খেয়ালি আমি হেয়ালি তুমি পর্ব ৭

খেয়ালি আমি হেয়ালি তুমি পর্ব ৭
আনিকা আয়াত

“ তোর ভাবির কাছে গেছিলাম। চেহারা দেখে বুঝিস না? ফুর্তি করে এসেছি। এবার ভেতরে গিয়ে গোসল করতে দে।”
অর্পণের বেফাঁস কথা এবং লাত্থির আঘাতে তাকে ছেড়ে দিলো অর্ণব। ছেলেটার মুখের রক্তিম বর্নের জন্য তার ভেতরের অতিরিক্ত রাগ, ক্ষোভ প্রকাশ পাচ্ছে । অর্পণের মুখের অবস্থাও করুণ। কিন্তু নিজের ব্যথায় তার কোনো ভাবান্তর নেই। গায়ের ময়লা কাপড় টেনেটুনে আর এলোমেলা উড়ে বেড়ানো চুলে অর্পণ সোজা হয়ে দাঁড়ালো। অসভ্যের মতো অধর বাঁকিয়ে হেঁসে উঠলো, অর্ণবের বাসার ভেতর ঢুকার পানে তাকিয়ে। উশৃংখল, বেপরোয়া অর্পণের ঠোঁটের কোণে হালকা র-ক্তের আভাস দেখা যাচ্ছে।

অর্ণবের থেকে ঘুষি খাওয়ার ফলস্বরুপ এই অবস্থা। ছোটবেলা থেকেই এক ভাই আরেক ভাইয়ের চরম প্রতিদ্বন্দ্বী! অথচ, মনে নেই কোনো হিংসা! ক্রোধ এবং আক্রোশ! দিব্যি হৃদয়ের গহীনে লুকিয়ে রাখা অল্প ভালোবাসা দিয়ে একে অপরকে আগলে রাখছে, ভালোবেসে যাচ্ছে।
অর্পণ গম্ভীর মুখে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ঠোঁট মুছে বাসায় ঢুকলো। ঝটপট শাওয়ার দিয়ে পেটের চাপে ডাইনিং-য়ে খেতে গেলো। টেবিলে ঢাকা সব বাটি উল্টে পাল্টে দেখার সময় চোখ গেলো, তৃষ্ণার বানানো মোগলাইয়ে! অর্পণ ওষ্ঠ প্রসারিত করে হাঁসলো। চেয়ারে বসে অবশিষ্ট মোগলাই টুকু প্রচন্ড ক্ষুধায় গপাগপ করে খেয়ে নেয়। ডিনার শেষে ভেজা ঘন চুলগুলো বামহাত চালিয়ে ঝেড়ে নিলো। রুমে প্রবেশ করে খেয়াল করলো, অর্ণব ততক্ষণে ঘুমিয়ে কাঁদা। বিছানার একপাশে কোলবালিশ জরিয়ে ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অর্পণ হঠাৎ করে নিজের রুমে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করলো না। দ্রুত লাফ দিয়ে অর্ণবের পাশেই শুয়ে পড়লো। ছেলেটা ঠান্ডা হিম শরীর নিয়ে অর্ণবকে তার দুই হাত-পা দ্বারা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লো।
অর্ণবের ঘুম ভেঙে যায়। তড়িৎ গতিতে চোখ খুলে অর্পণের বাঁধন থেকে ছুঁটার জন্য ধাক্কাধাক্কি শুরু করে। কিন্তু পরক্ষণেই বুঝতে পারে এই অসভ্য ছেলেটা তাকে ছাড়বে না। ইচ্ছে করেই এমন করছে। বেচারা না পেরে হাত বাড়ালো। অর্পণের গলা টিপে ধরে হিসহিসিয়ে বলল,
“ অসভ্য! দূরে গিয়ে ম/র কুত্তা। আমি তোর ভাই! বিয়ে করা বউ নই। ”
অর্পণ চোখ বন্ধ করে মিটিমিটি হাঁসলো। পা দ্বারা ভাইয়ের কোমরে ধপাস করে লাত্থি দিয়ে বলল,
“ আমি জানি অর্ণবের বাচ্চা। ঘুমা চুপচাপ। ”

