খেয়ালি আমি হেয়ালি তুমি পর্ব ২১
আনিকা আয়াত
“ চুমকির বাচ্চা..! আমার কথার হেরফের হলেই জানে মে/রে দেবো!”
চৈতী বিরক্ত হলেও মুখে প্রকাশ না করে, ঘনঘন মাথা নেড়ে ক্ষুদ্র স্বরে বলল,
“ আচ্ছা! ”
সমুদ্র এগিয়ে এসে রাগে ফোঁসফোঁস করে,
“ অর্পণের বাচ্চা..! একদম বাজে কথা বলবি না। এসব কি বলছিস ওকে? বন্ধু হয়ে শ-ত্রুদের মতো বিহেভ করার মানে কি? চৈতীকে কুবুদ্ধি দিচ্ছিস কেনো? ”
চৈতী তখনও ঠাই দাঁড়িয়ে। অর্পণ হাতের ইশারায় চলে যেতে বললে, সঙ্গে সঙ্গে চলে গেলো মেয়েটা। পিছু ঘুরে বন্ধুর রাগত্ব মুখশ্রী দেখে বাঁকা হাঁসলো ও। ছেলেটির গলা শক্ত করে একহাতে বগলদাবা করে বলল,
“ চৈতী সাদাসিধা মেয়ে। তোর টাইপ নয়। অন্য মেয়ে খুঁজ। নাকি আমি খুঁজে দেবো?”
সমুদ্র ফোঁসে উঠে গজগজ করছে। অর্পণ সুকৌশলে পকেট থেকে একটা সি/গারেট বের করে সমুদ্রের ঠোঁটের ভাঁজে গুঁজে দিলো।
সে জানে সমুদ্র অতিমাত্রায় হাইপার হলেও খানিক বাদেই শান্ত হবে। তখন নিজ থেকেই জিজ্ঞেস করবে, “ মেয়েটা কে ভাই?” বন্ধুর সঙ্গে এত বছরের সম্পর্ক! মনের সব কথাই যে জানা। তাছাড়া চৈতীর আশপাশ ভুলেও দ্বিতীয় বার দেখলে, শায়েস্তা করতে হবে এই ব্যাটাকে। এক ঘু/ষিতেই চরিত্র ফকফকে পরিস্কার! নো ভেজাল।
অর্পণ লাইটার দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিল,
“ ছ্যাঁকা খেয়েছিস। এবার সুখ টান দে! ”
সমুদ্র কাঁদো কাঁদো মুখে সত্যি সত্যি সি/গারেট টান দিলো। মুহূর্তেই খুকখুক করে কেশে অভিমানী কণ্ঠে বলল,
“ আমার ভালো কোনোদিনও চাস না অর্পণ। শুধু তুই কেনো? বাকিরাও চায় না। নইলে কি ওভাবে মজা নেয়? ওদের মতো তুই ও আমার শ/ত্রু! এখন যেই দেখলি, চৈতী আমার সঙ্গে হেঁসে হেঁসে কথা বলছে। লজ্জায় লাজুক হয়ে হাঁসছে। আমাকে পছন্দ করে ফেলেছে। একটু হলেই পটে যাবে । তখনই সব ঘেঁটে দিলি তুই। ধুর বা/ল। আমি সু/ইসা/ইড করবো। এ জ্বালা আর সহ্য হচ্ছে না। আর একটু হলেই পটিয়ে ফেলতাম। ”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
অর্পণ মুখ দিয়ে চূ চূ চূ, আফসোসের শব্দ করলো।
“ তাই নাকি? চৈতী তোকে ভালোবাসে? হেঁসে হেঁসে কথা বলেছে? কই দেখলাম না তো। আমি কি চোখে ভুল দেখি? লক্ষ্য করলাম, মেয়েটা বিরক্তে রি রি করছে। ”
সমুদ্র তেঁতে উঠল ওই শব্দে। রাগে গর্জে উঠলো। অর্পণের হাত ঝেঁটা দিয়ে ফেলে দূরে সরল,
“ শা/লা। আমার কথা কি তোর বিশ্বাস হয় না?”
অর্পণ বন্ধুর দুঃখে মুখটা কালো করল। ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
“ আমি কোনোদিন তোকে অবিশ্বাস করেছি.! জানিস না তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড? ”
মুহুর্তেই গদগদ হয়ে যায় সমুদ্র। অর্পণের পেটে পাঞ্চ মে/রে লাজুক ভঙ্গিতে বলল,
“ আসলেই তোর কাছে মেয়ে আছে?”
শব্দ করে হেঁসে ফেলে অর্পণ।
“ হুম। লাগবে?”
লজ্জা পেলো সমুদ্র। লাজুক ভঙ্গিতে নিচু কণ্ঠে বলল,
“ আলবাত লাগবে। বল না মেয়েটা কে! ফেসবুক আইডি অথবা নম্বর আছে? ছবি আছে.”
অস্থির কণ্ঠ ওর! অর্পণ ঠোঁট টিপে হেঁসে, বাইকে উঠতেই সমুদ্রও পেছনে চেপে বসলো। যেতে যেতে বলল,
“ সব আছে। আগে কথা দে চুমকির সঙ্গে ভুলেও আর কখনও ফ্লার্ট করবি না। ”
“ ক/সম। মাইয়া খুঁইজা দিলে ওইসব চৈতী ফৈতী বাদ। ”
অর্পণ বাঁকা হেঁসে তার দক্ষ হাতে গাড়ি চালায়। সে জানে, কোথায় ঢিল মা/রলে সা/পও ম/রবে না! লাঠিও ভাঙবে না! আপাতত সে বন্ধুকে কন্ট্রোলে আনতে পেরেছে। এই ঢের!.
