চেকমেট পর্ব ২৮

চেকমেট পর্ব ২৮
সারিকা হোসাইন

থমথমে উত্তপ্ত ভ্যাপসা গুমোট গভীর রাত।ঘড়িতে সময় কত তা জানা নেই।দূর থেকে রাস্তার বেনামি কুকুরের মিহি ঘেউ ঘেউ ধ্বনি ভেসে আসছে।উত্তপ্ত গরম বাতাস গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট সেই সাথে ঝি ঝি পোকার এক নাগাড়ে ডেকে চলা মেজাজ বিক্ষিপ্ত করে দিচ্ছে।
এহেন অস্থির প্রকৃতির খেলায় শহরের জনমানব হীন নিস্তব্ধ হাইওয়ের অন্ধকার বাঁকে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রয়েছে দুজন মানব।আশ পাশে ল্যাম্পপোস্টের খুঁটি না থাকায় পথটা ঠিক সেভাবে আলোকিত হয়নি।অদূরের সোডিয়াম লাইটের কেঁপে উঠা টিমটিমে আলো অন্ধকার টাকে আরেকটু গভীর করলো।কিন্তু বিলাস বহুল দামি গাড়ির হেড লাইটের চকচকে আলো পথের বাঁকের অন্ধকার টুকু গিলে নিলো।

সুদর্শন পুরুষ দুটো দুজন দুজনের কপালে নিজেদের গান তাক করে রেখেছে।ট্রিগার চাপলেই দুজনের খেলাই সাঙ্গ হবে নিমিষেই।মানুষ দুটো দুজনেই দুজনের চোখ গভীর দৃষ্টিতে পরখ করে চলেছে।যেনো সমস্ত কথা চোখে চোখেই হচ্ছে।স্বচ্ছ নীলচে ক্রোধের আগুন মিশ্রিত চোখ।কি ভয়ানক হুমকি সেগুলোতে!
“যেচে পরে মরতে এসেছিস?
কথাটি বলেই বাঁকা হাসলো রুদ্ররাজ।রুদ্ররাজ এর হাসি দেখে তাচ্ছিল্য হেসে ঠোঁটের কোণের রক্ত মুছলো সারফরাজ।এরপর বলে উঠলো
“মনে হচ্ছে ওপাড়ে যাবার খুব তাগাদা তোর।আর রাস্তাটা কারো বাপের নয়।কে যেচে পরে মরতে এসেছে সেটা সময়ই বলে দেবে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সারফরাজ এর কথায় রুদ্রের তীক্ষ্ণ চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো সেই সাথে দাঁত পিষে ট্রিগার চাপতে চাইলো।সারফরাজ তাচ্চিল্য হেসে পলক হীন দৃষ্টিতে বলে উঠলো
“আমার মরন তোর হাতে হবে না রুদ্র।আমি আমার জীবন অলরেডি অন্য একজনের কাছে সপে দিয়েছি।সে ছাড়া বিশ্বভ্ৰম্মান্ডের আর কারো শক্তি নেই আমাকে শেষ করার।সে তুই হোস আর যেই হোক।
সারফরাজ এর বড় বড় কথায় রুদ্র তার চিরবিড়িয়ে উঠা রাগ কোন ভাবেই যেনো নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।এদিকে গাড়িতে বসে বসে অভিরূপ ভেবে চলেছে কিছুক্ষন আগের কথা।

