চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৪৬

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৪৬
ইশরাত জাহান জেরিন

“পাপকে ভালোবাসা যায় চিত্রা?”
“পাপীকে ভালোবাসা গেলে পাপের দোষ কোথায়?”
ফারাজ থমকে যায়। কথার ভার বুক চেপে ধরে। ফারাজ নরম গলায় আবার প্রশ্ন করে। উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত সে থামবে না।
“আমি পাপী হলে আমাকেও ভালোবাসাবে?”
চিত্রা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। চোখে চাপা চাহুনি। মৃদু তাচ্ছিল্যের স্বরে উত্তর দেয়,
“স্বামী খারাপ হোক কিংবা ভালো, আমারটা আমারই। স্ত্রীর দায়িত্বই তো ভালোবেসে স্বামীকে ভালোর পথে আনা। একটা কথা বলব?”
“বারণ করেছি কি?”
চিত্রার ঠোঁটে বাঁকা হাসি। সে বলে,

“রোশান ভাই মনে হয় মোহনা ভাবীকে মারে। সিগারেট দিয়ে গায়ে ছ্যাকা লাগিয়ে দিয়েছে।”
ফারাজের চোখে ক্ষীণ জ্বলজ্বলে একটা ভাব। ঠান্ডা গলায় বলে সে কিয়ৎক্ষণ চেয়ে থেকে বলপ,
“ওদের ব্যক্তিগত বিষয় ওইসব। স্বামী-স্ত্রীর মাঝে অন্য কারো প্রবেশ নিষিদ্ধ। জানো না?”
“কিন্তু ওইসব তো অন্যায়। ভাবীর তো কষ্ট হয়।”
ফারাজ হঠাৎ গর্জে ওঠে, “চিত্রা!”
চিত্রা পিছিয়ে আসে না। নিঃসঙ্কোচে বলে,
“এমন করছেন কেনো?”
“এই বাড়ির কে কি করল দোহাই লাগে, সেইসবে তুমি আগ্রহ দেখাবে না। আর বিশেষ করে বাড়ির পুরুষদের থেকে দূরে থাকবে।”
“কিন্তু কেন?”
“প্রশ্ন করার অনুমতি দিয়েছি? জাস্ট আদেশ পালন করবে।”
চিত্রা হেসে ফেলে। ব্যঙ্গমিশ্রিত ভক্তিতে বলল, “যা আর্জি, জাঁহাপনা।”
চিত্রা আর কথা বাড়ায় না। সে ফারাজের বুকে মাথা রেখে চোখ বুঁজে। রাত অনেক হয়েছে এবার ঘুমানোর পালা। তবে ফারাজের ঘুম শেষ। যেই ভয়টা ফারাজ পেয়েছিল তাই হচ্ছে। চিত্রা নিষিদ্ধ বিষয়ে নাক গলাচ্ছে,আগ্রহ দেখাচ্ছে। এরপর ধীরে ধীরে একটার থেকে আরেকটা ঘটনা ঘটবে। চিত্রা এভাবেই আগ্রহ দেখাতে দেখাতে হুট করেই পৌঁছে যাবে ফারাজের তৈরি করা নিষিদ্ধ দেয়ালের ওপারে। আর তারপর সব শেষ!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

শেষ রাত। আকাশে মেঘ জমেছে। কুচকুচে আধাঁর। অমানিশার তার ফাঁক গলে বিদ্যুৎ মাঝে মাঝে ঝলকে উঠছে। জ্যোৎস্নাহীন নীলাভ আলোয় চারদিকটা অপরিচিত মনে হচ্ছে। বৃষ্টি নেমেছে।
চিত্রা ঘুমায় জানালার পাশেই। জানালাটা সচরাচর বন্ধ করে না সে।অন্ধকারের মাঝেও মুক্ত হাওয়ার স্পর্শ পেতে ভালোবাসে। আজও ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু বৃষ্টির ফোঁটা আচমকা এসে তার গাল ছুঁতেই ঘুম ছিঁড়ে পড়ে যায়। সে ধীরে ধীরে উঠে বসে। চোখে-মুখে ঘুমের চাদর এখনো পুরোপুরি সরেনি। তবু জানালার দিকে হাত বাড়ায়। জানালাটা বন্ধ করতে যাবে ঠিক তখনই একটা অপ্রত্যাশিত শব্দে তার স্নায়ু চমকে ওঠে। গাড়ির হর্ন! এত রাতে? এই ঘন বৃষ্টিতে? কার গাড়ি এলাহী বাড়িতে প্রবেশ করল? চিত্রা খাট থেকে নেমে আসে। পায়ের নিচে নরম কার্পেট। তবুও পায়ের তলায় শীতলতা ছুঁয়ে যাচ্ছে। ঘরের ড্রিম লাইটের মৃদু আলোয় সে সামনে এগিয়ে গিয়ে জানালার পর্দা সরিয়ে দাঁড়ায়। বাইরের দৃশ্য ঝাপসা। বৃষ্টির ফোঁটা কাচে আঘাত করছে।
তবু সে চোখ ছোট করে কিছু দেখার চেষ্টা করে।

