চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৫৪

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৫৪
ইশরাত জাহান জেরিন

অবচেতন চিত্রাকে বাহুতে তুলে নিজের কক্ষে নিয়ে এল বজ্র। বিছানায় শুইয়ে দেয় সে নিথর দেহটাকে। কিছুই বলছে না চিত্রা। জ্ঞান নেই, নীলাভ ঠোঁটে জ্বরের তীব্রতা ঝলসে উঠছে। বজ্র বুঝল, আর কিছুক্ষণ দেরি হলেই অনর্থ ঘটে যেত। এ মুহূর্তে যাকে সে স্যালাইন দিয়ে শুয়িয়ে রেখেছে সেই চিত্রার অবস্থা সত্যি খারাপ। আয়েশা যদি না বুঝত, যদি সময়মতো গিয়ে না জানাত বজ্রকে, চিত্রাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাহলে হয়ত আজকের রাতটা দুঃস্বপ্নে রূপ নিত। বজ্রের কাছে ফারাজ যে দায়িত্বটি দিয়ে রেখেছে সেই দায়িত্ব ছিল চিত্রা।

তবে বজ্র পালন করতে পারল না সেই দায়িত্ব। ব্যর্থ সে। চিত্রার এমন শোচনীয় অবস্থায় যদি ফারাজ এসে পড়ে… তবে হয়ত বিস্ফোরণ ঘটত। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়, চিত্রা কিভাবে চোখে ধুলো দিয়ে পৌঁছে গেল ওই সরাইখানায়? কীভাবে গেল, কেন গেল? সবকিছুই এখনও অস্পষ্ট বজ্রের কাছে। তবুও শুধুমাত্র প্রবল এক ধারণার টানে ছুটে গিয়েছিল সে সেই অখ্যাত সরাইখানায়। সেখানে পৌঁছেই যা ঘটাল বজ্র, তা সে নিজেও ভাবেনি। পিস্তলটা মাথায় ঠেকাতেই কেঁপে উঠল মালকিন। দম্ভে ফেটে পড়া সেই নারী মুহূর্তেই চুপসে গেল নিউরোসার্জন বজ্র কায়সারের চোখের হুঙ্কারে ও অস্ত্রের নির্মম বাস্তবতায়। বজ্র কখনও হুট করে অস্ত্র ছোঁড়ে না, ওর ধমনীতে এখনও নীতির রক্ত বইছে। কিন্তু আজ, আজ যদি সে পিস্তল না তুলত, তবে চিত্রাকে হয়ত আর ফিরে পাওয়া যেত না। ওই মহিলা, এই মালকিন সে কী করে ভাবল একজন অজানা মেয়েকে বন্দি করে সে কাস্টমারের কাছে পাঠাবে? সাহস তো কম নয় তার। তবে বজ্র তাকে ছেড়ে দিবে না। সে তাকে বুঝিয়ে দেবে কার শরীর স্পর্শ করার স্পর্ধা করেছে সে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সন্ধ্যার ম্লান আলো গা ছুঁয়ে যখন ফারাজ বাড়িতে ফিরে আসে তখনই কানে আসে অস্বাভাবিক এক নৈঃশব্দ্যেতা। রুমের দরজায় পা রাখতেই তার দৃষ্টিতে পড়ে ভিড়। মোহনা, নদী, ফারিহা, আয়েশা সবাই একত্র। ঘিরে আছে কারো নিঃস্পন্দ দেহকে। মুহূর্তেই ঠাণ্ডা শিরশিরে হাওয়া বইয়ে যায় রক্তে।
ফারাজের হাতে সদ্য কেনা নতুন ফোন। ফারাজ আসার সময় যমুনা থেকে নতুন ফোন নিয়েছে। কিছুদিন গেইম খেলবে তারপর এটাও না হয় ফেলে দিবে। তার ফোন ভাঙ্গলে কেমন জানি শান্তি শান্তি লাগে।
ক্রোধের ঝাঁজে ভাঙা ফোনের সংখ্যা যদি গোনা হয়, তবে তা দিয়ে বেশ বড় একটি ফোনের শোরুম দাঁড় করানো যেত। মার্কেট থেকে ফেরার পথে এক দোকানের কাচঘেরা পুতুলে চোখ পড়ে তার। টকটকে রক্তের মতো লাল শাড়ি। নিটোল বুনন, মাতাল করে দেওয়ার মতো রঙ। সেই শাড়ি দেখেই ফারাজের মনে হয়, যদি তার চিত্রা এই শাড়ি পরত, তবে নারী-সৌন্দর্যের সংজ্ঞাটাই নতুন করে রচিত হতো।

