খেয়ালি আমি হেয়ালি তুমি পর্ব ২
আনিকা আয়াত
“ বিশ টাকা লাগবে আমার! হবে? বিকেলেই নাহয় দিয়ে দিবো।”
স্নিগ্ধা রেগে তাকালো। সেই রাগ কে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে অর্পণ আর তুষিব হুড়মুড় করে রিকশায় উঠে বসে। আয়েশার সামনেই রিকশাওয়ালা মামাকে তাড়া দিয়ে বলল,
“ আন্টির থেকে আমাদের ভাড়া রেখে দিন মামা। দ্রুত কলেজ মাঠে চলুন! ক্রিকেট খেলা আছে। আজকে ফাটিয়ে দেবো মামা! আপনাকে স্পেশাল কুটু মিয়ার চা খাওয়াবো!”
আয়েশা জামান স্তব্ধ হয়ে, অর্পণের আচরণে বেশ অসন্তুষ্ট হলো। এ কেমন ধাঁচের ছেলো এটা? নূন্যতম ভদ্রতার লেশমাত্র নেই। মায়ের বয়সী নারীদের সাথে কেমন আচার-আচরণ করতে হয় তা কি বাবা-মা শেখায় নি? তিনি মনে মনে, নতুন শহরে যুবতী মেয়েকে নিয়ে ভীষণ ভীত হলো। যদি কখনও খারাপ কিছু ঘটে যায়? রিকশাওয়ালা মামা তার কল্পনার মাঝে উনাকে আরেক চমক দিলেন। তিনি সত্যি সত্যি ওদের ভাড়া রেখে, আয়েশা জামানের হাতে বাকি টাকা তুলে দিলেন। অর্পণ চমৎকার হেঁসে বলল,
“ চলি আন্টি। টাকা নিয়ে পরে একসময় আমরা ঘটা করে আলোচনায় বসবো। আপাতত আমি ভীষণ ব্যস্ত।”
বলেই তারা চোখের পলকে দূরে চলে গেলো। স্নিগ্ধা ক্ষোভে ফেটে পড়ে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“অসভ্য। বেয়াদব ছেলে। তোকে আমি দেখে নেবো।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রিকশায় উঠে অর্পণকে রহস্যময় হাঁসতে দেখে তুষিব কৌতুহল বশত বলল,
“ ভাই! আপনি ওই মেয়ের কাছ থেকে টাকা চাইলেন? আমি লজ্জা পেয়েছি ভাই। মেয়েটা আপনাকে গরীব মনে করলো! এমন কেনো করলেন? সুন্দরী মেয়ে দেখে ভাবসাব নিতে হয়! নিজেকে তাদের চোখে পড়ার জন্য এটিটিউট দেখাতে হয়। অথচ আপনি যা করলেন! উফ! আপনার বাইক কেনো গেইটে রেখে আসলেন?”
অর্পণ এক দৃষ্টিতে ঘন কালো আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। এই কটকটে রোদে হঠাৎ সমস্ত আকাশ ধীরে ধীরে কালো মেঘে ঢেকে যাচ্ছে। হয়তো তুমুল বেগে বৃষ্টি হবে। এই মধুর মুহুর্তে তুষিবের প্রশ্নের উত্তর দিতে ইচ্ছে হলো না। তার মন সম্পূর্ণ বিরোধিতা করে বলছে, ওই ছাগলের অহেতুক প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো প্রয়োজন নেই। এতোটাও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন নয় ওটা! টাকা নিয়েছে মানে কি? ইচ্ছে হয়েছে নিয়েছে। এমপির ছেলে বলে, টাকা দেওয়া যাবেনা এ কেমন কথা? কোথায় লেখা আছে? ও কেনো নিয়েছে একমাত্র সে আর তার হৃদয় জানে। এই ভেবেই মৃদু হাঁসলো অর্পণ! তুষিব উত্তর না পেয়ে তার অপেক্ষার বাঁধ ভেঙে গেলো। ছেলেটা মৃদুভাবে ধাক্কা দিলো। বলল,
