চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৫০
ইশরাত জাহান জেরিন
“ফারাজ মারা গেছে?”সোহান নিচু গলায় সিফাতকে জিজ্ঞেস করল।
“না ভাই,” সিফাত মাথা নাড়ল।
“কেন? কেন মরে নাই সে?”সোহানের চোখে জ্বলে উঠল অস্থিরতা।
“কি ভাইবা জানি, সে নিজের গাড়িতে না বইসা অন্যটায় উঠছে।”
“শালা, চালাক মাল! নির্ঘাত কিছু টের পাইছে।”
“হয়তো।”
“ফারাজ মরলে কি হইত জানিস?”
“কি?”
“চিত্রা আমার হইত।”
“দুনিয়ায় কি মাইয়ার অভাব পড়ছে ভাইজান?”
“না। তবে চিত্রা দুনিয়ায় একপিসই।”
সোহান চুপ করে গেল। তার দৃষ্টি কাঠের পাটাতনের ফাঁক গলে নিচে পড়ে থাকা পানির দিকে। ধপ করে বসে পড়ল। লুঙ্গির ভাঁজ হাঁটুর উপর তুলে নিল। মাথার ভিতর একটাই ছবি, একটাই নাম আর তা হলো চিত্রাঙ্গনা। সেদিন এক ঝলক তাকানোর পর থেকে মেয়েটা তার ভেতরে কেমন যেন ক্ষত তৈরি করে ফেলেছে। সে ক্ষত কেবল ভালোবাসার না, তৃষ্ণার, দখলের। সে চায় মেয়েটাকে। নিজের করে, একান্তভাবে নিজের করে। তবে পেতে হলে সরাতে হবে বাধা। সরাতে হবে ফারাজ নামক বাধাকে। তাকে সরাতে পারলেই সব পথ মুক্ত। চিত্রা তখন শুধুই তার। সে জানে, ফারাজ সহজ শিকার নয়। এলাহীর রক্ত কৈ মাছের মতো, হাজারবার ধরলেও ঠিক একভাবে না একভাবে ফসকেই যায়। কতোবার তাকে শেষ করতে চেয়েছে লোকজন, কেউ পারেনি। সোহান হাসল একপাশে মুখ ঘুরিয়ে। কৈ মাছ হোক আর যেই মাছই হোক না কেনো দূর্বল দিক সবারই আছে। শত হলেও তো মাছ বলে কথা। পানিশূন্য আর কতদিন তার বেঁচে থাকা?
এই তো কবেল শুরু। উপন্যাসের প্রথম পৃষ্ঠা মাত্র। পুরো গল্প এখনও লেখা বাকি। সোহান সেই গল্প শেষ করারই অপেক্ষায়।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
বিছানায় শুয়ে আছে ফারাজ। কপালে সামান্য চোট।মাথার এক পাশে হালকা ফুলে উঠেছে। সামনের গাড়িটায় হামলা হয়েছিল। অথচ ফারাজ পেছনের গাড়িতে ছিল বলেই অল্পের জন্য বেঁচে গেছে। ব্রেক কষার সময় আঘাতটা লেগেছে, তবে সেটুকুই।
গাড়িতে ওঠার মুহূর্তে এক অদ্ভুত অনুরণন হয়েছিল ভেতরে। কেন জানি নিজের গাড়িতে না উঠে অভ্রর গাড়ি বের করেছিল সে। সাধারণত ফারাজের গাড়ি থাকে মাঝ বরাবর, কিন্তু আজ ছিল একেবারে পেছনে। তাই হামলাকারীরা ভেবেছিল মাঝের গাড়িতেই ফারাজ আছে। সেটাতেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তারা। এই যাত্রায় ফারাজ কিভাবে বেঁচে গেল, তা তার নিজেরও ঠিক বোধগম্য নয়। কিন্তু খোদা তাকে কার জন্য বাঁচিয়ে রেখেছে, সে উত্তর তার স্পষ্ট। চিত্রাকে গুছিয়ে না রেখে, তাকে নিরাপদে না দেখে, ফারাজ কখনই মরতে পারে না। যদি মরে, তবে তার আত্মা বিষাদের আঁচে ভস্ম হয়ে যাবে।