কিন্তু সেই সৌন্দর্য আজ ধুলিসাৎ। ফারাজ রুমে পা রাখতেই মুহূর্তে জমে ওঠে ভারি নিস্তব্ধতা। কেউ কিছু বলে না। না, এই নীরবতা চিত্রার অসুস্থতা নিয়ে নয় বরং সেই অনাগত ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কায় যা ফারাজ নামক মানুষের ভেতর জন্ম নিচ্ছে ধ্বংসাত্মকভাবে। কেউ তাকে ফোন করে কিছু জানায়নি, চিত্রা যে কী ভয়াবহ অবস্থার ভেতর দিয়ে গেছে তা আজ নিজ চোখে দেখে বুঝতে পারছে সে। রুমে থাকা সকলেই অজান্তে একপাশে সরে যায়। হয়তো ফারাজের শরীর থেকে নিঃসৃত ক্রোধের তাপমাত্রা অনুভব করা তাদের কাম্য নয়। বজ্র তখন চিত্রার পালস ধরেছে। ঠিক ভাবে পালস নড়ছে না। স্যালাইনের প্রতিক্রিয়া হচ্ছে খুব ধীরে।

চিত্রার দিকে তাকাতেই ফারাজের চোখ স্থির হয়ে যায়। কপালে আঘাতের দাগ, ঠোঁট ফুলে আছে ব্যথায়, নির্যাতনে। ফারাজের শরীরজুড়ে একটা প্রচণ্ড স্নায়ুচাপ জমা হয়। মুষ্টিবদ্ধ হয় হাত, দৃঢ় হয়ে ওঠে শিরা। কপালের রেখায় ক্ষোভের ছাপ স্পষ্ট হয়। ঘাড় বেয়ে নামা শিরাগুলো টানটান হয়ে উঠেছে মুহুর্তের মধ্যে। সে গভীর একটা নিশ্বাস ফেলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। ঠিক তখনই পেছনের দরজা দিয়ে অভ্র আর রোজ রুমে প্রবেশ করে। চিত্রার অবস্থা দেখে অভ্র থমকে দাঁড়ায়। এ নীরবতা ঝড়ের পূর্বাভাস। অভ্র তা জানে, ফারাজের নীরবতা যত দীর্ঘ হয়, তত বেশি ভয়ংকর হয় তার প্রতিঘাত। চিত্রার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকা ফারাজ ধীরে, অত্যন্ত নিচু কণ্ঠে বজ্রকে প্রশ্ন করে,

“কারা করেছে?”
“দেখ, আমি পরে সব ব্যাখ্যা করে বলব তোকে।”
“আমি কিছু একটা জিজ্ঞেস করেছি বজ্র।” দাঁতে দাঁত পিষে বলল।
বজ্র নিরুত্তরে বলল, “তুই আগে ওর পাশে বস।”
“যেই হাত আমার জানের ওপর আঘাত করছে সেই হাত আমি উপড়ে না ফেলা অব্ধি চিত্রার পাশে বসা তো দূরের কথা ওর চোখেও চোখ রাখব না খোদার কসম। যে আমার কলিজায় আঘাত করছে, তার কলিজা আমার চাই।” ফারাজ থামল। নিথর চিত্রার দিকে তাকিয়ে পুনরায় অভ্রকে বলল, “স্থানীয় কুকুর ফার্মের মালিককে খবর দিয়ে বল ফারাজ এলাহী আজকে পুরো এলাকার সকল কুকুরকে নিজ দায়িত্ব পেট ভরাবে।”
ঘরের সবাই সেই বলা কথায় ছটফট করে উঠল। আল্লাহ জানে কার মরন আজকে হবে? বজ্র ফারাজের দিকে তাকালো। তারপর বলল, “বারান্দায় আয় বলছি।”

রাত তখন নয়টা না কি দশটা বাজে।
রাস্তার পাশে ফারাজের গাড়ি দাঁড়িয়ে। অভ্র আর বজ্র গাড়ির সামনে। দোকানের সামনে বসে থাকা একটা কুকুর ক্ষুধার তাড়নায় ঘুমোতে পারছে না। ফারাজ নেমে এসে কুকুরটির সামনে বসল। বরফ দেওয়া বাক্স থেকে একটা কলিজা বের করে শিস বাজিয়ে ডাকল। কুকুরটা ছুটে আসল। গপগপ করে চিবিয়ে খাওয়া শুরু করল সেই কলিজাটা। ফারাজের হাতে আবারও রক্ত লেগে আছে। সে কিছু বলার আগেই অভ্র জলদি গাড়ি থেকে মদের বোতল বের করে এনে হাত ধুয়ে দিল তার। ফারাজ উঠে দাঁড়ায়। সে অনেক বেশিই ক্লান্ত। বলেছিল চিত্রার সঙ্গে যারা এমন করেছে তাদের শাস্তি না দেওয়া পর্যন্ত বউকে ছোঁয়া তো দূরের কথা উল্টো দেখবেও না। তবে অনেক হয়েছে।