দিনের শুরুতে ব্যস্ত শহরের মানুষও প্রচন্ড ব্যস্ত হয়ে উঠে। সবাই নিজেদের কাজে চলে যায়। সময়ের সাথে পাল্লা ধরে বেঁচে থাকার লড়াই করে। প্রতিদিনের ন্যায় চৈতী ঝটপট সকালের নাস্তা করে ভার্সিটিতে চলে এসেছে। ক্লাসে যাওয়ার আগে সে বসে আছে, সবুজ ঘাসে ভরা মাঠের এক পাশে। মেয়েটার হাতে একটি ম্যাথ বই। সেদিকেই গভীর মনোযোগ! আর কোলে চিপস-এর প্যাকেট। মাঝে মাঝে কোল থেকে ডান হাত বাড়িয়ে চিপস খেয়ে যাচ্ছে। গায়ের হালকা ডিজাইনের কুর্তি আর প্যান্ট পড়া! গলায় ঝুলে আছে স্কার্ফ। চুলগুলো উঁচু করে বেঁধে রেখেছে।
চৈতী কি মনে হতে, হঠাৎ পড়ার মাঝে হাত উল্টো করে একনজর ঘড়িতে সময় দেখে নিলো। তৎক্ষনাৎ বিরক্তে তার চোখ-মুখ কুঁচকে যায়। ক্লাসের সময় হয়ে যাচ্ছে। অথচ, একটারও আসার খবর নেই। মেয়েটা দ্রুত পার্স থেকে ফোন বের করে জিনিয়াকে কল দিলো। সাথে সাথেই ওপাশ থেকে জিনিয়া ব্যস্ত কণ্ঠে জানায়। রাস্তায় জ্যাম ছিলো! সে দ্রুত আসছে। চৈতী ব্যাগে ফোন রেখে আবারোও গম্ভীর মুখে বই নিয়ে বসে রইলো। কলমটা ঠোঁটের মাঝে রেখে, ভ্রু কুঁচকে চৈতী কিছু ভাবছে। কারণ মেয়েটির মাথায় আপাতত পড়াশোনার টেনশন।

তার ঠিক কিছুটা দূরে বাইকে বসে আড্ডা দিচ্ছে অর্পণের বন্ধুমহল। ছেলেটার চোখ দুটি বন্ধ! দুহাত আড়াআড়ি ভাবে বুকে গুঁজা, পায়ের উপর পা তুলে নাচাচ্ছে। তুষিব ঠিক তার পেছনে দাঁড়িয়ে মাথার চুল টেনে দিচ্ছে। সকলের মুখেই লেগে আছে বিস্তার হাঁসি। বিভিন্ন টপিকে আড্ডার তালে হেঁসে যাচ্ছে তারা। নেই কোনো টেনশন! শুধু জীবনটা উপভোগ করার আনন্দ। তাদের এই মিষ্টি আড্ডার মাঝে হঠাৎ তৃধা সামনে তাকিয়ে লজ্জা লজ্জা মুখে উচ্চস্বরে বলল,
“ ওই দেখ রিয়াদ স্যার যাচ্ছে। স্যারকে ফর্মাল ড্রেসআপে দেখে আমি নর্দমায় ভেসে যাচ্ছি দোস্ত..! কিউট বাচ্চাটা আমার.!”
মেয়েটার কথায় উপস্থিত সবাই হু হু করে হেঁসে উঠলো। শিহাব তৃধার মাথায় চাটি মে/রে রসিকতার ছলে বলল,

“ তোর দুষ্টু চোখ দুটি বন্ধ কর। ওইরকম নষ্ট চোখ নিয়ে ঘুরিস কিভাবে? স্যারকেও রেহাই দিলি না?”
তৃধা দাঁত কটমট করে তাকালো। শিহাবের দিকে তেড়ে যেতেই পৃথা আটকালো তাকে। কিন্তু মেয়েটা কাঁধের ব্যাগ শক্ত করে ধরে, লজ্জা রাঙা চোখে দূরে হেঁটে চলা রিয়াদ স্যারের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ আমি ক্লাসে যাচ্ছি! তোরা আয়।”

