খেয়ালি আমি হেয়ালি তুমি পর্ব ১২
আনিকা আয়াত
প্রতিদিন খুব ভোরে উঠা চৈতীর একপ্রকার অভ্যাসে পরিনত হয়েছে! রাত জেগে পড়াশোনা কমপ্লিট করেই তবে সে ঘুমাতে যায়। আবার ফজরের ওয়াক্তেই উঠে পড়ে। গ্রামে থাকাকালীনও এটাই ছিল তার রুটিন। পড়াশোনার পাশাপাশি মায়ের হাতের কাজে সাহায্য করা, একসাথে নামাজ পড়াও ছিলো নিত্যদিনের তালিকায়। বরাবরের মতো চৈতী ফজরের নামাজ পড়ে কিছুক্ষণ পড়তে বসলো। আজ সেই দিন! যে দিনের জন্য এ- কয়েকদিন বন্ধুদের মাঝে ছিলো উত্তেজনা! উৎকন্ঠা! নবীন বরণে নিজেদের স্পেশাল ভাবে সাজানোর পাশাপাশি স্টেজ কাঁপিয়ে গান, উপস্থাপন এবং নাচে অংশগ্রহণ করে ফাটিয়ে দেওয়া। ছোটবেলা থেকেই চৈতীর মনোবল দৃঢ় ছিল। স্কুল, কলেজের সবগুলো ফাংশনে অ্যাটেন্ড করাও একপ্রকার সাহসের মধ্যে পড়ে। চৈতী মনে প্রাণে বিশ্বাস করতো, সব কিছুতেই অংশগ্রহণ করা উচিৎ। সফল হওয়ার চেয়ে ইচ্ছে শক্তি বড় বিষয়। কিন্তু দূরের ভার্সিটিতে প্রথম অনুষ্ঠানে তার খুবই নার্ভাস লাগছে..! এত হাজার মানুষের মাঝে কিভাবে স্টেজের সামনে দাঁড়াবে, সেটাই কয়েকদিন প্রাকটিস করেছে। কিঞ্চিৎ ভুল হয়ে আবার লজ্জায় না পড়তে হয়।
সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যেই গোসল সেরে ব্রেকফাস্ট করলো। তার রুমমেট পরিশ্রমী তাহিয়ার সাথেও ইদানীং খুব ভালো সম্পর্ক হয়েছে। ছোটবোনের মতো স্নেহ করে চৈতীকে। ওইদিন অর্পণের শার্ট হাতে নিয়ে হলে ফিরে আসার পর তাহিয়া সন্দিহান দৃষ্টিতে প্রশ্ন করেছিলো। চৈতী ইতিউতি করে মস্তক নত রেখে শুধু বলেছিল,
“ অর্পণ শেখ এর শার্ট। আমার ভুলের জন্য নষ্ট হয়েছে। তাই আমাকেই হাতে ধরিয়ে দিয়েছে, পরিষ্কার করার জন্য!”