খুশি মনে বাসা থেকে বেরিয়ে পরে সারফরাজ আর অভিরূপ।উদ্দেশ্য ছিলো আমজাদ হায়দার এর বাড়িতে যাবার।সাদা গোলাপ রূপকথার ভারী পছন্দ।গুনে গুনে একশত একটি সাদা গোলাপ কিনেছে সারফরাজ সেই সাথে রূপকথার পছন্দের চকলেট।যাত্রা পথে গুগল ম্যাপে ভয়ানক জ্যাম দেখে শর্টকাট গলির পথ ধরে সারফরাজ।কিন্তু হুট করে হাইওয়ের অদূরে গলির বাঁকে পথ আগলে দাঁড়ায় রুদ্রের গাড়ি।ঘটনাটা কাকতলীয় কিনা অভিরূপ জানেনা।সারফরাজ কে দেখেই রুদ্রের চোখ জোড়া জ্বলে উঠে ।নিজের অসামান্য ক্রোধ সংবরন না করে গাড়ি থেকে নেমে আসে রুদ্র।রুদ্রের চেহারা দেখা মাত্র পিটুইটারী গ্রন্থিতে রক্ত ছলকে উঠে সারফরাজ এর।অভিরূপকে গাড়িতে বসিয়ে কোমরে বন্দুক গুঁজে চোয়াল শক্ত করে চোখে ঠান্ডা আগুন জ্বালিয়ে নেমে যায় সারফরাজ।মুখোমুখি দাঁড়ায় দুই নির্দয় পশুতুল্য মানব।কে কার থেকে অধিক হিংস্র তার প্রমান দিতে শুরু হয় কথা হীন হাতাহাতি।যেনো সিংহে সিংহে মারামারি।কেউ কারো কাছে পরাজয় মানতে নারাজ।ঘুষি ,কিল, লাথি পাল্টাপাল্টি আঘাতে দুজনেই হয় রক্তাক্ত।শেষমেশ নিজেদের চূড়ান্ত নির্দয়তার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে দুজনেই বের করে আনে প্রাণঘাতী বন্দুক।তাক করে দুজন দুজনের কপালে।এরপর শুরু হয় কথার মার প্যাচ আর চোখে চোখে লড়াই।
এহেন অপ্রীতিকর ঘটনায় অভিরূপ যেনো স্তব্ধ নির্বাক।এই মুহূর্তে তার উচিত মধ্যস্থ হিসেবে দুজনের ঝগড়ার সমাপ্তি টানা।কিন্তু কেউ কি মানবে তার বুঝ দেওয়া কথা?

“আমার বারে আগুন জ্বালিয়ে ভাবছিস তুই জিতে গিয়েছিস?আমার সাথে টক্কর দিয়ে জিতে যাওয়া এতই সহজ?
বলেই ক্ষোভ জড়িত হাসলো রুদ্ররাজ।সেই হাসির পানে তাকিয়ে সারফরাজ চোখে ক্রোধ ঢেলে বললো
“অবশ্যই আমি জিতেছি মামাতো।তোর অহংকার, দম্ভ,অন্ধকার মিশ্রিত পাপ আর স্বপ্ন পুরোটাই আমি জ্বালিয়ে দিয়েছি।ভেবেছিলাম তোকে চমকে দেবো।কিন্তু আফসোস খুব দ্রুত জেনে গেলি এর পেছনে আমি আছি।কোনো ব্যাপার না।আই লাইক ইট।
কজ আই নো ইউ আর ব্রিলিয়ান্ট ডক্টর রুদ্ররাজ চৌধুরী।
বলেই ঠান্ডা চোখে নিস্পলক তাকিয়ে রইলো সারফরাজ।
সারফরাজ এর ভীতি হীন হেঁয়ালি রুদ্রের কপালের নীলচে শিরা ফুলিয়ে তুললো।লালচে ঠোঁট জোড়া ধারালো দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে রুদ্র হিসহিস করে বলে উঠলো

“তুই তো আমার ইট,কাঠ,সিমেন্ট এর তৈরি স্বপ্ন পুড়িয়েছিস।কিন্তু আমি কি করবো জানিস?তোর প্রতিটি শিরায় শিরায় আগুন ধরাবো।তোর নতুন করে চারাগাছ এর ন্যয় বেড়ে উঠা স্বপ্নকে পোড়াবো।কারন আমিও পুড়িয়ে ছাই বানাতে জানি ফুপাতো।
কথাটি বলে চোখের কোন বেয়ে গড়িয়ে পড়া রক্ত হাতের উল্টো পিঠে মুছে পুনরায় সারফরাজ এর পানে কঠিন দৃষ্টি তাক করলো রুদ্র।
রুদ্রের হুমকিতে সারফরাজ হো হো শব্দে হেসে উঠলো।সেই হাসি ফাঁকা রাস্তায় কেমন গা ছমছমে অনুভুতির সৃষ্টি করলো।কোনো মতে নিজের হাসি দমিয়ে সারফরাজ ভারী গলায় বলে উঠলো
“শিরায় আগুন লাগাতে আসিস।দেখিয়ে দেবো আমি কি চিজ।সুবহান গং এর বংশ নির্বংশ করে দেবো।তোদের ভিটে তে ঘুঘু চড়বে।সন্ধে আলো দেবার মতো কেউ অবশিষ্ট থাকবে না তোদের বংশে ।বুঝেছিস?যেমন করে আমার বাপ শুইয়ে দিয়েছিলো তোর বাপ কে।