কাউকে কোনো উত্তর দেওয়ার আগেই তৃধা ছুটে চলে গেলো রিয়াদের দিকে। ক্লাস শুরু হয়ে যাচ্ছে । সবাই যার যার মতো মাঠ থেকে নিজ নিজ ক্লাসের দিকে চলে যাচ্ছে। কিন্তু অর্পণ ভাবলেশহীন ভাবে সেখানেই বসে আছে। ঠিক সেই মুহুর্তে প্রচন্ড ব্যস্ত পায়ে স্নিগ্ধা তাদের সামনে দিয়ে হেঁটে যায়। তৎক্ষনাৎ অর্পণ সুক্ষ্ম চোখে পরখ করলেও, অস্থির সমুদ্র-র হৃদয়ে আচমকা ঝড় উঠে যায়। সে উত্তেজিত হয়ে হাত উঁচিয়ে উচ্চস্বরে ডাকলো,
“ এ্যাই স্নিগ্ধু। শুনো না। ”

স্নিগ্ধার হাঁটা থেমে যায়। মেয়েটা কপাল কুঁচকে পেছনে তাকালো। মুহুর্তেই অর্পণের চোখের সাথে চোখ পড়ে গেলো। স্নিগ্ধার আখিঁর সাথে কিঞ্চিৎ মিলন ঘটার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটা চোখ ঘুরিয়ে নেয়। কিন্তু অর্পণ তখনও স্থির। স্নিগ্ধা নড়েচড়ে নজর সরিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকালো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“ লাফাঙ্গার দল। একদম আমার পিছনে পড়বি না। ফলাফল ভালো হবেনা কিন্তু। ”
সমুদ্রের হাঁসি হাঁসি মুখ সেকেন্ডেই চট করে চুপসে যায়। শিহাব, পৃথা এবং তুষিব উচ্চস্বরে হেঁসে ছেলেটার কাঁধে থাপ্পড় দিলো। পৃথা সমুদ্রের গলা জরিয়ে বলল,
“ কিরে বা/ল? মিশন ডিস মিস? মেয়েটা এতো সহজে গলবে না। আস্ত লাল মরিচ। ”
সমুদ্র রাগে দুঃখে পৃথার হাত ঝামটা মেরে দূরে সরায়। অর্পণ বাইক থেকে লাফ দিয়ে নামলো। সমুদ্রের মাথায় চাটি মে/রে বলল,
“ ধানিলঙ্কাকে পটাতে চাইলে, অন্য ট্রিকস ফলো করতে হবে। মেয়েটা ভারী অভদ্র! তুই বরং নতুন কাউকে ট্রাই কর। ”
স্নিগ্ধার মেজাজ চটে যায়। সে মুখ মুচড়ে অর্পণকে উদ্দেশ্যে রাগী চোখে বলল,

“ আপনি মনে হয় খুব ভদ্র? অভদ্র, লাফাঙ্গা কোথাকার। আপনার বন্ধুদের সাবধান করবেন, আমার থেকে ১০০ হাত দূরে থাকতে। আমি কিন্তু চুপ থাকার মেয়ে নই! বেশি তিড়িং বিরিং করলে, আন্টির কাছে বিচার দিবো। ”
অর্পণ বাইক থেকে সরে এগিয়ে আসলো। স্নিগ্ধার রাগান্বিত চোখের দিকে তাকিয়ে হালকা ঝুঁকে বলল,
“ কি বিচার দিবে সুন্দরী? বিশ্বাস কর! নতুন বলে তোমাকে আজ ছেড়ে দিচ্ছি। নয়তো, এমন অভদ্রতা আমি সহ্য করতাম না। চড় খেয়েছ কখনও? ”