ফারাজ তার কথা রেখেছে এবার প্রানভরে চিত্রাকে দেখার পালা। তাকে স্পর্শ করার পালা। তার যন্ত্রণাগুলোকে নিজের ভেতর শুষে নেওয়ার পালা। ওই পতিতা ভবনের মালিকের নাম লতা। সেই লতা এখন মাটির নিচেও যাওয়ার সৌভাগ্য লাভ করে নি। করবে কেমন করে? দেহ তো হিংস্র প্রানীরা খুবলে খেয়েছে। তবে এত সহজ মৃত্যু ফারাজ তো অন্তত সেই ব্যক্তিকে দিতে পারে না যে কিনা ফারাজের স্ত্রীকে তীব্র যন্ত্রণা দিয়েছে ক্ষনে ক্ষনে। চিত্রার গায়ে যারা হাত দিয়েছে তাদের সেই সকল জায়গা থেকে মাংস তুলে নেওয়া হয়েছে যেখানে তারা তার স্ত্রীকে আঘাত করেছিল। ফারাজ নারীদের গায়ে হাত তুলে না। তাই এই কাজগুলো রোজ করেছে। তবে প্রতিটি নির্দেশনা ছিল ফারাজেরই। কোনো জীবন্ত মানুষকে জোর করে অ্যাসিড খাইয়ে দিলে কি পরিমাণ যন্ত্রণা হয় যদি বাকিরাও তা দেখতে পেত। ফারাজের চোখের সামনে গলে গলে গলার মাংস খসে পড়ছিল।

ফারাজ কেবল এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল সেই দৃশ্যের দিকে। ওদের ভাগ্য ভালো ওরা নারী হয়ে জন্মেছে। নারী হয়ে ফারাজের হাতে মৃত্যুর স্বাদ নেওয়া থেকে বেঁচে দিয়েছে তবে মৃত্যুর হাত থেকে তো আর নয়? গলে পড়তে থাকা অংশে রোজ বিষ প্রয়োগ করে। এই বিষে কেবল জ্বালা বাড়াবে এবং অতিমাত্রায় চুলকাবে ওই জায়গা। কারো কিছু করা লাগবে না। চুলকানির দাপটে ওরা নিজেরাই ওদের মাংস টেনে টেনে ছিঁড়বে। অতি ভয়ানক সেই দৃশ্য। তার থেকেও ভয়ানক ছিল বজ্রর করা সেই কাজ। জ্যান্ত অবস্থায় তাদের শরীর থেকে কলিজা বের করা হয়েছিল। যখন পেট কাটা অবস্থায় নাড়িভুঁড়ি দলা পেকে চোখের সামনে বেড়িয়ে আসছিল। নিজের এই হাল যখন নিজেরাই এক নজর দেখেছিল তখন আসল শান্তি লেগেছিল ফারাজের। এই সরাইখানা আজ থেকে বন্ধ। এখানে যে সকল মেয়েকে জোর করে ধরে আনা হয়েছে তাদেরকেও মুক্তি করে দেয় ফারাজ। যার যার বাড়ি ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে। আর যারা মাটির চাটুকারিতা করছিল তাদের মৃত্যুও ওই একই ভাবে হয়েছে যেমন বাকিদের। আজ থেকে এই ভবন পাপ মুক্ত হবে। এখানে কোনো নারী আর চিত্রার মতো লাঞ্ছনার শিকার হবে না।