দুপুরের শেষ প্রহর! পৃথা লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে তৃধার সঙ্গে রাস্তায় দাঁড়াল। আজ একটু বেশীই দেরী হয়ে গেছে। তৃধা সেই যে প্রথম ক্লাসে স্যারকে দেখেছিল, এরপর আর নজরে পড়েনি। হয়তো, অফিসের কাজে ব্যস্ত। কয়েকদিন পরেই ফাইনাল ইয়ারে এক্সাম শুরু হবে। এ নিয়েই সকলের ব্যস্ততা। পৃথা রিকশা ডেকে আনলো। তৃধাকে উঠতে বলার মাঝেই কানে এলো এক পুরুষালি গম্ভীর কণ্ঠস্বর,
“ পৃথা! ফ্রি আছ? সময় হবে? ”
তৃধা চট করে পেছন ঘুরলো। রিয়াদ স্যারকে ফর্মাল স্টাইলে দেখে বরাবরের মতোই ফিদা হয়ে যায়।সে বেহায়ার মতো তাকিয়ে আছে। রিয়াদ স্যার চট করেই বুঝলো হয়তো। কাঠকাঠ গলায় বলল,
“ চোখ সামলে মিস তৃধা। পিতার সমতুল্য স্যারের দিকে অসভ্য নজরে তাকাতে নেই। আপনি শুধুই আমার ছাত্রী! ”
মুহুর্তেই রাগে গর্জে উঠে মেয়েটা। নাকের পাটা তরতর করে ফুলে উঠল। কি বললো স্যার? পিতার সমতুল্য? সিরিয়াসলি? সব দোষ এখন তার? অথচ স্যার হয়ে যে, ছাত্রী কে বিয়ের প্রস্তাব দিলো তার বেলা? আবার জলজ্যান্ত চুমুও খেয়ে নিলো? অসহ্য! গিরগিটি লোক একটা। ঢং ভালোই পারে। পেটে পেটে কত যে শয়*তানি তা কে জানে? মেয়েটা রেগে মেগে আঙুল তুলে শাসিয়ে বলল,
“ সেই কন্যা সমতুল্য ছাত্রী কেই তো চুমু খেলেন। আবার সুর সুর করে বিয়ের প্রস্তাব ও দিয়েছেন। তার বেলা কিছু হয়না? আমি তাকালেই দোষ? আপনিও তো প্রতিদিন ইচ্ছে করে দাঁড় করিয়ে তাকিয়ে থাকেন দুষ্টু চোখে। তার বেলা? অসভ্য স্যার। তখন মনে থাকে না আমি ছাত্রী? ”
পৃথা মুখ চেপে হেঁসে উঠে। মেয়েটার উচ্চস্বরে কথা শুনে পাবলিক প্লেসে স্যার খানিকটা লজ্জা পেলো । যতই হোক হবু বর! এর আগে তো সে একজন ভার্সিটির শিক্ষক! ব্যক্তিত্ব আছে তার! এসব ঠোঁটকা/টা কথা সবার সামনে বলা যায়? ছেলেটির চোখে ধরা পড়ে, আশেপাশে কয়েকটি মানুষ বিস্ময়ে কোণা চোখ। এই মেয়েটার কি মাথায় ঘিলু-টিলু নেই? এভাবে পাবলিক প্লেসে এসব বলে? লজ্জা সরম পানিতে গিলে খেয়েছে। স্যার গলা ঝেড়ে নিজেকে সামলান। তৃধা রেগে হনহনিয়ে রিকশায় উঠল। রাগের কারণ, তাকে না ডেকে পৃথাকে কেনো বলছে ফ্রি আছে কিনা? রিয়াদ স্যার নিজেকে সামলে বলল,
“ পৃথা। সময় হলে নেমে আসো। কিছু কথা ছিল।”
পৃথা মাথা নেড়ে চুপচাপ নেমে আসতেই চট করে হাত টেনে ধরলো তৃধা। তিরিক্ষি মেজাজে বলল,
“ নামতে হবে কেনো? কি এমন কথা যে, একান্ত বলতে হবে।”
“ ভদ্র আচরণ কর তৃধা। ওর হাত ছাড়। নাহলে, বিয়ে ক্যান্সেল করে দেবো।”
সঙ্গে সঙ্গে হাত চট করে ছেড়ে দিলো তৃধা। বুকের ভেতরটা ধ্বক করে উঠেছে এমন সর্বনাশা কথা শুনে! স্যারের স্পর্ধা কত! বিয়ে ক্যান্সেল করবে? মেয়েটার এতগুলো মাসের কত শত স্বপ্ন, সাধনা কিভাবে নিমেষেই ভেঙে গুঁড়িয়ে দিবে। পা/ষাণ স্যার। এসব ভেবেই রাগ ধপধপ করে নিভে গেলো।
মুখ ফুলিয়ে, সামনে দৃষ্টি রেখে আমতা আমতা করে বলল,
“ হয়েছে হয়েছে। ওসব ঢং না করে জলদি কথা শেষ করুন। আমাকে বাসায় ফিরতে হবে।”
এক ডোজে কাজ হওয়ায় মিটি মিটি হাঁসলো স্যার। নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,
“ খুব কাজ দেখছি।”
বলেই পৃথাকে সামনে যেতে বলে তিনি পিছু পিছু গেলো। খানিক দূরে দাঁড়িয়ে একবার পিছু ঘুরে তৃধার দিকে তাকাতেই দেখলো, মেয়েটা কৌতুহলে দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে তাদের দিকে চেয়ে আছে। দূরে বসে থাকলেও তার মন-চোখ সর্বদা ওদের নিকট। আনমনে হেঁসে পৃথাকে সোজাসাপটা বলল,
“ তৃধার ব্যাপারে কথা ছিল। ও কি সত্যি বিয়েতে রাজি? তুমি ওর বেস্ট ফ্রেন্ড! নিশ্চয়ই ভালো জানবে ওর মতামত! আমি কি বাবাকে এগুতে বলবো? ”
পৃথা মৃদু হেঁসে একবার কিঞ্চিৎ দূরে হাঁসফাঁস করা বন্ধবীর দিকে তাকাল। এরপর অভয়ে বলল,
“ অবশ্যই রাজী স্যার! সেই কতগুলো মাস ধরে আপনাকে ভালোবেসে গেছে পা-গলটা। হঠাৎ করে অপ্রত্যাশিত ভাবে আপনি বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন তাই অতিরিক্ত খুশিতে লোড নিতে কষ্ট হচ্ছে। একটু সময় দিন আগের মতোই স্বাভাবিক হবে। আসলে প্রচন্ড ভালোবাসে তো! মনেপ্রাণে সারাক্ষণ আপনাকেই চাইতো। অবশেষে স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে। আপনি নির্ভয়ে বিয়ের তারিখ ফাইনাল করুন। ও আমাকে কি বলেছে জানেন?”