রুদ্র সারফরাজ এর মুখে নিজের বাপ সম্পর্কে ধৃষ্টতাপূর্ণ কথা আর সইতে পারলো না।কোনো বাছবিচার না করে টিপে ধরলো সারফরাজ এর গলা।মুহুর্তেই সৃষ্টি হলো অনাকাঙ্ক্ষিত এক পরিস্থিতি।নিজেদের লিমিট ভুলে গেলো দুজনেই।রুদ্র যেমন বনো ওল সারফরাজ তেমন বাঘা তেঁতুল।রুদ্রের থাবা থেকে নিজেকে চট করে ছাড়িয়ে শক্ত হাতে এক ঘুষি বসিয়ে দিলো রুদ্রের মুখ বরাবর।ঘুষির তোড়ে কে টে গেলো রুদ্রের আকর্ষণীয় লাল ঠোঁট জোড়া।ব্যাথায় ঠোঁট চেপে ছিটকে সরে গেলো রুদ্র।এরপর বন্দুক চালিয়ে দিলো সারফরাজ এর উপর।বিকট শব্দে বেরিয়ে এলো গুলি।চতুর তীক্ষ্ণ বুদ্ধির সারফরাজ নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টা করলো।কিন্তু আগুন সম উত্তপ্ত গুলি ছুঁয়ে গেলো সারফরাজ এর বাইসেপ মাসেল।গায়ের কালো শার্ট ভেদ করে চামড়া সমেত মাংস পুড়িয়ে ওপাড় হলো গুলি।মুহূর্তেই ফিনকি দিয়ে ছুটলো রক্ত ধারা।অভিরূপ আর গাড়িতে বসে থাকতে পারলো না।দৌড়ে সারফরাজ এর কাছে এসে উদ্বিগ্ন হয়ে বলে উঠলো

“বাড়ি ফিরে চল সারফরাজ।নিজেদের মধ্যে এমন ঝামেলা পাকানো ঠিক হচ্ছে না।।
সারফরাজ অভিরূপ কে ধমকে বলে উঠলো
“ভেতরে বস অভি।ওকে আমি জাস্ট খেয়ে ফেলবো এখন।
বলেই অভিকে ধাক্কা মেরে ফেলে রুদ্রের সামনে এগিয়ে নিজের বন্দুকের স্প্রিং টেনে তাক করলো সারফরাজ।এরপর গর্জে বলে উঠলো
“I will kill you bustard…You messed with the wrong animal and now you are going to see the monster I really am.
সারফরাজ এর হুমকিতে রুদ্র নিজেও বন্দুক তাক করে পুনরায় শুট করলো।কিন্তু গুলি বের হলো না।এবার ঘাবড়ে গেলো রুদ্র।কিটকিটিয়ে হেসে উঠলো সারফরাজ।
“এতো তাড়াতাড়ি দম শেষ?চালা গুলি ।দেখি তোর বন্দুকের কতো জোর!
বলেই হিংস্র বাজ পাখির ন্যয় রুদ্রের চোয়াল চেপে ধরলো সারফরাজ।এরপর চোখে চোখ রেখে হিসহিস করে ভয়ানক গলায় বলে উঠলো
“পবিত্র মানুষের কাছে যাচ্ছি।একদম সাফসুত্রা উপস্থিত হতে চেয়ে ছিলাম ।কিন্তু রক্তের দাগ লাগিয়ে অপবিত্র করলি আমাকে।মোড ভালো ।তাই ছেড়ে দিচ্ছি তোকে।নেক্সট টাইম পেলে ওখানেই পুঁতে দিয়ে চলে যাবো।বুঝেছিস কি বলেছি?