ফারাজ উঠে দাঁড়ায়। অভ্রকে বলে,”তোর ভাবী অপেক্ষা করছে। বাড়ি ফিরতে হবে।”
“জ্বী ভাই। আপনি গাড়িতে গিয়ে বসেন।”
ফারাজ বাড়ি ফিরে চিত্রার পাশে এসে বসে। রুম থেকে সবাইকে বের করে দেয়। চিত্রা তখনও নিথর হয়ে পড়ে আছে। ফারাজ চিত্রার ঠোঁটের সেই আঘাতে আঙুল ছোঁয়াতে গিয়েও ছোঁয়ায় না। যদি সে ব্যাথা পায়? ফারাজ হাত ধরে চিত্রার। সে এসবের জন্য চিত্রাকে দোষারোপ করে না একবারও। সব দোষ নিয়ে নেয় নিজের কাঁধে। যদি সে ঢাকা না যেত তাহলে কখনই এমন হতো না। তার চিত্রার এত যন্ত্রণা এত আঘাত সহ্য করতে হতো না। সব দোষ তার। ফারাজের চোখের কোণে জল! অবিশ্বাস্য। তার মতো পশু কাঁদছে? পশুদের কি অনুভূতি বলতে কিছু থাকে? ফারাজের মতে খারাপ মানুষের ডাকে সৃষ্টিকর্তা সারা দেয় না। তবুও ফারাজ আজ সৃষ্টিকর্তার কাছে কিছু চায়। তাকে বলতে চায়, ❝তুমি তার সকল ব্যথা বিলিয়ে দাও আমায়,
যে আমায় ভালোবেসে আমার সকল দুঃখ জড়িয়ে ঘুমায়।❞

সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। সাতদিন ধরে মাহাদী ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী মারিয়াকে বন্দি করে রেখেছে সোহান। শুধুই কি বন্দিত্ব? প্রতিদিন সূক্ষ্ম ও নিপুণ নির্যাতনে বিদীর্ণ হচ্ছে তাদের শরীর, ধসে পড়ছে তাদের মন। অথচ মারার হুমকি দিলেও সোহান এখন পর্যন্ত মারা মতো সময় পাচ্ছে না। গোডাউনে অগ্নিকাণ্ড ঘটে গেছে। দাউ দাউ করে জ্বলেছে সব। ছাই হয়ে গেছে কোটি টাকার মালামাল। চারদিকে শোরগোল উঠেছে। সবই নাকি দুর্ঘটনা! সবাই বলছে, ভুলক্রমে আগুন লেগেছে। নিয়তির নির্মম খেলা সব। কিন্তু সোহানের মনে সংশয় দানা বেঁধেছে। এত বছর ধরে এমন দুর্ঘটনার মুখোমুখি তো কখনও হয়নি। না, এটা নিছক দুর্ঘটনা নয়।

এর পেছনে হয়তো কোনো চতুর কৌশল অবলম্বন কারী লুকিয়ে আছে বলেই তার দৃঢ় ধারণা। লোকসানের অঙ্ক মাথার ভেতর ক্রমাগত বিদ্ধ হয়ে চলেছে। লক্ষ, কোটি, কোটি কোটি টাকা। যা ক্ষতি পূরণযোগ্য নয়। এই ক্ষতির রোষে পুড়ে যাচ্ছে সোহান। সেই ক্রোধের নিঃশেষ ঘটছে মাহাদী ও তার স্ত্রীর গায়ে প্রতিদিনের আঘাতে। কেন সে এমন করছে তা সে নিজেও জানে না। হয়তো ব্যথা দেওয়ার মধ্যেই আজ শান্তি খুঁজে নিচ্ছে তার অসুস্থ মন। সোহানের সেই রাতের কথা মনে পড়ে যায়।

সেদিন অঝোর ধারায় ঝরছিল বৃষ্টি। প্রকৃতির ডাকে সারা দিতে সিফাত ছাতা হাতে নৌকা থেকে নেমে গেল জঙ্গলের গা ঘেঁষে। কাজ শেষ করেই যখন ফিরে আসবে, ঠিক তখনই অন্ধকার চিরে আচমকা একটা যুবক তার সঙ্গে ধাক্কা খেল। ছেলেটির চোখে-মুখে আতঙ্ক ছিটিয়ে একাকার। কণ্ঠে অসহায় আবেদন, “একজন লোক আমাকে খুন করার জন্য ধাওয়া করতেছে। দয়া করে সাহায্য করেন!”

সিফাত হতবাক। এমন গভীর রাতে, জঙ্গলের নির্জনে কেউ কারও পেছনে ছুটছে মৃত্যুর উদ্দেশ্যে?অদ্ভুত! সে নাম জানতে চায়। ছেলেটি বলে “মাহাদী! মাহাদী নামক একজন লোক আমাকে মারার জন্য পেছনে লেগেছে।”
নামটি শোনামাত্রই সিফাতের অন্তরে বজ্রপাত হয়। সে বুঝে ফেলে আসল ঘটনা। ভয়ানক সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সে কিছুক্ষণ ভাবে। তখনই ছেলেটি থানায় ফোন করে। ঘটনা লম্বা হোক তা সিফাত চায় না। তাই কোনোমতে বুঝিয়ে ছেলেটিকে নৌকায় নিয়ে আসে। সোহান সব ঘটনা শুনে পুলিশকে অন্যত্র না পাঠিয়ে সরাসরি তাদের কাছে আসতে বলল। পুলিশের সঙ্গে সোহানের সম্পর্ক ভালো। টাকার কৃপার প্রলেপে সব কিছু ধুয়ে-মুছে ফেলে সে। এসবের কোনো দরকার পড়ত না। যদি না মাহাদী সেদিন ভুল করত। রাতে সোহান লোক পাঠায় মাহাদীকে ধরে আনার জন্য। ভাগ্য ভালো জঙ্গলেই খুঁজে পায় ওই তাকে। কাজ আরও সহজ হয়ে যায়। মাহাদী তখন হুশে ছিল না। নেতিয়ে পড়েছিল। সেই রাতে সোহানের আদেশে পৃথিবীকে খুন করে সিফাত। মাহাদীকে পাশেই ফেলে রাখে কিন্তু হুশ ফিরতে ফিরতে সকাল হয়। তারপর আর কি?