চিত্রা সারাদিন ধরে পাশে বসে সেবা করে যাচ্ছে। যদিও এই সামান্য চোটে এলাহীরা কষ্ট পায় না। তারা যন্ত্রণারই সন্তান। পাপের ছায়া থেকে জন্ম নেয়া। তাদের না আছে মন, না আছে ব্যথা। তবু চিত্রার চোখে টলমল জল দেখে বুকটা হাহাকার করে ওঠে ফারাজের। চুপচাপ চিত্রার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে সে। এই মুখটাই যে গত কিছু মাস ধরে তার প্রার্থনার কেন্দ্র। কত রাত সে নিঃশব্দে বলেছে স্রষ্টার কাছে “তার সকল দুঃখ আমায় দাও। তার কান্না আমায় দাও। তার ব্যথা আমায় দাও।”
কিন্তু স্রষ্টা কি শুনেছেন? নাকি তিনি পাপীদের প্রার্থনায় কান দেন না? যদি শোনতেন, তাহলে আজ হয়তো তাকে এই অন্ধকার রাস্তায় নামতে হতো না।চিত্রার গাল বেয়ে টপটপ করে নেমে আসা অশ্রু মুছে দিয়ে ফারাজ হেসে বলল,
“কাঁদছো কেন? আমার কিছুই হয়নি তো!”
চিত্রা ক্ষীণ কণ্ঠে রাগ আর কান্না মিলিয়ে বলে,“আপনি কী করে এতটা দায়িত্বহীন হতে পারেন? মাথায় আঘাত পেয়েছেন আর বলছেন কিছু হয়নি?”
ফারাজ উঠে বসল। চিত্রার হাত ধরে বলল, “তুমি কাঁদবে না। তোমার চোখে জল দেখলে আমার ভেতর পুড়ে। ভেতরে যেই উত্তপ্ত লাভা টগবগ করে তা নেভানোর ক্ষমতা পৃথিবীর কোনো জলের হয় নি,কোনো সমুদ্রের হয় নি। দয়াকরে করে কেঁদো না বিবিজান।”
ফারাজ চিত্রাকে বুকে টেনে নেয়। এতক্ষণে বুকটা পরিপূর্ণ লাগছে। এতক্ষণ মনে হচ্ছিল দেহ থাকলেও তা যেন নিষ্প্রাণ। হৃদপিন্ডটা ছিটকে পড়েছে হয়তো কোথাও। ফারাজ সিলিংয়ের দিকে তাকায়। নিশ্বাস ছেড়ে প্রথমেই তার কথা ভাবে সে যাকে মারার চেষ্টা করেছে। কে হতে পারে? খুনী কি তার খুব কাছের? নাকি অচেনা? ফারাজ নিশ্বাস ছেড়ে চিত্রার পিঠে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আবার ভাবনার দুনিয়ায় পথভ্রস্তা পথিকের ন্যায় হারিয়ে যায়। মনে মনে ঠিক করে নেয় সামনে দু’টোই পথ খোলা। এক পথে চিত্রা দাঁড়িয়ে অন্যটায় পাপ। কাকে বেছে নেওয়ারা বড্ড প্রয়োজন তা ফারাজ জানে। চিত্রা….তাকেই বেছে নিবে সে। কাউকে ভালোবাসলে, তাকে আপন করে পেয়ে কাছে রাখতে চাইলে মানুষ সব করতে পারে। পাপ বিসর্জনের বদলে পবিত্রতা পাবে সে এটা ভাবলেই তো ভেতরটা শান্তির মোহে ডুবে যায়।
বাহিরে তখন আবারও বৃষ্টি নেমেছে। চিত্রা আশ্রয় নিয়েছে ফারাজের বুকে। বারান্দার দরজা খোলা। সে স্বামীর বুকে মাথা রেখে বিধ্বস্ত নজরে তাকায় সেই কালো মেঘের অন্তরালে লুকিয়ে থাকা আকাশের দিকে। খানিক চুপ থেকে কি ভেবে যেন হুট করে বলে উঠল,”জানেন, বৃষ্টির জন্ম কিভাবে হয়? আকাশ আর মাটির ভালোবাসা থেকেই। তারা জানত তাদের স্পর্শ অসম্ভব!আকাশ সবসময় উঁচুতে, মাটি সবসময় নিচে। তবুও তারা প্রতিদিন একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকত। তাদের এই দুরত্বের মাঝখানে জন্ম নেয় মেঘ। আর একসময় সেই মেঘ ভরে উঠে চোখের জল দিয়ে…যখন আর সহ্য হয় না, তখন বৃষ্টি নামে আকাশের অশ্রু হয়ে, মাটির বুকে!এটাই তাদের এক মুহূর্তের মিলন, এক শাশ্বত বিরহের মধ্যে! ভাবনার বাইরে যা হয়, সেটাই হয়তো সত্যি ভালোবাসা। কারণ বাস্তবটা আমাদের ইচ্ছার ধার ধারে না!