“ ফাইনাল ইয়ারের অর্পণ শেখ? ওই-যে সমুদ্রের বন্ধু! বখাটে ছেলেটা! ”
তাহিয়ার রাগান্বিত এবং বিরক্ত কণ্ঠস্বরে চৈতী ভয়ে শুধু মাথা ঝাঁকিয়ে চলে গেছে। রাতে পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলতেই তাহিয়া চৈতীকে আদর করে বলেছে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ এ শহরে ভালো মানুষের চাইতে খারাপ, ইতর লোকের সংখ্যা বেশী চৈতী। আমি তোমার বড় বোনের মতো! তুমি খুব মেধাবী ও পরিশ্রমী। এই জায়গায় পৌঁছানোর আগে কতশত কষ্টের গল্প তোমার ভেতরে লুকিয়ে আছে। আমি কিছুটা হলেও অনুভব করি। তবে, শুন! নিজেকে শক্ত রাখতে হবে। কাঁদা পানিতে পা ফেলা যাবে না। তাহলে, একসময় তোমার সব স্বপ্ন মরিচীকার মতো হাওয়া হয়ে যাবে! আমি খুব করে চাই আন্টি-আংকেলের গর্বের কারণ হও। একদিন সাফল্যের উচ্চতায় পৌঁছে নিজের জায়গা বুঝে নাও। দেখিয়ে দাও সবাইকে..! চৈতী দূর্বল নয়। তাই ভুল পথে না হেঁটে সাফল্যের পথে হাঁটো। আমি জানি, এসব কথা তোমার ভালো লাগছে না। তবে, এতদিন এক রুমে থেকে তোমাকে যতটা পড়তে পেরেছি, আমি চাইনা তুমি ওদের সঙ্গে নিজেকে জড়াও। ওরা এ শহরে তাদের পাওয়া-রে চলে। তাদের পরিবার রাজনৈতিক নেতার নয়তো সুনামধন্য বড় লোক! এখানে আমি-তুমি সাধারণ মানুষ। ওদের কিছুই হবেনা কিন্তু আমাদের মতো মধ্যবিত্তদের ক্যারিয়ার এবং জীবন দুটোই নষ্ট হয়ে যাবে। আমি চাই তুমি অর্পণের থেকে নিজেকে দূরে রাখো। ওরা কিন্তু একদমই ভালো নয়। ভার্সিটির প্রতিটি মেয়েকে জ্বালিয়ে মারে। তাছাড়া ওই সমুদ্র তো একেবারে প্লে বয়! ”
চৈতী মন দিয়ে শুনেছে তাহিয়ার কথা। মেয়েটার মিষ্টি করে বুঝানো-তে একটাও ভুল খুঁজে পায়নি সে। এরপর থেকেই চৈতী দূরত্ব রেখে চলছে! পরেরদিন শ্রাবণ-কে দিয়ে যখন শার্ট পাঠালো তখনও কত রাগ অর্পণের। জেনো তার মানসম্মানে লেগেছে বিষয়টা। কেনো মেয়েটি নিজে এসে তার হাতে তুলে দিলো না? কেনো দুটি ভালো কথা বললো না? নষ্ট করার সময় মনে ছিলো না? এই শার্ট এত সস্তা নয়। এভাবে যে কেউ হাতে ধরতে পারেনা। বন্ধুর হাতে ধরিয়ে দিয়েই কি সে বেঁচে যাবে? রেগে সে দাঁত চেপে শ্রাবণ-কে বলল,
“ তোর বান্ধবী কই? এই মুহুর্তে ডাক!”
শ্রাবণ ভয়ে থতমত খেয়ে নিচু কণ্ঠে উত্তর দিলো,
“ ও একটু ব্যস্ত ভাই। উপস্থাপনে টপিক নিয়ে। তাই রিহার্সেল করছে। ”
অর্পণ কটমট করে তাকায়। শ্রাবণের টি-শার্ট খামচে ধরে শাসিয়ে বলেছিল,
“ ১০ মিনিটের ভেতর আমার সামনে দেখতে চাই। যদি না আসে তোর এই মুখ থেঁতলে দিবো। ”
অর্পণের হাত থেকে ছাড়া পেয়েই শ্রাবণ ধুরু ধুরু বুকে ক্লাসের সামনে আসলো। দেখতে পেলো, চৈতীর ভয়ার্ত মুখ। মেয়েটাও এতক্ষণ দূর থেকে লুকিয়ে দেখছিল। শ্রাবণের চুপসে যাওয়া মুখ দেখে চৈতী দাঁত দিয়ে নখ খুঁটে অস্ফুট স্বরে বলল,
“ বাজে ভাবে ফেঁসে গেলাম! ওই ছেলেটার হাত থেকে রেহাই কিভাবে পাবো দোস্ত। কেনো তোরা সবসময় ভয়ংকর বিপদে আমাকে ফাঁসিয়ে দিস? ”
শ্রাবণ ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে চৈতীকে দ্রুত যেতে বলল। হাতে মাত্র ৪ মিনিট সময়। যদি এরপর সত্যি সত্যি তার মুখ থেঁতলে দেয়? তখন কি উপায়? অর্পণ শেখ কে দিয়ে বিশ্বাস নেই। চৈতী মনে মনে ভয় পেলেও বুকে আকাশ সম সাহস নিয়ে অর্পণের সামনে দাঁড়ালো। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“ কি বলবেন বলুন। আমাকে যেতে হবে। ”
“ এত কিসের তাড়া? জামাই রেখে আসছিস? তুই আমার শার্ট কে অবহেলা করিস? ওই বা/ল – সাল রে দিয়া আমার শার্ট পাঠাইলি? ভয় করলো না? তোরে যদি এখন কষিয়ে চড় মা/রি কি করবি?”
