চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৪০ (২)
ইশরাত জাহান জেরিন
বাইরে ধুলোর আস্তরণ উড়ে যাচ্ছে। আকাশে জমে উঠেছে ধোঁয়াটে মেঘের স্তর। শহর আবারও বৃষ্টিতে ভিজবে। ঘরের বারান্দা, পিচঢালা রাস্তাগুলো, জানালার কাঁচ সবকিছু যেন প্রস্তুত হয়ে আছে বৃষ্টির ছোঁয়ার জন্য। গাছেরা হবে সতেজ, সবুজে মোড়ানো নবজীবনের মতো। চিত্রা বৃষ্টি ভালোবাসে, তবে তার চেয়েও বেশি ভালোবাসে বৃষ্টির আগমুহূর্তকে। সেই থমথমে নীরবতা, বাতাসে ঘনিয়ে ওঠা আবেশ। সব মিলিয়ে একটা বিষণ্নতা ছড়িয়ে দেয়। মনে করিয়ে দেয় ফেলে আসা গল্পগুলো, যেগুলোতে ছিল হারানোর যন্ত্রণা, না-পাওয়ার ক্ষত, অথবা নিঃসঙ্গ প্রতীক্ষার দীর্ঘতম সময়। চিত্রা বসে আছে জানালার ধারে, হাতে খোলা উপন্যাসের ২৬৬তম পৃষ্ঠা। হঠাৎই থমকে যায়। কপালের ভাঁজে বিস্ময়। ঠোঁটের কোণে একরাশ হতাশা। বিরবির করে বলে ওঠে,
অবিরাম বৃষ্টির প্রথম ফোঁটাগুলো কান্নার ধ্বনি হয়ে কাঁচে এসে পড়ছে। চিত্রার মনে জমে থাকা প্রশ্নগুলোর মতোই, তারা উত্তর খুঁজে ফিরলেও কিছুতেই ফসকে যাওয়া সময়ের দরজায় পৌঁছাতে পারছে না। চিত্রা বইয়ের পাতার প্রশ্নতে হারিয়ে গিয়েছে। নিরব সে। তার নিস্তব্ধতাকে ভেঙে আচমকাই হঠাৎ কোথা থেকে যেন ফারাজ এসে চিত্রার হাতের বইটা ছোঁ মেরে কেড়ে নেয়। চিত্রা প্রথমে কিছুই বুঝে ওঠে না। পারা মাত্রই বলে, “আমার থেকে আবারও বইকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছো আগুন সুন্দরী? ফারাজ বইয়ের পাতায় চোখ বোলায়। শুধু সেই একটি পৃষ্ঠা পড়ে অনুমান করতে পারে নায়কের স্ত্রী নিজ হাতে গুলি চালিয়েছে তার স্বামীর বুকে। যে ছিল প্রেমিকা, সে-ই হয়ে উঠেছে খলনায়িকা। ফারাজ হঠাৎ জিজ্ঞাসা করে,
“তুমি কি আমার বুকে গুলি চালাতে পারবে?”
চিত্রার চোখে অস্বস্তি ছড়িয়ে পড়ে।
“কার সঙ্গে কিসের তুলনা করছেন আপনি?”
“তালুকদার বাড়ির মেয়ে না তুমি? তোমার পরিবারের সবাই তো মারা গেছে। খুনীকে যদি সামনে পেতে, কী করতে?”
চিত্রা গভীর শ্বাস নেয়। অতীতের ধুলো ঝেড়ে বলে
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“হ্যাঁ, আমি তালুকদার বাড়ির মেয়ে। তবে আমার পরিবারকে কেউ খু*ন করেনি। আর যদি করেই থাকত তাহলে তাদের জন্য আপনি তো আছেনই।”
ফারাজ থমকে যায়। “আমি? আমি থাকলে কী হতো?”
