চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৩২

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৩২
ইশরাত জাহান জেরিন

ফারাজ বারান্দায় দাঁড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ ফোনে জরুরি কথা বলে রুমে ফিরে এলো। গায়ে কালো রঙের টি-শার্ট ও ট্রাউজার। রুমে ঢুকে দেখল চিত্রা খাটে বসে মনোযোগ দিয়ে খবরের কাগজ পড়ছে। ইদানীং পত্রিকা আসার সঙ্গে সঙ্গেই চিত্রা নিচ থেকে তা তুলে নিয়ে আসে। তারপর সারাদিন সেটাই পড়ে কাটিয়ে দেয়। ফারাজ রুমে ঢোকার পরও চিত্রার দৃষ্টি কাগজের পাতায় নিবদ্ধ। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে সে বিরক্ত চোখে তাকিয়ে থাকল। তারপর ভ্রুকুটি করে বলল,
“আগুন সুন্দরী! একবার আমার দিকে তাকাবে?”
চিত্রা কোনোরকম প্রতিক্রিয়া দেখাল না। তার দৃষ্টি এখনো পত্রিকাতেই আটকে। ফারাজের ভেতর অস্বস্তি আর বিরক্তি জমতে লাগল। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে একটানে খবরের কাগজটা কেড়ে নিতেই চিত্রা চমকে উঠল।
“আরে! এভাবে নিলেন কেন? আমি তো এখনো শেষ করিনি!”
ফারাজ কাগজের ভাঁজ খুলে চোখ বুলিয়ে বলল,

“এসব কি দেখছিলে?”
“কেন? মডেলদের? এই অংশটাই আমার সবচেয়ে ভালো লাগে!”
ফারাজ কপাল কুঁচকে কাগজের পাতার দিকে তাকাল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“তাই বলে আন্ডারপ্যান্ট পড়া ছেলেদের ছবি দেখতে হবে?”
“আরে! ওটা তো বিজ্ঞাপন!” চিত্রা সহজভাবে উত্তর দিল।
“বিজ্ঞাপন হোক বা যা-ই হোক, দেখার কী দরকার? যদি এতই শখ থাকে, আমাকেই বলতে পারতে। ওই বিজ্ঞাপনের ছেলেগুলো যা পরে আছে, তার চেয়ে হাজার গুণ দামি জিনিস আছে তোমার স্বামীর কাছে। তুমি চাইলে এখনই ঘরের ভেতর চাড্ডি পড়ে ক্যাটওয়াক করে দেখাতে পারি!”
চিত্রা ফারাজের কথায় চোখ বড় বড় করে তাকাল, তারপর বিরক্ত মুখে বলল,
“ধন্যবাদ, লাগবে না। আপনি শুধু আমার পত্রিকাটা ফিরিয়ে দিন তো।”
“যদি না দেই?”
“কেড়ে নিবো।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ফারাজ চিত্রার দিকে এগিয়ে এসে কানের কাছে মুখ নামিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে, “উফফ আগুন সুন্দরী! কেড়ে নেওয়ার খেলায় এলাহীর সঙ্গে পারা মুশকিল।”
ফারাজ চিত্রার দিকে এগিয়ে এসে কানের কাছে মুখ নামিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে, “ভয় পাই না। কারন কি জানেন? আমিও এলাহী বাড়ির বউ।”
ফারাজ কিছু না বলে শুধু তার গভীর দৃষ্টি স্থির করে রাখে চিত্রার চোখে। তারপর পকেট থেকে লাইটার বের করে পত্রিকার এক কোণ ধরে আগুন লাগিয়ে দেয়। মুহূর্তেই শিখার ঝলকানি চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। চিত্রার চোখের সামনে আগুনের লেলিহান শিখা নাচছে। কিন্তু তার দৃষ্টি স্থির, ভয়হীন। বরং সেই লেলিহান আগুনের প্রতিফলনে তার ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি দোল খাচ্ছে। পত্রিকাটি দাউ দাউ করে পুড়ে যায়। ছাই হয়ে মেঝেতে ঝরে পড়ে। ফারাজ বাকি অংশ ফ্লোরে ফেলে দেয়। আগুন ধীরে ধীরে নিভে আসে। এরপর ফারাজ চিত্রার কোমর স্পর্শ করে তাকে কাছে টেনে নেয়। মুখ একদম কাছে এনে অধরে মদিরা ছোঁয়ায় গভীর কণ্ঠে বলে,
“আমি বিনা দুনিয়ার অন্য পুরুষের দিকে মনোযোগ দেওয়া তোমার জন্য হারাম। তুমি কেবল আমার। আমাকে দেখবে,আমাকে নিয়ে ভাববে। ছলনার চেষ্টা করলে ভালোবাসাকে তোমাকে সঙ্গে দাফন করে দিবো।”
চিত্রা মৃদু ঢোক গিলে ফিসফিস করে,