অর্পণ চৈতীর মুখের দিকে কটমটিয়ে তাকিয়ে রাগান্বিত গলায় বলল। চৈতী ঘামতে শুরু করে। বামহাতের উল্টো পিঠ দিয়ে কপাল মুছে নিচু স্বরে বলল,
“ দুঃখীত। মাফ করবেন আমাকে। সত্যি এতকিছু ভেবে আমি ওর কাছে শার্ট পাঠাইনি। তাহলে হয়তো আমি-ই নিয়ে আসতাম। ”
অর্পণের ভ্রু কুঁচকে গেলো। চটপট বলল,
“ হয়তো মানে কি? বল আমি-ই নিয়ে আসতাম। ”
চৈতী হালকা ঢোক গিলে বলল,
“ আমিই নিয়ে আসতাম। এবার যাই? আমার দেরী হচ্ছে! ”
“ যাহ বা//ল। ” বলেই অর্পণ তুষিবের সাথে দূরে কোথাও চলে গেলো।
চৈতী সেইদিনের পর থেকে আর কথা বলেনি। অনুষ্ঠানের ব্যস্ততায় অর্পণেও সময় হয়নি। সারাক্ষণ প্যান্ডেল, স্টেজ এবং লাইটিং সহ বিভিন্ন কিছু আয়োজনের কাজে ব্যস্ত ছিলো।
স্নিগ্ধা বান্ধবীদের সঙ্গে ম্যাচিং করা শাড়ি পড়ো নিলো। মিষ্টি তাকে সাহায্য করলো শাড়ির কুঁচি ধরায়। মেয়েটি হালকা মেকআপ করে ঘন চুল গুলো ভালোভাবে আঁচড়ে ছেড়ে দিলো। শুধু কানের পেছনে কালো ক্লিপ দ্বারা বেলির গাজরা লাগিয়ে রেডি হয়ে নেয়। ব্রাশ পিংক রঙের শাড়িটা যেনো ফর্সা গায়ে দ্বিগুণ উজ্জ্বলতা বাড়িয়ে দিয়েছে। স্নিগ্ধা আয়নায় নিজেকে দেখে চুড়ি পড়ার মাঝে শুনতে পেলো মিষ্টির টিপ্পনী কথা।
“ রানু মন্ডল কেও তোর থেকে সাত গুণ সুন্দর লাগে। এই সাজে তুই ডান্স করবি? ছেলেরা টাঙ্কি খেয়ে পড়া তো দূর মুখ মুচড়ে ছি ছি বলবে। ”
স্নিগ্ধার মুহুর্তেই রাগ উঠে যায়। পেছন ঘুরে দাঁতে দাঁত চেপে তাকাতেই খিকখিক করে হেঁসে দৌঁড়ে পালায় মিষ্টি। স্নিগ্ধা পার্স ব্যাগ হাতে নিয়ে বেরিয়ে এসে মিষ্টির উদ্দেশ্যে বলল,
“ আজকের পর থেকে আমার জিনিসে হাত দিয়ে দেখিস। খু//ন করে ফেলবো মিষ্টির বাচ্চা। তোর মতো করলার জুস কে মিষ্টি নাম কেনো রেখেছে আম্মু? শয়-তান একটা। থাপড়িয়ে কান গরম করে দিবো। ”
মিষ্টি ভেংচি কাটলো। বিড়বিড় করলো,
“ তুই শাঁকচুন্নী হয়ে যদি স্নিগ্ধা হতে পারিস। তবে আমিও করলা হয়ে মিষ্টি হতে পারি। জংলী একটা। ”
স্নিগ্ধার আয়েশা জামানকে বলে বেরিয়ে পড়লো ভার্সিটিতে। হনহনিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় দেখা হয়ে যায় জামিল শেখ-এর সাথে। আংকেলের পেছনে অর্ণব-ও আছে। প্রথমে আঙ্কেল-কে দেখে মৃদু হেঁসে সালাম দিলেও পেছনে অর্ণবের পানে চোখ যেতেই লজ্জা পেল সে। চোখ নিচু করে পা বাড়ালো সিঁড়িতে। কিন্তু অর্ণবের চোখ যেনো অজান্তেই পলকহীন ভাবে আটকে গেলো। সে হা করে তাকালো মেয়েটার দিকে। আজ প্রথম শাড়িতে এই মোহনীয় নারীকে দেখে তার হৃদয়ে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। খোলা চুল গুলোর সঙ্গে মুখের হালকা মেকআপে ঘোর লেগে গেলো তার। সে নির্লজ্জের মতো তাকিয়েই রইলো। চোখের চশমা খুলে আনমনেই বলে ফেলল,