বাড়ির সামনের গেটে একটা গাঢ় রঙের গাড়ি দাঁড়িয়ে। দরজা খুলে কয়েকজন নেমে এসেছে। হাতে টর্চ, মাথায় ছাতা। টর্চের আলো বৃষ্টির পর্দা ছেদ করে আলো-ছায়ার কুয়াশা তৈরি করেছে। চিত্রার ভ্রু কুঁচকে যায়। সে ফিসফিস করে নিজের সঙ্গে কথা বলে, “জুনায়েদ এলাহী না? এত রাতে কোথা থেকে আসছে?”
জুনায়েদ এলাহীকে সচারাচর দেখা যায় না। তাকে দেখতে পাওয়া বড়ই দূর্লভ বিষয়। শুধুই কি তাকে? ফারাজ ব্যতিত বাড়ির কোনো পুরুষকেই তো দেখতে পাওয়া যায় না। মাছের ব্যবসা এতই কি কঠিন? তাকি তারা সহজ বিষয়কে কঠিন বানিয়েছে? কি এত কাজ তাদের যে সারারাত বাহিরে কাটাতে হয়?ভোরে বাড়ি ফিরে সারাদিন মৃত মানুষের মতো ঘুমিয়ে পার করে সন্ধ্যায় উঠে আবার নিখোঁজ হয়ে যায়। চিত্রা দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। জানালার কাচ ভিজে ধরা পড়ে তার নিঃশ্বাস। অন্ধকারে কেউ যেন তাকিয়ে আছে, হয়তো সে ভুল দেখছে, কিংবা ঠিকই দেখছে। হঠাৎ একটা বিদ্যুৎ চমকে চারদিক জ্বলে ওঠে এক সেকেন্ডের জন্য। সে মুহূর্তেই চিত্রার চোখে পড়ে, জুনায়েদ টর্চ হাতে তাকিয়েছিল ঠিক জানালার দিকেই। জুনায়েদ এলাহীর দৃষ্টি কি তারই দিকে তবে?চিত্রা চমকে ওঠে। দ্রুত জানালাটা বন্ধ করে দেয়। হৃৎস্পন্দন একটু বেড়ে গেছে। রাত আরও গভীর হয়, কিন্তু চিত্রার চোখে আর ঘুম নামে না। ফারাজকে বুকে শান্তি খোঁজার চেষ্টা করে। তবে কিছুতেই মনকে শান্ত করতে পারছে। তার মূল কারন মাথাভর্তি কিলবিল করতে থাকা একঝাঁক প্রশ্ন? এত প্রশ্নের উত্তর তাকে দিবে কে? কেউ কি দিবে? নাকি খুঁজে নিতে হবে নিজেকেই?