“ ও ভাই? কোন জগতে হারিয়ে গেলেন? মতিগতি শুধিবার ঠেকছে না। মাইয়ারে মনে ধরলো নাকি? এমপির ছেলে বিশ টাকা ধার করলো! ভাবলেই মেজাজ চটে যাচ্ছে। হিসেব মিলছে না। ”
অর্পণ এবার ঠোঁট এলিয়ে চমৎকার ভাবে হাঁসলো। তখনও সে আকাশের পানে তাকিয়ে। গভীর বাদামী বর্ণের চোখজোড়া বন্ধ করে মৃদু কণ্ঠে বলল,
” বিশেষ করে, সুন্দরী মেয়েদের ভয়ার্ত মুখ! লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া গাল। অপ্রত্যাশিত ঘটনায় হতভম্ব, হকচকিয়ে উঠা চেহারা! সংকোচবোধ করা! এসব দেখতে আমি পৈশাচিক আনন্দ অনুভব করি!মেয়েদের হুটহাট ভয় পাইয়ে দিতে শান্তি লাগে ভাই! ধর! মেয়েদের দুটি মিষ্টি কথা বললেই, ওরা লজ্জায় লাল হয়! আবার ধমক দিলেই কেঁদে কেটে ভাসায়। ওসব আমি হেব্বি ভাবে এনজয় করি। তাদের মনের খবর ধরে ফেলার অদম্য ইচ্ছে আমার! ”
তুষিব নিজেই এসব শুনে হতভম্ব হয়ে গেলো। চোখ দুটি বড় বড় করে তাকায়! মুখটা হা করে থ মে/রে রয়। এই ছেলেকে দেখে কে বলবে? গ্যাঞ্জামের নাম্বার ওয়ান গুরু? যার মুখে রস নেই। অথচ, এখন কি কাব্যিক কথা বলছে। অবশ্য মেয়েদের জন্যই শুধু মধু! সবার ক্ষেত্রে নীম পাতার রস! অর্পণ আকাশ থেকে চোখ নামিয়ে তুষিবের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ উচ্চস্বরে বলল,
“ দেখলি না? ওই মাইয়া কেমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ছিলো? তাই দুষ্টুমি ছলে আরোও বিভ্রান্তিতে ফেলে দিলাম। বিশ টাকা বাহানা মাত্র! আসল ঘটনা হচ্ছে আমার পা/গলাটে ইচ্ছে ! ওহহো! মুখটা একদম দেখার মতো হয়েছিল। আর সকালের মেয়েটা? তাকেও কাঁদিয়ে আমি শান্তি পেয়েছি! বেচারী! খুব ভয় পেয়েছে। আর একটু হলেই জ্ঞান হারাতো! ”
তুষিব তৎক্ষনাৎ ধরে ফেললো তার বড়ভাইয়ের সেই অসাধারণ প্রতিভা। যিনি চট করেই মেয়েদের কাঁদাতে পারে! আবার চোখের পলকেই প্রেমে ফেলে দিতে বাধ্য করে! সেটা পরিচিত হোক অথবা, মাত্র দেখা মেয়ে হোক। তার লক্ষ্যই সুন্দরী মেয়েদের একটু ঘেঁটে দেখা। মুখের ভাবভঙ্গি তীক্ষ্ণ চোখে লক্ষ্য করা। এ মানুষটি আসলেই আজিব ভাই। অথচ তুষিব ভুলে গিয়েছিল, সেই বিখ্যাত ফ্লার্টের কথা? আজ নিশ্চয়ই ক্রিকেট মাঠেও শত নারীকে টুপ করে তার প্রেমে ফেলে যন্ত্রণা দিবে? কে জানে? মানুষটা যে সুন্দরী মেয়েদের কাঁদাতে ভালোবাসে। নিজের যন্ত্রণা সুন্দরীদের উপর ঝেড়ে শান্তি পায়।
