চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৩১
ইশরাত জাহান জেরিন
❝সংসার কোমল ফুলের মতো। যার সৌন্দর্য যত্নে টিকে থাকে কিন্তু অবহেলায় ঝরে যায়। যেমন একটি ফুলকে সতেজ রাখতে পানি, আলো আর যত্ন প্রয়োজন তেমনি সংসারের সৌন্দর্যও ভালোবাসা, বিশ্বাস আর ত্যাগের ওপর নির্ভরশীল। ফুল যেমন কাঁটার সঙ্গে থাকে। সংসারেও সুখের পাশাপাশি দুঃখের কাঁটা লেগে থাকে। তবে সেই কাঁটা এড়িয়ে, যত্ন আর মায়ায় গড়া সংসারই একদিন সুবাস ছড়ায়, যেমন ভাবে একটি ফুটন্ত ফুল তার সৌন্দর্যে সবাইকে মোহিত করে।❞
সংসার নামের সম্পর্কটা মোহনার জন্য একটা দায়, একটা বোঝা। দুপুরে গোসল সেরে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে সে। তার সংসার টিকে আছে ঠিকই তবে ভালোবাসার পরশে নয় দায়িত্বের ভারে, আত্মসম্মানের দেয়ালে ঠেকে।
আজ জুনের উনিশ তারিখ। সাল ২০২২। পাঁচ বছর আগের সেই দিনের কথা মনে পড়ে তার। রোশানের সঙ্গে বিয়েটা কেমন যেন অদ্ভুত ভাবেই হয়েছিল। এক দেখাতেই রোশান তাকে বিয়ে করে ফেলে। কিন্তু কেন? সেই প্রশ্নের উত্তর আজও অজানা। তবে মোহনা জানে রোশানের সৌন্দর্যের প্রতি এক অমোঘ আকর্ষণ আছে। সবকিছুর চেয়ে বেশি টান সুন্দর জিনিসের প্রতি। রোশান যখন একদিন হঠাৎ করেই শাহবাগে আসে, মোহনার সঙ্গে দেখা হয় তার। শাহবাগের উষ্ণ বাতাসে তখনও মোহনার প্রথম প্রেমের স্মৃতি মিশে ছিল। সে তখনও ওই প্রাণের শহরকে ছাড়তে পারেনি। কারণ তার হৃদয়ের এক টুকরো তখনও সেখানে রয়ে গিয়েছিল। এক দেখাতেই রোশান মোহনাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু মোহনা রাজি হয়নি। রাজি হয়েছিল তখন, যখন জানতে পেরেছিল রোশানের ভাই ফারাজ এলাহী। “ফারাজ “যে মোহনাকে ভালো না বেসে কষ্ট দিয়েছিল। অবহেলায় দগ্ধ করেছিল তার হৃদয়। মোহনা সিদ্ধান্ত নেয় প্রতিশোধের। রোশানের বড় ভাইয়ের বউ হয়ে সে ফারাজকে সেই একই যন্ত্রণা দেবে যা একসময় সে পেয়েছিল। কিন্তু প্রতিশোধের এই যাত্রায় মোহনাই বুঝতে পারেনি কষ্টের অগ্নিতে সে নিজেই জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। প্রতিটি দিন, প্রতিটি রাত তাকে আরও কঠিন আরও নিঃসঙ্গ করে তুলবে। ফারাজকে কষ্ট দেওয়ার ইচ্ছে থাকলেও বাস্তবে সে নিজেই কষ্টে পাথর হয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় বেদনা? যার জন্য এত আয়োজন, এত যন্ত্রণা সে তো এতটুকুও বিচলিত হয়নি! ফারাজ দিব্যি সংসার করছে। তার স্ত্রীর সঙ্গে সুখে-শান্তিতে দিন কাটাচ্ছে। মোহনার দুঃখ, তার অশ্রু, তার সমস্ত প্রতিশোধই অন্তহীন শূন্যতায় বিলীন হয়ে গেছে। শুধু মোহনা জানে এই যন্ত্রণার ভার সে আজীবন বয়ে নিয়ে যাবে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রোশান মোহনাকে ভালোবাসে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। বিয়ের পর মোহনার আত্মবিশ্বাস ছিল রোশান আর কোনো নারীর সান্নিধ্যে যায়নি। পুরোনো অভ্যাস