চিত্রাঙ্গনা পর্ব ২৮

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ২৮
ইশরাত জাহান জেরিন

ফারাজ এক দৃষ্টিতে সামনের নিথর দেহটির দিকে তাকিয়ে রইল। সাবিবের শরীর র*ক্তে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। ফারাজের শাদা শার্ট লাল স্রোতে প্লাবিত। ধীরে সিগারেট ঠোঁটে তুলল সে। নিঃশ্বাসে আগুন ধরিয়ে ধোঁয়ার দীর্ঘ রেখা ছড়িয়ে দিল বাতাসে। চোখ সরু করে একপাশে তাকাল।
গুলিটি বুকে বিদ্ধ হওয়ার পর সাবিবের মরণ আসতে খুব একটা দেরি হয়নি। ব্যথার আর্তনাদ পর্যন্ত করার সুযোগ পায়নি সে। যন্ত্রণায় ছটফট করার আগেই মৃ*ত্যু তাকে আঁকড়ে ধরেছে। ফারাজের গুলি তার দেহের অবশিষ্ট নিঃশ্বাসটুকুও শুষে নিয়েছে। ওই যে এসিডে গলিত মাংসপিণ্ডের ওপরই গুলি চালিয়ে সাবিবকে মুক্তি দিয়ে দিয়েছে ফারাজ। র*ক্তাক্ত শ্বাসরুদ্ধ পরিবেশে ফারাজ ধীরস্থির ভঙ্গিতে লা*শের কাছ থেকে সরে দাঁড়ালো।

“এই লা*শ কি করবো ভাই?” অভ্র জিজ্ঞেস করল।
ফারাজ একটু চুপ থেকে বলল,
“বাড়িতে ওর বউ আছে না? পার্সেল করে বউয়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে আয়।”
” দিলে লাভ কি? স্বামীর এসব কাজের সঙ্গে সে নিজেও তো জড়িত ছিল।”
“আচ্ছা।” ফারাজ থামলো তারপর বলল,
“তাহলে পুলিশের সঙ্গে কথা বল। নিশ্চিত কর, খু*নের দায় যেন ওর স্ত্রীর ওপরই বর্তায়। সবাই যেন জানে, সে পরপুরুষের সঙ্গে পরকীয়ায় লিপ্ত ছিল। প্রেমিকের সঙ্গে মিলেই স্বামীকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছে।”
অভ্র সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল,”আচ্ছা।”
ফারাজ এবার নিজের শার্টের দিকে তাকাল। র*ক্তমাখা কাপড়ে নিষ্ঠুর শিল্পকর্মের ছাপ লেগে আছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে আবার বলল,
“পোশাক বদলাতে হবে। কালো শার্ট আর প্যান্ট পাঠিয়ে দে।”
অভ্র মাথা ঝুঁকিয়ে সাড়া দিলেও এবার তার কণ্ঠে কৌতূহল মিশল। “এখন বাসায় ফিরবেন?”
“উঁহু! আরেকটা কাজ তো বাকি।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

নদীর একেবারে পাড়ে পাশাপাশি দুটি নৌকা বাঁধা। চারপাশ নিস্তব্ধ। কেবল পানি ছলাৎ ছলাৎ করে বয়ে যাচ্ছে। সিফাত নিঃশব্দে একটা কয়েল ধরিয়ে নৌকার একপাশে রেখে দেয়। পান চিবোতে চিবোতে সোহান কাগজ দিয়ে একটা ছোট্ট নৌকা বানাচ্ছে। হয়তো সময় কাটানোর অজুহাত খুঁজছে। হঠাৎ সিফাত নিচু স্বরে বলে ওঠল, “ভাই, হেয় চইলা আসছে।”
মেঘে ঢাকা চাঁদের আলোয় চারপাশটা অদ্ভুত লাগছে। অন্ধকার, বাতিহীন, চাপা উত্তেজনায় ভরা। সোহান চোখ তুলে তাকায় না। তবু বুঝতে পারে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে তার সামনে। লম্বা, চওড়া গড়নের এক লোক। যার মুখটা অন্ধকারে ঢাকা। সোহান তার চেহারা দেখতেও চায় না। দরকার নেই। সে জানে কে এসেছে। সোহান খানিকক্ষণ নীরব থেকে ধীর গলায় বলল, “মেলা দেরি কইরা ফেলাইছো। তাও তো আইলা। তোমার অপেক্ষা তেই ছিলাম। এই সিফাইতা! দুই কাপ সর ওয়ালা মালাই চা আন। সাহেবের কাপে সর একটু বেশি দিবার কইস।”
লোকটা তার পাশে এসে বসল। তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “কি খবর জানতে চাও?”