“অধিকারের ক্ষমতায় বলছেন নাকি ভালোবাসার?”
“কথা বলতে ক্ষমতার প্রয়োজন নেই আগুন সুন্দরী।”
চিত্রা চোয়াল শক্ত করে বলে, “চিন্তা নেই। আপনার আগুন সুন্দরী আমৃত্যু আপনার হয়েই থাকবে। আপনি যদি হন জল তবে আমি আগুন। যে আমায় ধরবে সেও পুড়ে মরবে। আমি সহজে ধরা দেওয়ার পাত্রী নই সোনাবর।”
ফারাজ একধাপ এগিয়ে প্রশ্ন করে, “কিন্তু আমার আগুন সুন্দরী আমার কাছে ধরা দিচ্ছে কবে?”
চিত্রা চোখ নামিয়ে মৃদু হাসে, “যেদিন আগুন-জলে মিলিয়ে যাবে।”
ফারাজ চিত্রাকে বিছানার দিকে ইশারা করে। চিত্রা বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে তাকাতেই ফারাজ হেসে বলে,
“তুমি বউ বিছানায় আসো। আগুন-জলে মিলিয়ে দেওয়ার দায়িত্বটা আমার।”
“যাহ বেডা লুইচ্ছা।”
“তুই বেডি এদিকে আয়। বাসরের ফিলিংস পাচ্ছে তোর স্বামীর।”

চিত্রা কিছু বলার আগেই ফারাজ এগিয়ে আসে। চিত্রা এক মুহূর্তও দেরি না করে বালিশ ছুঁড়ে মারে তার দিকে। ফারাজ ততক্ষণে বালিশটা ধরে ফেলে। এবার সে দৌড়ে চিত্রার দিকে এগিয়ে আসে। চিত্রা দ্রুত খাটের ওপরে উঠে। হাতে আরেকটা বালিশ নিয়ে আড়াল করে নিজেকে। বলে,
“আব্বে হালা! দূরে থাকেন! বারবার গোসল করতে ভালো লাগে না!”
“হালা আবার কে? বলডি নেশা করলি নাকি? চোখ মেলে কাছে আয়। কাছে এসে চুমু খেয়ে দেখ আমি কে?”
ফারাজ ধীরে ধীরে খাটের ওপরে উঠে যায়। যতই সে এগোয়, চিত্রা ততই পেছাতে থাকে।
“দেখুন আমি ভাত খাবো। রাত হয়েছে।”
” না তুমি বউ আমাকে খাবে। একেবারে হালার ফুড আমি।”
চিত্রা দিশাহারা হয়ে বলে, “আমাদের…তো আবার ঢাকা যেতে হবে। চলুন নিচে যাই।”
ফারাজ ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে, “আগে পিরিতের দুনিয়া থেকে তোমাকে ঘুরিয়ে তো নিয়ে আসি? তারপর নিচে-ওপরে সব খানেই যাওয়া যাবে।”
চিত্রা আর পিছু হটতে পারে না। খাটের কোণ ঘেঁষে পিঠ ঠেকে যায়। ভয় আর লজ্জার মিশেলে সে একদৃষ্টিতে ফারাজের দিকে চেয়ে থাকে। ফারাজ তার দৃষ্টি দেখে মুচকি হাসে। এক হাতে চুলে হাত বুলিয়ে গুনগুন করে গান ধরে,