সোহান মাথা নিচু করে কাগজপত্র ঘেঁটে চলেছে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে প্রতিটি লাইন, প্রতিটি হিসাব। এমন সময়ে রাজন চুপচাপ এসে তার পাশের চেয়ারে বসে। মাথায় হাত রেখে হঠাৎ বলে ওঠে,”চলো চিত্রাকে মেরে ফেলি।”
এক মুহূর্তেই সোহানের স্নায়ুতে রগরগে আগুন ছুটে যায়। চোখের লাল শিরাগুলো স্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠে। এই রাজন কি সত্যিই তার সঙ্গে এসব কথা বলছে? ওর কি মাথা ঠিক আছে? সোহান দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “আমার চিত্রার বিষয়ে যেন আর কোনোদিন এসব কথা মুখ থ্যাইকা না বের হয় রাজন।”
রাজন ঠান্ডা গলায় জবাব দেয়, “মিয়া রাখো ওই মাইয়া আমাগোরে ধ্বংস করব দেইখো।”
সোহানের কণ্ঠ কঠিন হয়ে ওঠে,

“কি হইছে, খোলাসা কইরা বলো।”
রাজন একটু ঝুঁকে আসে। মুখটা সোহানের কান ঘেঁষে নিয়ে বলে,”ওইদিন নাকি সরাইখানায় গেছিল।”
“কিহ!”সোহান স্তব্ধ হয়ে যায়।
“আরে হ। ওই মাইয়া দুনিয়ার চালাক। আমি ফোনে সরাইখানায় যাওয়ার কথা বলছিলাম ওইটা শুইনা ফেলছে। তার চেয়েও বড় কথা আমি যেই সরাইখানায় গেছি ওই সরাইখানাতেই কেমনে সে গেলো?”
সোহানের চোখ সংকুচিত হয়ে আসে।”দেইখা ফেলছে?”

“না। ওই সরাইখানার মালিক লতার থেকে আমি মোনালিসারে কিন্না ফেলছিলাম। ওইদিন আগে থেকেই সব ব্যবস্থা করা ছিল। খালি মোনালিসারে সরাইখানা থেকে বের কইরা গাড়িতে বসাইছি। ওর জন্য নতুন বাড়ি কিনছি। ওখানে গেছিলাম গা। আমি যাওয়ার পর দিয়াই সম্ভবত চিত্রা ওইখানে গেছে।”
সোহান অবাক, কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এত বড় বিষয় ঘটে গেছে। চিত্রা এমন জায়গায় গিয়ে ঘুরে এসেছে আর সে বিন্দুবিসর্গও জানে না? সে কিছু বলবে তার আগেই রাজন পুনরায় বলে উঠল,
“চিত্রা সবাইরে সন্দেহ করতাছে। আর ওর সন্দেহ আমাগো মরণ ডাইকা আনব। ভাইবা দেখছো সরাইখানায় যদি সত্যি ওইদিন আমি থাকতাম তাইলে ফারাজ নিজ হাতে আমারে খাইয়া ফেলত? ভাই হেয় মানুষ না। চিত্রার প্রেমে কানা হয়ে গেছে। এই চিত্রা কোনদিন আমাগো সব গুলারে মারব। ওর ব্যবস্থা করো জলদি। তুমি না করলে কিন্তু আমি নিজেই করতে বাধ্য হমু।”