তুষিব অর্পণের বি/ষাক্ত ঘটনার স্মৃতি মনে করে, কষ্ট পেলো। হৃদয়ে তার একরাশ কষ্ট হানা দিলো। অথচ, পাশের মানুষটার ছন্নছাড়া, বাউণ্ডুলে জীবনের মাঝে অদ্ভুত এক কাহিনী লুকিয়ে আছে। আগে তো বড়ভাই এমন অপরিপাটি, রাগচটা ছিলো না! তাকে দেখে এক বিন্দু বুঝার উপায় নেই, মানুষটার ভেতর কি লুকিয়ে আছে। সবসময় নিজের শান্তি খুঁজতেই কত আয়োজন। কেনো এমন হলো? নারী জাতি এতোটাই ভয়ংকর? একটি মানুষের সুন্দর জীবন ধ্বং/স করে দেয়! অর্পণের সাথে সে পাঁচ বছর ধরে চলাফেরা করছে। ছেলেটার কাছের কেউ যে কথা, ঘটনা জানে না তার সব কিছু তুষিব জানে। অর্পণ তাকে যে ভীষণ বিশ্বাস করে।
রিকশা মাঠে আসতেই অর্পণ পকেট থেকে পঞ্চাশ টাকার চকচকে একটি নোট রিকশাওয়ালা মামাকে দিলেন। মামা হেঁসে তার মাথায় আদর করে বললেন,
“ বেঁচে থাকো বাবা! বাইরে থেকে তুমি যে কঠিন, শক্ত দেখাও, আমি জানি তুমি কঠিন নও! এই ভেতরটায় একটি নরম মন, লক্ষী ও ভদ্রলোক লুকিয়ে আছে। ”
“ ভদ্র? তাও আবার অর্পণ? ধুর মামা! ”
অর্পণ চোখ-মুখ কুঁচকে তার উত্তরের পাত্তা না দিয়েই দৌঁড়ে গেলো মাঠে। দূর থেকে সব বন্ধুদের হাঁক ছেড়ে ডেকে বলল,
“ সবাই কই তোরা? আজ খেলা হবে বস! সৌরভ শুরু কর! ”
স্নিগ্ধার বাবা যে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে সেটা বিশাল জায়গার খোলামেলা ফ্ল্যাট। রুম গুলোও অনেক বড়। পাশাপাশি বারান্দা দুটিও বেশ সুন্দর। প্রকৃতির ঠান্ডা ফুরফুরে বাতাস বয়ে যায় সকাল-বিকাল। বারান্দায় বসলে বিষন্নতা দূরে পালিয়ে যায়। দেখেই বুঝা যাবে এ বাসার মালিক খুব শৌখিন মানুষ। রুচিশীল ব্যক্তি। স্নিগ্ধা গোসল সেরে ভেজা মাথায় রুমাল জড়ালো। দ্রুত রুম হালকা পাতলা গুছিয়ে খাবার খেতে যায়। আয়েশা জামান বাসায় ফেরার পর থেকেই বেশ চিন্তিত। মুখের হাঁসি টুকু যেনো মিলিয়ে গেছে। স্নিগ্ধার বড় ভাই থাকে রাজশাহী। সেখানেই মাস্টার্স করছে! আর ছোট্ট একটি বোন মিষ্টি! মেয়েটা বাবার সাথে স্কুলে ভর্তি হতে গেছে আজ। ক্লাস সেভেনে পড়ে। সারাক্ষণ বোন স্নিগ্ধার সাথেই মেতে থাকে সে। এই পাঁচজন মানুষ নিয়েই স্নিগ্ধার পরিবার। মেয়ের পড়াশোনার জন্য তার বাবাও এখানে সিফট করেছেন! আয়েশা জামান খাবার বেড়ে দিলেন। স্নিগ্ধা জিজ্ঞেস করলো,
“ বাবা কখন আসবে?”