সোহান কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। নদীর জলের দিকে তাকিয়ে রইল। সময়ের ভারী নীরবতা ভেদ করে সিফাত এসে হাজির হলো। হাতে ধোঁয়া ওঠা চায়ের পেয়ালা। সে এক কাপ সোহানের দিকে বাড়িয়ে দিল। অন্যটি লোকটির হাতে তুলে দিলো। লোকটি অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করল। অতি পরিচিত দক্ষতায় সিগারেট ঠোঁটে চেপে আগুন ধরাল। তারপর গভীরভাবে টান নিয়ে ধোঁয়ার কুণ্ডলী ছেড়ে দিল সন্ধ্যার বাতাসে। কয়েক মুহূর্ত নীরবতা বজায় রেখে চুমুক বসালো চায়ের কাপে। শীতল স্বরে বলল,
“জলদি বলো। কেন ডেকেছো? কি খবর জানতে চাও?”

সোহান চোখ তুলে তাকায়। কণ্ঠস্বর তার স্থির। কিন্তু ভিতরে অস্থিরতা দোল খাচ্ছে৷ “চিত্রার। চিত্রার খবর জানবার চাই। আর কতকাল তারে নিজে দেখবা? এইবার আমাগোরেও সুযোগ কইরা দাও।”
লোকটা মৃদু হাসল। বলল, “সময় হোক। এখনো তো নিজেই ভালো করে দেখতে পারতাম না। আমার কাজ শেষ হলে চিত্রার সান্নিধ্য তুমি অবশ্যই পাবে।”
সোহান গম্ভীর গলায় বলল , ” খালি তোমার লইগা এখনো সংযম দেখাইতেছি। নাইলে কবেই কাম সাইরা ফেলতাম। দেখো সোহানের মাইয়া মানুষের প্রতি অত নজর নাই। তবে ওই মাইয়ার যেই রুপের বর্ণনা শুনতাছি তাতেই তো দেখার সাধ জাগতাছে। তার থেকে বেশি কিছু না। আমার মতো পাপীগো কাছে সৌন্দর্যের মূল্য নাই। আমরা সৌন্দর্যরে নিলামে তুলি। আমাগো জন্যে রূপ বিলাসিতা না, ব্যবসার পণ্য। আমরা সৌন্দর্য বেইচা পেট চালাই।”

লোকটি মাথা নেড়ে বলল, ” “চিত্রা কেবল সুন্দরী নয়, সে দহনশোভিতা। আগুনের মতো তার রূপ। সময় হলে তাকেও সরবরাহের তালিকায় যুক্ত করা হবে। আগে তো দেখি,ছুঁই, কাছে যাই।”
সোহান কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “কাছে যাইতে গিয়া প্রেমে পইরা যাইও না। প্রেম ধ্বংস করার অস্ত্র। এই অস্ত্রে গর্দান পড়লে জীবনরে একেবারে পিইষা মারবো।”
দূরের কোনো লঞ্চের নেভিগেশন বাতির আলো হঠাৎ করেই লোকটির গায়ে পড়ল। মুহূর্তমাত্র স্থায়ী হয়ে মিলিয়ে গেল অন্ধকারের অতল গহ্বরে। ক্ষণিকের জন্য সোহানের দৃষ্টি আটকে গেল লোকটির পরিধেয় কালো শার্টের উপর। পরক্ষণেই সে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। লোকটি আর বসে রইল না। এখানে নির্বিকার বসে থেকে মুহূর্ত ক্ষয় করার অবকাশও নেই তার কাছে। সে ধীর পদক্ষেপে উঠে দাঁড়াল। চারপাশের কালোত্তীর্ণ অন্ধকার তাকে আপন শূন্যতায় আহ্বান জানাচ্ছে। সে সোহানের দিকে হাত বাড়িয়ে শক্ত সংক্ষিপ্ত করমর্দন করল। গম্ভীর গলায় বলল,
“উঠলাম।”
সোহান নির্বিকারভাবে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিতেই লোকটি উঠে দাঁড়ায়। দৃষ্টির সীমানা ভেদ করে ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে যায় অন্ধকারের অন্তহীন গহ্বরে। এক মুহূর্তের মধ্যেই তার অস্তিত্ব মিলিয়ে যায় রাতের অতলে। সোহানের গভীর নিঃসীম কালো চোখ দু’টি স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে লোকটির অদৃশ্য হয়ে যাওয়া পথে। কিন্তু সেখানে কেবল ঘন কালো আবরণ, সেখানে দেখার কিছু নেই, থাকার কথাও নয়। প্রকৃতি তার সন্ধ্যার শোক-চাদর বিস্তার করে রেখেছে সেখানে।