“আপনি তাদের শাস্তি দিতেন।”
“কি শাস্তি দিতাম?”ফারাজ তাকিয়ে থাকে।
চিত্রা চোখ মেরে হেসে ফিসফিসায়, “খু*নের বদলে খু*ন।”
চিত্রার কথা ফারাজের কানে বিষের মত ঢুকে যায়। এক মুহূর্ত চুপ থেকে,শীতল স্বরে বলে,“তোমার কি মনে হয় আমি খু*নী? খুন করতে পারব? এসব বা*লের খু*ন-খারাবি অন্তত তোমার স্বামীর থেকে আশা কোরো না। আমার তো র*ক্ত দেখলেই গা কাঁটা দিয়ে ওঠে।”
চিত্রা ধীরে উঠে দাঁড়ায় খাটে। উচ্চতা যতই কম হোক এইভাবে দাঁড়ালেই সে ফারাজের নাগালে আসে। সে এগিয়ে গিয়ে ফারাজকে জড়িয়ে ধরে। ফারাজজ তাকে আঁকড়ে ধরে রাখে। যেন পুরো জগতটাই হারিয়ে গিয়েছে এই দু’জনের আবর্তে।
চিত্রা আবিষ্ট কণ্ঠে ফিসফিসিয়ে বলে,
“আমি জানি আপনি নির্মল। আপনার হাতে কোনো দাগ নেই, কোনো রক্ত, কোনো পাপও না। কিন্তু জানেন তো চাইলেই পাপকে পবিত্র করা যায়। চাইলে নিষিদ্ধকেও শুদ্ধ বলে মানা যায়।”
ফারাজ চুপ করে থাকে। অতঃপর চাপা স্বরে বলে,
“তুমি চাও পাপ শুদ্ধ হোক? পাপ কখনো নিজেকে শুদ্ধ করে না, চিত্রা। বরং শুদ্ধতাকে গ্রাস করাটাই তার ধর্ম।”
শব্দেরা আরেকটু ঘনিয়ে আসে। বাইরের বৃষ্টি তখন আর কাঁচের গায়ে নয় চিত্রা আর ফারাজের মনেই বাজছে। প্রশ্ন, আবেগ আর না বলা সত্যের রূপ ধরে। চিত্রা ফারাজকে ছেড়ে নেয়। হাত বুলিয়ে নিজের চুল ঠিক করে বলে। “আপনার মতিগতি ঠিক লাগছে না।”
ফারাজ হেসে ওঠে।”তোমাকে দেখলে ঠিক থাকে কবে?”
চিত্রার ঠোঁটে ঝলকে ওঠে বিরক্তি, “সামনে থেকে সরুন।”
“কই যাবে?”
“মরতে।”
ফারাজের কন্ঠ আবারও গম্ভীর হয়,”মরার জন্য রহু এত উতলা?সবুর করো মৃ*ত্যু তো সবার জীবনেই আসে। এই ধরো তুমি কালকেও মরতে পারো, আজকেও আর এই মুহুর্তেও।”
চিত্রা তাকে ধাক্কা দিতে যায়, কিন্তু ফারাজ চিত্রার কব্জি শক্ত করে ধরে ফেলে।
“লাগছে,” চিত্রা শ্বাস রুদ্ধ করে বলে।
“নড়বে না বউজান। নড়লে আরো লাগবে।”
“কি চান আপনি?”
“যদি বলি তোমাকে।”
চিত্রা চোখের গভীরে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
“বহু আগেই নিজেকে আপনাকে সমর্পণ করেছি।”
ফারাজ চিত্রার কব্জির বাঁধন আরো শক্ত করে। ব্যথায় চিত্রার চোখে জল জমে ওঠে। ফারাজ তার ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে সেই অশ্রু মুছে, চোখে একটুকরো চুম্বন আকেঁ। তারপর ধাক্কায় চিত্রাকে বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে। কিন্তু সেই ধাক্কায় কোনো হিংস্রতা নেই, ছিল কেবল দাবির অদ্ভুত আকুতি।
চিত্রা সব সহ্য করে, কোনো প্রতিরোধ করে না। সে জানে, তার স্বামী ঠিক কী চায়।
“ভয় করছে?”
চিত্রা ধীরে মাথা নাড়ে,”উঁহু।”
“উফ… ভয় তো করা উচিত। নারীর চোখে ভয় না থাকলে আদর ঠিক জমে না।”
“আপনি এভা….”
কথা শেষ করার আগেই অধরের অধর মিলিয়ে যায়। ফারাজ চিত্রার ডান হাতের মুঠোয় চিত্রার দুইহাতের কজ্বি একত্রে চেপে ধরে।
কথা শেষ হওয়ার আগেই, ঠোঁট ঠোঁটে মিশে যায়। ফারাজ তার এক হাতে চিত্রার দুই কব্জি চেপে ধরে রাখে। চিত্রার শরীর-মন জুড়ে তখন এক উত্তাল স্রোত বয়ে যায়। চিত্রা চুপ। তার নিঃশ্বাস দ্রুত। বুকের ওঠানামা ভারী হয়ে উঠেছে। ফারাজ তার উপর ঝুঁকে পড়ে। চোখে চোখ রেখে চুপচাপ দেখে যায়। একটা নীরব যুদ্ধ চলছে দু’জনের দৃষ্টিতে। কোনো কথা নেই, কেবল অনুভবের তীব্রতা। চিত্রার ঠোঁট কাঁপে। ফারাজ ধীরে হাত বাড়িয়ে তার গাল ছুঁয়ে বলে, “ আমার ভালোবাসা যদি তোমায় ধ্বংস করে? যদি এই আমিটা তোমায় ভেঙে দেই?”