“ কি?”
রিয়াদ স্যারের অস্থির কণ্ঠ। পৃথা হেঁসে বলল,
“ ও দুপায়ে রাজি। যদি দেখতে আসার দিনেই আপনি বিয়ে করতে চাইতেন। তবুও তৃধা রাজি ছিলো। মোট কথা, সব শেষে তৃধার শুধু আপনাকেই চাই।”
রিয়াদ স্যারের চোখ-মুখ খুশিতে চকচক করে উঠল। সে লম্বা শ্বাস ফেলে তৃধার দিকে তাকিয়ে ওষ্ঠ প্রসারিত করে। ঠোঁট কামড়ে বলল,
“ থ্যাংক ইউ পৃথা। তোমার বান্ধবী কে বিয়ের জন্য প্রস্তুত কর। আমি রিলাক্স হলাম। একয়েকদিন ভার্সিটিতে না দেখে ভয়ে ছিলাম, মেয়েটা হয়তো আমাকে ভুল ভাবলো। হয়তো রাজী নয়। আমি অজান্তেই মেয়েটাকে ট্রমা-তে ফেলে দিলাম কি না। কখনও চাই নি ওর লাইফে আমার জন্য বাজে ইফেক্ট পড়ুক। আমি ওর পক্ষ থেকে পজিটিভ সাইন পেয়েই এগিয়েছি। ভেবেছি, ও আমাকে পছন্দ করে। তাই আর কি! নয়তো, তাড়াহুড়ো করতাম না।”
“ পছন্দ করে মানে? হান্ড্রেড পার্সেন্ট! ”
পৃথা মনে মনে দোয়া করলো দুজনের জন্য। রিয়াদ স্যার হাতের ঘড়ি একবার দেখে নিয়ে বলল,
“ তাহলে বিয়ের দিন দেখা হচ্ছে? আমি বরং জলদি সব এরেঞ্জ করে ফেলি। বিয়ের বয়স যেহেতু হয়েছে, তবে ঝুলিয়ে রেখে কি প্রয়োজন! ”
“ অবশ্যই স্যার। দেখা হবে স্যার নয় দুলাভাই রূপে। ভালো থাকবেন।”
বলেই আগে আগে হেঁটে পৃথা রিকশায় উঠে বসলো। তৃধার দৃষ্টি তখন সামনে। কিন্তু মনে খচখচানি। কি এত কথা হলো দুজনের, দেখে তো মনে হচ্ছে বেশ জমিয়ে ফেলেছে। কি হাঁসি দুজনের মুখে। তৃধা দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত হয়ে বসে রইলো। ওর দিকে কেউ যে গাঢ় নয়নে তাকিয়ে আছে সেটাও লক্ষ্য করলো না। সে মনে মনে ভয়ংকর রেগে আছে। ওর সঙ্গে কথা বললেই ওই ব্যাটা খেঁকিয়ে উঠে। অথচ, পৃথার সঙ্গে কি হাঁসা হাঁসি। একবার বিয়ে হোক সব সোজা করে ফেলবে।
“ কি রে? মুখ গুমরা করে রেখেছিস কেনো? পেঁচি মুখ দেখে মনে হচ্ছে বিয়ের আগেই জামাই ম/রেছে। ”
“ কথা বলবি না আমার সঙ্গে। যা স্যারের সঙ্গে হাঁসা হাঁসি কর। এত কিসের কথা দুজনের?”
“ জ্বলা জ্বলি শুরু হয়ে গেছে। বাহ বাহ! পোড়া গন্ধ পাচ্ছি। ”
পৃথা উচ্চস্বরে হেঁসে উঠে বন্ধবীর জেলাসে। এতক্ষণ দূরে দাঁড়িয়ে পরখ করা রিয়াদ স্যার হন্তদন্ত হয়ে তাদের নিকট আসলো। তৃধার সামনে দাঁড়িয়ে রিকশা শক্ত করে ধরে মা/দক আঁখিতে তাকাল। মেয়েটির রাগী মুখশ্রী তে নজর বুলিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“ কাল শুক্রবার। সকাল ঠিক ১০ টায় আমি অপেক্ষা করব। তুমি গেইটে চলে এসো! ওকে?”
তৃধা চোয়াল শক্ত করে জবাব দেয়,
“ পারবো না। ”
বলেই রিকশাওয়ালা মামাকে বলল,
“ মামা! জলদি চলুন।”
রিকশা চালু করলেন তিনি। রিয়াদ স্যার বাঁকা হেঁসে বলল,
“ আমি জানি তুমি আসবে। কারণ, তৃধা আসতে বাধ্য। অপেক্ষা করবো প্রিয়…ব–ওপস ছাত্রী। নাহলে কিন্তু বিয়ের আগেই শ্বশুর বাড়ি ঢুকে যাবো। তখন পালাবে কই?”