রোশান বাড়ির প্রবেশপথে পা রাখতেই চিত্রার সঙ্গে মুখোমুখি হলো। আয়েশা ও মিতালিও চিত্রার পাশে দাঁড়িয়ে। চিত্রা এক মুহূর্ত ইতস্তত করলেও অবশেষে বিনীত ভঙ্গিতে সালাম জানাল। এ বাড়ির মানুষদের সঙ্গে তার খুব বেশি কথা হয়নি এখনো। কোথাও একটা অদৃশ্য দূরত্ব গেঁথে আছে। এক ধরনের অস্পষ্ট বিচ্ছিন্নতা। যা চিত্রাকে কুয়াশার মতো আচ্ছন্ন করে রেখেছে। তার এই নতুন পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হয়তো আরো সময় লাগবে। স্কুলজীবনেও সে ছিল নিঃসঙ্গ। সহপাঠীদের জটলায় মিশে যাওয়ার ক্ষমতা তার ছিল না। ক্লাসের নির্জন এক কোণে বসে দিন পার করত, বন্ধু বলে কেউ কখনো ছিল না। চিত্রা কালো ওড়নাটার প্রান্ত আরও শক্ত করে মাথায় জড়িয়ে নিল।
রোশান চিত্রার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কোথায় গেছিলা?”
চিত্রার কণ্ঠ ক্ষীণ, “ভাইয়া,এই তো একটু বাগানে গিয়েছিলাম।”
রোশানের গলার স্বরে অনুকম্পার ছিটেফোঁটাও নেই। “এই বাড়ির আশপাশে বন-জঙ্গলের অভাব নাই। রাতের বেলা সুন্দর মাইয়াদের এইভাবে একা ঘুইরা বেড়ানো শোভা পায় না।”

“আমি ঘরে যাচ্ছি।”
“হুম।”
রোশান একবার আয়েশার দিকে দৃষ্টিপাত করল। খানিকক্ষণ নীরব থেকে ব্যঙ্গ মিশ্রিত গলায় জিজ্ঞেস করল,
“তুমি আবার কে? নতুন কামের মাইয়া?”
আয়েশার মুখে নির্লিপ্তিতা। স্থির কণ্ঠে উত্তর দিল, “জ্বী। আমি হলাম আশেয়া। মেট্রিক ফেইল। পকেটমার স্পেশাল।”
রোশানের চোখের পলক নড়ল। মেয়েটির নির্লজ্জ স্বীকারোক্তি তাকে সামান্য বিস্মিত করেছে। তবে মুখে সে বিস্ময়ের লেশমাত্র প্রকাশ করল না। পরিমিত স্বরে বলল, “এত গুন নিয়া এই বাড়িতে আইলা কেমনে?”
“চিত্রা আর ফারাজ ভাইয়ের নেয়ামত।” আয়েশা এবারও নির্লিপ্ত স্বরে উত্তর দিলো।
রোশান একটুও প্রতিক্রিয়া দেখাল না। তার গায়ে জড়ানো কালো চাদরটা একঝটকায় সামলে নিয়ে নিচু স্বরে বলল,
“নিয়ামতের কারনে যেন আবার কেয়ামত না চইলা আসে।”