পুরো রাত রাজনের মুখে আর একটুও হাসি ফুটল না। ফোটার উপায়ই বা কী? মাথার ভেতর খটখট শব্দে ঘুরছে হাজারটা চিন্তা। সোহান পালোয়ান মাসশেষের হিসাবপত্র মেলাতে মেলাতে হঠাৎ থেমে গেল।
“ফুর্তি হাওয়া হইয়া গেল নাকি?”
রাজন কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “মিয়া, মশকরা কইরো না।”
সোহান ভ্রু কুঁচকে তাকাল রাজনের দিকে। সিগারেটটা ধরিয়ে বলল, “খুন কে করতে পারে ধারনা আছে?”
“থাকলে কি আর এখানে ইসা থাকতাম?”
“ফারাজ করছে মনে হয়।”
রাজন অবাক চোখে তাকাল। “কেনো মনে হইল?”
সোহান ধীরকন্ঠে বলল, “মিতালির চিত্রার কাছে মানুষ ছিল। ওইদিন কইলা না, মাইয়াটা মিতালির লইগা বহুত কানছে?”
“তো?”
“বুঝো বা বাল? চিত্রারে তেমার ভাই পাগলের মতো মোহাব্বত করে। বউয়ের কান্দন দেইখা ডিলে হয়তো জ্বলা-পুড়া করছে। তাই হয়ত সবার আগে আমাগো লোক মারছে। আমি সিউর মরার আগে আকরাম-ফারুক আমাগো নাম কইছে, শুধুমাত্র বাঁচার জন্য।”

রাজন গম্ভীর গলায় বলে, “ফারাজ কখনও আমাগো বিষয়ে নাক গলায় নাই। তার কিছু নীতি আছে। ওইসব মাইনা চললে সে ভুলেও কারো বিষয়ে ঢুকবে না। আসলে ভাই তো আমারই তাই ভালো কইরা চিনি। শালায় স্বার্থপর। আবার ভয়ানক। ওরে খোঁচা না মারলে জীবনেও সে কাউরে খোঁচা দিব না। আমি ওরে চিনি।”
সোহান মাথা দোলায়। ঠোঁটে বিরক্তি। “এখন তো বদলাইয়া যাইতেও পারে। ভালোবাসা নাকি মানুষ বদলাইয়া ফেলে।”
রাজন চাপা হেসে সটান জবাব দেয়, “লজিক ছাড়া কথা বাদ দাও। ভালোবাসায় মানুষ বদলাইতে পারে, শয়তান না। আর পাপী কখনও পাপ ছাড়ে? নেশার চাইতেও বড় নেশা মানুষ খুন করা। পাপ করা। আল্লাহর রহমতে আমার ভাই সবেতেই এক নম্বর মাল।”
সোহান কাঁধ উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, “এত ভরসা?”

“জ্বী, এতই। কারণ আমরা সবাই ঘুইরা ফিইরা একই পথের পথিক। পার্থক্য খালি এইটুকু সে করে পাচার, আমরা করি জোগাড়।”
সোহান এবার গলা নামিয়ে বলল, “ওরে বলো আমাগো লগে হাত মিলাইতে। তাইলে তো ধান্দা আরো বাড়বো।”
রাজন মাথা নাড়ল ধীরে, “উঁহু। চেষ্টা করছি। কাম হয় নাই। বেশি চাপ দিতে গেলে দেখা যাইবো ঝামেলা বাঁধাইবো। তার চেয়ে ভালো, ওরে ওর মতো থাকতে দেও। কয়দিন পর এমনিতেই বিদেশ চইলা যাইবো।”
সোহান থমকে গেল এক মুহূর্ত, তারপর বলল, “কিন্তু সে দেশে আসছেই বা কেন? কাম কি তার? আর খুন সে না করলে করছে কে?”
রাজনের দৃষ্টি জানালার বাইরে। কালো রাতের দিকে স্থির। “জানি না কিছু। তবে আমাগো এখন আরো সাবধান থাকতে হইবো। মনে আছে, আমাদের বাড়ির পুকুরে দুইটা লাশ পাওয়া গেছিল? বলছিলাম তোমারে? সেই লাশ দুইটারও কিন্তু ঠোঁট সেলাই করা ছিল।”
“তার মানে খুনি একজনই?”