বারান্দার গ্রিলে সদ্য গোলাপি রঙের ফুলেফুলে ভরা, এঁকেবেকে বেয়ে উঠেছে বাগানবিলাস। এ বাসায় সিফট হওয়ার পরেই স্নিগ্ধা অনেকগুলো গাছ কিনেছিল বেলকনির জন্য। শীতে গাঁদাফুল গুলোও নিজেদের রূপ প্রকাশ করতে ব্যস্ত। গোলাপ গাছটাও বেশ সতেজ! রোদেলা বিকেল বিদায় জানিয়ে ঘন কালো সন্ধ্যা নেমে আসছে। নীড়ের পাখি নিজস্ব নীড়ে ফিরছে। আজ প্রকৃতি টাও বিষণ্ণ। সকাল থেকে নেই কোনো সূর্যের আলো। গুমোট আবছা আবছা হয়ে আছে।
স্নিগ্ধা তার বিলাসী বারান্দায় একটি মোড়া পেতে উদাস মুখে বসে তাকিয়ে আছে দূরের আকাশে। তার মন বিষণ্ণ! সারাক্ষণ মনে হয় কি যেনো নেই! বুকের ভেতর টা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। চাপা কষ্ট প্রকাশও করা যায় না। খাওয়া দাওয়াও কমে গেছে। মুখটা কি দিনদিন রুক্ষ হচ্ছে? স্নিগ্ধার সম্পূর্ণ ধ্যাণ পড়ে থাকে রুমের বাইরে। এই বুঝি কেউ ডাকলো,
“ স্নিগ্ধা..! আপনি কি একটু ছাঁদে আসবেন? ”
আফসোস কেউ বলার নেই। মেয়েটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে এলোমেলো পায়ে রুমে গেলো। ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা কাপড়, জিনিসপত্র একপলক দেখে হতাশার শ্বাস ফেলে। আজকাল গুছিয়ে রাখতেও ক্লান্ত লাগে। রুমের বাইরে শুনা গেলো কিছু হাস্যকণ্ঠস্বর। নিশ্চয়ই মিষ্টি মায়ের সঙ্গে সন্ধ্যা বেলা চা খাচ্ছে।
স্নিগ্ধা হেলেদুলে তাদের নিকট গেলো। ড্রয়িংরুমে পা দিতেই কিছুক্ষণের জন্য চমকে উঠল মেয়েটা। সামনের পৌর মহিলা টি গল্পের তালে চা খাচ্ছেন। স্নিগ্ধাকে দেখে তিনি গাল ভরে হাঁসলেন,
“ এই দেখো তোমাকে রেখেই চা খাচ্ছি। ”
স্নিগ্ধা প্রতিত্তোরে মৃদু হাঁসলো। বসলো মিষ্টির পাশে। মেয়েটা ঠোঁট টিপে হাঁসছে। স্নিগ্ধা চোখ গরম করে চুপচাপ থাকতে বলে। পায়েল শেখ মুখ ভার করে বলল,
“ অর্ণব চলে যাওয়ায় আমি ভীষণ একা হয়ে গেছি ভাবী। রুমে টিকতেই পাচ্ছি না। সারাক্ষণ মনে হচ্ছে, এই বুঝি আম্মু বলে ডাক দিল। ছেলেটা এ কয়েক মাসে মায়া বাড়িয়ে গেলো। প্রতিবার ওর ছুটির পর প্রথম কয়েকদিন আমি এক দানাও খেতে পারি না। ছেলের জন্য বড্ড মন কাঁদে। কিভাবে নিজেকে সামলাবো? ”
আয়েশা জামান শীতল চোখে তাকালো,
“ মেয়েরাই সারাজীবন মায়ের কোলে থাকে না আবার ছেলে মানুষ? ওরা বড় হয়েছে। চাকরির তাগিদে দূরে যাবে এটাই স্বাভাবিক। আপনি মন খারাপ করবেন না। নিজেকে হালকা করুন। বাস্তবতা মেনে নিতে পারলেই জীবন সুন্দর! আবেগ কন্ট্রোল করতে হবে।”
স্নিগ্ধা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মাথা নত করে বিমুঢ় হয়ে বসে রইলো। তার অস্থির লাগছে। কোথাও শান্তি পাচ্ছে না। পায়েল শেখ আঁচলে চোখের কোণের পানি মুছে তপ্ত স্বরে বলল,
“ দোয়া করবেন। অর্ণব যেনো অনেক বড় হয়। ”
আয়েশা জামান সান্ত্বনা দিলেন তাকে। স্নিগ্ধার আর সহ্য করতে পারলো না। অস্থির হৃদয়টা নিজের সঙ্গেও বিরোধীতা করছে। ত্বরিত পায়ে চলে গেলো নিজ কক্ষে। দরজা ঠাস করে লাগিয়ে বিছানায় শুয়ে শক্ত হয়ে রইলো । গোলগাল গলা বেয়ে কখন যে, অশ্রু ঝরঝরে পড়ছে তার খেয়াল নেই। সে ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে। তবুও বাঁধ মানে না। নিজের সঙ্গে এমন হচ্ছে কেনো? সে তো অল্পতেই ভেঙে পড়ার মেয়ে নয়। অল্প তেই কান্না করাও তার রুটিনে নেই। তবুও আজ কেনো কাঁদছে? মেয়েটি বালিশে মুখ গুঁজে অস্পষ্ট স্বরে বলল,
“ আমার এত কষ্ট কেনো হচ্ছে অর্ণব? আমি সহ্য করতে পাচ্ছি না। কেনো হুট করে এসে হুট করেই চলে গেলেন? আমি এত মাস কিভাবে একা কাটাবো? আমার ভেতর স্বত্বা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে অর্ণব। আমি ভালো নেই! আপনি নিশ্চয়ই খুব ভালো আছেন?”