কথার তীক্ষ্ণতায় আয়েশা মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। তাকে কিছু বলার সুযোগ দেওয়ার আগেই রোশান বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যায়। চিত্রা রোশানের যাওয়ার পথে একবার তাকায়। রোশান দৃষ্টির আড়ালে চলে গেলে চিত্রা ঘরের ভেতরে প্রবেশ করল। ভেতরে মোহনা, নিরু, এবং নদী বসে ছিল। নদী তখন নিরুর হাতে মলম লাগিয়ে দিচ্ছিল। ব্যথায় নিরু বারবার ছ্যাত করে উঠছিল। তবু মুখে কোনো অভিযোগ নেই। নদী এক মুহূর্ত চুপ করে রইল। তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ”
“নিরু কেন করো এইসব? তুমি ওরে চেনো না? এলাহী বাড়ির মাইয়া হইয়া কেমন কইরা এসব ভুল করো?”
“মন রে বুঝাইতে চাই ভাবী। পারি না। মন তো বুঝে না। আপনার যত্ন কইরা লালন করা স্বপ্ন যদি অন্য কেউ কাইরা নেয় তাহলে কেমন লাগবো?”

নদী গভীর এক নিশ্বাস ফেলে নিস্তব্ধ হয়ে গেল। তার আবার স্বপ্ন? স্বপ্ন শব্দটি এ বাড়ির বাতাসে বিলীন হয়ে গেছে বহু আগে। তার অস্তিত্ব কেবল নিরুর মতো কিছু বোকার হৃদয়ে রয়ে গেছে। যারা এখনো অনুভব করতে চায়। এখনো আশায় বুক বাঁধে। ঘরের কোণে মোহনা মনোযোগী ভঙ্গিতে রুমানার মাথায় বিলি কাটছে। আঙুলের স্পর্শে ক্লান্তি মোচনের চেষ্টা। চিত্রাকে বাহিরে থেকে আসতে দেখে রুমানা ভ্রু কুঁচকায়।
“আরে বউমা তুমি রাইত কইরা বাহিরে থেইকা কেন আসতাছো? কই গেছিলা?”
“কোথাও না। এখানে ছিলাম।”
“আচ্ছা। আসো এদিগে আহো। আমার কাছে আইসা বসো মা।”

রাত নয়টার দিকে বাড়ি ফিরল নিহান। বাহিরে তখন বাতাসের দাপট বাড়তে শুরু করেছে। বৃষ্টি নামার আগমনী বার্তা স্পষ্ট। সদর গেট অতিক্রম করতেই আচমকা ছোট্ট এক শিশু তার সঙ্গে ধাক্কা খায়। বাচ্চাটির পরনে ধুলো মাখা একটি হাফ প্যান্ট। গায়ে সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি। নিঃশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে নাক থেকে সর্দি গড়িয়ে পড়ছে। ভারসাম্য হারিয়ে প্রায় পড়েই যাচ্ছিল। কিন্তু নিহানের হাত দ্রুততার সঙ্গে তাকে ধরে ফেলে।
“আরে বাবু!”নিহান আশ্চর্য হয়ে একবার চারপাশে তাকায়।
“তোমার আব্বু কোথায়?”
“জানিনে।”

নিহান জানে, এই বাচ্চাটি মালির ছোট ছেলে। বিরক্তিতে তার ভ্রু কুঁচকায়। এমন বৈরী আবহাওয়ায় এত রাতে কেউ বাচ্চাকে এভাবে ছেড়ে দেয়? আশেপাশে মালির অস্তিত্ব না পেয়ে সে পকেট থেকে ফোন বের করে কল করতে উদ্যত হয়। ঠিক তখনই দ্রুত পায়ে এক কিশোরী ছুটে আসে।ছেলেটিকে এক ধমক দিয়ে কোলে তুলে নেয় সে। বলে, “বেশি খারাপ হয়ে গেছোস! কি সাহস একা একা বাইরে চইলা আসোস? খাড়া, কাকি আম্মারে কইতাছি!”
নিহান ফোন করার প্রয়োজন বোধ করল না। একবার মেয়েটির দিকে তাকালো। তার পরনে সবুজ রঙের একটি ফ্রক, চেহারায় কৈশোরের ছাপ স্পষ্ট, বয়স বেশি নয়, তবে উচ্চতায় লম্বা। তবে এসব নিয়ে নিহান মাথা ঘামায় না। সে ঘরের ভেতর ঢোকার জন্য পা বাড়াতেই হঠাৎ কাঁধে কারও হাতের স্পর্শ অনুভব করে। ঘাড় ঘুরাতেই দেখলো জুনায়েদ এলাহীকে।

