে কখন যে জায়নামাজের উপর ঘুমিয়ে পড়েছিল, সেটা রাতুল নিজেও জানে না। ভোরের আলো জানালা দিয়ে এসে চোখে লাগতেই তার ঘুমটা ভেঙে গেল।
চোখ মেলে ধীরে ধীরে চারপাশটা দেখল। দেখল, এখনো সে জায়নামাজের উপরই শুয়ে আছে। শরীরের প্রতিটি অংশ যেন অবসন্ন, কিন্তু মনে এক অদ্ভুত শান্তি নেমে এসেছে।
ধীরে ধীরে উঠে বসলো। একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বললো,
“আল্লাহ, আজ থেকে নতুন করে শুরু করবো।”
জায়নামাজ থেকে উঠে ধীরে ধীরে সেটি সুন্দর করে গুছিয়ে নিল রাতুল। প্রতিটি ভাঁজে যেন ছিল তার ইবাদতের স্পর্শ, শান্তির এক অনুভূতি। যত্ন করে জায়নামাজটা ভাঁজ করে আলমারির ওয়াড্রোবে রেখে দিল।
সবকিছু ঠিকঠাক করার পর গভীর এক শ্বাস নিয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়াল। মনে হলো, এই ছোট্ট কাজটার মধ্যেও এক অদ্ভুত প্রশান্তি লুকিয়ে আছে—যেমনটি পাওয়া যায় সবকিছু ঠিকঠাক করার পর।
নিজের রুমে এসে রাতুল ধীরে ধীরে দরজাটা বন্ধ করলো। রুমের ভেতরে ছড়িয়ে থাকা অগোছালো জিনিসগুলো তার চোখে পড়ল। প্রতিটা জিনিস যেন তার মনের অস্থিরতার প্রতিফলন।
একটু থেমে চারপাশে তাকালো। তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে জানালার পর্দা সরিয়ে দিল। ভোরের আলো রুমের ভেতরে ঢুকে চারপাশ আলোকিত করে তুললো। ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটা এসে তার ক্লান্ত মুখে একটুখানি স্বস্তি দিল।
রাতুল নিজের টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল। চেয়ারে বসে চোখ বন্ধ করে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল। তারপর ডায়েরি খোলার জন্য হাত বাড়াল—যেখানে সে সবসময় তার অনুভূতি, পরিকল্পনা আর প্রতিজ্ঞাগুলো লিখে রাখে।
আজ সে লিখবে, “আমি হারব না। চৈতীর জন্য, নিজের জন্য, এবং আল্লাহর দেওয়া এই জীবনের জন্য—আমি লড়বো।”
ডায়েরিতে প্রথম লাইনটি লিখেই তার মনে শক্তির নতুন ঢেউ বয়ে গেল। এখন তার সামনে একটাই লক্ষ্য—চৈতীকে আগের মতোই হাসিখুশি করে তোলা।
ধীরে ধীরে ঘুম থেকে উঠলো চৈতী। চোখ কচলাতে কচলাতে চারপাশে তাকাল। নরম আলোতে ভেসে আসা সকালটা যেন একটুখানি শান্তি এনে দিচ্ছিল। হঠাৎই তার দৃষ্টি পড়লো সামনে—পড়ার টেবিলের কাছে বসে আছে রাতুল।
নিরব, স্থির ভঙ্গিতে ডায়েরির পাতায় কিছু লিখছে সে। মুখে গভীর মনোযোগের ছাপ, ভ্রু কুঁচকে আছে সামান্য। জানালা দিয়ে আসা সূর্যের আলো তার মুখে পড়ছে, যেন পুরো দৃশ্যটাকে আরও স্পষ্ট করে তুলছে।
চৈতী কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। ফ্রেশ হয়ে আসতেই চৈতী দেখলো, রাতুল তার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা আর কণ্ঠে নরম কিন্তু কঠিন সুরে বলল, — “রেডি হয়ে থাকবে। আমি তোমাকে স্কুলে নিয়ে যাবো আর স্কুল থেকে নিয়ে আসবো। বোরকা পড়ে নিবা।”
চৈতী অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, — “স্কুলে বোরকা পড়বো?”
রাতুল ঠান্ডা গলায় জবাব দিলো,
— “হ্যাঁ, পড়বা। তুমি এমপির বউ, কেউ তোমাকে কোনো প্রশ্ন করবে না।”
চৈতী কাঁধ উঁচিয়ে হাসলো, — “ক্ষমতার অসৎ ব্যবহার করছেন এমপি আহাম্মেদ।”
রাতুলের ঠোঁটে এক চিলতে হাসি খেলল, চোখে খেলা করলো গভীরতা, — “এটা অসৎ ব্যবহার না, বরং সৎ ব্যবহার। এতো দিন যা করেছি, সবই ছিলো অসৎ।”
চৈতী ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলো, — “হঠাৎ এতো সাধু হচ্ছেন যে?”
রাতুল এবার চেয়ার থেকে হেলে বসে চোখে সরল কিন্তু গভীর এক দৃঢ়তা নিয়ে বললো, — “এতো দিন কোনো পবিত্র ফুল ছিলো না, তার পবিত্র সুবাসও ছিলো না, তাই সাধু হতে পারিনি। কিন্তু এখন আছে। আর সেই সুবাসকে আমি গোটা দুনিয়ার থেকে আড়াল করে রাখতে চাই।”
একটু থেমে, গলার স্বর নরম থেকে কঠিন হয়ে উঠল— “বেশি বেয়াদবি না করে যাও, বই-খাতা-কলম গুছিয়ে নাও। টাইম মতো স্কুলে যেতে হবে।”
চৈতী ধীরে ধীরে বই-খাতা গুছিয়ে নিলো। সবকিছু ঠিকঠাক করে রাখার পর, আলমারি থেকে বোরকা বের করে পরলো। তারপর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সুন্দর করে হিজাব বেঁধে নিলো, যেন কোনো দিকেই ত্রুটি না থাকে। তার মুখে এক অদ্ভুত দৃঢ়তার ছাপ ফুটে উঠছিল।
এদিকে রাতুলও উঠে চলে গেলো ফ্রেশ হতে। বেশ কিছুক্ষণ পর ফ্রেশ হয়ে ফিরে এলো। তার চোখেমুখে ছিল একরাশ প্রশান্তি আর দায়িত্বের গাম্ভীর্য।
কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ৮
দুজনেই নাস্তার টেবিলে গিয়ে বসল। নাস্তা করতে করতে তাদের মধ্যে অদ্ভুত এক নীরব বোঝাপড়া চলছিল—শব্দের প্রয়োজন ছিল না, শুধু চোখের ভাষাই যথেষ্ট ছিল।
নাস্তা শেষ করে দুজনেই প্রস্তুত হলো রওনা দেওয়ার জন্য। গাড়ির দরজা খুলে চৈতীকে আস্তে করে বসতে সাহায্য করলো রাতুল। গন্তব্য—স্কুল। চৈতীর জন্য নিরাপত্তা আর দায়িত্ববোধের এই ছোট ছোট মুহূর্তগুলো যেন রাতুলের ভালোবাসাকে আরও দৃঢ় করে তুলছিল।