সুস্থতার পর চিত্রা তার ভুলের সবচেয়ে বড় যেই শাস্তি পেলো তা ছিল ফারাজের সঙ্গে তার মন-দেহের দূরত্বতা। সে কেবল তার স্পর্শ থেকে নয় বরং তার শব্দ থেকেও নির্বাসিত হয়েছিল। ফারাজ তাকে এত বড় শাস্তি না দিয়ে যদি গালে দু’টো শক্ত চড় বসাতো। মেরে হাড় গুঁড়োকরে দিত তবুও যদি খানিকটা কথা বলত! জীবনের এই পর্যায়ে এসে চিত্রার মনে হচ্ছে কিছু শাস্তি না দিয়েও দেওয়া যায়। কিছু অভিমান প্রকাশ করা লাগে না৷ তারা গোপনে বেদনা ছড়ায়,দুঃখ দিয়ে ভেতর ক্ষয় করে ফেলে। মানুষ ভাবে শাস্তি মানে দাহ। তবে তারা কি জানে কিছু শাস্তি শব্দেরও ঊর্ধ্বে। কিছু দহন চোখে পড়ে না। তবুও তারা স্তব্ধতায় আগুন জ্বালে, একফোঁটা রক্ত না ঝরিয়েও গর্ভে চূর্ণবিচূর্ণতা তৈরি করে। এই যন্ত্রণার কথা না কাউকে বলা যায়,তা কাউকে এর জন্য দোষারোপ করা যায়। ❝প্রিয়জনের আচরণের পরিবর্তন মানুষকে খুন না করেও হত্যার ক্ষমতা রাখে।❞ এটি নীলাভ নৈঃশব্দ্যতা। যেখানে মানুষ প্রলাপ করে না। শুধু সংলাপের গতি থেমে যায়, দৃষ্টিতে জমে ওঠে অপাঠ্যতা। কেউ কাউকে আর ছোঁয় না, কেউ কাউকে আর নাম ধরে ডাকে না। কথাগুলো বরফ হয়ে জমে যায় ঠোঁটের কোণে। আর হৃদয়ের ভেতর জন্ম নেয় অনাদৃত শূন্যতার মহাফসিল। ব্যাস এইটুকুই যথেষ্ট একটি প্রেমকে রক্তাক্ত ছাই করে মাটির নিচে চাপা দেওয়ার জন্য। একটি হৃদয়কে জীবন্ত কবর বানিয়ে তার কালো গোলাপের বাগান করার জন্য।

এই যে বিগত সাতরাতে চিত্রা অনুভব করেছে রাত জেগে কেউ তার পাশে বসে আছে। কেউ মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে। কেউ ভেজা তোয়ালে দিয়ে শরীর মুছে দিয়ে পোশাক বদলে দিচ্ছে। কারো গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া চোখের জল হুট করে চিত্রার গালে এসে পড়েছে। কেবল অনুভবই করতে পেরেছে সে। চোখ মেলার মতো অবস্থাও তার ছিল না। কেমন যেন হয়ে গিয়েছিল সে। সব অনুভব করতে পারছে ঠিকই তবে চোখ মেলে, শরীর নাড়িয়ে দেখার, বলার সাধ্য নেই। যেন সজ্ঞানে অচেতন, চেতনাতেও শিকলবন্দি।অসুস্থতার শেষ পর্যায়ে যখন চিত্রা প্রায় সুস্থ হয়ে উঠেছিল সেই থেকে ফারাজকে চোখের সামনে দেখে নি। অথচ চিত্রা যে মানুষটি রাতের আঁধারে তার নিঃশ্বাস গুনেছে, শরীরের তাপ মেপেছে,অসুস্থতার রাত্রিরে তাকে সুস্থ করার রোগে নিজেই অসুস্থ রোগীর ন্যায় ছটফট করেছে সেই ছায়াসম লোকটি কেবলই তার স্বামী।

চিত্রা মলিন মুখে অভ্রর রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আয়েশা তাকে দেখে জলদি উঠে এসে বলে, “আপা আমাকে একটা কল করতা। সিঁড়ি বেয়ে উপরে আসছো কেন?”
“অভ্র নেই?”
“আছে।”
চিত্রা রুমে গিয়ে বসে। অভ্র তাকে দেখা মাত্রই উঠে দাঁড়ায়। সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কোনো দরকার ছিল ভাবী?”
“আপনার ভাই কোথায়?”
অভ্র দ্বিধায় পরে যায়। “আসলে ভাবী ভাই তো কাজে।”