“কি বাজান, এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”কণ্ঠে স্বভাবসুলভ নরম
নিহানের দৃষ্টি আবারও মেয়েটির দিকে চলে যায়। ততক্ষণে সে অনেকটা দূরে চলে গেছে। তার দৃষ্টির অনুসরণে জুনায়েদ এলাহীও ওদিক তাকান। কিছুক্ষণ নীরব থেকে প্রশ্ন করেন,
“ওইখানে কী দেখছো?”
“না, কিছু না। ওই মেয়েটাকে আগে দেখিনি। যাই হোক, বাসায় চলুন।”
জুনায়েদ এলাহী হালকা মাথা নাড়েন। দুজন একসঙ্গে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে। বাহিরে তখনও দমকা হাওয়া। বৃষ্টি এলো বলে!

রুমানা অনেক আগেই নিজ কক্ষে প্রবেশ করেছেন। রাতের আহার প্রস্তুত করতে নদী রান্নাঘরে ব্যস্ত। আর ফারিয়া একবার নিচে নামলেও নিহান আসার সঙ্গে সঙ্গেই ঘরে ফিরে গেছে। খাবারের সময় হলে তবেই আবার আসবে। চিত্রাও রুমে চলে গিয়েছে। কি নাকি কাজ আছে। নিরুর শারীরিক ও মানসিক অবস্থা বিচলিত। এমনিতেই সে চিত্রাকে কখনো সহানুভূতির চোখে দেখেনি, আর আজকের ঘটনার পর তো তার মন আরও বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে।
“ভাবী বলেন না কি করলে ফারাজ ভাইকে পাবো? আমি যে আর সহ্য করতে পারতাছি না।” মোহনার কাঁধে মাথা রেখে নিরু হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। তার চোখের কোণে জমে থাকা নোনা জল থরথর করে কাঁপছে। হঠাৎ পেছন থেকে এক সুরেলা পরিচিত কণ্ঠস্বর তার কান্নার গতিকে থামিয়ে দিলো।
“কালো মানিক হাত পেতেছে। চাঁদ ধরিতে চায়। বামুন কি আর হাত বাড়ালে চাঁদের দেখা পায়?”

মোহনা দ্রুত পিছন ফিরে তাকাল। দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে আছে ফারাজ। তার পাশেই অভ্রনীল সরকার। মানে অভ্র। ফারাজের চোখে সেই চিরচেনা ব্যঙ্গ। ঠোঁটের কোণে অবহেলার এক চিলতে হাসি। নিরু এক পলক তাকিয়ে থাকল। তারপর দ্রুত চোখ মুছে নিলো। ফারাজ ধীর পায়ে এগিয়ে এলো। এক হাত প্যান্টের পকেটে গুঁজে দাঁড়ালো। নিরু আর তার মধ্যকার দূরত্ব মিনিমাম এক হাত।
“এই যে তেঁতুল গাছের ডাইনি আফা। আর কতকাল অন্যের সোয়ামির দিকে বদনজর দিবেন?কোন দিন না জানি আপনার নজরের কারনে আমার পেট খারাপ হয়।”
নিরু জবাব দেয় না। তবে তার বদলে মোহনা নিরেট কন্ঠে বলে উঠল, “আর কতজনকে কষ্ট দিবে ফারাজ?”
ফারাজ ভ্রুকুটি করল। ঠোঁটের কোণে সেই অমোঘ ব্যঙ্গচিহ্ন ফুটে উঠল।
” ভাবী কোন ধরনের কষ্টের কথা বলছেন? না মানে কষ্টের তো বিভিন্ন ধরণ আছে। এই ধরেন কোষ্ঠকাঠিন্যতা নিয়ে বাথরুমে গেলেও কিন্তু কষ্ট হয়। আপনি কি তেমন কিছু মিন করছেন?”