“ডু ইউ ওয়ান্ট মি? ডু ইউ নিড মি? ওয়ানা লাভ মি? আজা বেবি মেরে নাল… রাইট নাও…”
ফারাজ চিত্রার একেবারে কাছে যাওয়ার আগেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে একরাশ চাপা বিরক্ত নিয়ে দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে উদ্দেশ্য বলে, “আরে কোন শালার যৌবনে আবার ধাক্কা লাগলো যে আমার বাসরে কল্লা ডুকাতে হলো? বালের বাড়িতে বেশিদিন থাকলে আমার আর আব্বা ডাক শোনা হবে না।”
ফারাজের মুখটা ছোট হয়ে আসতেই চিত্রা খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। কিন্তু ফারাজের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তার হাসি মুহূর্তেই স্তব্ধ করে দেয়। “বেডি আদৌও কি তুই আমার আপন বউ? কুত্তার পেটে ঘি হজম হয় না জানা আছে তো? নারী হলো গিয়ে সেই জাতের। বেশি ভালোবাসা হজম হয় না। দাঁড়া বেডি বিদেশ গিয়ে যদি তোরে প্রবাসির বউ না বানাই তবে আমার নামও দা…ফারাজ এলাহী না। তখন ইমুতে খালি আমাকে দেখবি আর ভালোবাসার জন্য নুন লাগানো ঝোঁকের মতো ছটফট করবি।”
ফারাজ আর কথা না বাড়িয়ে চুলে হাত বুলিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যায়। দরজা খুলতেই দেখে মিতালি দাঁড়িয়ে আছে। ফারাজ চোখ সরু করে বলল,
“আরে তোরই কমতি ছিল। আয় আয়। তোর তো কাজই অন্যের পিরিতে ঠ্যাং ঢুকানো। ভেতরে আয়। এসে ভালো করে ঠ্যাং ঢুকা।”
মিতালি আজকে আর ফারাজের কথায় ঠাস করে জবাব দেয় না। রুমের ভেতরে একবার উঁকি দেয়। চিত্রা বিছানা থেকে ততক্ষণে নেমে ফারাজের পাশে দাঁড়ায়। মিতালি একবার চিত্রার দিকে তাকায়। অন্যবার ফারাজের দিকে। অস্থির চোখে একটা ঢোক গিলে মৃদু কণ্ঠে বলে,
“আপার সঙ্গে একটু কথা ছিল খালু।”

খাবার টেবিলে বসে অভ্র গেমস খেলছে। একটু পড় ঢাকার উদ্দেশ্যে রৌওনা হতে হবে। আগে পেটকে শান্ত করাতে হবে তবেই তো দুনিয়া শান্ত হবে। চিত্রা আর ফারাজ বাহিরে থেকে যাওয়ার পথে ডিনার করবে। তাই নিচে নামেনি তারা। অভ্রর পাশে বজ্র বসে আছে। আয়েশা দুজনের জন্যই খাবার পরিবেশন করেছে। বজ্র নির্বিকার ভঙ্গিতে খেতে ব্যস্ত। তবে অভ্রর খাওয়ার দিকে কোনো মনোযোগই নেই।
“খান না কেন, সরকার ভাই?”
অভ্র গেম থেকে চোখ সরিয়ে সরু দৃষ্টি ফেলে আয়েশার দিকে। মনে মনে ভাবছে, এই গুওয়ালী আজ এত ভালো হয়ে গেল কীভাবে? এই মেয়ে তো মিঠা পানির মাছ না, যে মুখ দিয়ে মধু ঝরবে! শালী তো আস্ত একটা নিমগাছ!
“সরকার ভাই?” আয়েশা আবারও ডাকল।
অভ্র গলাটাকে ভারী করে বলল, “জ্বী, মাননীয় গুমন্ত্রী!”
“খাচ্ছেন না কেন? একটু শাক দিই?”
অভ্র কাঁধ ঝাঁকিয়ে প্লেট এগিয়ে দিতেই আয়েশা পুরো শাকের বাটি কাত তার প্লেটে ঢেলে দিল।
“আরে আরে! এত শাক কে খাবে? বেশি শাক খেলে তো গুয়ের রং শাকের মতো হয়ে যাবে!”
“আরে খান না, সরকার ভাই!”