কিয়ৎক্ষণ বাদে টলমল চোখে অর্ণনের ছবিটা বের করে আরোও বাঁধ ভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়ে। মোবাইলের স্ক্রিনে ছেলেটার মুখে হাত বুলিয়ে বলল,
“ মিস ইউ অর্ণব! আমি অপেক্ষা করবো আপনার। আপনি কি আমায় মনে রাখবেন? নাকি সেখানে, নতুনত্ব সুন্দরী রমনী পেয়ে ভুলে যাবেন? ”
বলেই কান্না করে দিলো। এরপর হুট করেই প্রশ্ন করলো,
“ আমি আপনার কি হই অর্ণব? আমাদের মাঝে তো কোনো সম্পর্ক গড়ে উঠেনি। তবে কিসের সম্পর্ক আমাদের? কোন কারণে কষ্ট হচ্ছে আমার? কিসের এত মায়া? আমাদের কি দূরে গেলে কান্না করার মতো সম্পর্ক হয়েছে? আমি কি আপনাকে বিশেষ কেউ ভাবছি? এসবে উত্তর কোথায় পাবো! বলুন না।”
রৌদ্রজ্বল দুপুর! গভীর ঘুমে মগ্ন থাকার মাঝেই বালিশের নিচের ফোনটা তীব্র কর্কশ শব্দে বেজে উঠলো। শরীরটা রাত থেকে খারাপ অনুভব করায় ভার্সিটি যাওয়া হয়নি। হোস্টেলে শুয়ে বসেই কাটিয়ে দিয়েছে। কিন্তু পেট ব্যথা আর মাথা ব্যথায় নিস্তেজ হয়ে আসছে চৈতীর দেহ। লাগাতার শব্দ তুলে ফোনটা একসময় নিশ্চুপ হয়ে যায়। চৈতীও নড়েচড়ে ফের আরাম করে শুয়ে পড়লো। কিন্তু বিরক্তকর ফোনটা আবারোও বিকট শব্দ তুলে। এ যেনো থামার নয়। বিরক্তে নাক-মুখ কুঁচকে গেলো মেয়েটার। চোখ খিঁচে দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত করে ফোন তুললো তৎক্ষনাৎ এক চিন্তিত কণ্ঠ ভেসে এলো তার কানে,
“ কল ধরছিস না কেনো? আর ইউ ওকে? চৈত্র মাস!”
চৈতীর কথা বলার এই মুহুর্তে কোনো ইচ্ছে নেই। সে রয়ে সয়ে ছোট্ট করে বলল,
“ উম।”
“ এনি প্রবলেম চৈত্র! ঠিক আছিস?”
“ হ্যাঁ। জরুরী কিছু বলবি? আমি ঘুমাচ্ছি। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। ”
শ্রাবণের বড্ড মায়া হলো নাজুক গলা শুনে। অনেক কথা বলার থাকলেও চুপ করে রইলো। রোদ তপ্ত দুপুরের খরখর আকাশের দিকে তাকিয়ে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“ তুই ভালো থাক। আমার কাছে জরুরি কথা মানেই, তুই ঠিক আছিস। রাখছি।”
চৈতী ফোন কান থেকে নামিয়ে বালিশ জড়িয়ে ধরতেই পেটের মধ্যে তীব্র যন্ত্রণা খামচে ধরলো। তৎক্ষনাৎ মেয়েটির চোখ খিচিয়ে কষ্ট সহ্য করে নেয়। এ ব্যথা কয়েকমাস আগের। হুটহাট উদ্ভব ঘটে। বেশীর ভাগই দেখা দেখ, পি/রিয়/ডের সময়কালে। মেয়েটা সয়ে নেয় নিশ্চুপে। হয়তো, দেহে র/ক্ত কম তার মধ্যে পানি খাওয়া এমনকি খাবারেও অনিয়ম। এজন্যই ব্যথা জেঁকে ধরে ছোট্ট দেহে। মনে বললো, একটু গরম পানি খেলে হয়তো ভালো লাগতো কিন্তু উঠে নিচ তলায় যেতে হবে। ভীষণ জ্বালা। আপুটাও গেছে ক্লাসে। এই অবস্থায় কে সাহায্য করবে তাকে? চৈতী তপ্ত শ্বাস ফেলে দাঁত চেপে ফের পড়ে রইলো বিছানায়।
শ্রাবণ ফুটপাতের রাস্তা ধরে একটা পুরোনো লাইব্রেরি-তে আসলো। হাতে কয়েকটি উপন্যাস নিয়ে নাড়াচাড়া করা শুরু করে। হিমু সমগ্র বুকে চেপে বসলো এক বেঞ্চে। পুরনো বই মানেই অন্যরকম অনুভূতি। পড়ার আগে সম্পূর্ণ বই ঘাটতে পছন্দ করে। শেষের দিকে পেইজ ঘাটাঘাটি করার সময় হাতে বাজলো একটি শুকনো গোলাপ। শ্রাবণের ভ্রু দ্বয় আপনা আপনি কুঁচকে যায়। সে আলতো হাতে গোপাল নিয়ে উদাসীন হয়ে গেলো। আদুরে কণ্ঠে বলল,
“ মানুষের ভালোবাসার প্রকাশের ধরণ একেক জনের কাছে একেক রকম। প্রিয় গোলাপটা অবহেলায় ফেলে চলে গেছে।”
বলেই চাপা শ্বাস ফেলে শ্রাবণ বইটা নিজের সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। লাইব্রেরির কোণে, অল্পদূরে রেখে গেলো একজোড়া হাস্যজ্জল চঞ্চলা আঁখি। তার গোলাপ এতদিন অপেক্ষায় থাকতে থাকতে শুঁকিয়ে গেছে। আজ পূর্ণতা পেলো তার অপেক্ষাময় গোলাপের। সঙ্গে তার হৃদয়ের উৎকণ্ঠা এবং অপেক্ষার। এই কয়েকদিনের পৃথিবীতে নতুনত্ব স্বাদ অনুভব করে বেঁচে থাকাও একপ্রকার আনন্দের।