বদলাতে সময় লেগেছে কিন্তু সে বদলেছে। তবুও মোহনার চোখে রোশান এক পাপী নোংরা পুরুষ। নোংরা পুরুষ হওয়ার জন্য অন্য নারীর দিকে চোখ দেওয়াটা জরুরী নয়। নোংরা মনমানসিকতা পোষণকারী ব্যক্তিও নোংরাই হয়। কিছুদিন আগে মোহনা গর্ভপরীক্ষা করিয়েছিল। ভাগ্যিস, সে গর্ভবতী হয়নি! আর কত অনাগত প্রাণের মৃত্যু দেখবে? মোহনা ব্যর্থ। মা হিসেবেও, স্ত্রী হিসেবেও। স্বামী খারাপ হলেও স্ত্রীকে ভালোবাসতে হয়। সমাজ এটাই বলে। কিন্তু মোহনা পারেনি। তার মন আজও অন্য কারও বন্দীশালায় পড়ে আছে। এমন নারীরা মা হওয়ার যোগ্যতা রাখে না। স্ত্রী হওয়ারও নয়। তারা পাপী, কলুষিত। তবে মাঝেমধ্যে রোশানের জন্য খুব খারাপ লাগে তার। যেই রোশান তাকে ভালোবেসেছিল তার আর আজকের রোশানের মধ্যে বিস্তর ফারাক। আজকের রোশানকে সে নিজের হাতে পাপের জগতে ঠেলে দিয়েছে। হয়তো তাই নিয়তি তাকে ধুঁকে ধুঁকে পাপের শাস্তি দিচ্ছে।
মোহনা তোয়ালে খুলে চুল ঝেরে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। পায়ে মোটা দুইজোড়া রুপার নূপুর পড়ে। বারান্দায় গিয়ে দেওয়ালের সঙ্গে পিঠ ঠেকিয়ে দূরের জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে গুন গুন করে একটা রবীন্দ্র সঙ্গীত গায়।
❝ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখো তোমার মনের মন্দিরে,
ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে❞
আকাশ আজ পরিষ্কার। তবে রাস্তায় কোথাও কোথাও বৃষ্টির পানি জমে আছে। বর্ষার এটাই সবচেয়ে বিরক্তিকর দিক। মেঘলা, স্নিগ্ধ আকাশ মনকে প্রশান্তি দিলেও নিচে জমে থাকা পানির কাদা ও স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ চলাচলে বিঘ্ন ঘটায়।
দূরে মহিলা সরকারি স্কুলের সামনে বিস্তৃত মাঠ। যার ওপার দিয়ে বড় সড়কে উঠতে হয়। সেখান থেকে সরু পথগুলো এঁকেবেঁকে ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। মাহাদী একটা সরু পথে হাঁটছে। রাস্তার দুপাশে সারি সারি সুপারির গাছ। বাতাসে তাদের সরু পাতাগুলো ধীর লয়ের দোল খাচ্ছে। দুপুরের এই সময়টায় এদিকটায় মানুষের আনাগোনা প্রায় নেই বললেই চলে।চারপাশ অদ্ভুত নিস্তব্ধতায় আচ্ছন্ন। সামনে জঙ্গলের মতো ঘন গাছপালার এক অংশ পেরোলেই বিশাল বিল। বর্ষার জলে থইথই করা সেই বিলটি আশপাশের মানুষের কাছে পরিচিত লাল শাপলার জন্য। যা পানির বুকে ছড়িয়ে পড়ে এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য তৈরি করে। মাহাদী খানিকটা এগিয়ে গিয়ে একটা সুপারি গাছের সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। তার চোখ অস্থি। যেন কারও জন্য অপেক্ষা করছে। প্রতিদিন এই পথ ধরে দু’টি মেয়ে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরে।সরকারি কলেজের ছাত্রী তারা।