“ অপূর্ব! আজ মানতেই হচ্ছে, শাড়িতেই নারীর সৌন্দর্য। ”
স্নিগ্ধার কানে তৎক্ষনাৎ সেই কথা বাজলো। সে লজ্জায় লাল হয়ে চট করে পেছন ঘুরে। পরক্ষণেই দুজনের দৃষ্টি একত্রিত হয়ে যায়। অর্ণব নিজের মুখের বিরুদ্ধে হতভম্ব হয়ে গেলো। সে অজান্তেই কি সব বলে ফেললো? লজ্জায় অপ্রস্তুত হয়ে থতমত খায়। শা/লার আজকাল নিজের মনও নিজের কাছে কন্ট্রোলে থাকে না। কিসব মুখ ফসকে বেরিয়ে যায়।
“ কিছু বললেন? ”
স্নিগ্ধার প্রশ্নে আরোও অপ্রস্তুত হয়ে গেলো সে। চশমা চটপট চোখে ঠেলে মেয়েটার কৌতুহল নয়নের দিকে তাকিয়ে অর্ণব আমতা আমতা শুরু করলো। বলল,
“ ওইইই মানে! আপনাকে সুন্দর দেখাচ্ছে। ভার্সিটি যাচ্ছেন নাকি? তাহলে দেরী না করে বেরিয়ে পড়ুন। ”
স্নিগ্ধা লাজুক হেঁসে বড় বড় পা ফেলে নেমে চলে যায়। অর্ণব দ্রুত আশেপাশে তাকিয়ে গায়ের শার্ট ঠিকঠাক করে গলা খাঁকড়ি দিলো। কেমন জেনো অস্থির অস্থির লাগছে। গলা শুঁকিয়ে আসছে অদ্ভুত ভাবে। একবার পেছন ঘুরে স্নিগ্ধাকে দেখতে না পেয়ে স্বস্তির নিশ্বাস নিলো। যাক মেয়েটা চলে গেছে। এই মুহুর্তে মেয়েটা তার সামনে থাকলে হয়তো সে অপ্রত্যাশিত ঘটনার জন্য লজ্জায় পড়ত। এছাড়া লজ্জায় পড়া বাকি আছে কই? ছেলেটা মাথা চুলকে মনে করলো, বাবার কথা। তৎক্ষনাৎ সামনে দেখতে না পেয়ে চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। যাক বাবা আগেই চলে গেছে। এসব লক্ষ্য করেনি।
অর্ণব রুমে প্রবেশ করে দেখলো, অর্পণ আজ সতেজ মেজাজে আছে। ফুরফুরে মনে গায়ে একটা অর্ণবের পাঞ্জাবী জড়িয়েছে। মাথার কুঁকড়া লম্বা চুলগুলো চিরুনী করতে ব্যস্ত। অর্পণের হাজারটা পাঞ্জাবী থাকার পরেও এই অনুষ্ঠানে ভাইয়ের পাঞ্জাবী পড়ার টেকনিক টা মাথায় ঢুকাতে পারলো না অর্ণব। সে হাত বুকে আড়াআড়ি ভাবে গুঁজে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে দেখতে লাগলো অর্পণকে। ছেলেটা হাতে দামী ঘড়ি পড়লো। চোখে স্টাইলিশ নতুন কেনা চশমা পড়ে উড়াধুরা পারফিউম স্প্রে করে গাল ভরে হাঁসলো। পেছনে অর্ণবকে ভোঁতা মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আয়নার মাঝ থেকে নজর রেখে বলল,