অভ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে এক চিমটি শাক তুলে মুখে নেয়। তারপর স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলে, “বাহ! রান্না তো দারুণ হয়েছে! এই মর্গের ডাক্তার, খাবি নাকি?”
বজ্র মুখের ভাত শেষ করে শান্ত স্বরে বলে,
“নিউরোসার্জনকে মর্গের ডাক্তার বলার মানে কী?”
“ভাই, কাজ তো ওই একটাই তোদের। কেটে-ছিঁড়ে জিনিস বের করা। খাবি না শাক?”
“না, পেট ভরে গেছে। তুই খা। এই আয়েশা, আমাকে দু’চামচ ডাল দাও তো।”
আয়েশা বজ্রকে ডাল এগিয়ে দিয়ে অভ্রর প্লেটের দিকে তাকাতেই থমকে গেল। অবাক চোখে দেখল প্লেট একদম পরিষ্কার। একটুও শাক বাকি নেই। শাকটা কি তবে এতই মজার হয়েছিল? আয়েশা কিছু বলতে যাবে, ঠিক তখনই জমেলা দৌড়ে এসে তেতে উঠে, “কিরে ছ্যামড়ি! লেপটিনের পেছন থেকে যে হাকপাতা তুলে আনছিলি, সেগুলো কই? ফালাইয়া দিছোস নি?”
অভ্র থমকে যায়। আয়েশার দিকে সন্দেহভরা চোখে তাকায়। আয়েশা ঠোঁটের কোণে হাসি চেপে অভ্রকে চোখ মেরে বলে, “খাও, খাও! আরও মোজ মেরে খাও। গুয়ের শাক যে তোমার এত পছন্দ হবে, তা জানা ছিল না!” বলেই সে হো-হো করে হেসে উঠে।

বজ্রর মুখ বিরক্তিতে কুঁচকে যায়। ভাগ্যিস শাকটা খায়নি! আনহাইজেনিক খাবার খেয়ে না জানি কী হতো! সে প্লেট একপাশে সরিয়ে বসে। অভ্র আয়েশাকে কিছু বলার আগেই আয়েশা দৌড়ে সেখান থেকে পালায়। অভ্র তখনও বোঝার চেষ্টা করছে। কথাটা পুরোপুরি মাথায় ঢুকতেই তার মুখ শুকিয়ে যায়। চোখ স্থির হয়ে যায় শূন্যে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আচমকা উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে, “গুওয়ালী রে, তোরে আজকে খাইছি!” বলেই ওয়াক ওয়াক করতে করতে দৌড়ে বেসিনের দিকে যায়।
বজ্র একবার এদিক তাকায়, একবার ওদিক। যেন বুঝতে পারছে না এ কী হচ্ছে! ঠিক তখনই জমেলা তার কাঁধে হাত রেখে গম্ভীর গলায় বলে, “এই দামড়া আর হাউ মাচ গিলবা?গো রুমে। আমার স্লিপিং পাইছে। আজকে নো লুমান্স। আই আংরি ইউর সাথে। ইউ ননচেন্স দামড়া আন্ডারইস্ট্যান্ড?”
বজ্রর তো চোয়াল অবধি খুলে যাওয়ার অবস্থা! হিচকি তুলে মনে মনে শুধু বলে উঠে,” হায় আল্লাহ, এ কোন পাগলের বাড়িতে এসে পড়লাম! এখানে তো সবাই দেখি মানসিক প্রতিবন্ধী!”