তবে সরাসরি বাড়ি না গিয়ে পথে সময় নেয়, কারণ ফেরার পথে লাকড়ি সংগ্রহ করে। কখনো শুকনো পাতা কুড়িয়ে নেয়। কখনো কাঠের বোঝা বয়ে আনে। আজও ঠিক এই সময়েই আসবে তারা। মাহাদীর মনে এক অদ্ভুত মায়া জাগে ওদের জন্য। বয়সই বা কত? একজন চৌদ্দ-পনেরো, অন্যজন সাত-আট। অথচ সংসারের কাজে তাদের কাঁধেই বোঝা। ক্ষুধা পেয়েছে মাহাদীর। সকালে কিছু খেয়ে বের হয়নি। কাজেও যায়নি আজ। অনর্থক এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। ম্যানেজার করিম সকালে মারা গেছেন। হাসপাতাল থেকে খবর এসেছে। কিন্তু মাহাদী যায়নি। আশ্চর্যজনকভাবে তার ভেতর কোনো অশান্তি নেই। আবার শান্তিও নেই। কী করলে ভালো লাগবে সেটাই বুঝতে পারছে না। চোখ বন্ধ করে গাছের গায়ে হেলান দিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। হঠাৎ হাসির শব্দে চমকে চোখ মেলে তাকায়। মেয়েদু’টো কাঠের বোঝা মাথায় নিয়ে গল্প করতে করতে বাড়ির পথে হাঁটছে। মাঝে মাঝে খিলখিলিয়ে হেসে উঠছে তারা।
মাহাদী আলগোছে হাত দিয়ে চুল ঠিক করে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। ঠিক তখনই ছোট মেয়েটি হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে গিয়েও নিজেকে সামলে নেয়, তবে তার হাত থেকে একটি লাকড়ি গড়িয়ে পড়ে মাটিতে। একটি পড়া মানেই সব নামিয়ে আবার নতুন করে আঁটি বাঁধতে হবে। একা হাতে কুড়িয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। বড় বোনটি এগিয়ে এসে নিজের লাকড়িগুলো নামিয়ে ওকে সাহায্য করতে যাবে ঠিক তখনই পেছন থেকে গম্ভীর ভারী এক পুরুষালী কণ্ঠ ভেসে আসে।
মেয়েদু’টো থমকে দাঁড়ায়। ধীরে ধীরে পেছন ফিরে তাকায়। মাহাদীর চোখে স্থিরতা। মুখে সৌজন্যমূলক হাসি।
“দাঁড়াও আমি উঠাইয়া দেই,” শান্ত কণ্ঠে বলল সে।
জোহান উপর হয়ে শুয়ে আছে। পরনে কালো শার্ট। রাতভর নেশা করে ফিরেছে। বিকেল গড়িয়ে গেলেও তার মাথা ঝিমঝিম করছে। শরীরে ক্লান্তি চেপে বসেছে। ঘরটাও তেমনই বিধ্বস্ত। জিনিসপত্র এলোমেলো। এক কোণে পড়ে আছে তার গিটার, ধুলোর আস্তরণ জমেছে স্ট্রিংয়ের উপর। রুমানা আয়েশাকে ওর ঘরে পাঠিয়েছে। আয়েশা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে ডাক দিল, “জোহান ভাই?”
বিরক্ত হয়ে জোহান তাকে ধমক দেয়। কিন্তু পরক্ষণেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বালিশের নিচ থেকে ফোনটা বের করে। আধবোজা চোখে স্ক্রিনের দিকে তাকায়। আছরের আজান দিতে মাত্র কয়েক মিনিট বাকি! সময় দেখে ওর মাথা আরও ভারী হয়ে আসে। তাকে আজই একটা জরুরি কাজে বের হতে হবে। অথচ এই ঘুম শরীরের সমস্ত শক্তি শুষে নিচ্ছে।
‘এত ঘুম আসে কোত্থেকে?’ নিজের মনেই বিড়বিড় করে সে। চোখের পাতায় ক্লান্তির ভার টেনে উঠে বসে।
জোহান ধীরগতিতে উঠে বসে। মাথাটা এখনো ভার হয়ে আছে। বিছানার পাশে রাখা সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা বের করে ঠোঁটে চেপে ধরে, লাইটারের আঁচে আগুন ধরায়। ধোঁয়ার কুণ্ডলী ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে ঘরের বাতাসে। তার কণ্ঠে স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ। রূঢ় স্বরে বলে ওঠে, “আয়েশা, যা, তেঁতুল জল আন।”
সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে খানিকটা আয়েশে বসে, তারপর অসন্তুষ্ট কণ্ঠে বিড়বিড় করে, “ধ্যাত! সঙ্গে যদি একটা চা থাকত, তাহলে বালের মাথাটাও হয়তো ঠিক হয়ে যেত!” দরজার ফাঁক দিয়ে আয়েশা একবার উঁকিঝুঁকি দেয়। তার চাহনি কৌতূহলী। জোহান তাকে দেখেই চোখ সরু করে তাকায়, ধমকের সুরে বলে ওঠে,
“তোকে না বলেছি তেঁতুল জল আনতে? বালের হ্যাংওভারকে আমার মাথাটাকে একেবারে চ…”
কথাটা শেষ করার আগেই আবার ধোঁয়া ছাড়ে। দৃষ্টি স্থির হয় আয়েশার ওপর। আয়েশা ঢোক গিলে ধমকের তেজে দৌড়ে সেখান থেকে পালায়। যেতে যেতে গালমন্দ করে মনে মনে শুধায়,
“শালায় খাইবো গু গোবর
হাগবো কি সন্দেশ? ওইসব ওখাদ্য না খাইলে কি বড়লোকের ব্যাডা গো বাথরুমের হিসাব নিকাশ ক্লিয়ার হয় না? শালায় ধমক দেয় আমারে! ওয় আমারে চিনে? আমি কতবড় পকেটমার জানে?দাঁড়া ব্যাডা তোর পকেট মাইরা হাতে যদি ভিক্ষার থলে না ধরাই তাইলে আমার নামও আয়েশা না।”
তিনতলার পুরোটাই অতিথিদের থাকার জন্য নির্ধারিত। তবে করিডরের একেবারে শেষ মাথায় যে কক্ষগুলো রয়েছে সেগুলো সবসময় তালাবদ্ধ। সেখানে প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তবে উপরের দিকে একটা রুম আছে। যা পুরোপুরি বইয়ে ঠাসা। একটি ছোটখাটো ব্যক্তিগত লাইব্রেরির মতো। দেয়ালের সারি সারি বুকশেলফে পুরোনো থেকে নতুন, নানা ধরণের বই গুছিয়ে রাখা। রুমের মাঝখানে বসার জন্য নরম সোফা আর কয়েকটি চেয়ার সাজানো। এখানে এখন তিনজন বসে আছে। ফারাজ লম্বা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে, এক পা তুলে অন্য পায়ের হাঁটুর ওপর রেখেছে। হাতে লাল আপেল। মাঝে মাঝে কামড় বসিয়ে রস উপভোগ করছে। তার চোখে কালো সানগ্লাস। গায়ে সী-গ্রিন রঙের ফুলহাতা শার্ট। যার হাতা কনুই পর্যন্ত গুটিয়ে রাখা।
অভ্র মোবাইলে মগ্ন। গেমের স্ক্রিনে চোখ আটকে আছে। আঙুলগুলো দ্রুত নড়ছে। পাবজির উত্তেজনায় সে চারপাশ ভুলে গেছে। তাদের সামনে বসে আছে বজ্র। মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙার উপক্রম। কিছুক্ষণ নীরবে বসে থাকার পর অবশেষে ফারাজের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছোড়ে,
“কিরে ফারাজ? এখানে ডেকে বসিয়ে রেখেছিস কেন?” ফারাজের মনোযোগ তখনও তার আপেলের দিকে। তবে বজ্রের গলা শুনে সে ধীরগতিতে সানগ্লাসটা নাকের কাছে নামায়। চোখ উপরে তুলে একবার তাকিয়ে ঠোঁটে একপাশে হাসির আভাস ফেলে বলে,
“ওহে বজ্রপাত, কিছু বলেছো নাকি?”
বজ্রের ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যায়। সে কপালে ভাঁজ ফেলে বলে ওঠে,
“আরে ভাই, এই ঘরে ডাকলি কেন?”
ফারাজ আবার আপেলে কামড় বসিয়ে অনায়াস ভঙ্গিতে বলে, “তুই আসছিস কেন?”
বজ্র কিছুটা রাগ নিয়েই বলে, “তুই ডাকছিস যে!”