সারফরাজ এর কথায় রুদ্র দাঁত মুখ কামড়ে বলে উঠে
“গেম অলরেডি শুরু হয়ে গেছে সারফরাজ।এই খেলার সমাপ্তি আমি তোর রক্ত দিয়েই টানবো।
রুদ্রের কথায় অবিশ্বাস্য চোখে সারফরাজ শুধায়
“ওহ মাই গড!রিয়েলি?তোর বার পুড়িয়েছি এটা তো একটা ট্রেইলার ছিলো মাত্র।যেদিন তোর আত্মাটা এভাবে পোড়াবো সেদিন হবে এই গেমের দ্যা এন্ড।আর এই খেলার সমাপ্তি আমার হাতেই হবে।তোর হাতে নয়।তোর যম হয়ে তোর সামনে দাঁড়াবে আমি।মৃত্যু ভয় কতোটা নির্মম আর কষ্ট দায়ক হয় তোকে আমি হাড়ে হাড়ে বোঝাবো।
কথাটি বলেই হনহন করে গাড়িতে উঠে বসলো।এরপর স্টিয়ারিং হুইল ধরে ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে ক্ল্যাচে চেপে ধরলো।রুদ্র তখনো সামনে দাঁড়িয়ে।সারফরাজ বাঁকা হেসে স্পিড বাড়িয়ে সামনে অগ্রসর হতেই রুদ্র লাফিয়ে রাস্তা ছাড়লো।
সেই দৃশ্যে তাচ্ছিল্য হেসে সারফরাজ বিড়বিড় করে বলে উঠলো

“এসেছে আমার স্বপ্ন পোড়াতে।স্কাউ ন ড্রেল কোথাকার।
সারফরাজ এর রক্তাক্ত হাত আর মুখের পানে তাকিয়ে অভিরূপ বলে উঠলো
“বাড়ি ফিরে চল সারফরাজ।তোর রেস্ট প্রয়োজন।শরীরের অবস্থাও যথেষ্ট খারাপ।ড্রেসিং করে ব্যান্ডেজ লাগানো জরুরি।
সারফরাজ অভিরূপ এর কথার প্রত্যুত্তরে মাথা ঝাকিয়ে জবাব দিলো
“রূপকথা অপেক্ষা করছে আমার জন্য।আমি যদি মরেও যাই আমার লাশ ওর সামনে যাবে।কারন আমি ওকে কথা দিয়েছি।
“সারফরাজ তোর হাত থেকে ব্লিডিং হচ্ছে অনবরত।এভাবে চলতে থাকলে তুই জ্ঞান হারাবী।জীবনের চাইতে কথা রাখা কি বেশী ইম্পরট্যান্ট?

গাড়ির স্পিড আরো কয়েক গুণ বাড়িয়ে দুর্বল গলায় সারফরাজ জবাব দিলো
“আমি না গেলে ও কাঁদবে অভি।আমি চাইনা ও আমার অপেক্ষায় কাঁদুক।কারণ ওর চোখের এক ফোটা জল আমার জীবনের চাইতেও দামী।
“তুই ওকে ফোন করে বল এই ঝামেলার কথা।বোঝদার মেয়ে।অবশ্যই বুঝবে।
শুনলো না সারফরাজ।সে ধীর গলায় বললো
“বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আমার জন্য সে অপেক্ষা করছে অভি।তার অপেক্ষা আমি বিফলে যেতে দিই কি করে?তাছাড়া ওকে প্রমিস করেছি আমি যাবো।আমি চাইনা ওর মনে কখনো এমন ভাবনার উদয় হোক যে ,সারফরাজ কথা রাখেনি।এমনিতেই এক যুগের অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটেছে কেবল।
অভিরূপ ফাঁকা দৃষ্টিতে সারফরাজ এর পানে তাকিয়ে বলল
“যদি মরে যাস ব্লিডিং হতে হতে?
সারফরাজ ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা টেনে উত্তর করলো
“তাহলে ও জানবে শেষ নিঃশ্বাস অবধি আমি ওর কাছেই আসার চেষ্টা করেছি।এবং আমার দম ফুরিয়েছে ওকে এক পলক দেখার পিপাসায়।”

মেঝেতে বসে বিছানায় হেলান দিয়ে হাটু ভাঁজ করে বসে আছে রূপকথা।চোখের দু’কূল বেয়ে অনবরত ঝরে পড়ছে নোনতা জলের ফোয়ারা।হাত বাড়িয়ে সেগুলো মুছলো না রূপকথা।অবলীলায় নিঃশব্দে ঝরতে দিলো তাদের।সারফরাজ এর উপর অভিমান এর পাহাড় জমলো খুব করে।মানুষটার কঠিন মুখশ্রী মনে পড়তেই হৃদয় কেমন ধক করে উঠলো।দেয়াল ঘড়ির দিকে আরেকবার নজর বুলিয়ে রূপকথা সিক্ত গলায় বলে উঠলো
“যখন আসবেই না তবে প্রতিশ্রুতি কেনো দিলে?
ভেতর থেকে উত্তর আসে