হাসপাতালের করিডোরে কিছুক্ষণ নিরবে পায়চারি করে সোহাগ ধীরে বাইরে বেরিয়ে আসল। রাত ঘন হয়ে এসেছে। ল্যাম্পপোস্টের ম্লান আলো ঝিমিয়ে পড়া শহরের নীরব রাস্তা আঁচড়ে যাচ্ছে। মাথা নিচু করে সোহাগ হাঁটছে। পায়ে অদৃশ্য শিকল বাঁধা।
ফারাজ বাবার চিকিৎসার জন্য লোক পাঠিয়েছিল বাসায়। চিকিৎসা এখানকার হাসপাতালে দুদিন চলবে। তারপর ঢাকায় স্থানান্তর। সেখানেও কাজ না হলে বিদেশে নিয়ে যাওয়া হবে। এত তৎপরতা, এত আয়োজন সবই চিত্রার জন্য কারণ ফারাজ তাকে ভালোবাসে। ভালোবাসার এই প্রকাশে কোনো কার্পণ্য নেই কারণ ফারাজের টাকার অভাব নেই। যার টাকা আছে তার জন্য ভালোবাসা দেখানোও যেন সহজ হয়ে যায়। মানুষকে খুশি করতে তার সময় লাগে না, চিন্তাও হয় না। চিত্রা নিশ্চয়ই খুশি হবে। হওয়ারই কথা। ফারাজ তার পাশে দাঁড়িয়েছে, সাহায্য করছে, নিরাপত্তা দিচ্ছে। সোহাগ থেমে যায় একপলক। তার কি আছে? না আছে টাকা, না আছে সেই সুযোগ। সেও চেয়েছিল চিত্রাকে খুশি করতে। ভালো রাখতে, কিন্তু পারল না। আর এখন তো সেই চেষ্টাটুকু করার অধিকারও নেই। সোহাগ একটা নিশ্বাস ফেলে বলে, ❝তারা হৃদয়ে মিশেও অন্যের হয় কিভাবে? অভাবে নাকি স্বভাবে?❞
সোহাগ চেকশার্টের হাঁটা গুটিয়ে নিস্তব্ধ রাস্তায় বসে থাকা ন্যাড়ি কুকুরটার দিকে একবার চেয়ে আকাশের দিকে তাকায়। গলা ছেড়ে গান ধরে,
❝পেয়ে হারানোর বেদনায় পুড়ে চলেছি সারাক্ষণ,
কেনো তুমি মিছে মায়ায়
বেঁধেছিলে আমায় তখন?❞

সোহানের ব্যবসা ভালোই চলছে। প্রতিদিনের হিসাব, লাভ-লোকসান সবই সুমনের হাতে। সুমন সোহানের কালো ব্যবসা সম্পর্কে অনেক কিছুই জানে। জেনেও না জানার মতো থাকে। এসবে ঢুকে লাভ কি? সোহান তো পরিবারের কারো দিকে নজর দিচ্ছে না। কারো সঙ্গে খারাপ ব্যবহার কখনো করে নি। তাই অন্যের লুকোনো রুপটা উন্মোচনের তো কোনো প্রয়োজন নেই। অন্তুত পরিবারের সামনে সোহান মানুষ থাকুক। অমানুষের মতো রুপটা লুকিয়ে রাখুক তাতেই চলবে। তবে মাঝে মাঝে মনে হয় এই মিথ্যার জাল একদিন না একদিন ছিঁড়ে যাবে। কারণ যতই লুকানো হোক শেষ পর্যন্ত সত্যি একদিন পৃথিবীর সামনে বেড়িয়ে আসবেই। সুমন তার হিসাব শেষ করে সোহানের রুম থেকে বের হতেই সিফাত রুমে ঢুকলো। সোহান সিফাতকে নিজ হাতে গড়ে তুলেছে। তার গল্প একেবারে অন্য। সিফাতের কোনো নাম ছিল না, কোনো পরিচয় ছিল না। সোহান তাকে নাম দিয়েছিল, পরিচয় দিয়েছিল। তারা শুধু শরীরে নয়, মন আর আত্মায়ও এক। সোহান লুঙ্গির গিট ঠিক করতে করতে সিফাতকে বলল,