আয়েশা জামানও খেতে বসলেন। ভাত মেখে জবাব দিলো,
“ বিকেলে! বন্ধুর বাসায় গিয়েছে। মিষ্টি নাকি শহর ঘুরবে, তাই বাসায় আসতে পারেনি।”
স্নিগ্ধা নিরব রইলো! দুজনের মাঝে আর কোনো কথা আদান-প্রদান হলো না। কিছুসময় পর আয়েশা জামান বললেন,
“ এই এলাকাটা আমার ভালো ঠেকছে না। একটা ছেলেও ভদ্র নয়। কেমন বেয়া/দব হয়েছে। তোমার বাবা আসুক! কথা বলবো বাসা চেঞ্জ করা নিয়ে। অন্য এলাকায় গেলে আমার চিন্তা কমবে। এর থেকে খুলনা-ই ভালো ছিলো স্নিগ্ধা। কোনো বখাটেপনা ছিলো না। আজকের মতো এত চিন্তা কখনও করিনি আমি। ”
স্নিগ্ধা মন দিয়ে মায়ের কথা শুনলো। তারও আজকের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো ভালো লাগেনি। সে খাওয়া থামিয়ে ওই অভদ্র ছেলেটার কথা মনে করলো। এরপর হঠাৎ কি মনে হতে বলল,
“ কিন্তু আম্মু! এখান থেকে ভার্সিটি খুব কাছে। অন্য জায়গায় গেলে বাবার ও প্রবলেম! আমারোও। তাছাড়া এ বাসায় তিনমাসের ভাড়া এক্সট্রা দেওয়া হয়েছে। ”
আয়েশা জামান খাওয়া শেষে বেসিনে হাত ধুয়ে বলল,
“ আমি তোমাকে নিয়ে চিন্তা করি স্নিগ্ধা। ”
স্নিগ্ধার খাওয়া থেমে যায়। সে গাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে মায়ের অস্থিরতা খুব কাছ থেকে অনুভব করলো। ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছে তার মা তাকে নিয়ে কতটা উদগ্রীব থাকে। কতটা চিন্তিত হয়! স্কুল থেকে কলেজ কখনও একা ছাড়েনি। নিজের শত কষ্ট হলেও দুই বোনকে টিউশন, স্কুলে নিয়ে গেছেন। মেয়ে দুটোর জন্য কত ত্যাগ, কষ্ট সহ্য করেছে এই মানুষটা। স্নিগ্ধা অতীত মনে করে চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। খাওয়া শেষে রুমে যেতে যেতে ভরসার সুরে বলল,
“ কিচ্ছু হবে না আম্মু। তুমি একটু রেস্ট নাও! অনেক কষ্ট করছো এই কয়েকদিন। ”
স্নিগ্ধা রুমে প্রবেশ করলো। হাঁটতে হাঁটতে বারান্দার মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে ব্যস্ত শহরের পানে তাকাল। রিকশা, গাড়ি ব্যস্ত ভঙ্গিতে চলাচল করছে। এই বিকেলের গোধূলি লগ্নে স্নিগ্ধার মাথায় খেলা করছে নানা রকম চিন্তা! ছেলেটা অদ্ভুত! কেমন রহস্যময়ী! স্নিগ্ধা ধীরে ধীরে গভীর ভাবনায় হারিয়ে যায়। কিছু সময় পর, হঠাৎ নিজেই এই কল্পনায় চমকে উঠলো। চোখ খিঁচে বলল,
” ছিঃ! ছিঃ! কিসব ভাবছি। ”
পরক্ষণেই বারান্দায় দাঁড়িয়ে পরিকল্পনা করলো, কালকে সারাদিন কি কি করবে সে। ওই অনুযায়ী মনে মনে রুটিন করে নেয়! বারান্দায় ফুল গাছ নেই। কয়েকটি রঙ বেরঙের ফুলগাছ কিনতে হবে। ভার্সিটি থেকে ফেরার পথে কিছু গাছ আর ঘর সাজানো সামগ্রী সাথে আনবে স্নিগ্ধা। এই ভর দুপুরে সে নিজের ব্যস্তজীবনে হারিয়ে গেলো! সম্পূর্ণ ভাবে ভুলে গেলো কিছুক্ষণ আগের সব ঘটনা!
চৈতী ভার্সিটি থেকে ফেরার পর এক দানা ভাতও মুখে তুলতে পারে না। ভেতরে ভেতরে গিল্টি ফিল হচ্ছে। চৈতী পাকাপোক্তভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার বন্ধু জিনিয়া, শ্রাবণ আর হিমু ওদের সাথে কখনও কথা বলবে না। বন্ধুত্বও শেষ! সকালের ঘটনায় সে খুব লজ্জিত! আত্মসম্মানে লেগেছে তার! সে ম/রে যেতে প্রস্তুত তবুও কস্মিনকালেও ওই ভার্সিটি মুখো হতে পারবে না। কিভাবে দ্বিতীয়বার দাঁড়াবে ওই লোকটার সামনে? খচ্চর ছেলে! তাকে কষে চড় মা/রলো? মেয়েদের গায়ে হাত তুলতে একটুও বাঁধলো না? ছেলেটার নাম যেনো কি? চৈতী আকাশ পাতাল ভেবে সারা রুম পায়চারী করছিলো। হঠাৎ হৃদয়টা হাহাকার করায়, সে ধপ করে বিছানায় মুখ লুকিয়ে শুয়ে পড়লো। ছেলেটির নাম মনে করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“ অর্পণ শেখ! আসলে তুই গোবর গণেশ! তোর নাম এটাই পারফেক্ট! ”
চৈতীর বুক ভার হয়ে কান্না আসে। এ জীবন গ্রামে পড়াশোনা করলেও এতটা কষ্ট হয়নি। কখনও এতো বাজে সিচুয়েশনে পড়েনি। লজ্জায়, অপমানে সহজ-সরল মেয়েটা জর্জরিত! সে রাগে দুঃখে হাত -পা ছেড়ে ছুঁড়ে বসে পড়লো। মনে শান্তি নেই! নেই! নেই! নেই!