ফারাজ এবার চোখের ওপর দিয়ে সানগ্লাসটা ঠেলে আবার ঠিক জায়গায় বসিয়ে নেয়। তারপর ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলে,
“জাহান্নামে ডাকলেও যাবি? যাহ! না চাইলেও সঙ্গে করে তোকে নিয়ে যাবো। লাভিং করি যে তোকে।”
অভ্র হঠাৎই এক ঝটকায় ফোনের স্ক্রিন থেকে চোখ তুলে ফারাজের দিকে তাকায়। চোখেমুখে বিরক্তি টেনে বলে,
“এই ভাই, ছোটলোকি কথা বলবেন না! এমনিতেই স্ত্রীহীনা, এতিম পুরুষ আমি। তার ওপর ছোটলোকি ইংরেজি বলে আমার নাড়িভুঁড়ি নাড়িয়ে দেওয়ার কোনো মানে হয় না!”
ফারাজ ঠোঁট বাঁকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দেয়, “আসছে আমার বড়লোকের ছাওয়াল নবাবি সেমাই।”
অভ্র বিন্দুমাত্র দমে না গিয়ে তৎক্ষণাৎ জবাব দেয়, “আপনার মতো এলাচ হওয়া থেকে সেমাই হওয়াই ভালো। অন্তত গিলে ফেললে পেটে গিয়ে শান্তি দেবে। আপনাকে তো গিলার আগেই ডাস্টবিনে ফেলে দিতে হয়!”
ফারাজের ঠোঁটের হাসি মিলিয়ে যায়। সানগ্লাসের ভেতর থেকেই তার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। অভ্র এক মুহূর্তে চুপ মেরে যায়। ফারাজ কয়েক সেকেন্ড স্থির তাকিয়ে থাকে। তারপর হঠাৎই হাসে। সে এবার বজ্রের দিকে তাকিয়ে বলে,
“সার্জন তোমার কাজ হচ্ছে সার্জারি করা। তোমাকে দেশে আনা হয়েছে কেনো জানো তো?”
“হ্যাঁ।”
“তোর কাজ ভাই কিডনি, লিভার, চোখ সবকিছু বের করে আনা আর আমার কাজ?”
ফারাজ মুচকি হাসে। হেসে ফের বলে, “কলিজাটা বের করা আমার কাজ।”
সন্ধ্যা নেমেছে। আকাশজুড়ে লালচে আভা। যেন রক্তের দগদগে দাগ লেগে আছে। বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে অজানা উত্তেজনায়। বাড়িতে এই মুহূর্তে জান্নাত আর মারিয়া ছাড়া কেউ নেই। জান্নাত উঠানে গাছ গুলো ছাঁটাই করতে ব্যস্ত। চিত্রার হাতে লাগানো গাছগুলো পরম যত্নে ছাঁটছে সে। মেয়েটা কাজের ছিল। হাতে গাছের পরশ পড়লেই তা ফুলে-ফলে ভরে উঠত। মারিয়া বারান্দা থেকে কাপড় তুলে ফেলে আকাশের দিকে তাকায়। সূর্য ডুবে গেছে। পাখিরা নীড়ে ফিরছে ব্যস্ত পায়ে। তবে আকাশের লালচে রঙে অস্বস্তি জাগে তার মনে।
কাপড় গুছিয়ে মারিয়া ঘরের দিকে এগোয়। শ্বশুরটা বিছানায় একা পড়ে আছে। তাকে ওষুধ দিতে হবে, তার আগে একটা কয়েল ধরিয়ে আসতে হবে। বড় ঘরে পা রাখতেই হঠাৎ জান্নাত বাহিরে থেকে ছুটতে ছুটতে এসে দরজা বন্ধ করে দেয় প্রচণ্ড শব্দে। মুখে ভয় জমে আছে। নিশ্বাস অস্থির।
“ভাবী… ভাবী, কারা যেন আইছে! কালো গাড়ি, তাড়গা মরদ! কালো পোশাক পড়া! আমাগো বাড়ির দিকেই আসতাছে!”
চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৩০
মারিয়া থমকে দাঁড়ায়। তার দৃষ্টি দরজার দিকে আটকে যায়। পরক্ষণেই দরজায় প্রচণ্ড আঘাত ধাক্কা দেয় তার কানে, গায়ে, মনে। ধকধক করে ওঠে বুকের ভেতর।
“ভাবী, ওরা চইলা আসছে!” জান্নাত ফিসফিস করে, গলাটা আতঙ্কে কাঁপছে। মারিয়া শ্বাস নিতে ভুলে যায় এক মুহূর্তের জন্য। তারপর আস্তে শুধায় ,
“আবার কোন বিপদ আইলো?”