“খবর কি?”
“ভাইজান, নিকলীর আরেকটা বড় প্রোজেক্ট আসছে। ভুইঁয়া কিন্তু কাজের নির্দেশ দিছে। এবার অক্ষরে অক্ষরে তা পালন করার পালা।”
সোহান জবাব দেয় না। তবে ভুইঁয়াদের সঙ্গে নতুন প্রজেক্টে সামিল হতে পারলে কিন্তু মন্দ হয় না। নিকলীর হাওর এলাকা জুড়ে তার গড়ে তুলা অবৈধ ব্যবসার বিস্তৃত সম্পর্কে আজও জানে না। সবাই জানে ভুইঁয়া নামের কেউ একজন আছে যে নির্দেশে সকল অবৈধ ব্যবসা হয় কিন্তু তাকে আজ অব্দি কেউ দেখেনি। সবাই শুধু তার নামের পদবী জানে। কেও তাকে, জানে না তার নাম কি। কে সে?দেখতেই বা কেমন? একেবারে ভুঁইয়ার কাছের মানুষগুলোই হয়তো তার সম্পর্কে জানে। কথায় আছে না বাপেরও বাপ আছে? ভুঁইয়ারা তেমন। দেশীয় অবৈধ ব্যবসার বাপ বলে তোকে তাদের। তবে ভুইঁয়াদের ব্যবসার একটা বিশেষত্ব হলো তার নারী-পুরুষ ভেদাভেদ করে না। উভয়কে ঘিরেই তাদের ব্যবসা। সোহান ভুইঁয়াদেট সঙ্গে কাজ করেই কালো জগতে প্রবেশ করেছে। সোহানদের কাজ শুধুমাত্র প্রোজেক্টের জন্য মাল রেডি করা। তবে মাল জায়গা মতো পৌঁছানোর দায়িত্ব ভুঁইয়াদের।ক’দিন আগে যেই প্রোজেক্টটা সফল করেছে তাও ভুঁইয়াদের আন্ডারে ছিল।
“ওগো নতুন প্রোজেক্টে কি নিয়া?”
“১০০ মানুষ লাগবো। ৫০ টা মেয়ে মানুষ বাকি ৫০ পুরুষ মানুষ।”
“এত মানুষ দিয়া শালারা করেটা কি?”
” দান্ডা চালাইবো ভাইজান বুঝেন না?”

ফারাজ চিত্রার মসৃণ হাতটি দৃঢ়ভাবে ধরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছে। চিত্রার পরনে গভীর রাত্রির মতোই কালো একখানা শাড়ি। যার প্রতিটি ভাঁজে গাঢ় নিঃশব্দতা জমে আছে। সাজগোজে কৃত্রিমতার ছায়া নেই। অথচ তার অনবদ্য সৌন্দর্য নিঃশব্দে শাসন করছে চারপাশ। ঠোঁটে একটুখানি রানি গোলাপি লিপস্টিক। সে-ও কোনো রক্তজবার নিঃশ্বাস। এই লিপস্টিকই ফারাজ উপহার দিয়েছিল। চিত্রাকে দেখা মাত্রই আয়েশা ছুটে এসে শুধায়,
“আপা, আপনে ঠোঁটে যেই লিপিস্টিক দিছেন, ওইটা দেন না আমারে। একটু লাগাইয়া দেখি। টেস্ট কইরা বুঝি কেমন।”
চিত্রার উত্তর দেবার অবকাশ হওয়ার আগেই ফারাজ পকেটে হাত গুঁজে চিত্তাকর্ষক ভঙ্গিতে সাড়া দেয়,
“তোর টেস্টের দরকার নেই। ওইটা আমি অনেক আগেই টেস্ট করে ফেলছি।” তার কণ্ঠের ইঙ্গিতপূর্ণ রসবোধে হলরুমে প্রবেশ করা রুমানার মুখ ফস করে উঠে,
“তওবা! ছেলেটারে মানুষ করতে পারলাম না।”