“সেই ঢাকায় যাওয়ার আগে শেষবার তাকে মন ভরে দেখেছিলাম ভাই। মাঝে দুই-চার হুট করে চোখে চোখ পরলেও কি সব কাজের অজুহাত দিয়ে চলে যায়। তারপর দু’দিন ধরে যে নিখোঁজ হয়েছে এখনও বাড়ি ফিরে নি। আপনি তো তার কাছের লোক। আপনি তো জানেন সে কোথায় আছে? দয়াকরে বলুন ভাই। আমি আর এই দূরত্ব মানতে পারছি না।” চিত্রা ছোট্ট বাচ্চার মতো কান্নায় ছটফট করে। আয়েশা তা সহ্য করতে পারে না। কাছে বসে চিত্রার চোখ মুছিয়ে দিতেই আয়েশাকে জড়িয়ে ধরে চিত্রা। ডুকরে উঠে তার বুক। হাহাকার মিশ্রিত গলায় বলে উঠে,” আয়েশারে আমি আর পারছি না। আমার ফারাজকে ফিরে আসতে বল। তার চিত্রা মরে যাচ্ছে তার শূন্যতায়। তার কাছে নিয়া চল আমায়।”

অভ্র শ্বাস নেয়। কষ্ট তারও হচ্ছে। ওদিকে ওই মানুষটা তার নিজের দোষ ভেবে নিজেকে সবচেয়ে বড় শাস্তি দিচ্ছে। সেই শাস্তি হচ্ছে তার চিত্রার থেকে দূরত্ব বজায় রাখা। আর এদিকে এই মানুষটা সেই দূরত্বকে নিজের শাস্তি ভেবে ডুকরে উঠছে। চিত্ররাজ নিজেদের থেকে দূরে সরে নিজেদের প্রেমদহনেই পুড়ে মরছে। অনেক হয়েছে এবার অভ্র চিত্ররাজের মিলন চায়। আর দূরত্ব নয়। ফারাজকে সে নিজেই আজকে বাড়ি ফিরিয়ে আনবে৷ আনবেই। সে তার ভাইকে এভাবে আর ধুঁকে ধুঁকে মরতে দেখতে পাবে না। অনেক দিয়েছে সে নিজেকে শাস্তি আর নয়।

চিত্রা এখন পুরোপুরি সুস্থ। তবুও সেই ঘটনার পর চিত্রা কখনও হাসে নি সে । ফারাজ পাসপোর্ট তৈরি করতে দিয়েছে। জলদি ডেনমার্ক ফিরবে। চিত্রাও সঙ্গে যাচ্ছে। তারপর কবে ফিরবে জানা নেই। সেই ঘটনার পর থেকে ফারাজ চিত্রার কাছে এখনও আসে নি। এই যে কতদিন হলো চিত্রা সুস্থ হয়েছে তবুও ফারাজ সেই অসভ্য কথাবার্তা মুখ থেকে বের করে নি। রাত হলে এখনও কাজের অজুহাতে রুমে আসে না। কাজের কথা বলে স্টাডি রুমেই থাকে। চিত্রা জানে ভুল তারই। এই ভুলের ক্ষমা হয় না। ওইদিন রাজন ভাইকে সে সরাইখানায় পায় নি। নিশ্চয়ই আবারও ভুল বুঝেছিল? ভুল বুঝাবুঝি কত্ত খারাপ জিনিস তা এখন সে হারে হারে টের পাচ্ছে চিত্রা। সে নিজেকে নিজে কথা দিয়েছে। আর কখনও কোনো বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাবে না সে। ভালো শিক্ষা হয়েছে। তবে শুনেছে ফারাজ নাকি পুলিশকে খবর করে ওই মহিলাকে ধরিয়ে দিয়েছে আর মেয়েগুলোও মুক্তি পেয়েছে। তার স্বামী আসলেই একজন নম্র-ভদ্র মানুষ। রাত হয়েছে। চিত্রা তাকের বইগুলো গুচ্ছাছিল। এমন সময় রুমে বজ্র আসে। চিত্রা তাকে দেখে বসতে বলে। বজ্র দাঁড়িয়েই চিত্রাকে জিজ্ঞেস করে, “শরীর কেমন লাগছে?”

চিত্রা শান্ত গলায় বলল,”ভালো।” চিত্রা খানিকক্ষণ চুপ থেকে আবার বলল, “ফারাজ কি আজকে রাতেও আসবে না?”
বজ্র দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল,”ওকে একটু সময় দাও। আসলে তোমার সেদিন না বলে ওইখানে যাওয়া উচিত হয় নি। এক মুহুর্ত দেরি হলে কি হতো ভেবে দেখেছো? ভাগ্যিস আমি বাঁচাতে গিয়েছিলাম। যদি আমার বদলে সত্যি সত্যি অন্য কোনো নোংরা পুরুষ নোংরা ভাবে তোমায় স্পর্শ করত?”
চিত্রা হঠাৎ ঠোঁট চেপে বলল,”থামুন ভাই। আমি ওইসব থেকে এবার বাহিরে আসতে চাই। আর মনে করিয়ে মনকে মারতে চাই না।”