“সহজ করে বলো।”
“কিছুই বলার নেই। শুধু বলতে চাই আমারা যেন মাটি আর আকাশ হয়ে না উঠি কখনও। দূরত্ব হওয়ার আগে মৃত্যু হোক।”
“হলে কি হবে?”
“আমরা যদি মাটি আর আকাশের মতো হই। তখন চাইলেও ছুঁতে পারবো না একে অপরকে।
হয়তো এক অদৃশ্য টানে প্রতিদিন চোখে চোখ রাখব,
চোখে না হলেও, হৃদয়ে, অন্তর্গত কোথাও। এই দূরত্বের মাঝেই জন্ম নিবে আমাদের অনুভবের মেঘ। তাতে জমবে না বলা কথার জল।কখনো সে ঝরে পড়ে চুপিচুপি অভিমান হয়ে, অভ্যস্ত হয়ে, অথবা নীরব কান্না হয়ে। আর এভাবেই একদিন হয়ে যাবে অনাঙ্ক্ষিত বিচ্ছেদ। আমি বিচ্ছেদ সইতে পারবো না ফারাজ। আপনাকে হারালে হারিয়ে যাবো আমি। চাই না আপনাকে হারাতে। আপনি আমায় ছেড়ে কখনও যাবেন না। কথা দিন?”
চিত্রা হাত বাড়ায়। ফারাজ হাতে হাত রেখে চিত্রার কপালে চুমু দিয়ে বলল,”দিলাম।” ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে সুধিয়ে উঠল,” পাপীরা কথা দিয়ে কখনও কথা রাখে না চিত্রা।”
“আমি তো একেবারে চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম,” আয়েশা অভ্রর দিকে তাকিয়ে বলল। “তোমার যদি কিছু হয়ে যেত?”
“উঁহু বোকা মেয়ে, কিছু হবে কেন?”
“যদি তোমাদের গাড়িটার ওপর হামলা হতো?”
“হয়নি তো?”
“কারা করেছে জানো কিছু?”
“কি করে বলব? দুনিয়ায় কি কম শত্রু পুষে রেখেছি?”
“মানে?”
“এই ঘরনী জড়িয়ে ধরো না একটু। ভালো লাগছে না।”
“ভালো না লাগলে জড়িয়ে ধরতে হবে কেন?”
“শান্তির জন্য।”
আয়েশা অভ্রকে জড়িয়ে ধরল। চোখ বুজতেই হঠাৎ মগজ সজাগ হলো। আচ্ছা জড়িয়ে ধরলে শান্তি পাওয়া যায় তা সরকার ভাই কেমন করে জানল? তার মানে কি আগেও সে কাউকে জড়িয়ে ধরে শান্তি লাভ করেছে?ইশ এ তো তাহলে চোরের ওপর বাটপারি হয়ে গেল। আয়েশা ধাক্কা মেরে অভ্রকে সরিয়ে দেয়। অভ্রর মাথায় কিছুই ঢুকছে না। সে জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে তাকাতেই আয়েশা বলে উঠল,”তুই ধরবি না শালা আমাকে আর কয়টা মেয়েকে এমন করে জড়িয়ে ধরে শান্তি লাভ করছিস?”
“কি!”