ফারাজের পরনে কালো স্যুট-প্যান্ট। চোখে চোখে কাঁচঘষা কালো সানগ্লাস। নিরাসক্ত চেহারা নিয়ে সে যখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। তার পার্সোনাল দেহরক্ষীরা হুড়মুড়িয়ে ছুটে এসে একে একে সালাম ঠুকে দাঁড়িয়ে যায়। অভ্র গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়ায়।
গেটের একপাশে দাঁড়িয়ে আয়েশা উঁকি-ঝুঁকি মারছে। মন ভালো নেই তার। কতদিন হলো সরকার ভাইয়ের সঙ্গে ঝগড়া হয়নি। ওই লোকটার সঙ্গে ঝগড়া না করলে তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে সে গেট অবধি চলে আসে। হুট করে ফারাজের চোখে আয়েশা পড়ে যায়। অভ্র ইশারায় তাকে ভেতরে যেতে বলার আগেই ফারাজ ঠোঁটে বাঁকা হাসি টেনে জিজ্ঞেস করে, “কি অবস্থা মেন্টাল দাদীর নাতনি? উঁকি ঝুঁকি মারছিস কেন? আশেপাশে তোর মজনু-ফজনু আছে নাকি?”
আয়েশার চোখ কপালে। ধরা পড়ে গেল নাকি? কিছু বলার আগেই অভ্র একটা খোঁকারি দেয়। ফারাজ চশমা খুলে ফুঁ দিয়ে মুছতে মুছতে বলে,”গাড়িতে পানি আছে কুদ্দুসের বাপ। জলদি পানি গিল।”
অভ্র গলা খাঁকারি সেরে গম্ভীর গলায় বলে,”ভাই কাজে যাবেন না? আমাদের লেট হয়ে যাচ্ছে।”
” আরে রাখো মিয়া। তো আয়েশা আমরা জানি কই ছিলাম?”
“ভাই একটু আগেও আমরা এখানেই দাঁড়িয়ে ছিলাম এখনও আছি।”

“কি বললে?”
“একটু…”
“উঁহু এর আগে কি বললে?”
“ভা…ভাই।”
“কোন জনমের ভাই?”
“ইয়ে মানে এই জনমের।”
“আব্বা লাগি তোর মেয়ে।”
“এ্যা!”
“এ্যা না হ্যাঁ। ডাক আ…ব্বা।”
আয়েশা অভ্রর দিকে আঁড়চোখে চায়। অভ্র ইশারায় সব অক্ষরে অক্ষরে বলতে বলে।”
“জলদি। সময় নেই আমার।”
“আব্বা হন আপনি আমার। আচ্ছা আব্বা আমি এখন ঘরে যাই।”
ফারাজ তৃপ্ত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে,”দ্যাটস মাই গার্ল।যাও মামুনি এবার নাচতে নাচতে তুমি স্বর্গে চলে যাও। আই ডোন্ট কেয়ার।”
আয়েশা জলদি বাড়ির ভেতর ঢুকে পরে।সে যাওয়ার পর অভ্র ফারাজকে বলে উঠে,”শশুরমশাই এবার বাড়িতে উঠুন । মেয়ের সাথে আপনাকেও স্বর্গে নামিয়ে দিয়ে আসি।” হিসহিসিয়ে বলে।
“কিছু বললি নাকি? ”
“না বলেছি কি ভাই গাড়িতে উঠে বসেন। কাজ আছে অনেক।”
ফারাজ গাড়িতে উঠতে যাবে এমন সময় পেছন থেকে কেউ ডাকে,“বাবা ফারাজ! দাঁড়াও দাঁড়াও।”
ঘাড় ঘুরিয়ে ফারাজ দেখে পাশের বাড়ির সেই চিরচেনা বৃদ্ধ এগিয়ে আসছেন। ফারাজ একটা ঢোক গিলে। চুরি করার সময় দেখে ফেলেনি তো? আয় আল্লাহ শেষে কিনা এভাবে ইজ্জতের বেগুনভর্তা বানাবা?
“কিছু বলবেন, খালু?”
“আরে বাবা পেয়ারা দিতে আসছিলাম বাড়িতে।”
“কার বাড়িতে?”
“তোমাগো।”