“ নির্লজ্জের মতো ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছিস কেনো? আগে কখনও আমার মতো হ্যান্ডসাম ছেলেকে দেখিস নি? অবশ্য এই শহরে একমাত্র হ্যান্ডসাম, সুদর্শন এবং ড্যাশিং ছেলে শুধুমাত্র আমি। তাই বলে ওই বেহায়া নজরের গিলে খাওয়ার দরকার নেই। তোর কি লজ্জা করেনা? ওই দুষ্টু দৃষ্টিতে শুধু বিয়ে করা হালাল বউকে দেখতে হয়। নিজের মায়ের পেটের জমজ ভাইকে নয়। চোখ নামা। আমার মেজাজ চটে যাচ্ছে। বেশী তিড়িং বিরিং করলে গলা টিপে দিবো। অন্তত আজকের দিনটা নষ্ট করার মুড নেই আমার। ”
অর্ণবের এতক্ষণের রাগ এবার মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠলো। একটু আগের শান্ত মেজাজ খারাপ হলো মুহুর্তেই। দাঁতে দাঁত শক্ত করে তেড়ে গিয়ে অর্পণের গলা চেপে বলল,
“ আমার নতুন পাঞ্জাবী পড়েছিস কেনো? তোর গুলো কই ? কাভার্ডে হাজারটা পাঞ্জাবী রেখে তুই আমার পছন্দের পাঞ্জাবী -তে হাত দিয়েছিস। নিজের জিনিসে তো হাত দেওয়া দূর নজরও দেওয়া যায়না। অথচ আমার পছন্দের জিনিস দেখলে হামলে পড়িস। এখন-ই খুলবি তুই। ”
অর্পণ ঠোঁট এলিয়ে ভেংচি কাটলো। হাত উঁচিয়ে নিজের গলা থেকে অর্ণবের হাত ছাড়িয়ে উল্টো ছেলেটার গায়ের শার্টের কলার ঠিকঠাক করে দুহাতে কাঁধে চাপ্পড় দিলো। ভ্রুও নাঁচিয়ে বলল,
“ কুল ম্যান! অযথা হাইপার হচ্ছিস কেনো? রিলাক্স বেবিস। মেয়েদের মতো ন্যাকামি করিস না৷ তোর জিনিস মানেই আমার। কিন্তু অর্পণের জিনিস মানেই শুধুমাত্র তার!” বলেই দাঁত বের করে হাঁসলো সে।
অর্ণব ফট করে বলে উঠল,
“ মানে? আমার বউ-কেও তুই ছিনিয়ে নিতে চাইছিস? হাত-পা ভেঙে লক-আপে পুড়ে দিবো শা/লা। যাবত জীবন জে/লের ভাত খাবি। ”
অর্পণ নাক-মুখ কুঁচকে বলল,
“ ছিহ অর্ণব। তোর কল্পনা এত নোংরা। কতদূর চলে গেছিস। ”
অর্ণব কটমটিয়ে তাকাল। বলল,
“ বেরিয়া যা বাসা থেকে। তার আগে আমার পাঞ্জাবী খুল। আমার মাথায় আসেনা বাইরের মেয়েরা কিভাবে তোর মতো খচ্চর কে দেখে বেহায়া নজরে তাকায়। ছিহ। আজকাল মেয়েদের রুচি জঘন্য। ”
“ ওসব -এ তোর মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই। তুই বরং দেশ সেবা কর। আমি মেয়ে সেবা করি৷ ” বলেই অর্পণ হাত ঘড়ি দেখে নিয়ে এবার সিরিয়াস কিছু ভাষণ দেয়।
“ শুন বলদ! তোর কি মনে হয় আমার পাঞ্জাবী পড়ে ট্রায়াল দেইনি? পেছন ঘুর! দেখ পুরো বিছানায় আমার সব কাপড়। কপাল পুড়লে যা হয়। একটাও রুচিতে ধরছিল না। শেষে উপায় না পেয়ে তোর মতো খচ্চরের পাঞ্জাবী গায়ে পড়তে হল। এটার থেকে বিশ্রী অনুভূতি আর দুটো আছে? ব্যাপার না! তুই খবিশ হলেও তোর পাঞ্জাবী খবিশ নয়। বরং তোর থেকে আমাকেই বেশী হ্যান্ডসাম লাগছে..!”