হলরুমে তখন ব্যস্ততা ও শোরগোল। অভ্র ঘরের লাগেজগুলো বাহক দিয়ে গাড়িতে তোলাচ্ছে। বজ্রও তার সঙ্গে। ক্ষণস্থায়ী যাত্রা হলেও প্রস্তুতিটা দীর্ঘ অভিযানের মতো। চিত্রার কাছে মিতালি আর আয়েশা মানে অন্যরকম মানসিক আশ্রয়। তাই তাদের ছাড়া দুই দিনের ভ্রমণও তার কাছে ভাবনার অতল ছিল। দু’জনকেই সঙ্গে করে সে ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছে। উপরন্তু ফারাজ সারাদিন থাকবেই কাজের দিকচিহ্নে নিবিষ্ট। বাসায় একা একা চিত্রার দিন মিতালি আর আয়েশাকে ছাড়া কি করে কাটবে?
এক এক করে হলরুমে জড়ো হয় ফারিয়া, নদী, নুড়ি, মোহনা ও নিরু। নিরু প্রথমে আসতে চায়নি, ভেতরে ভেতরে দ্বিধা ও ক্লেশে জর্জরিত ছিল সে। কিন্তু ফারাজের প্রতি তার নিঃশব্দ, নিঃশেষ প্রেম—তা কি তাকে বসে থাকতে দেয়? যাওয়ার আগে ফারাজকে চোখে না দেখলে এই দুই রাতই তার কাছে হয়ে উঠত নিদ্রাহীন অপেক্ষার বন্দিশালা।
“আম্মাজান জলদি আইসা পইড়ো। যদিও তুমি না গেলেই পারতা। পুরুষ মানুষগো কত কাম থাকে। কতদিকে দৌড় পারন লাগে। সবখানে কি আর ঘরের বউয়ে নিয়া যাওন যায়? বউগো কাম ঘরে থাকা, সংসার সামলানো, বাচ্চা পয়দা করা।”

ফারাজ এক মুহূর্ত চুপ থেকে ঠোঁট বাঁকায়। তারপর স্বরটা দৃঢ় করে বলে ওঠে,
” হ্যাঁ আম্মা বাচ্চা পয়দার নমুনা তো দেখছিই। এত বাচ্চা বাড়িতে যে তাদের ডায়াপার দিয়ে ডাস্টবিন ভরে গিয়েছে। আর বাকি রইল সংসার সামলানো? তো সামলাও না। আমার জন বাঁধেও ঘরে বউয়ের অভাব নেই। ওদের সামলাতে বলো। নিজে সামলাও। চিত্রা কোথায় যাবে,কখন যাবে, কয় ডজন বাচ্চা পয়দা করবে তার সিদ্ধান্ত একান্ত আমি নিবো। বউটা যেহেতু আমার তাই তোমাদের অত না ভাবলেও চলবে।”
রুমানা চুপ হয়ে যান। মনে মনে না জানি কি ভাবছেন? ফারাজ মোহনার দিকে তাকায়। মোহনাটা আগ থেকে তার পানেই হা করে চেয়ে আছে। চেয়ে থাকবে না কেন? ফারাজকে কি সুন্দর লাগছে! এমন পুরুষ দেখলে চোখ ফেরানো যায় না। তার ওপর যদি হৃদয়ের অলিন্দে জুড়ে তার বসত থাকে।
“মশারী ভাবী দোয়া করবেন আশার সময় যেন খুশীর সংবাদ নিয়ে আসতে পারি।”
ফারাজ আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল তবে তার আগে চিত্রা তাকে চিমটি পারে। এই লোককে বুঝিয়ে কোন কাজ হওয়ার নেই। চিমটি মেরেই থামাতে হবে।