“তোর মাথা।”
“আরে ঘরনী আমি জীবনেও কোনোদিন কোনো মেয়ের দিকে তাকায় নি। অপবাদ দিলে পাপ লাগবে।”
“চিটারি করছিস তুই আমার সাথে রে। ধোঁকা দিলি রে।”
আয়েশা অভ্রকে আরেকটা ধাক্কা মেরে উঠে যায়। যাওয়ার সময় একগাল কথা অবশ্য বলে। এদিকে অভ্র ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসে আছে? কি হলো কিছুই বুঝল না। কিন্তু এটা বুঝল তার বউ একটা তাড় ছিঁড়া। নিজের তাড় তো ছিঁড়াই এখন অভ্রের গুলো টেনে ছিঁড়বে।
সারাদিন ফারাজের চোখের সামনে থেকেও একচুল না নড়ে থাকা চিত্রা শেষমেশ সন্ধ্যার সময় রুম থেকে বের হয়। ফারাজের আঘাত গুরুতর নয়, কপালে সামান্য চোট লেগেছে মাত্র, তবুও চিত্রা তাকে একা ছাড়েনি একবারের জন্যও। দুনিয়ার সব কাজ বাদ দিয়ে একদিন নিজের মানুষটার পাশে থাকা এটাকে সে পাপ মনে করে না। চিত্রা নিচে নেমে আসে কফি আর নাস্তা আনার জন্য। নিচে নেমেই দেখে, রাজন ডাইনিং টেবিলে বসা। ঘুম থেকে সদ্য উঠেছে বলে চোখ লালচে, শিরাগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মুখ গোমড়া। হাতে সিগারেটের গন্ধ লেগে আছে এখনো। টেবিলে বসে বসে মদ গিলছে। মনের কি নোংরা আর বাজে গন্ধ।
রান্নাঘরে ঢুকতেই নদী খাবার সাজিয়ে দেয়। আজকের পদটি নতুন, শুনেছে কিছু একটা ইতালিয়ান কোনো খাবার। অন্য সময় হলে চিত্রা নদীর রান্না দেখে লাফিয়ে উঠত, মুখে দিয়ে প্রশংসায় ভরিয়ে দিত। কিন্তু আজ মনটা ভার। শরীরটা যেন বাস্তবতার ভারে চুপসে গেছে। চিত্রা খাবারের থালা হাতে সিঁড়ির দিকে এগোতেই হঠাৎ কাঁচ ভাঙার বিকট শব্দে থমকে যায়। ঘুরে দাঁড়াতেই দেখে মেঝেতে গরম খাবারের ওপর পড়ে আছে নদী। তার চুল এলোমেলো, মুখ থুবড়ে। চিত্রা তড়িঘড়ি দৌড়ে যায়, থালা টেবিলে রেখে নদীকে উঠাতে যাবে, এমন সময় রাজনের কণ্ঠ গর্জে ওঠে,
“তুমি সর।”
“ভাই! আপনি ভাবীর গায়ে হাত তুললেন? কেন?”
“ও আমার বউ। কী করব না করব সেটা আমার ব্যাপার। তোমার কথা বলার দরকার নেই।”
“তাই বলে আপনি যা খুশি তাই করবেন?” চিত্রার গলা কাঁপলেও স্বর তীক্ষ্ণ।
“তর্ক করতেছো?”
“সেই সাহস আমার কোথায়… তবে—”
চিত্রার কথা শেষ হওয়ার আগেই রুমানা এগিয়ে এসে চিত্রাকে চেপে ধরার মতো করে বলে ওঠে,
“ছোট বউ, তুমি যাও ফারাজের কাছে। নদীর গায়ে হাত দিও না। ওর ছোঁয়া লাগলে যদি তোমারও সন্তান না হয়?”
চিত্রার চোখ জ্বলতে থাকে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না করাটাও তো একধরনের অন্যায়। রাজন তখন নিজের লুঙ্গি সামলে আবার নদীর দিকে এগিয়ে আসে। তার চোখে হিংস্রতা। চুলের মুঠি ধরার আগেই চিত্রা সামনে এসে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। নদী চিত্রার পেছনে লুকিয়ে পড়ে।
“সামনে থেইকা সরো চিত্রা,” রাজনের গলা থরথর করে ওঠে।
“সরবো না। নদী ভাবীর দোষটা কী?”
“দোষ কী মানে! আমারে মদ খাইতে নিষেধ করে। আমি কি ওর বাপের পয়সায় খাই? কোন সাহসে সে বলে আমি নিষেধ করে?আজকে শালীরে মাইরাই ফেলমু!”