“মানুষটাকে তুই ই জোর করে চলেছিস সব সময়।সে নিজে থেকে তোর কাছে আসেনি রূপকথা।
প্রতিবাদ করে চিৎকার করে উঠে রূপকথা।হাতের আজলায় মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে বলে উঠে
“সব মিথ্যে,ও এসেছিলো।আমাকে বুকে জড়িয়ে হৃদয়ের আগুন নিভিয়েছে।আমি এক তরফা ওকে ডাকিনি।
ভেতর থেকে আর কোনো কথা আসে না।বড় বড় স্বচ্ছ নেত্র দ্বয় কেমন ঘোলাটে লাল হয়ে উঠে।বাঁকানো ল্যাস গুলো ভিজে জট পাকায়।ফুলে উঠে চোখের পাতা।
হাতের কাঁচের মুঠ চুড়ি গুলোর পানে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয় রূপকথা।এরপর আলগোছে তা খোলে নেয় সরু হাত থেকে।মেঝেতে অযত্নে সেগুলো ফেলে উঠে দাঁড়ায়।পোশাক পরিবর্তন করা জরুরি।
রূপকথা উঠে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।কিছুক্ষন আগের মোহনীয় সাজ নষ্ট হয়ে গেছে।কাজল লেপ্টে পুরো চোখ ছেয়ে গেছে।লিপস্টিক টাও খানিক উঠে গিয়েছে।গোছানো চুল হয়েছে আলুথালু।অভিমানের খাতায় সারফরাজ এর নিষ্ঠুরতা নিয়ে কয়েকটা লাইন লিখে মুখ মুছে নিলো রূপকথা।
এরপর ফুঁপিয়ে বলে উঠলো

“আর কখনো তোমায় ডাকবো না সারফরাজ।সত্যিই তুমি বড্ড নিষ্ঠুর মানব।
রূপকথা শাড়ি খুলতে উদ্দ্যত হতেই বেজে উঠলো গাড়ির হর্ন।
গাড়ির হর্ন শুনে থেমে গেলো রূপকথার হাত।অসাড় শক্তিহীন মূর্তির ন্যয় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো ড্রেসিং টেবিলের সামনে ।শুষ্ক অধর জোড়া ঈষৎ ফাঁকা হয়ে তপ্ত কম্পিত শ্বাস বেরিয়ে এলো।দৃষ্টি হলো আরো ছলছলে।

খোলা বেলকনি দিয়ে রূপকথার কক্ষের ঝকমকে আলো দেখতে পেলো সারফরাজ।গাড়ির হর্ন পেয়েও রূপকথা বেলকনিতে এলো না মানেই সারফরাজ বুঝে নিলো অভিমান জমে জমে মেঘ হয়েছে।গাড়ি থেকে নেমে সারফরাজ উঁচু গলায় ডাকলো
“রূপকথা!
এবারও একটুও নড়লো না রূপকথা।সে ওভাবেই শাড়ি খামচে ধরে দাঁড়িয়ে রইলো।
ফোনের স্ক্রিনে সময়ে নজর বুলিয়ে অভিরূপ এর উদ্দেশ্যে সারফরাজ বলে উঠলো
“বড্ড অভিমানিনি বুঝলি।উপরে যেতে হবে রাগ ভাঙাতে।
বলেই আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করলো না সারফরাজ।একহাতে ফুলের বিশাল গোছা বুকে চেপে পূর্বের ন্যয় গাছ বেয়ে তরতর করে উঠে গেলো দুতলায়।অভিরূপ বোকা চোখে পুরো ঘটনা দেখে কপাল চাপড়ে বলে উঠে
“কি মানুষ কি করে বেড়াচ্ছে।আহহা!