চিত্রা শ্বাস আটকে বলে, “ আমি চাই আপনি আমায় ভাঙুন। নষ্ট করুন। আমার ভেতর যা পবিত্র, তাকে চুরি করুন… আমি তাতেই শান্তি খুঁজে নিব।”
ফারাজের চোখ জ্বলে ওঠে। চিত্রার গলায় ঠোঁট ছুঁয়ে বলে, “তুমি নারী ভয়ঙ্কর । আর আমি পুরুষ তোমার ভয়ঙ্করতাকেই ভালোবেসে ফেলেছি।”
চিত্রার শরীর ধীরে ধীরে ফারাজের ঘনিষ্ঠতায় গলে যেতে থাকে। সে চোখ বন্ধ করে। ফারাজ নিঃশব্দে চিত্রার কপালে চুমু খায়। “আমি কেবল তোমার সঙ্গে নিজেকে খোলে দিই, চিত্রা। তুমি ছুঁলেই আমি আর আমি থাকি না।”
চিত্রা আবার ফারাজকে জড়িয়ে ধরে। চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে আসে। ঘরের জানালায় বৃষ্টি নানছে এখনো, কিন্তু ভেতরে এক অন্যরকম ঝড়, যা কেবল হৃদয়ের গভীরতম জায়গায় বয়ে যায়।
এক হাতে চিত্রার চুলে আঙুল চালিয়ে ফারাজ তার কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলে, “ আমি তোমায় ভালোবাসি চিত্রাঙ্গনা। পাপের মতোই ভয়ংকর রকমের ভালোবাসি।”
চিত্রা কাঁপা কণ্ঠে বলে, “ আমিও আপনাকে ভালোবাসি। আমার ধ্বংসের শেষ নিশ্বাসেও আপনার নাম থাকবে।”
সন্ধ্যার আযানের ধ্বনি ছড়িয়ে পড়েছে দূর থেকে। জানালার ওপাশে বৃষ্টির রেশ কিছুক্ষণ থেমেছিল, এখন আবার আগের চেয়ে খানিকটা বেশি ছন্দে নামছে। ঘরের ভেতরে আলো-আঁধারির খেলায় আবছা হয়ে আছে ঘনিষ্ঠ, নিশ্চুপ, জড়িয়ে থাকা। দুইটি শরীর। চিত্রা ফারাজের বুকের উপর মাথা রেখে শুয়ে আছে। তার আঙুলগুলো ধীরে ধীরে ফারাজের বুকে আঁকছে অনাহূত এক চিত্রকলার রেখা।
“বুকের লোমগুলো কেটে ফেলেছেন কেন?” চিত্রার প্রশ্নে মৃদু আক্ষেপ ঝরে পড়ে।
ফারাজ এক হালকা নিঃশ্বাস ফেলে। “জিম করি। বুকের ওপর যদি জঙ্গল হয়ে থাকে, তবে শরীর গড়েও আর লাভ কী বলো? গাঁজনে ঢাকা পড়ে যায় সব সৌন্দর্য।”
চিত্রা ঠোঁট বাঁকায়, “লোমশ বুকে আপনাকে বেশ লাগত।একটা রুক্ষ, বুনো ছোঁয়া ছিল আপনার গায়ে।”
ফারাজ ভ্রু কুঁচকে বলে, “তাহলে তোমার থেকে কয়েকটা চুল কেটে আঠা দিয়ে বুকে লাগিয়ে নিই?”
চিত্রা হেসে ফেলে, চাপা স্বরে বলে, “মুড়ি খান।”
ফারাজ চোখ ছোট করে তাকায়। “আরে আমি মুড়ি খান না, ফারাজ এলাহী। তোমার আপন স্বামী। স্বত্বাধিকারভুক্ত!”