“ এত বড় সাহস আপনি আমাকে মা/রবেন? আমি কি বসে থাকবো? প্রিন্সিপালের কাছে অভিযোগ করবো। ”
শিহাব, সমুদ্র উচ্চস্বরে খিলখিল করে হাঁসলো। অর্পণ মুচকি হেঁসে বাইক থেকে ব্যাগ হাতে নেয়। কিন্তু পৃথা স্নিগ্ধার দিকে আঙুল চুলে হিসহিসিয়ে বলল,
“ এ্যাই মেয়ে! কাকে কি বলছ? ডর ভয় নেই? যাও ক্লাসে যাও। অসভ্য মেয়ে। ”
পৃথার তিরিক্ষি মেজাজের কথা শুনে স্নিগ্ধা দাঁতে দাঁত চাপলো। চোখ গরম করে মুখ বাঁকিয়ে চলে যায়।
অর্পণ সঙ্গে ওরা ক্লাসের দিকে যাওয়ার সময় সমুদ্র একবার ঘাড় ঘুরিয়ে স্নিগ্ধার দিকে তাকালো। তৎক্ষনাৎ তার কপাল কুঁচকে যায়। স্নিগ্ধার পাশের মেয়েটার দিকে নজর পড়তেই ছেলেটার চোখ দুটি চকচক করলো। সে উৎফুল্ল সুরে অর্পণের বাহু জরিয়ে বলল,
“ স্নিগ্ধা মেয়েটা বাদ। ওই মেয়েটার সাথে প্রেম করিয়ে দে ভাই। ওইযে স্নিগ্ধার পাশে বসে হাঁসছে।”
পৃথা কৌতুহল চোখে তাকিয়ে চোখ বড় বড় করে বলল,
“ চৈতী? আর ইউ সিরিয়াস?”
“ হু মামা। নামটা সুন্দর! আমার চৈতী সোনা।”

অর্পণ তীক্ষ্ণ চোখে চৈতীর দিকে তাকায় । স্নিগ্ধার সাথে তাকে দেখে কপাল কুঁচকে ফেললো। ওরা একসাথে কেনো? তবে কি একই ক্লাসের? পরক্ষণেই সমুদ্রের কথা শুনে হঠাৎ রাগ বাড়লো তরতর করে। কাঁধের ব্যাগ দিয়ে সমুদ্রের পিঠে আঘাত করে, দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“ অসম্ভব। ওই ফাজি/ল মেয়েটা নয়। অন্য কাউকে দেখ।”
“ কেনো? মেয়েটা সুন্দর। ফা/জিল হবে কেনো? তোর কিসের প্রবলেম। ”
সমুদ্র মুখ বাঁকিয়ে জবাব দেয়। অর্পণ ক্লাসে যেতে যেতে পেছন ঘুরে রাগান্বিত গলায় বলল,
“ এলার্জি আছে আমার। ওই মেয়েটাকে যেনো তোর আশেপাশে না দেখি।”
অর্পণ হনহনিয়ে ক্লাসে চলে গেলো। সমুদ্র এক দৃষ্টিতে চৈতীকে দেখছে। ঠোঁটে অদ্ভুত হাঁসি টেনে হেলেদুলে ক্লাসে গেলো।

স্নিগ্ধার সাথে কথা বলার মধ্যে কখন যে, চৈতীর দৃষ্টি অর্পণের দিকে গেছে সে বুঝতেই পারেনি। ছেলেটার ভঙ্গি দেখে সে অজান্তেই হেঁসে উঠে। খামখেয়ালি বশত তার পাশে স্নিগ্ধার দৃষ্টিও ছেলেটির দিকে। এক অদ্ভুত মহিমায় দুটি মেয়ের চোখই একই ব্যক্তিকে দেখে যাচ্ছে। হঠাৎ তাদের ভাবনায় ছেদ পড়লো শ্রাবণের ডাকে। চৈতীর পাশে ধপ করে বসে বলল,
“ কখন এসেছিস?”
ভাবনায় ছেদ পড়ে, চমকে উঠে দুজনেই। নিজেদের স্বাভাবিক করে চৈতী মিনমিন স্বরে বলল,
“ অনেকক্ষণ। স্নিগ্ধার সাথে গল্প করছিলাম। ”
স্নিগ্ধাও চো/রের মতো এলোমেলো দৃষ্টি ফেললো। নিজের প্রতি তার রাগ হচ্ছে। কেনো সে ওই অভদ্র ছেলের দিকে তাকিয়ে ছিলো? কি আছে ছেলেটার ভেতর? চৌম্বক জাতীয় কিছু? স্নিগ্ধা নড়েচড়ে নিজেকে সামলে শ্রাবণকে বলল,