এধারে মাথা নিচু করে ফুঁপিয়ে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে রূপকথা।কান্নার হিড়িকে ছোট দেহ খানা কেঁপে কেঁপে উঠছে শুধু।বেলকনিতে দাঁড়িয়ে পুরো ঘটনা অবলোকন করলো সারফরাজ।এরপর আলগোছে বেলকনির দরজা লাগিয়ে পেছন থেকে রূপকথার লতানো কোমর জড়িয়ে চিকন পাতলা কাঁধে থুতনি রাখলো সারফরাজ।তরপর অপরাধীর স্বরে বলে উঠলো
“সরি।ইচ্ছে করে দেরি করিনি।
আকস্মিক পুরুষালি স্পর্শে আর কন্ঠে বরফ খণ্ডের ন্যয় জমে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো রূপকথা।সারফরাজ এর উষ্ণ দেহের স্পর্শে মোমের মতো গলে যেতে ইচ্ছে করছে রূপকথার।কিন্তু নিজেকে কঠিন বাঁধনে বেঁধে নিভু গলায় বলে উঠলো
“চলে যাও সারফরাজ।
রূপকথার এহেন নিঠুর শব্দে আরেকটু বাধন শক্ত করলো সারফরাজ।এরপর রূপকথাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বলে উঠলো
“বললাম তো ইচ্ছে করে দেরি করিনি।

রূপকথা এবার অল্প চোখ তুলে সারফরাজ কে দেখলো।মুহূর্তেই সকল অভিমান কেমন গলে গেলো।সারফরাজ এর ঠোঁটের কোণে এখনো রক্ত জমাট জখম ।ভ্রুর কাছেও বেশ খানিক কেটে গিয়েছে।নাকের উপর লম্বালম্বি কাটা দাগ।গায়ের পোশাক এলোমেলো সেই সাথে বাইসেপ মাসেল এর কাছের ছেড়া শার্ট সমেত রক্ত।
সারাফরাজ এর এহেন ভয়ানক অবয়বে রূপকথা ব্যতিব্যস্ত হয়ে ভেজা গলায় সুধালো
“এক্সিডেন্ট করেছো?নাকি মা রা মা রি?
বলেই সারফরাজ কে উল্টেপাল্টে দেখলো রূপকথা।এরপর ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে দ্রুত টিস্যু নিয়ে সারফরাজ এর ঠোঁটের কোণে চেপে ধরে নীলচে চোখে চোখ রাখলো।

রূপকথার এলোমেলো সৌন্দর্যে লাগাম হীন হলো সারফরাজ এর চিন্তাভাবনা।সব কেমন গুলিয়ে যেতে চাইলো।ফর্সা দেহে কালো শাড়ি,খোলা চুল ,এলোমেলো রূপ সব কিছু কেমন নেশা ধরালো সারফরাজ এর ভয়ানক চোখে।ধীরে ধীরে দৃষ্টি জোড়ায় কেমন ঘোর লেগে গেলো।শক্ত হাতে রূপকথার হাত চেপে ধরে কম্পিত শুস্ক ঠোঁটের পানে তেড়ে এলো সারফরাজ।সারফরাজ কে দেখে চোখ খিচে বন্ধ করে উরুর কাছের শাড়ি খামচে ধরলো রূপকথা।রূপকথার বেকাবু অবস্থায় মুহূর্তেই থেমে গিয়ে নিজেকে সামলে নিলো সারফরাজ।এরপর হাস্কী গলায় বলে উঠলো
“নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের আগ্রহ বেশী।ভুল হয়ে গেছে।ক্ষমা করো আমায়।
বলেই দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ালো সারফরাজ।সারফরাজ কে আগাগোড়া পরখ করে কোমরে আঁচল গুঁজলো রূপকথা।না চাইতেও ফর্সা উন্মুক্ত মেদহীন উদরে নজর আটকালো সারফরাজ এর।নিজের ধৈর্যের চূড়ান্ত পরীক্ষা দিয়ে ঠাঁয় শক্ত হয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো সারফরাজ।
কাবার্ড থেকে মেডিকিট বক্স নিয়ে সারফরাজ এর সামনে দাঁড়ালো রূপকথা।এরপর মিহি গলায় বিছানা নির্দেশ করে বললো