ঠিক তখনই রাজন সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামে। সঙ্গে জোহানও ছিল। দুই ভাই দুপুরের খাবার সেরে বেরোবে। জোহান একবার চিত্রার দিকে তাকায়। কিন্তু চট করে চোখ নামিয়ে ফেলে। তবে পরমুহূর্তে তার দৃষ্টি গিয়ে পড়ে মিতালির ওপর।মিতালি নিচের দিকে তাকিয়ে। মনোযোগ অন্য কোথাও। জোহান রাজনের দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় কিছু বোঝায়। রাজন সে ইশারা বুঝে খাবার টেবিলের দিকে এগিয়ে যায়। তবে তার আগেই চিত্রা রাজনকে পেছন থেকে ঢেকে বলে,
“ভাইয়া আমরা আসছি।”
রাজন থেমে যায়। পেছন ফিরে সৌজন্যেমূলক হাসি দিয়ে বলে, “দোয়া করি সুস্থ ভাবে যেন বাড়ি ফিরতে পারো।”
ফারাজ রাজনের দিকে চেয়ে আছে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে চিত্রার হাতটা আরো শক্ত করে ধরে বলে,
“এসে যেন দেখি ভাই তুমিও সুস্থ আছো। মানুষের তো আবার বিপদ আসতে সময় লাগে না।”
এতক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা বজ্র ভেতরে প্রবেশ করে। বিরক্ত হয়ে দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। বারবার ফোন করেও ফারাজ কল ধরছে না। দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই সে দেখে ফারাজ চিত্রার হাত ধরে আছে। কথা বলছে। কিছু সময় স্থির তাকিয়ে থাকে সেই দৃশ্যের দিকে। একটা শুষ্ক ঢোক গিলে কণ্ঠ খাঁকারি দিয়ে ফারাজকে ডাকে,

“ফারাজ জরুরি কথা ছিল।”
ফারাজকে ডাক দিতেই ফারাজ পেছনে তাকায়। বজ্রকে দেখে হেসে বসে,
“ওহে বজ্রপাত চুনাপাখি আসতাছি।”
ফারাজ চিত্রার হাত ছেড়ে বলে,”আমি আসছি দুই মিনিট আগুন সুন্দরী।”
ফারাজ বজ্রর সঙ্গে বাহিরে গিয়ে কথা বলতেই রাজন মিতালিকে বলে,
“তুমিও যাইতাছো নাকি?সব গেলে গা কাম করবো কে?”
“ভাই!”
“ভাই ওকে আমি আমার সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি।” মিতালিকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে চিত্রা তার হয়ে জবাব দেয়।
“ভালো।”

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৩১

রাজন হাত ঘড়ির দিকে তাকায়। মুখের কোণে বাঁকা হাসি খেলা করছে। মুহুর্তেই মিতালির ফোনে কল আসে। কল রিসিভ করতেই মিতালির শরীর কেঁপে উঠে। ওপাশ থেকে অশ্রুরুদ্ধ একটা কন্ঠ ভেসে আসে।
“তোর আব্বায় আমাগোদের রাইখা চইলা গেছে।”
মিতালি রাজনের দিকে স্তম্ভিত নয়নে তাকায়। মুখে তার সেই বাঁকা হাসি।

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৩৩