অর্পণের পা পুরোপুরি সেরে উঠল সপ্তাহ খানেক পর। কিন্তু কালো কালসিটে দাগ এখনও যায়নি। হয়তো যাবেও না। ডক্টরের দেওয়া ক্রিম মেডিসিন অবহেলায় পড়ে আছে এলোমেলো বিছানায়। তার মন কি চায় সে কখনও জানেনা। শুধু জানে, শান্তিতে বাঁচতে চায়। কিন্তু ইদানীং ওই মানসিক শান্তি পাচ্ছে না। পায়ের ক্ষীণ ব্যথার থেকে ভেতরের অসুখের মাত্রা গুরুতর। এলাকায় জমিয়ে আড্ডা, ফুটবল, ক্রিকেট ম্যাচের আয়োজন করলেও আগের মতো শান্তি নেই। সারাক্ষণ মনে হয়, ওই ভার্সিটি গেলেই অন্তর আত্মা শান্ত হবে। কিন্তু এমন কেনো মনে হয়? উত্তর হয়তো এখনও পায়নি সে!
তৃধা সেজেগুজে রেডি হয়ে আয়নায় নিজের মুখশ্রী দেখলো। কালো টি-শার্ট এবং জিন্সে বরাবরের মতোই তার চোখ ধাঁধার সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে। ছোট থেকেই শহরে বড় হওয়ার দরুন স্টাইলিশ জামা-কাপড় পড়েই সাচ্ছন্দ্যবোধ করে। নিজেকে সবসময় ভিন্ন ভিন্ন পোষাকে , ভিন্ন রূপে দেখে মুগ্ধ হয়। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক দিয়ে পিঠের চুলগুলো ছেড়ে দিলো। এরপর সেলফি তুলে সেই নিজের ব্যক্তিগত পুরুষকে পাঠালো।
“ মার্কেটে যাচ্ছি। কেমন লাগছে আমায়?”
কিয়ৎক্ষণের ভেতরেই রিপ্লাই এলো,
“ উমম! চিলি চার্ম!”
লজ্জায় লাল হলেও প্রকাশে রাগান্বিত ইমোজি দিতেই বেরিয়ে পড়লো। আজ সবাই মিলে মার্কেটে শপিং করতে যাবে।
সময় ঘনিয়ে এসে বিয়ের বেশী দেরী নেই। এইতো দুদিন পরেই তারিখ ফিক্সড করা হয়েছে। সুকৌশলে, অতন্ত্য বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে এসব কিছু অ্যারেঞ্জ করেন রিয়াদ স্যার। সেদিন পৃথার কথা শুনে আর দেরী করেনি। ঝটপট বাসায় এসে বাবা মাকে বলেন। ওনারাও চান এবার ছেলেটা বিয়ে করুক। বয়সও বাড়ছে। কম তো পাত্রী দেখা হলো না! সবগুলো মেয়ের ছবি-ই রিয়াদ স্যার ডাস্টবিনে ফেলেছে। এবার যখন নিজ থেকে পছন্দ করেই ফেলেছে তবে দেরী কিসের? মেয়েটাও অসম্ভব সুন্দরী এবং মিষ্টি মেয়ে। তার বাবাকে সেই কতবছর থেকে চেনেন। কাছেই মেয়ে রেখে তিনি কিনা দূরে দূরে খুঁজেছে।
উনারা জলদি বিয়ের কার্ড ছাপিয়ে পাঠিয়ে দিলেন সমস্ত আত্নীয় স্বজনকে। বিদেশে পড়ুয়া ভাইয়ের ছেলে-মেয়েদের আসতে যেনো আপত্তি না থাকে। রিয়াদ বন্ধুদের দাওয়াত দিয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনছে বিয়ের। মেয়েটাকে কাছে পাওয়া আকাঙ্ক্ষা হুট করেই বেড়ে গেছে। কবে পাবে সম্পূর্ণ নিজের করে? এসব নিয়েই তিনি এখন ভাবনায় বিভোর থাকেন।
তৃধার সঙ্গে আর আলাদা দেখা করার সময় হচ্ছে না। ভার্সিটির কাজ অতঃপর একমাত্র ছেলে হওয়ায় বিয়ের শুরু থেকে শেষ! সম্পূর্ণ দ্বায়িত্ব নিজের-ই। ওদিন তৃধার সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা থাকলেও মেয়েটা-কে নিরাশ করেছে। ভালো ভাবে বুঝিয়ে বলেছিল,
“ আর তো কয়েকদিন। তারপর আজীবনের জন্যই আমি তোমার। আলাদা দেখাও করতে হবে না। ঘুম থেকে উঠেই তোমার মুখ দর্শন করবো তৃধা পাখি। অনুমতি নিয়ে হাত ধরতে হবে না, যখন তখন গভীর স্পর্শে তোমার হৃদয় জমিয়ে ফেলবো। ”
লজ্জায় আর প্রতুত্তর করেনি। মেনে নিয়েছে স্যারের কথা। দিনদিন স্যার যেনো খাপছাড়া কথা বলছে। আগে সে জ্বালাতো, ইদানীং স্যার-ই তাকে জ্বালাতে ব্যস্ত। বিয়ের পর আরোও কত কি করবে কে জানে?কৌশলে লজ্জায় আড়ষ্ট ঠিকই করতে পারে। তারিখ ফিক্সড করার পর রোজ রাতে অল্পসময় কথা হয় দুজনের। তখন আর ফটরফটর করার দম থাকে না, স্যারের একের পর এক বাক্যে লজ্জায় মিইয়ে যায়। শুধু উত্তরে, “ হুম! হ্যাঁ!” করে।