“মজা করছো?”
“উঁহু। ছ্যাহ! ওইসব ছোটোলোকি কারবার। এই মশারী ভাবী! অনেক ক্ষুধা লেগেছে। ফ্রিজে কলিজা ভুনা আছে না?একটু বের করে ভুনা করেন না। আর মশারী ভাবী বলে ডেকেছি বিধায় রাগ করবেন না। কি করবো বলেন? মশারীর মতো কি সব পড়ে থাকেন সবসময়। তবে আরো লাগলে বলবেন কিন্তু। আমার ঘরেরটাও দিয়ে দিবো। আমার আবার অনেক বড়। আই মিন মন।”
নিরু গলায় জমে থাকা লোনাজল গিলে ফারাজের দিকে তাকাতেই। ফারাজ গভীর এক নিশ্বাস ছাড়ল।
“তোকে তো কেবল হালকার ওপর ঝপসা ট্রেলার দেখিয়েছি। ব্লকবাস্টার সিনেমা কিন্তু এখনো বাকি। সো বি কেয়ারফুল।”
ফারাজের কণ্ঠস্বরে হুমকির সূক্ষ্ম রেখা ফুটে ওঠল। সে খানিক থেমে শীতল স্বরে বলল,
” যাই হোক খুব জলদি বউটাকে আবার বিয়ে করবো। আবার বাসর করবো। আর বাসর সাজাবি তুই আর আমার প্রানপ্রিয় মগজ হীন মশারী ভাবী।”
নিরুর মুখ পাংশুটে হয়ে গেল। মোহনা স্থির। সে এসবে অভস্ত্য। ফারাজ এক ঝটকায় নিজের ব্লেজার খুলে হাতে নিল। তারপর অভ্রর দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকালো। “অতিথিকে নিয়ে গেস্টরুমে যা। আমি একটু পরেই আসছি।”
মোহনার কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ে।অতিথি?
ফারাজ অতিথির কথা বলল? কিন্তু এই অতিথি আবার কে? কে আসছে?

ফারাজ কক্ষে প্রবেশ করতেই চিত্রার অবয়ব দৃষ্টিগোচর হয়। সে বিছানায় উপুড় হয়ে শায়িত। দু’পা অলস ভঙ্গিতে শূন্যে উত্তোলিত। গভীর মনোযোগে সংবাদপত্র পাঠে নিমগ্ন। ফারাজ গলাধঃকরণ করল। কণ্ঠনালী শুষ্ক মরুভূমির বালুকণায় রুদ্ধ হয়ে আসছে। এমন একটি দৃশ্যের সম্মুখীন হয়ে আত্মসংযম রক্ষা করা তার পক্ষে আদৌ সম্ভবপর হবে তো? ফারাজের হৃদয়ের গভীরে সুপ্ত কোন আকাঙ্ক্ষা অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলে উঠছে। সেই অনুভূতিকে সংবরণ করার প্রয়াস নিদারুণ ক্লেশসাধ্য হয়ে উঠছে তার জন্য। ফারাজ নিঃশব্দে এগিয়ে এসে চিত্রার কেশরাশির ভেতর আঙুল চালিয়ে দেয়। নরম, কোমল অন্ধকার স্পর্শে শিহরিত হয়ে ওঠে। মুহূর্তেই চিত্রা চমকে ওঠল। দ্রুত ফিরে তাকিয়ে কঠোর কণ্ঠে বলল,

“এই বেডা! ভয় পেয়েছি না?” ফারাজ গভীর চোখে চিত্রার দিকে চেয়ে বলল,
“বেডা কি হুম? নিশ্বাস হই তোমার। আমাকে ছাড়া এক মুহূর্ত টিকতে পারবে না বিবিজান।”
চিত্রা সঙ্গে সঙ্গে সোজা হয়ে বসল। বুকের ওপর থু থু দিয়ে রাগী চোখে ফারাজের দিকে তাকালো। দৃষ্টিতে বিদ্যুৎ ঝলকাচ্ছে। ফারাজ সেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিকে উপভোগ করল। নিজের ঘাড়ে হাত বুলিয়ে হালকা হেসে বলল,
“এই বউ, তুমি এলকোহল নাকি তোমার মধ্যে এলকোহল? কী এমন নেশা তুমি? শালার এই নেশা আমার কাটতেই চায় না!”
চিত্রা ভ্রু কুঁচকে বিরক্তির সুরে বলল,”আপনে দূরে যান। মেয়াদোত্তীর্ণ গাঁজা খেয়ে এসে এখন উল্টোপাল্টা বকছেন।”
ফারাজ একপাশে মাথা কাত করে তাকায়। ঠোঁটে চাপা হাসি। “ছি! এমন ছোটলোকি কথাবার্তা কই থেকে শিখো? তোমার মুখে রোমান্সের ভাষা মানায়। আমার সঙ্গে ওই ভাষাতেই কথা বলবে।”