পরক্ষণেই অর্পণের কথা মনে হতে সে ভয় পেয়ে যায়। ভীত হলো চৈতীর ছোট অন্তর- আত্মা! ব্যাগ থেকে ছোট আয়না বের করে মুখের সামনে রাখল। তৎক্ষনাৎ বামহাত গালে চলে যায়। এখনও ওই ব্যাটার চড়ের দাগ স্পষ্ট! জায়গাটা লাল হয়ে আছে। সে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তার হৃদয়ে কড়া নাড়লো, “ অর্পণ শেখ মানুষটা ভয়ংকর! ভয়ংকর! তার থেকে একশো হাত দূরে থাকবি। বলা তো যায়না, আরেক গালেও চড় মে/রে দিলো!”
রাতের খাবার খেয়ে পড়তে বসলো চৈতী। হঠাৎ কল আসায় বিরক্তি মুখে রিসিভ করে বলল,
“ বলো মা!”
“ কেমন আছিস মা? হোস্টেলে থাকতে অসুবিধা হচ্ছে না? খাবার কেমন? খেতে পারিস? তোর আব্বারে পাঠায় দিমু?”
মায়ের গলা শুনে, চৈতীর সারাদিনের সকল খারাপ লাগা নিমেষেই পালিয়ে গেলো। ভারী হওয়া অস্থির বুক শীতল বাতাসে ঠান্ডা হয়ে যায়। সে লম্বা শ্বাস টেনে হেঁসে বলল,
“ মা..! আমি ভালো আছি। খাবারও ঠিকঠাক। চিন্তা করো না। তোমরা ভালো থেকো! সায়মনকে দেখে রেখো, তাই হবে। ”
চৈতীর মা আরিফা বেগম তবুও নিশ্চিন্ত হতে পারলো না। মেয়েকে জিজ্ঞেস করলো অনেক কিছু। কলেজে কেমন লেগেছে! বন্ধুগুলো ভালো কিনা! চৈতীর চোখ টলমল করে মায়ের আদুরে কথা শুনে। কাছে থাকলে, তার মা সারাক্ষণ খ্যাঁক খ্যাঁক করতো। কর্কশ গলায় কথা বলতো। এসবের মাঝে যে ভালোবাসা লুকিয়ে ছিলো, সেটা আরিফা বেগম প্রকাশ করতো না। অথচ, মাত্র কয়েকদিন দূরে চলে আসায় কেমন পা*গলের মতো আচরণ করছে। মেয়েকে ছাড়া তিনি যে একা।
এই প্রথম চৈতী পরিবার ছেড়ে দূরে একা একা থাকতে এসেছে। কখনও মা তাকে একা ছাড়েনি। সে কল রেখে দেওয়ার সময় চৈতীর মা তাড়াহুড়ো করে বলল,
“ চৈতী! টাকা লাগলে জানাবি। কষ্ট করবি না। আমি যতদিন বাঁইচা আছি, যেমনে হোক টাকা পাঁঠায় দিমু। ”
চৈতীর চোখে মেঘ ভেঙে বৃষ্টি পড়ে। চোখের পানি টপটপ করে, ঝরঝরিয়ে পড়ল বইয়ের উপর। সে নিজেকে সামলে বলল,
“ টাকা লাগবে না। তুমি আব্বারে ঠিকমত ওষুধ খেতে বলবা। সায়মনকে দেখে শুনে রেখো মা। আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না। তুমি খেয়ে কাজ কইরো। ”