বলেই অর্পণ বাঁকা হেঁসে বেরিয়ে পড়লো। অর্ণব বিছানায় সব কাপড় এলোমেলো দেখে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“ এগুলো কে পরিষ্কার করবে? তোর বউ?”
“ না আমার বলদ ভাই। ”
ড্রয়িংরুম থেকে উচ্চস্বরে ভেসে এলো অর্পণের কণ্ঠ।
স্নিগ্ধা রিকশায় বসে অর্ণবের কথা ভেবেই ফিক করে হেঁসে উঠলো। ওইদিন সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরে, সে-কি ভয়ানক অবস্থা। আয়েশা জামান দরজা খুলেই একের পর এক প্রশ্নে তাকে বিব্রত করে তুলে। মেয়ে না পারে গুছিয়ে কিছু বলতে, না পারে এড়িয়ে যেতে। মায়ের চিন্তা! শুষ্ক মুখ তাকে বরাবরের মতোই ভাবিয়ে তুলেছিল। এটা নতুন নয়। প্রত্যেক বারেই এমন হয়েছে। তার মা একটু পান থেকে চুন খসলেই কৈফিয়ত চাওয়া শুরু করে। প্রতিটি কঠিন প্রশ্নে সে থতমত খায়। এবারও উপায় না পেয়ে ফট করে বলেছিল, বান্ধবী হয়েছে একটা। তারই জন্মদিন ছিলো। কিছুতেই আজ স্নিগ্ধাকে ছাড়ছিল না। শেষে উপায় না পেয়ে বাসায় যেতে হয়। তবে, ভার্সিটির পাশেই তারা থাকে। তৎক্ষনাৎ আয়েশা জামান জিজ্ঞেস করে, এত বার কল করলে সে ফোন কেনো তুলে নি? স্নিগ্ধা ভয়ে ঘামতে শুরু করে। তার মা চটপট জানতে চায়,
“ মেয়েটার বাসার এড্রেস দিবি। আমি তাকে দেখতে চাই। মেয়েটা কেমন এটাও জানা প্রয়োজন আমার। ”
স্নিগ্ধার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। মনে মনে মায়ের অতি চিন্তায় বিরক্ত হলেও ভয়ে সে চুপসে যায়। উল্টোপাল্টা বলে কিছুতেই বুঝাতে পারেনা। শেষে উপায় না পেয়ে বলে,
“ ওর বিয়ে হয়েছে মা। পর্দা করে তাছাড়া এভাবে তুমি যেতে পারো না। মাইন্ড করবে তো। আমি নাহয় একদিন বাসায় নিয়ে আসবো। ”
অবশেষে গাইগুই করে তিনি শান্ত হয়। তবে, কাঠকাঠ গলায় বলে দেয়, ভুলেও নেক্সট টাইম কোথায় গেলে তার পারমিশন নিতে। এবং কল করলে ধরতে। এমনিতেই এই এলাকা তার অপছন্দ। মেয়েটাকে নিয়ে সে চিন্তিত। সেখানে যদি স্নিগ্ধা এমন করে তার মনের অবস্থা কি হয়! এবারের মতো মাফ করায় স্নিগ্ধা ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে।