“না ভাই, আপনি আজ আর এক কদমও সামনে যেতে পারবেন না।”
চিত্রার প্রতিবাদ রাজনের ভেতরটা আরও জ্বালিয়ে তোলে। মুখচোরা, অনুগত চিত্রা আজ কোথা থেকে এমন সাহস নিয়ে এল! রাজনের চোখ রক্তবর্ণ। সে হাতে উপরে উঠায় টেনে চিত্রাকে সামনে থেকে সরানোর জন্য। ঠিক তখনই ফারাজের কণ্ঠ বজ্রাঘাতের মতো হুংকার ছাড়ল,
“ওই হাত যদি আমার স্ত্রীর শরীর ছোঁয় খোদার কসম হাত আর হাতের জায়গায় থাকবে না।”
পুরো ঘর স্তব্ধ। রাজনের হাত মাঝ পথে থেমে যায়।
চিত্রা ঘাড় ঘুরিয়ে সিঁড়ির দিকে তাকায়। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে ফারাজ। সাদা শার্টে মোড়ানো, সুগঠিত দেহ, পকেটে হাত গুঁজে রাখা। চোখে তীক্ষ্ণ বিদ্যুৎ ঝলসে পড়ছে। রুমানা ধীরে ধীরে পেছাতে থাকে। ফারাজের চোখে চোখ রাখতে সাহস হয়নি। বিপদ যেন জানালার পর্দা সরিয়ে সামনে দাঁড়াতেই তিনি এখানে এক দন্ড দাঁড়িয়ে থাকার সাহস হারিয়ে ফেলেন। ফারাজ এগিয়ে এসে চিত্রাকে সামলে নেয়। চিত্রা হাত ধরে নদীকে টেনে তোলে। ফারাজ চিত্রার দিকে তাকিয়ে গাম্ভীর্য কন্ঠে বলে,
“ভাবীকে রুমে নিয়ে যাও। আর তুমি ঠিক আছো তো?”
চিত্রা মাথা নেড়ে বলল, “হুম।“
তাহলে রুমে যাও। খাবার আমি নিয়ে আসছি।”
চিত্রা নদীকে সঙ্গে করে নিয়ে চলে যায়। ফারাজ এবার সামনে এসে দাঁড়ায় রাজনের মুখোমুখি। চোখে চোখ আটকে যায়। রাজনের ঠোঁটে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য,
“বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না? তুই আমার বিষয়ে নাক গলালে আমিও কিন্তু নাক গলাতে বাধ্য হব।”
ফারাজ একপা এগিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে উঠে,”দুঃখিত নাক গলানোর আগেই যদি ফারাজ এলাহী আপনার নাকটাই কেটে দেয় ভাইজান?”
গভীর রাত। আকাশ কালো। চাঁদ মেঘে ঢাকা। নিঃস্তব্ধ পরিবেশে শুধু মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে কোদালের শব্দ। রাতকে চিরে ফাটিয়ে দিচ্ছে সেই শব্দ। মাহাদী তার শরীরের সমস্ত শক্তি একত্র করে গর্ত খুঁড়ছে। মাটি সরে যাচ্ছে তার শক্তির সম্মুখে ঘামের ফোঁটা জমে জমে তার কপাল দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে চোখের কোণে। গর্তটা যথেষ্ট গভীর হলে সে কোদাল থামিয়ে দাঁড়ায়। কিছুটা দূরে পড়ে থাকা মেয়েলী মৃতদেহটির দিকে তাকায়। নিষ্প্রাণ, নিথর, নির্বাক সেই দেহখানা। মুখটা এমনভাবে আঁকা যেন চিরতরে চিৎকারটা থেমে গেছে। মুহূর্ত খানেক সে দাঁড়িয়ে থাকে নিস্পন্দ। তারপর নিজের মনে হিসেব করে। পুরো দেহটা একসাথে পুঁতে দিলে হয়তো লাশ সহজে খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিংবা সহজেই শনাক্ত হয়ে যাবে লাশ। এটাই করা মঙ্গলময়। সে কোনো ঝুঁকি নিতে চায় না। একটু থেমে নিঃশ্বাস টেনে মাটির ওপর রাখা কুড়াল তুলে হাতে নেয় সে। ঠাণ্ডা ধাতবের নিচে অচল গলা।