“দেখুন আমি ছোট বলে আমাকে যা ইচ্ছে তাই বলতে পারেন না।”
“ তোমাকে বড় বানানোর জন্য আমি তো আছি।”
শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে আসে সে। চিত্রা তৎক্ষণাৎ দু’কদম পেছনে সরে যায়, ভয় আর সতর্কতার মিশেলে বলে ওঠে,
“কাছে আসবেন না দারাজ এলাচী।”
“আবুলের নাতনি তুমি দেখি ভালো হবা না। আমার নামটারে এক্কেবারে আরআইপি করে দিয়েছো।”
সঙ্গে সঙ্গেই চিত্রার কব্জি আঁকড়ে ধরে নিজের কাছে টেনে নেয় ফারাজ। চিত্রা তীব্রভাবে ছটফট করে মুক্তি পাওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। তাতে কাজ হয় না। ফারাজ একটুখানি ঝুঁকে এসে চাপা স্বরে বলে,
“এত যে ছটফট কেনো করো ময়না? আমার সঙ্গে পেরে উঠবে? সাইজে তো পাঁচ ফুট চার। কোন সুবুদ্ধি নিয়ে ছয় ফুট চারের একটা পুরুষের সঙ্গে লাগতে আসো? আমার কাছে পৌঁছাতে হলেও তো মই ব্যবহার করতে হবে।”
চিত্রা প্রচণ্ড বিরক্ত। সে ঠোঁট চেপে জবাব দেয়,”ঘোড়ার ডিম।”

ফারাজ থমকে দাঁড়ায়। অপলক দৃষ্টিতে চিত্রার দিকে তাকিয়ে থাকে। সেই চোখের গভীরে কী এক অভাবনীয় নেশা লুকিয়ে ছিল। চিত্রা শ্বাস নিতে ভুলে গিয়ে কাঁপা কণ্ঠে বলল,
“এই দেখুন।”
“দেখাও।”
“উফ! আপনি যে কোন চোখে আমাকে দেখছেন আমি কিন্তু তা ভালো করেই বুঝে গিয়েছি। দূরে থাকেন সাবধান। আপনি আমা..কে।”
বাক্য শেষ হওয়ার আগেই ফারাজ দ্রুত তর্জনী ঠোঁটের ওপর এনে চুপ করিয়ে দেয় চিত্রাকে। সেই স্পর্শে বিদ্যুতের ঝলকানি খেলে যায় চিত্রার শিরায় শিরায়। ফারাজ হাসে। গভীর, প্রলুব্ধ করা এক হাসি। তারপর মৃদু স্বরে গেয়ে ওঠে,
“আমি নষ্ট মনে নষ্ট চোখে দেখি তোমাকে
মন আমার কি চায় বুঝায় কেমনে?”

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ২৭

ফারাজের কণ্ঠস্বরে ঘোর লাগানো মায়া। যা মুহূর্তেই চারপাশের বাস্তবতাকে বিলীন করে দিতে পারে। কিন্তু সেই মায়ার আবরণ ভেদ করে হঠাৎই কক্ষের দরজা ধাক্কা দিয়ে খুলে যায়। প্রবল বিকট স্বরে কেউ একজন গর্জে ওঠে,
” হেন্ডু জান্স হুয়াই ইউ চিপকাচিপকি অন্য ছ্যামড়ি? ইউ খালি মাই। আন্ডারইস্টান্ড?”
ফারাজ বিরক্তিতে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। চোখের কোণে বিরক্তির ছাপ। মুখ থেকে একটা অসম্পূর্ণ ‘চ’ জাতীয় শব্দ বেরিয়ে আসে। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“শালার দরজাটার ছিটকিনি! তোকে আমার লাগাতে কেন মনে থাকেনা।”

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ২৯