“ হিমু আসছে না কেনো?”
“ শালী নতুন বয়ফ্রেন্ড নিয়ে ব্যস্ত!”
“ কি বলিস? ওর কবে বয়ফ্রেন্ড হলো।”
চৈতী কৌতুহল চোখে প্রশ্ন করলো। শ্রাবণ ওর মাথায় চাটি মে/রে বলল,
“ ধুর পাগ/ল এমনি বললাম। ”
চৈতী হঠাৎ ব্যাগ থেকে দুটি চকলেট বের করলো। শ্রাবণকে দিয়ে বলল,
“ নে আমার তরফ থেকে চকলেট। ”
শ্রাবণ খুশিতে গদগদ হয়ে চকলেটের প্যাকেট খুলে খাওয়া শুরু করলো। চৈতী হেঁসে আরেকটা চকলেট স্নিগ্ধার হাতে দিয়ে বলল,

“ তোমার জন্যও!”
শ্রাবণ চকলেট খেয়ে চৈতীকে ক্লাসে যাওয়ার জন্য বলল। চৈতী হেঁসে উঠে দাঁড়ায়। স্নিগ্ধা চকলেট হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে উদাসীন কণ্ঠে বলল,
“ চৈতী! তুমি আমাকে ফ্রেন্ড ভাবো না?”
“ কেনো বলো তো?”
“ বন্ধুকে তাহলে কেউ তুমি করে ডাকে? ওদের তো তুমি করে বলো না। ”
চৈতী হাঁটার মাঝে খিক করে হেঁসে দাঁড়িয়ে পড়লো। ক্লাসে ঢুকার আগে স্নিগ্ধার গলা জরিয়ে করে হেলেদুলে বলল,
“ এই ব্যাপার? তুইও জিনিয়া, হিমুর মতো আমার বেস্টি! ওকে? এবার ক্লাসে যা। আবার দেখা হবে। আজ থেকে স্নিগ্ধা আমার বেস্টি! ”

“ হ্যাঁ আমি তো কারোও বন্ধু নই!”
শ্রাবণের মুখ ফুলিয়ে কথায় ওরা দুজনেই হেঁসে উঠলো। চৈতী ছেলেটার মাথায় বই দিয়ে বারি মে/রে বলল,
“ ঠিক বলেছিস! তুই আমার শ্রাবণ মাস!”
স্নিগ্ধা খিলখিল করে হাঁসলো। কেমিস্ট্রি ক্লাসে যাওয়ার আগে চৈতীর বিনুনি টেনে বলল,
“ আমি যাচ্ছি তাহলে! তোরা ওই মোটা স্যারের ক্লাস কর।”

সূর্যের তীর্যক রশ্মিতে দেহ যেমন ক্লান্তি লাগে ঠিক তেমনি মৃদুমন্দ বাতাসে গা শীতল হয়ে যায়। ভার্সিটির গেইটে যানবাহনের শব্দে মুখরিত! ক্যাম্পাসে এই ক্লান্ত দুপুরে এখনও তুমুল ভীর ছাত্র-ছাত্রীদের। অর্পণ প্রথম ক্লাস করেই ক্যান্টিনে বসে আছে। তুষিব আর শিহাব ছাড়া বাকিরা ক্লাসে। অর্পণ সিঙ্গাড়ায় কামর দিয়ে শিহাবকে বলল,
“ ফাস্ট ইয়ার দের নবীন বরণ কবে?”
শিহাবের গভীর মনোযোগ গিটারের দিকে ছিলো। সে অর্পণের প্রশ্নে আঁতকে উঠল। একটু নড়েচড়ে বসে আনমনে বলল,
“ কি বললি?”
“ তোর বউয়ের বিয়া কবে?”
অর্পণের বিরক্তিকর কথায় শিহাব দমে গেলো। তুষিবকে ইশারা দিয়ে বলল,
“ ওই! তুই বল। ”
“ কইতে পারমু না। আপনে দিনের বেলায় স্বপ্ন দেখেন?”