এক কোপেই মাথা আলাদা হয়ে যায় দেহ থেকে। তারপরে শুরু হয় নিষ্ঠুর পদ্ধতিগত ছেদন। হাত, পা, উরু, বুক সবই আলাদা করা হয় দেহ থেকে। খুঁড়ে রাখা কয়েকটি ছোট গর্তে একে একে সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পুঁতে ফেলে সে। মৃত শরীরটিকে একেবারে অচেনা করে দেয়। সমস্ত কাজ শেষ করতে দীর্ঘ সময় লাগে। রাত প্রায় শেষের দিকে। মাহাদী ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ে নদীর পাড়ে। শীতল হাওয়া বইছে। ঘামে ভেজা শরীর হালকা হচ্ছে। সে গভীর এক নিঃশ্বাস ফেলে। তারপর উঠে দাঁড়ায়। আবার একটি ছোট গর্ত খুঁড়ে তাতে কোদাল এবং কুড়ালটা পুঁতে দেয়। মেয়েটির মৃত শরীর থেকে ছেঁড়ে নেওয়া ওড়নাটা সে লুঙ্গির মতো শরীরে। পেঁচিয়ে নেয়। তারপর নিজের শার্ট আর প্যান্ট খুলে নদীর জলে নেমে পড়ে। ঠাণ্ডা জলে ডুবে যায় মাথাসহ। দীর্ঘ সময় ডুবে থেকে ওঠে। আহা, কী প্রশান্তি! শরীরে আর কাদা নেই, নেই রক্তের কষাঘাত। জলের ভেতর সব পাপ ধুয়ে যাচ্ছে তার। সে তৃপ্তভাবে গোসল শেষ করে উঠে আসে। ধীরে ধীরে নিজের পোশাক পরে। ছেঁড়া ওড়নাটা খানিকটা কুচকে ছিঁড়ে নদীর স্রোতে ভাসিয়ে দেয়। তার মুখে তখন পরম তৃপ্তি । অন্ধকার ভেদ করে আজ বহুদিন পর ভোরের আগে বাড়ি ফিরবে সে। মনের ভেতর একটানা শান্তির ঝংকার বাজে। ঘরে ফিরে বউটাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাবে। নিশ্চিন্ত এক ঘুম দিবে। সে শিষ বাজায়। ঠোঁটে প্রশান্তিদায়ক মৃদু বাঁক। অন্ধকারের বুক গলে ভয়াল শোনা যাচ্ছে সেই শিষ ধ্বনি।
বাড়িতে ফিরতেই কান্নার রোল। রাত কেটেছে ভয়ে আর অপেক্ষায়। কেউ ঘুমায়নি। দরজায় কড়া দিতে না দিতেই ভিতর থেকে ছুটে এসে দরজা খুলে দেয় মারিয়া। মাহাদীকে দেখেই জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে সে। গলা কাঁপছে, “কত গুলা কল করছি… ধরলা না ক্যান?” কণ্ঠে অভিযোগের চেয়েও বেশি আতঙ্ক।
মাহাদী শান্ত মুখ। অভ্যস্ত ভঙ্গিতে সে জবাব দেয়,“কাজে ছিলাম। কী হইছে তোমার?”
মারিয়া কান্নার ফাঁকে বলে,“জান্নাত… জান্নাতরে খুঁজে পাওয়া যাইতাছে না…”
চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৪৯
এই একটুকু কথায় মাহাদীর মুখে লুকানো অসুরটি ক্ষণিকের জন্য দৃষ্টি ফেলে দেয়। তার চোখের পেছনে হঠাৎ করেই জ্বলে ওঠে গা ছমছমে বাসনা। সে কিছু বলে না। শুধু মারিয়াকে বুকের কাছে টেনে নেয়। তার পিঠে হাত বুলায়। সান্ত্বনার অভিনয়ে ওস্তাদ সে। তবে তার ঠোঁটের কোণে পরম তৃপ্তির হাসি লেগে আছে। একটু শিষ বাজাতে পারলে নেহাৎ মন্দ হতো না।