চৈতী ফোন রেখে দেয়। তাদের ছোট্ট সংসারে একমাত্র হাল ধরেছে তার বাবা। মেয়ের স্বপ্ন পূরণের জন্য দূরে ভর্তি করিয়েছে খুব কষ্টে। এই বাবার মূল্য কিভাবে শোধ করবে সে? সকালের ওই বাজে ঘটনা পালিয়ে গেলো চট করে চৈতীর মাথা থেকে। শুধু মনে পড়লো, পড়াশোনা করতে হবে। একটি ভালো চাকরি করে বাবা-মা আর ছোট ভাইয়ের দ্বায়িত্ব নিতে হবে। এ জীবনে ওসব ছোটখাটো বিষয় হয়েই থাকে।
চৈতী পড়া শেষ করে শুয়ে শুয়ে ভাবলো, অর্পণ নামক ছেলেটার সাথে আজই প্রথম ও শেষ কথপোকথন হয়েছে। ওসব স্বপ্নের মতো। ভাবলেই বড় হবে এই ঘটনা। তবে, ভবিষ্যতে দেখা না হোক। ছেলেটা ভীষণ রাগী। আবার ভুলে যদি তার ক্ষতি করে? তাছাড়া এখানে সে একা! পরিবার ছেড়ে দূরে। সে শুনেছে, অর্পণ এমপির ছেলে। ভার্সিটির কেউ ভয়ে নালিশ করতেও পারে না। তবে, ছেলেটার সম্পর্কে কিছুই জানেনা চৈতী। ডেয়ারে ফেঁসে গিয়ে ওই একটু কথোপকথন হয়েছে, এই যা!
কিন্তু এই গোল পৃথিবীতে কি আধোও চৈতীর সাথে অর্পণের দেখা হবে না? তাদের মাঝে কিছুই গড়ে উঠবে না? নাকি ওই খানিকের স্বপ্নের মতো ছোট্ট একটা ঘটনাই স্মৃতি হয়ে বেড়াবে আজীন৷ চৈতীর জীবনে এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনা সে কখনোই ভুলতে পারবে না।
সারা রাত বৃষ্টির দাপটে জম্পেশ ঘুম হয়েছে সবার। কিন্তু এই অলস সকালেও চোখ ভেঙে ঘুম আসছে। স্নিগ্ধা আজকের দিনের জন্য অনেক এক্সাইটেড! তাই অলসতা কাটেয়ে, ঝটপট রেডি হয়ে বাবার সাথে বেরিয়ে গেলো। ভার্সিটির মাঠে প্রবেশ করে সে হতবিহ্বল হয়ে যায়। আজই তার প্রথম ক্লাস! কিন্তু ক্লাস কিভাবে খুঁজে পাবে সে? আশেপাশে এক মেয়েকে ডেকে জিজ্ঞেস করার পর, সে দেখিয়ে দিলো। তাড়াহুড়ো করে স্নিগ্ধা ক্লাসে চলে যায়।
অর্পণ বটগাছের নিচে দুই হাত বুকে ভাজ করে বাইকে হেলান দিয়ে আছে। চোখের চশমা মাথায় রাখা। চোখ দুটি বন্ধ করে গুনগুনিয়ে গান গাইছে।
খেয়ালি আমি হেয়ালি তুমি পর্ব ২
পাশে তুষিব আর রনি ব্যাপক ভাবসাব নিয়ে দাঁড়িয়ে। আশেপাশের যুবতী মেয়ে দেখে তুষিবের চোখ চিকচিক করে। গায়ের শার্ট পেছনে টেনে টুনে ঠিকঠাক হয়ে দাঁড়ায়। অর্পণের মতো, একটু মেয়েদের অ্যাটেনশন পাওয়া আশায়। তবুও কেনো যে সুন্দরী সব মেয়ে অর্পণের চারপাশে ভনভন করে! কে জানে? বড় ভাই কি ব্ল্যাক ম্যাজিক জানে? হবে হয়তো! তাহলে আজ গভীর রাতে এই বিষয়ে আলোচনায় বসতে হবে অর্পণের সাথে। তুষিব চশমাটা নাকের ডগায় ঠেলে দিলো। রনিকে খুঁচা মে/রে বলল,
“ ওই মাইয়াডা দেখ! কি ঢেউ খেলানো চুল। ”