ফারাজ ভেতর ভেতর আরেকটা ঢোক গিলে। ফারাজের মুখ শুকিয়ে যায়। আবার সেই পেয়ারা কাণ্ড! আজ তো দেখছে এত মানুষের সামনে ইজ্জতের প্রাণ সস চাটনি হবেই হবে। ধ্যাত রে তখন তো আবার মানুষ তাকে সিঙ্গারায় মাখিয়ে মাখিয়ে মোজ মেরে খাবে। মেয়েমানুষের তো এমনিতেই তার ওপর কু-নজর দেওয়ার স্বভাব!
বৃদ্ধ ঘাড় নেড়ে বলে, “আরে জানো না। সমাজটা নষ্টামিতে ভইরা গেছে। কাল রাতে কারা যেন নুপুর খুইল্লা আমার পেয়ারা গাছের সামনে কি সব করছে। পেয়ারা কাজটা অপবিত্র হইয়া গেছে। পবিত্র করার জন্য আশ পাশের সবাইরে পেয়ারা বিতরণ করতাছি। কাল একটা মিলাদ পরামু। আইসো কিন্তু।”
“ছ্যাহ ছ্যাহ কোন এগুলোরে ধইরা পেঁদানি দেওয়া উচিত।” অভ্র কথাটা বলতেই ফারাজের হিচকি উঠে যায়। অভ্র গাড়ি থেকে পানি দিতে গেলে ফারাজ বলে,
“আমি ঠিক আছি। কাজ আছে চল ভাই।”

লোককে বিদায় দিয়ে ফারাজ গাড়িতে উঠে বসে। পেয়ারা গুলো লোক দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে ফারাজ। তবে অভ্র হাতে একটা পেয়েরা নিয়ে গাড়িতে বসে ফারাজের দিকে তাকিয়ে
কামড় বসিয়ে চিবোতে চিবোতে বলে, “ভাই নুপুর খুলে কি কাজটাই না করলো। শালারা বোধ হয় পাক্কা খেলোয়াড়। কবে যে এমন দিন আমারও আসবে? আমার তো ভেবেই কাতুকুতু চলে আসছে।”
ফারাজ চোখ কুঁচকে বলে,”আরেকটা কথা বলে দেখ তোর প্রকৃতির ডাকও এখনি চলে আসবে।”

সকালবেলাতেই ফারাজ কোনো একটা দরকারি কাজে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার পর চিত্রা আবারও বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। কিন্তু কখন যে ঘুম নেমে আসে চোখে টেরই পায় না। ঘুম ভাঙে অনেক পরে ঘড়িতে তখন প্রায় এগারোটা। মাঝখানে একবার আয়েশা এসে নাস্তা রেখে গিয়েছিল।কিন্তু চিত্রার কোনো কিছুতেই মন বসছিল না। রুম থেকে বেরোয়নি সে। এই একঘেয়ে দুপুর।এই চার দেওয়ালের ভিতরেই তার আজকের গন্তব্য। আজ কলেজে যাবার কথা ছিল তার। কিন্তু ফারাজ ব্যস্ত, তাই সে আবারও রক্ষা পেল। নিরু যেই কলেজে পড়ে সেখানেই তাকে ভর্তি করা হয়েছে। কিন্তু তাতে তার কি? মনে মনে খালি ফন্দি আঁটছে কি করে ফাঁকিবাজ করা যায়। শেষে উত্তর না পেয়ে নদীর কাছে যায়। নদী তখন কাঁথা সেলাই করছিল। বারান্দায় নদীর পাশে বসে চিত্রা জিজ্ঞেস করে,
“ও ভাবী আমার না কলেজে যাওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই। কি করবো বলুন তো?”
নদী কিছুক্ষণ চুপ থেকে শান্ত স্বরে জবাব দেয়, “একটা বাচ্চা নিয়ে নাও। দেখবে ফারাজ তোমাকে আর কলেজে যেতে দিচ্ছে না।”
চিত্রা লজ্জায় মুখ নামিয়ে নেয়। হ্যাঁ, তারও শখ আছে। একটা বাচ্চা, ঘরে খেলা করবে, কোলে ঘুমাবে। কিন্তু বাচ্চা আবার নেয় কেমন করে? ওটা কি কোনো পন্যসামগ্রী নাকি? আচ্ছা বাচ্চা কি ফারাজের থেকে চাইতে হবে? যদি হিংসুটে লোকটা না দেয়? চিত্রা ঘরে ভালো করে চোখ বুলিয়ে আবারও প্রশ্ন করে,
“ভাই আসেনি? আচ্ছা ওনারা কি ওমন কাজ করে যে সারারাত-দিন বাহিরে কাটাতে হয়?”
নদীর চোখ মুখ শুঁকিয়ে আসে। কি বলবে বুঝতে পায় না।
“আসলে তেনাদের কাজই এমন। বহুত কষ্টের।”
চিত্রা গলা নামিয়ে আবার জিজ্ঞেস করে, “কি জানি বাপু। মাথায় ঢুকে না। আচ্ছা ভাবী আপনার বাড়িতে কে কে আছে? বাড়ি যান না?”