“বসো ওখানটায়।
বাধ্য বাচ্চার ন্যয় সারফরাজ বিনা বাক্যে বসে গেলো।
টেবিলের উপর থেকে চুলের কাটা তুলে দাঁত দিয়ে আলতো করে আকড়ে ধরলো রূপকথা।এরপর এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে সুন্দর করে আটকে নিলো।
রূপকথার চুল বাধার দৃশ্যে গলা শুকিয়ে উঠলো সারফরাজ এর।ফাঁকা ঢোক গিলে গলা ভিজানোর প্রয়াস চালালো সে।সেই সাথে চলতে লাগলো এডাম অ্যাপলের ক্রমাগত উঠানামা।
চুল গুছিয়ে মেডিকিট বক্স থেকে একে একে বের করে আনলো ডেটল,তুলো,পোভিসেপ ওয়েন্টমেন্ট আর গজ।এরপর সযত্নে তুলো তে ডেটল লাগিয়ে সারফরাজ এর ক্ষত পরিষ্কার করলো রূপকথা।ব্যাথায় চোখ খিচে হাত মুঠিবদ্ধ করলো সারফরাজ

ঘর ভর্তি নীরবতা।কেউ কোনো শব্দ পর্যন্ত করলো না।শুধু সারফরাজ এর ভারি শ্বাস মাঝে মাঝে নীরবতার ছন্দ পতন করছে।রূপকথা চোখে জল নিয়ে সারফরাজ এর হাতে ব্যান্ডেজ বাড়ছে।এমন সময় নিজেকে আর ধরে রাখতে না পেরে রূপকথার ধবধবে ফর্সা নেশা ধরানো উদরে চেপে ধরলো সারফরাজ।অস্থির শিহরনে কেঁপে উঠলো রূপকথা।নিজেকে সামান্য ধাতস্থ করে রূপকথা আমতা আমতা করে বললো
” কি করছো তুমি? তোমার তো ব্যথায় কুঁকড়ে যাওয়ার কথা, আর তুমি!
রূপকথার লাজুক মুখের পানে তাকিয়ে সারফরাজ অল্প দুস্টু হেসে জবাব দেয়
“তুমি যখন এতো করে ডাক্তারের মতো যত্ন করছো তখন ব্যথা আর কোথায় লাগে বলো?
রূপকথা মুখ ভার করে চোখ নামিয়ে হাত পরখ করে বলে উঠলো

“গভীর ক্ষত হয়েছে এখানে।বড় ডক্টর দেখাতে হবে সেই সাথে মেডিসিন নিতে হবে।
সারফরাজ রূপকথার পানে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে জবাব দিলো
“সামান্য ক্ষত এটা রূপকথা।তোমার চোখের জল দেখার পর বুকের বাঁ পাশে যেই গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে তার তুলনায় এটা কিছুই নয়।
বলেই এক ঝটকায় রূপকথাকে নিজের কোলে বসালো সারফরাজ।এরপর রূপকথার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে উঠলো
“শরীরের চিকিৎসা বাদ দিয়ে আমার মনের চিকিৎসার দায়িত্ব নেবে রূপকথা?
রূপকথা ভীরু চোখে সারফরাজ এর পানে দৃষ্টি মেললো।সারফরাজ এর চোখ জোড়া অনেক কথা বলছে যেনো রূপকথাকে।রূপকথা সব গুলোই বুঝলো বোধ হয়।সে সরু চিকন আঙ্গুলি দিয়ে সারফরাজ এর নাকে আঁকিবুকি করে বলে উঠলো

চেকমেট পর্ব ২৭

“নেবো।
সারফরাজ অল্প হেসে রূপকথার চুল চেপে ধরে নিজের একদম মুখোমুখি এনে রূপকথার নেশা ধরানো ঠোঁটের কোণে চুমু আকলো ছোট করে।সারফরাজ এর স্পর্শে সারফরাজ এর শার্ট এর কলার খামচে ধরে চোখ বুজে ফেললো রূপকথা।সারফরাজ পরিতৃপ্তির হাসি হাসলো শব্দ করে।এরপর হাস্কী স্বরে বললো
“স্ট্যাম্প মেরে দিয়ে গেলাম।আজ থেকে আমার একান্ত ব্যাক্তিগত ডাক্তার তুমি।আমার এপোয়েন্টমেন্ট ছাড়া আর কারো এপোয়েন্টমেন্ট গ্রহণ করলে ওইদিন ই হবে তোমার জীবনের শেষ নিঃশ্বাস নেওয়া এই সুন্দর ধরনীতে।

চেকমেট পর্ব ২৯