অর্পণ মজা পেলো তুষিবের কথায়। শিহাবের কফি হাত বাড়িয়ে নিলো। লম্বা এক চুমুক দিয়ে গুনগুনিয়ে গান গাইলো। শিহাবের সহ্য হলো না। এই ছেলে দুটো একই স্বভাবের। ত্যাড়া মানে প্রচন্ড ঘাড়ত্যাড়া। মাঝে মাঝে শিহাবের ইচ্ছে করে, এই দুটোকে কষে চড় মা/রতে। সে গাল ফুলিয়ে অর্পণের বাহুতে গুঁতা দিয়ে বলল,
“ বলবি না?”
“ না। ”
তুষিব হু হু করে হেঁসে উঠে। তৎক্ষনাৎ আগমন ঘটল ফাস্ট ইয়ারের ছাত্র-ছাত্রীদের। চৈতী, শ্রাবণ,জিনিয়া আর স্নিগ্ধা ক্যান্টিনে এসে বসলো। স্নিগ্ধা চঞ্চলতার সহিত সবার জন্য কফি নিয়ে এসে বলল,
“ আজ মার্কেটে যাবি? সবাই মিলে যাই চল। মজা হবে!”
জিনিয়া তৎক্ষনাৎ নাকচ করে দেয়। ভাড়া বাসায় থাকায়, দেরী করা যাবে না। চৈতী রয়েসয়ে কফিতে চুমুক দিয়ে বলল,

“ আমার কিছু কেনার দরকার নেই। তাছাড়া বিকেলে টিউশন আছে। স্নিগ্ধা অন্যদিন যাই?”
স্নিগ্ধা মুখ গুমরা করে কিছু বলার জন্য মুখ খুললো। তৎক্ষনাৎ শ্রাবণ স্নিগ্ধার পাশে বসে উৎফুল্ল সুরে বলল,
“ তোর সাথে আমি যাবো!”
স্নিগ্ধা মুচকি হেঁসে বই বের করলো। একটু দূর থেকে অর্পণ এক অদৃশ্য টানে কেনো জানি চৈতীর দিকেই তাকিয়ে আছে। তীক্ষ্ণ ও শীতল তার দৃষ্টি! চৈতী সিরিয়াস হয়ে আজকের পড়ার টপিক নিয়ে আলোচনা করা শুরু করে। কিছুসময় পর হঠাৎ উচ্চস্বরে গান বেজে উঠল। আকস্মিক ঘটনায় চৈতী হকচকিয়ে উঠে। শিহাব এবং অর্পণ উচ্চস্বরে গলা ছেড়ে গেয়ে যাচ্ছে,

“ চুমকি চলেছে একা পথে..
সঙ্গী হলে দোষ কি তাতে?
রাগ করো না সুন্দরী গো,
রাগলে তোমায় লাগে আরও ভালো.!
চুমকি চলেছে একা পথে,
সঙ্গী হলে দোষ কি তাতে…”
চৈতী ভয়ে তৎক্ষনাৎ পেছন ঘুরে তাকায়। অর্পণ খেয়াল করলো সুক্ষ্ম চোখে। বাঁকা হেঁসে ভ্রু নাচিয়ে উচ্চস্বরে বলল,
“ চুমকি বসেছে আমার সামনে..
সঙ্গে বসলে দোষ কি তাতে? ”
স্নিগ্ধার মুখের বদন কঠিন হতে কঠিন। এই বেয়াদব কাকে মিন করছে? সে চৈতীর পানে তাকাতেই, চট করে বুঝে গেলো। জিনিয়া ফিসফিস করে বলল,