তৃধাদের বাসায় অলরেডি সব গেস্ট আসা শুরু করেছে। বন্ধুরা সবাই গায়ে হলুদে চলে আসলেও এক বাক্যে নাকচ করে দেয় অর্পণ। ছেলেটা আস্ত বদমাশ। বলে কিনা! শতশত সুন্দরী রমনীর মাঝে আমি নেই। তুষিবের সঙ্গেই ঢের ভালো। তোরাই ভংচং কর। কিন্তু তৃধা ওসব শুনতে রাজী নয়। সাফসাফ জানায়, “ আমার বিয়েতে না আসলে বন্ধুত্ব ছিন্ন করে ফেলবো। ” উত্তর হেলেদুলে চলে গেছে অর্পণ। এখনও জানায় নি, আসবে। ওসব রংতামাশা, গান বাজনা, শত নারীর আটা ময়দা মাখা মুখশ্রী এবং তাদের হইচই একদম পছন্দ নয় তার। বিরক্ত লাগে সব। তৃধার মা ওর বন্ধুদের পরিবার সহ আসতে বলেছে। রিয়াদ স্যারের মতো তৃধাও যে বংশের একমাত্র মেয়ে। ভীষণ ধুমধাম করে বিয়ে সারতে চান উনারা। বংশের যত আত্নীয় আছেন, সব হাজির হবে তৃধার বিয়ে উপলক্ষে!
তৃধা নিচে এসে তার বন্ধুদের আড্ডা গ্রুপে মেসেজ করলো,
“ তোরা কই? আমি বের হচ্ছি। সবাই মার্কেটে উপস্থিত থাকবি। আমার বিয়েতে তোরা সব পছন্দ করবি মনে আছে? তোদের ছাড়া আমি কিছুই পছন্দ করবো না। সবাইকে জেনো দেখি।”
সবাই রিপ্লাই করলো,
“ রাস্তায় দোস্ত। জলদি আয়। আমাদের কেও শপিং করিয়ে দিতে হবে।”
তৃধা মুচকি হেঁসে চাচাতো ভাই-বোনদের নিয়ে রওনা হলো মার্কেটে। গাড়িতে বসে রিপ্লাই দিল,
“ আজ সব খরচ রিয়াদ স্যার! যত ইচ্ছে শপিং কর। স্যারকে ফকির করার জন্যই তো শা/লা শা/লি। ওকে ডিয়ার? দৌঁড়ে আয়। স্যারের পকেট আজ ফাঁকা করবো। দেখি কত দম! নিজ ছাত্রীকে বিয়ে করার জ্বালা পদে পদে অনুভব করবে।”
সমুদ্র রিকশায় বসে রসিকতার ভয়েস দিলো তার কথায় উত্তরে,
“ ছেলেদের বউ-ই সব। বিয়ে যে কত মজা। আমাদের জীবনে বউ পেলেই সুখ আর সুখ। টাকা কি দেহ-মন শান্ত করতে পারে? এজন্য তো স্যারের তোকে দরকার। তাই তোর পিছে টাকা খরচ করলেও প্রবলেম নেই।”
তৎক্ষনাৎ সবাই হাহা দিল ওর ভয়েজ মেসেজে। অর্পণ সিন করলো তখন। সবগুলো মেসেজে লাইক দিতেই তেঁতে উঠল সবাই। রেগে মেগে বলল,
“ শা/লা ক্ষ্যাত! গুরুত্বপূর্ণ কথার মাঝে বা হাত দিতে প্রস্তুত! ”
“ এসব উস্কানিমূলক কথা গুরুত্বপূর্ণ? ”
পৃথা হিংস্র ইমোজি দিতেই শিহাব কথা ঘুরিয়ে বলল,
“ দশ মিনিট ধরে মার্কেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি বা/ল। কই তোরা?”
স্নিগ্ধা, জিনিয়া এবং চৈতী বিকেলে বের হলো শহরে ঘুরার জন্য। পার্কে বসে ফুচকা খেয়ে চললো তারা সামনের মেলায়। সেখানে বাচ্চারা উল্লাসে মেতেছে। গ্রামেও বছরের শুরুতে মেলা হতো। আজ এই জাঁকজমকপূর্ণ হইচই পরিবেশে খোলা জায়গায় মেলা দেখে খুশিতে উৎফুল্ল হলো চৈতী। নাগরদোলা, ঘোরা রাইড নৌকা সহ টয় টায় ট্রেন ও রয়েছে। আশেপাশের ভীরে হইচই পরিবেশ। চারাপাশে স্টল বসেছে, চুড়ি, প্রসাধনী, আচার, জামা, কসমেটিকস সহ আরোও অনেক কিছুর। স্নিগ্ধা খুশিতে দৌঁড়ে গেলো ভেতরে। জিনিয়া শ্রাবণকে ফোন করে জানলো, ও আশেপাশেই আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মেলায় আসছে। চৈতী কসমেটিকস এর স্টলে দাঁড়াল। হাত দিয়ে নাড়াচাড়া করলো, নুপুর, চুড়ি! জিনিয়া একজোড়া মোটা চুড়ি হাতে নিয়ে বলল,
“ কেমন? ”
“ দারুণ। আমিও কিনবো। আয় তিনজন কিনি।”
স্নিগ্ধা হাতে পড়লো সোনালী চুড়ি। কিন্তু চৈতী গাইগুই শুরু করে। হাত থেকে চুড়ি গুলো যথাস্থানে রেখে বলল,
“ তোরা নে। আমার এসবের দরকার নেই।”
স্নিগ্ধা শুনলে তো? জিনিয়া চোখের ইশারায় কিছু বলতেই মেয়েটা তিনজোড়া সোনালী পাথরের চুড়ি কিনে নিলো। চৈতীর হাতে দিতেই না না করে উঠে,
“ অসম্ভব। এসব পড়িনা আমি।”
“ পড়তে হবে। তুই না চাইলেও আমার জন্য। কাল তিনজন মিলে চুড়ি পড়ে ভার্সিটি যাবো। বুঝলি?”