বজ্র একটু বিব্রত হয়ে মাথা নিচু করল। তারপর ধীরে বলল,” আচ্ছা,বেশ তবে। চলুন অন্য কিছু বলা যাক। জানেন আমাদের কায়সার বংশের মানুষকে জনগণ এখনও ভয় পায়। কারন একটাই কায়সাররা আগে ডাকাতি করত। ডাকাতি কিন্তু অনেকভাবেই করা যায়। তবে অন্য সব জায়গায় যেমন ছেলে মেয়েকে আলাদা চোখে দেখা হয় আমাদের বংশে তেমনটা হয় না। এই বংশের মেয়েদের মুখের আগে হাতের ছুড়ি চলে। আর সবচেয়ে বড় বিষয় তারা একবার সেখানে চোখ ফেলে তা নিজের করে তবেই ছাড়ে। উদ্দেশ্য পূরণে তাদের জুড়ি নেই। ”
চিত্রা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,”খুনী বংশ নাকি?”

বজ্র হেসে ফেলল,” আরে উঁহু উদাহরণ দিলাম মাত্র।”
“আপনি কি বুঝাতে চাইছেন?”চিত্রা সন্দিগ্ধ কণ্ঠে প্রশ্ন করল।
“কিছুই না। তবে বলছিলাম কি আমিও তো ওই বংশেরই ছেলে। আর…”
চিত্রা সোজা তাকিয়ে বলল,”আর কিছুই না। এসব আমাকে শুনাচ্ছেন কেনো?
বজ্র নরম গলায় বলল,”মন চাইলো তাই। আচ্ছা আপনি তো নিজেকে বাঁচাতে পারতেনই ওইদিন। ওই মহিলাদের সামনে নিজেকে হারিয়ে দিলেন কেন?
চিত্রা হাসল। বলল,”হেরে যদি উদ্দেশ্য পূরণ হয় তাহলে জিতে লাভ কী বলুন বজ্র কায়সার?”

ফারাজ অন্ধকার রুমের মধ্যে কারো কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। মেয়েলি একটা হাত তাঁর চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। হঠাৎ সেই হাতের মালিক নরম গলায় বলল,
“রাত হয়েছে? বাড়ি ফিরবে না?”
ফারাজ চোখ না খুলেই জবাব দিল,”তোমার কাছে থাকলে তোমার অসুবিধা হবে বুঝি?”
“তা বলেছে কি?” তোমার বউ বাড়িতে অপেক্ষা করছে আর তুমি কিনা আমার কাছে পরে আছো।”
ফারাজ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, “বউতো আমায় বোঝেনা। তুমি তো বোঝো। আজকে রাতটা তোমার কাছে থাকতে দাও মণি।”

মণি আদুরে দৃষ্টিতে ফারাজের কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল, “আমার থেকেও বেশি ভালোবাসো বউকে?”
ফারাজ চোখ মেলে তাকায় না, শুধু বলে,”বাসিতো। কেনো তোমার হিংসে হয়?”
মণি চোখ মুচড়ে হাসে,”খুব হয়।”
“যাও তোমাকে একটু বেশি ভালোবাসা দিব। তুমি বদলে আমার দুঃখ ভুলিয়ে দাও।”
“দুঃখ পেলেই তো আমার কথা মনে পরে তোমার। আমার কাছে আসো। তাছাড়া তোমার জীবনে মণির অস্তিত্ব আর কই?এখন তো আবার সতীন এনেছো আমার। শুনো ফারাজ সতীন হিসেবে কিন্তু আমি বেশ ঝগড়ুটে। তোমার বউ পারবে তো আমার সঙ্গে?”

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৫৩

“আরে বড় বউ তোমার সেবাযত্নের জন্যই তো বিয়ে করলাম। এত ঝগড়ুটে হতে নেই বড় বউদের।”
ফারাজ মণির কোলে মাথা রেখেই ছোট্ট বাচ্চাটির মতো চোখ বুজল। মণি মৃদু হাসল। বলল, “একটা গল্প শুনবে?”
ফারাজ মৃদু কন্ঠে হু বলল কেবল। সে শুনতে চায়। রাত গাঢ় হচ্ছে। আচ্ছা ফারাজকে ছাড়া আরেকটা রাত কাটাতে কি তার চিত্রার অনেক কষ্ট হবে? সে কি একটা ভেবে মণিকে বলল, “গল্পটা জলদি শুনাও। বাড়ি ফিরতে হবে। বউকে অনেক মনে পরছে। তাকে জড়িয়ে ধরে রাতটা ফুরিয়ে দিতে চাই।”

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৫৪ (২)