“ চৈতী ভয় পাবি না। অর্পণ শেখ যা খুশি বলুক। চুপ করে থাক। ইদানীং খুব বিরক্ত করছে।”
চৈতী ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে বলল,
“ তোদের জন্যই ছেলেটা আমাকে চিনে ফেলেছে। কি দরকার ছিল ওই বাজে ডেয়ার দেওয়ার?”
জিনিয়া এবং শ্রাবণ অসহায় চোখে তাকে স্বান্তনা দিলো। তবে, স্নিগ্ধা জিনিয়ার কথা শুনে ফুঁসে উঠল। সে চৈতীর হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে বলল,
“ একদম ভয় পাবি না। ওই ছেলেকে ভয় পাওয়ার কি আছে? ওকে আমার খুব ভালো করেই চেনা আছে। অভদ্র কোথাকার। ওর সাথের ছেলেটাও এক নম্বর বেয়াদব। ”

চৈতী হতভম্ব দৃষ্টিতে অর্পণের দিকে ফের তাকাল। ছেলেটা মাথার চুল এলোমেলো ভঙ্গিতে পেছনে ঠেলে বসে আছে। তার ঠোঁটের শয়-তানি হাঁসি ও রহস্যময় ধারালো চোখ দুটি অপলক চৈতীর ভয়ার্ত মুখে স্থির! চৈতীর অসহায় মুখ খানা দেখে, মনে মনে বাঁকা হাঁসলো সে। পাশে বসে আপনমনে শিহাব গিটার চালাচ্ছে। শ্রাবণ এই কয়েকদিনে অর্পণের ডিটেইলস কালেক্টর করে বুঝেছে, ছেলেটা ভয়ানক। গ্যাঞ্জাম পাকানোর উস্তাদ। তাই কিছু বলতেও পারছে না। তবে, চৈতীকে সাহস দেওয়ার জন্য আবারোও বলল,

“ চল বাসায় চলে যাই। মেসেঞ্জার গ্রুপে এই টপিক নিয়ে আলোচনা করবো। ”
স্নিগ্ধাও তার কথায় স্বায় জানায়। চৈতী ঘাড় ঘুরিয়ে শ্রাবণের দিকে তাকালো। হালকা ঢোক গিলে বলল,
“ সমস্যা নেই। আরোও কিছুক্ষণ বসি। হোস্টেলে একা একা ভালো লাগেনা। ”
কিন্তু শ্রাবণ কথা শুনতে রাজি নয়। সে স্নিগ্ধাকে তাড়া দিয়ে চৈতীর ব্যাগ হাতে নিলো। ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। চৈতী বিরক্ত মুখে জিনিয়ার সাথে পেছন পেছন যাওয়ার সময়, তার কানে এক পুরুষালি গম্ভীর কণ্ঠ ভেসে আসে ,
“ পালাচ্ছ কেনো মেয়ে? আমি তো গান গাইছিলাম। তাছাড়া তুমি কি চুমকি? ”
চৈতীর পা তৎক্ষনাৎ থেমে যায়। অর্পণের কথার জবাবে সে চুপ করে রইলো। এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে মিনমিন স্বরে বলল,
“ অবশ্যই না। আমাকে হোস্টেলে ফিরতে হবে তাই যাচ্ছি। আপনারা এখন শান্তিতে আড্ডা দিন। আরোও গান গাইতে থাকুন।”
“ তুমি না থাকলে জমে চুমকি? ”
অর্পণ চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে রসিয়ে রসিয়ে বলল। চৈতী চাপা রাগ নিয়ে হনহনিয়ে বেরিয়ে যায়।

দুপুরের তেজীয় রৌদ্রে তৃধা পৃথার সাথে রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। চিকন গড়নের তৃধা বিরক্ত হয়ে বলল,
“ রিকশা আসছে না কেনো?”
“ চল হেঁটে যাই! ”
তৃধা দ্বায় সাধে। সে এই রোদে হেঁটে যেতে পারবে না। পৃথা কটমট করে তাকিয়ে, রেগে মেয়েটার চুল ধরে টান দিলো। বলল,
“ রিয়াদ স্যার আমার জায়গায় থাকলে কি করতি?”
তৃধার চোখ দুটি তৎক্ষনাৎ চিকচিক করে উঠে। সে লজ্জা লজ্জা মুখে উত্তর দিলো,
“ হাতে হাত ধরে এই রোদেও আমি মাইলের পর মাইল হেঁটে যেতাম। শুধু এই খালি রাস্তায় আমি আর রিয়াদ স্যার!”