চিত্রা এবার হো হো করে না হেসে, ঠোঁট কামড়ে হাসে। সে ফারাজের বুক জড়িয়ে ধরে আরও একটু গা সেঁটে আসে। বাইরে বৃষ্টি, ভেতরে উষ্ণতা। এ এক পরম মুহূর্ত, যে মুহূর্তে সময় থেমে থাকে, শব্দেরা মিশে যায় নিঃশ্বাসে। ফারাজ মাখা তুলে জানালার দিকে তাকায়। বাইরে নামছে ঘন ঘন মুষলধারে বৃষ্টি। যেন আকাশ নিজেই সব শব্দ ডুবিয়ে দিতে চাইছে। মুহূর্তের নীরবতা ভেঙে ফারাজ হঠাৎ বলে ওঠে,
“আমার সঙ্গে ভিজবে? চলো না, আজ একসঙ্গে ভিজি।”
কথা শেষ হতে না হতেই ফারাজ উঠে দাঁড়ায়। গায়ে সাদা একটি টি-শার্ট জড়িয়ে মুহূর্তেই চিত্রাকে পাঁজা কোলে তুলে নেয়।
“নামান! পড়ে যাবো তো।” চিত্রার কণ্ঠে আতঙ্ক।
“শুনতে পাচ্ছি না।” ফারাজ মুখ গম্ভীর করে বলে।
“নামান বলছি!” কণ্ঠ তুলেও লাভ নেই।
“আরেকটু জোরে।” ফারাজের ঠোঁটের কোণে খেলছে অদ্ভুত দুষ্টামি।
“ফারাজ!”
“উঁহু চিত্রা, একদমই শুনতে পাচ্ছি না,” বলে সে চিত্রাকে আরো শক্ত করে চেপে ধরে। দুই পা তিন পা করে সে এগিয়ে যায় ছাদের দিকে চিত্রাকে কোলে নিয়েই। ছাদে পা রাখতেই ঠান্ডা বৃষ্টির ধারা তাদের দু’জনকে একমুখী করে দেয়। ফারাজের সাদা টি-শার্ট ভিজে গায়ে লেপ্টে গেছে। তার মজবুত বুক, চওড়া কাঁধ, আকর্ষনীয় শরীর যেন আরও বেশি করে ফুটে উঠেছে সেই ভিজে কাপড়ে। চিত্রার চোখ আটকে থাকে তার বুকের রেখায়।
“নামাবেন না?” চিত্রা কাতরভাবে বলে।
“না। এখনও মুহূর্তটা চিরস্থায়ী করা বাকি ।”
শেষমেশ চিত্রার অস্থিরতায় তাকে নিচে নামায় ফারাজ। না নামিয়ে উপায় কই? ম্যাডাম তো আবার কোথায় কোথায় গালে চাল ভরে। শিলা বৃষ্টি
বেয়ে নামছে। সেই রোমাঞ্চিত ঘনঘোরে তারা একে অন্যের চোখে চোখ রাখে, ঠোঁটে ঠোঁট মেলে দেয়। বৃষ্টি ধুয়ে দেয় সব কৃত্রিমতা। থেকে যায় শুধু ভালোবাসা আর তীব্র এক আকর্ষণ। চিত্রা বারবার ফারাজকে ছুঁতে চায়। কাছে পেতে চায়, অথচ প্রতিবারই মনে হয় সে দূরে সরে যাচ্ছে। মেয়েটা খুব ছোট। ফারাজকে নাগাল পায় না। ফারাজ ধীরে তাকে তুলে ছাঁদের বাউন্ডারির ওপর বসায়। সোজা চিত্রার চোখে চোখ রেখে ফিসফিসিয়ে বলে,
“এখান থেকে যদি পড়ে যাও?”
চিত্রা প্রশান্তির কণ্ঠে বলে, “আফসোস থাকবে না। জীবনের শেষ মুহূর্তটা যদি আপনার সঙ্গে কাটাই তাহলেই আমি পূর্ণ।”
চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৪০
ফারাজ তার দুই কাঁধে হাত রাখে। এক মুহূর্তের নীরবতা। চারপাশ থমকে যায়। চিত্রা নিচে তাকায় না। তাকালেই যদি ভয় পায়? আচ্ছা এখান থেকে পরে গেলে কি মৃ*ত্যু নিশ্চিত? ফারাজ তার মুখের খুব কাছে এসে দাঁড়ায়। শ্বাস গায়ে এসে লাগে, ঠোঁটের স্পর্শমাত্র দূরত্ব।
“যদি তোমার কাছে তোমায় খুনের আবদার করি?” ফারাজের কণ্ঠ ছুরির মতো ধারালো।
চিত্রা বাঁকা হেসে গুনগুন করে ওঠে,
“লিখবো… তোমার হাতে আমি আমার মরণ।”
ফারাজ তীক্ষ্ণ চোখে তাকায়। চোখে এক অপার্থিব অন্ধকার। হাত ছেড়ে দিয়ে বলে,
“বিদায় আগুন সুন্দরী।”