বাড়ির কথা মনে পড়তেই চোখ কেমন ছলছল হয়ে ওঠে। চোখে জল চিকচিক করে। সে চোখের পানি সামলে বলে,
“কেউ নেই। আমার কেউ নেই। তুমি কিছু খাবে? ঘরে বাতাসা আছে দিবো?”
“না না, কিছু লাগবে না। গরমে মাথা কেমন যেন ঝিম ধরে আছে। গোসল করতে হবে।”
ঠিক সেই মুহূর্তে হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে পড়ে ফারিহা। ব্যস্ত কন্ঠে সুধায়,”ভাবী! জলদি উঠেন। আকবর আসছিল। রাজন ভাই দুপুরে মেহমান নিয়া বাড়িতে আসবো জানেন না। রান্নাবান্না কতদূর?”
চিত্রা একটু অবাক হয়। কই মেহমান আসবে তাকে তো কেউ কিছু বলেনি। কে আসবে?চিত্রা নুড়ির চুলে হাত বুলাতে বুলাতে ফারিহার দিকে তাকায়। কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে তার আগেই নদী ফারিহাকে বলে,
“সব আয়োজন শেষ। এখন খালি খাবার টেবিলে সাজানোর পালা।”
ফারিহা একটু থেমে কাঁথার দিকে তাকিয়ে কেমন কটাক্ষে বলে, “তো এই কাঁথা রাইখা কামে লাগেন। আপনার তো আর বাচ্চার মুখ দেখার সৌভাগ্য নাই। কাঁথা কার জন্য সেলান?”
নদীর ভেতরটা ছলছল হয়ে আসে। কদিন আগেও তো মা হয়েছিল সে। সেদিন হোঁচট খেয়ে সিঁড়ি দিয়ে না পড়লে আজকে তার কোলেও সন্তান থাকত। ফারিহার কথা চিত্রার মোটেও পছন্দ হয় নিচিত্রা তীব্র বিরক্তি নিয়ে চায় সে নদীর দিকে। নদী চুপ। খুব করে চুপ। কিন্তু তার ভেতরটা তার কাঁদছে। চিত্রা নদীকে চুপ থাকতে দেখে ভীষণ ক্ষেপে গিয়ে বলে,

“এটা কি ধরনের ব্যবহার?ভাবী এই বাড়ির বড় বউ। ওনার সাথে এভাবে কেন কথা বলছ?”
“বাদ দাও না চিত্রা। আমি কিছু মনে করি নি।”
ফারিয়া কৈফিয়ত দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করে নেই। কেমন যেন মুখ বাঁকিয়ে হইহই করে রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। চিত্রাকে স্বাভাবিক করতে নদী বলে,
“তুমি জানো না মেহমান আসব যে?”
“কেউ বলে নি। কে আসবে?”
“নিরুরে দেখতে আসব।”
“ভালোই হবে দেখতে আসুক। আমিও চাই মেয়েটার যেন বিয়ে হয়ে যায়।”চিত্রা মুখ ঘুরিয়ে ফেলে।
“কেনো গো? তুমি চাও কেন?”
“আমার স্বামীর দিকে নজর দেয় ওই মেয়ে। বুঝি না মনে করেছে? সবই বুঝি। খাই না তো সুজি তাই সব কিছুই বুঝি।”

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৪৫

“হিংস্রা হয়?” নদী মিটমিট করে আসে।
“না পুড়িয়ে মারতে ইচ্ছে করে।” চিত্রা আনমনে বিড়বিড়িয়ে উঠে।
“কিছু বললা?
” কই নাতো। আচ্ছা পাত্র কে? এবারও কি পিয়াস ভাইয়ের মতো কাহিনী হবে নাকি?”
“আল্লাহ মাফ করুক।” নদী থেমে একটু ভাবে।
“কি জানি নামটা? ওহ আচ্ছা মনে পরেছে। পালোয়ান… পাত্রের নাম সোহান পালোয়ান।”

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৪৭