পৃথা জানতো মেয়েটা এমনই বলবে। এই কয়েক মাসে রিয়াদ স্যারকে নিয়ে তৃধার জন্য মুগ্ধতা। সারাক্ষণ রিয়াদ স্যার, রিয়াদ স্যার করে মুখে ফ্যানা তুলে। পৃথা মুখ বাঁকালো। তৃধা খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,
“ দোস্ত! স্যারের ওই শক্তপোক্ত দেহটা দেখেছিস? ভাই প্রথম সেদিন ভার্সিটিতে পা রাখল ওইদিনই আমি ফিদা। ওইযে স্যারের দুটি গোলাপি ঠোঁট! যখন কথা বলার সময় ঠোঁট দুটি নড়াচড়া করে! আমি কল্পনায় হারিয়ে যাই। ভাবতে থাকি, একদিন ওই ঠোঁটের স্পর্শ শুধুমাত্র আমিই পাবো। ইশশ! আমি আর ভাবতে পারছি না। রিয়াদ স্যার কি জাদু করলেন আপনি?”

শেষের কথাগুলো একটু জোরেই বললো তৃধা। খুশিতে মেয়েটা হেলে-দুলে ঠোঁট টিপে হাঁসছে। পৃথার পানে তাকাতেই, তার দম বন্ধ হয়ে যায়। সে চোখ বড় বড় করে শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইলো। কারণ, রিয়াদ স্যার চোয়াল শক্ত করে পৃথার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। ওই কঠিন চোখ দুটি দূর থেকেই যেনো, মেয়েটাকে শাসিয়ে যাচ্ছে। তৃধা কাঁদো কাঁদো মুখ করে মাথা নত রাখলো। নিশ্চয়ই স্যার সব শুনে ফেলেছে। ছিঃ কি যে ভাবছে তাকে নিয়ে। তার ইচ্ছে করলো, এই মুহুর্তে গাড়ির নিচে চাপা পড়তে। সে পৃথাকে বাহু নিয়ে ধাক্কা মে/রে বলল,
“ দোস্ত ফেঁসে গেছি।”
পৃথা বিরক্ত গলায় জানতে চাইলো,
“ কিভাবে!”
“ স্যার সব শুনে ফেলেছে। তোর পেছনে স্যার। এখন আমি কোথায় লুকাবো পৃথা। সর্বনাশ হয়ে গেলো। কি করি আমি? ”

খেয়ালি আমি হেয়ালি তুমি পর্ব ৬

পৃথার চোখ বড় বড় হয়ে যায়। ধীরে ধীরে ভয়ে পেছনে ঘুরতেই দেখলো, স্যার একটি রিকশায় উঠছে। চোখ দুটি তখনও তৃধার দিকে স্থির। তবে, সেই দৃষ্টিতে কোনো কঠিনতা নেই। কেমন অদ্ভুত ভঙ্গিমায় তাকিয়ে আছে। শীতল ও সচ্ছ চোখের দৃষ্টি। দেখে বুঝার উপায় নেই, তিনি রেগে আছেন নাকি শান্ত! কেমন ঘোরের মাঝে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। পৃথা গলা খাঁকড়ি দিয়ে তৃধার কানে কানে বলল,
“ স্যার আসলেই সব শুনে ফেলেছে। তোর দিকে এখনও তাকিয়ে আছে। সামনে দেখ। ”
তৃধা চো/রা চোখে ভয়ে ভয়ে সামনে তাকায়। তৎক্ষনাৎ চোখে চোখ পড়ে যায় দুজনের। হালকা ঢোক গিয়ে কাঁদো কাঁদো করলো মুখটা। রিয়াদ স্যার রিকশা দূরে চলে যাওয়ার পরও হঠাৎ পেছন ঘুরে কপাল কুঁচকে তাকালো তাদের দিকে।

খেয়ালি আমি হেয়ালি তুমি পর্ব ৮