“ নিতে পারবো না। রাখ তুই।”
বলেই রেখে দিল স্টলে। স্নিগ্ধা রেগে গেলো। বেরিয়ে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব হতেই হাত টেনে ধরে জিনিয়া। ফিসফিস করে বলল,
“ রাগিস না। আমি দিয়ে দিবো। চল নাগরদোলায় উঠি।”
মুখটা কালো করলেও এবার নরম হলো। কয়েক ধরণের আচার কিনে ওরা গেলো, আশেপাশে ঘুরতে থাকা চৈতীর নিকট । আচার দেখে বাঁধ সাধলো না। নিজেই মুখে পুড়লো এরপর তৃপ্তিময় ভঙ্গিতে করে বলল,
“ উমম! কি মজা। মনে হচ্ছে আমাদের গ্রামের আকবর মিয়ার সেই হাতের চালতার আচার। ”
স্নিগ্ধা ভেংচি কাটলো। বলল,
“ নাগরদোলা উঠ। ”
টিকেট কেটে জলদি উঠে পড়লো তিন বান্ধবী।
তৃধার হুড়োহুড়ি তে সন্ধ্যার আগ মুহুর্তে মেলায় উপস্থিত হলো ওরা সবাই। অর্পণ চলে গেলো দূরে! মেয়েগুলো সুর সুর করে ঢুকে পড়লো প্রতিটি স্টলে। শিহাবের কাছে বান্ধবী দের হেফাজতে রেখে দৌঁড়ে পালানো সমুদ্র। ওইযে সামনেই এক ঝাঁক সুন্দরী দেখা যাচ্ছে। ভুলবশত বড়শি তে মাছ টপকে গেলেই হলো। এ জীবন সার্থক। ছেলেটা চোখের পলকে দূরে যেতেই শিহাব ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,
“ এখানেও শুরু হয়ে গেলো।”
তৎক্ষনাৎ জুয়েলারি দেখতে দেখতে হেঁসে উঠে দুই বান্ধবী।
নাগরদোলা চলতে শুরু করতেই সম্পূর্ণ জায়গাটা চিৎকারে ভরে উঠল। অর্পণ পকেটে হাত গুঁজে হাঁটার মাঝেই শুনতে পেলো সেই নাগরদোলায় চিৎকার! না চাইতেও সামনে তাকাতেই ভ্রু জোড়ায় আরেকটি ভাজ পড়ে। দৃষ্টি প্রগাঢ় হতেই একনাগাড়ে কিছুক্ষণ নাগরদোলা চলে থেমে গেলো। আতঙ্কে স্নিগ্ধা চট করে নেমে হাঁপাচ্ছে। চৈতীর ভয় লাগলেও হাতে ময়লা ঝাড়ার মতো কোনমতে বলল,
“ চল..! আরেক রাউন্ড হয়ে যাক।”
“ পা-গল নাকি? আবার?”
স্নিগ্ধার থতমত ভঙ্গি কমেনি। চৈতী ঘনঘন নিশ্বাস ফেলে বাঁকা হাঁসলো। দূর থেকে সেই চাহনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে কেউ। মেয়েটি কোমরে দুহাত রেখে বলল,
“ অবশ্যই। শ্রাবণ কই? আসেনি? ও আসলে আবার উঠবো।”
“ না। তোরা যা। আমার এত সুরসুরী নেই।”
বলেই জিনিয়া সেখান থেকে চলে আসে। পাশের একটি বেঞ্চে বসে স্নিগ্ধা হালকা ঢোক গিলে বলল,
“ বাসায় ফিরবি না?”
খেয়ালি আমি হেয়ালি তুমি পর্ব ২০
চৈতী উত্তর দিলো না। হাতে পড়িয়ে দেওয়া স্নিগ্ধার চুড়িগুলো নাড়াচাড়া করতে লাগলো।
অর্পণ ধীরপায়ে নাগরদোলা কাছে এসে সব বন্ধুদের ডাকলো। কিয়ৎক্ষণের ব্যবধাণেই উপস্থিত হয় সকলে। বেঞ্চে বসা মেয়েগুলো আকস্মিক ওদের এখানে দেখে বিস্মিত হলো। চৈতী না চাইতেও কাঙ্খিত পুরুষটির দিকে তাকাতেই চোখে চোখ পড়ে যায়। কি ঘোলা সেই দৃষ্টি। চোখ-মুখ কঠিন! মেয়েটা তৎক্ষনাৎ চোখ সরিয়ে মস্তক নত করলো। স্নিগ্ধা আশেপাশে নজর বুলিয়ে, পরক্ষণেই নিজেদের সামলে উঠে পাশ কাটিয়ে যেতে নেয়। তৎক্ষনাৎ তৃধা ধরে ফেলে। মিষ্টি হেঁসে বলল,
“ তোমরা এখানে.? ”