ভার্সিটির চত্বরের বিশাল খোলা জায়গায় আয়োজন করা হয়েছে। চারপাশে বসার জায়গা। স্পেশাল ভাবে প্রথমে শিক্ষকদের বসার স্থান। এরপর ক্রমান্বয়ে প্রতিটি ব্যাচদের বসায় আয়োজন। শিক্ষকদের পরেই অর্পণ দের ব্যাচ। সবশেষে চৈতীরা। সকাল ১০ টার ভেতরেই সবাই ধীরে ধীরে ভীর জমাতে শুরু করে ভার্সিটিতে। কিছুক্ষণের ব্যবধানে ভরে যায় চারপাশ। সকলের গায়েই আজ শাড়ি কিংবা পাঞ্জাবী। স্যার -ম্যাম রাও আজ মিলিয়ে পড়েছেন। প্রতিটি বছরেই আয়োজন থাকে বিশাল।
শুনা যাচ্ছে রাতে কনসার্টের ব্যবস্থা করেছে ভার্সিটির প্রিন্সিপাল। তবে, কথাটা নাকি এখনও গোপন। অর্পণ সহ কয়েকজন জানে। মূলত সারপ্রাইজ বলা চলে। চৈতী কে শাড়ি পড়তে সাহায্য করেছে তাহিয়া। মেয়েটা ওর মতোই ইনটেলিজেন্ট! চৈতী খুব বেশী শাড়ি পড়েনি। দীর্ঘদিন না পড়ায় ইতস্ততবোধ করছিল। লজ্জা পাচ্ছিল এত মানুষের ভীরে যেতে। চুলগুলো বান্ধবী-দের কথা অনুযায়ী এই প্রথম কোমরের নিচে গড়িয়ে পড়া চুলগুলো খোলা রেখে চোখে কাজল লাগালো। হাতে কাঁচের চুড়ি, কানের ছোট ঝুঁমকা আর গলায় ছোট্ট লকেট পড়ে নেয়। অতঃপর শাড়ি ঠিকঠাক করে তাহিয়ার সঙ্গে ভার্সিটি আসে। এত সেফটিপিন লাগিয়ে শাড়ি পড়লেও বারবার তার মনে হচ্ছে, এই বুঝি পেট, পিঠ দেখা গেলো। ভুলবশত শাড়ি সরে গেলো। সে সচেতন ভঙ্গিতে মাঠে আসতেই শ্রাবণ দৌঁড়ে এলো তার নিকট।
মেয়েটাকে আগাগোড়া পরখ করে ওষ্ঠ প্রসারিত করে হাঁসলো। শ্রাবণ হয়তো কল্পনাও করেনি, শাড়িতে চৈতী এতটা মুগ্ধতা ছড়াবে। খোলা চুলগুলো বাতাসের তালে ঢেউ খেলছে..! অথচ, চৈতী হাঁসফাঁস করছে। এবার মনে হচ্ছে, স্টেজে উঠে নাচা তো দূর! একটি কথাও ভালোভাবে উপস্থাপন করতে পারবে না। ভয়ে সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। আর এই বদ ছেলে কিভাবে ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে আছে দেখো। মনে হচ্ছে কখনও দেখেনি। মনে মনে ভেংচি কাটলো সে। বলল,
খেয়ালি আমি হেয়ালি তুমি পর্ব ১১
“ জিনিয়া, স্নিগ্ধা কোথায়?”
“ চুপচাপ দাঁড়া। আগে তোকে প্রাণ ভরে দেখে নেই। বরাবরের মতো আজ-ও আমি তোর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলাম। কিন্তু এই মুহুর্তে গভীর সাগরে ডুবে যাচ্ছি দোস্ত। আমাকে ভালোবেসে জলদি উদ্ধার কর। হয়তো, শেষ পর্যন্ত পানিতেই ম/রন হবে আমার।”