চেকমেট শেষ পর্ব 

চেকমেট শেষ পর্ব 
সারিকা হোসাইন

সারফরাজ এর ফরেস্ট প্যালেস যেনো আবার নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছে।বিশাল রাজ প্রাসাদ তুল্য বাড়িটি দীর্ঘদিন শুনশান নীরব থাকার পর মানুষের হাসি আনন্দে পুনরায় মুখরিত হয়েছে।সিয়েরা ফরেস্ট এখন আর ভয়ানক গা ছমছমে অরণ্য নয়।সময়ের বিবর্তনে এখানে জনমানবের কোলাহল বেড়েছে।বড় বড় বিত্তশালীরা শহর ছেড়ে একটু নিরিবিলি আর প্রকৃতির মাঝে বিলীন হবার সদিচ্ছায় এখানে বসতি গড়েছে।ঘরের বাইরে পা রাখলেই এখন আর ভয়ানক বন্য পশুর ডাক শোনা যায়না।বিশাল অজগর সে যেনো এখন দুঃস্বপ্ন।মাঝে মাঝে বুনো হরিণের দল ওক গাছের ছায়ায় এসে বিশ্রাম পাতে।কিন্তু মানুষের আনাগোনা দেখলেই দৌড়ে পালায়।চোখ জুড়ানো সেই দৃশ্য।আলপাইন এরিয়ার চারপাশে নানান রঙ ঢঙের প্রতিবেশী।বাড়ির বাইরে কদম ফেললে এখন আর নেকড়ের হাউলিং শোনা যায়না।এখন বাতাসে ভেসে বেড়ায় প্রতিবেশীর কুশলাদি―

“হেই নেইবর !হুয়াটস আপ?
রূপকথার জেদের তোপে পরে কেউ আর টিকতে পারেনি বাংলাদেশে।শাশুড়ি,বাবা- মা,সন্তান সব নিয়ে হাজির হয়েছে সারফরাজ এর চেনা পরিচিত আবাস স্থলে।রূপকথা নিজের এমবিবিএস শেষ করে ইন্টার্নি করে মাস্টার অব সার্জারির জন্য পড়াশোনা করছে।আর সারফরাজ নিজের বিজনেস সামলায়।ওসব খুন খারাবী ছেড়েছে কি না কে জানে?তবে প্রায় সময়ই গভীর রাতের আধারে তাকে ঘরের বাইরে পা ফেলতে দেখা যায়।যখন ফিরে তখন ঠোটের কোনে বাঁকা হাসির রেখা খেলা করে সেই সাথে শীতল নির্লিপ্ত দৃষ্টি।যেনো গত রাতে সে ঘরেই ছিলো।কিচ্ছুটি হয়নি।কিন্তু টিভি খুললেই গা ছমছমে নিউজ।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সুফিয়ান চৌধুরী অবসর নিয়েছেন আরো বছর তিনেক আগে।একমাত্র নাতিকে নিয়েই তার সকল জল্পনা, কল্পনা, খেলাধুলা।মায়া রেখা আগের থেকে একটু বয়স্ক হয়ে গিয়েছেন।অভিরূপ এর মা গত হয়েছে মাস ছয়েক আগে।বোন অন্তুর বিয়ে হয়েছে ক্যালিফোর্নিয়ায় সিটিজেনশিপ পাওয়া এক ভদ্র ফ্যামিলিতে।নেলি একজন মেডিকেল অফিসার হিসেবে ক্যালিফোর্নিয়ার একটা হসপিটালে নিয়োগপ্রাপ্ত রয়েছে।নিনাদ সাড়ে সাত বছরের বালক।সকলেরই পরিপূর্ণ সুখের সংসার।এখানে দুঃখের হাতছানি নেই।দুঃখ বলতে একটাই তা হচ্ছে শত চেষ্টার পরেও রূপকথা দ্বিতীয়বার মা হতে পারছে না।এ নিয়ে অবশ্য সারফরাজ এর কোনো আফসোস নেই।সে তার ছেলের মধ্যেই সমস্ত সুখ খোঁজে পায়।কিন্তু রূপকথা একটা কন্যা সন্তানের প্রত্যাশায় রাত হলেই সারফরাজ এর বুক ভেজায় চোখের জলে।
সারফরাজ এর বিশ্বস্ত দেহরক্ষী ইয়ং কে বছর দুই আগে গ্রহণ করেছে এরিকা।লুইসের মায়ের অনুরোধে তাকে এই কঠিন পথ অবলম্বন করতে হয়েছে।প্রথমে এরিকা ইয়ং এর থেকে দূরে দূরে থাকলেও ইয়ংয়ের ভালোবাসায় নিজেকে একটু একটু সামলাতে শুরু করেছে সে।ইয়ং এরিকার উপর কোনো জবরদস্তি চালায় নি।বরং সে অপেক্ষায় আছে একদিন এরিকা সব ভুলে তাকে ভালোবাসবে।

ও হ্যা!এতো কিছুর ভিড়ে আপনাদের তো আসল মানুষের খবর ই দেয়া হলো না।ঠিক ধরেছেন।শাহরান শাহজাইন।বয়স সাড়ে ছয়।শারীরিক গড়ন,চেহারা আর তীক্ষ্ণ বুদ্ধিতে সারফরাজ কেও ছাড়িয়ে গেছে সে।কথায় কথায় সারফরাজ এর নাম ভাঙিয়ে মানুষকে হুমকি ধামকি দেয়া তার নিত্য দিনের কাজ।বেশি ভয়ে থাকে ইয়ং।কারন ছোট মাফিয়ার অর্ডারের শেষ নেই।মুখ থেকে ওর্ডার বের করা মাত্র তা সামনে হাজির করা চাই।সারফরাজ বেশ কয়েকবার শাষিয়ে ধমকে ঠিক করার চেষ্টা করেছে ছেলেকে।কিন্তু তার নিজের রক্তই যে বইছে ছোট দেহটায়।নিজের রক্তকে নিজেই বাগে আনতে হিমশিম খেতে হয় তার।শাহরান সুফিয়ান চৌধুরীর চোখের মণি।নাতির সাত খু ন মাফ তার কাছে।কেউ তার নাতিকে চোখ গরম করলে তার চোখ উপড়ে নেবার সুযোগ খুজেঁন এই ভদ্রলোক।নাতির কোনো দোষ তার চোখে পড়ে না।তার মতে পৃথিবীর সমস্ত দোষ শুধু সারফরাজ এর।
অভিরূপের ছেলে নিনাদের সাথে শাহরান এর গলায় গলায় ভাব।সারফরাজ আর অভিরূপ নিজেদের বন্ধুত্ব খোঁজে পায় এই দুজনের মধ্যে।নিনাদ সব সময় আগলে নেয় শাহরান কে।শাহরান যতটা দুস্টু আর কুমতলবের অধিকারী নিনাদ ততোটাই শান্ত আর বিচক্ষণ।

সারফরাজ এর বৃহৎ ড্রয়িং রুমে খেলা করছে নিনাদ,সুফিয়ান চৌধুরী আর শাহরান।রূপকথা রান্নার কাজে ব্যস্ত।মায়া আর রেখা নিজেদের ঘরে রেস্ট নিচ্ছে।সারফরাজ এঞ্জেলো কে কোলে নিয়ে বসে বসে ল্যাপটপে নিজের ব্যাক্তিগত কাজ সাড়ছে।এমন সময় বেজে উঠলো কলিংবেল।শাহরান আওয়াজ পেতেই উঠে দাঁড়ালো এরপর দৌড়ে গিয়ে খুললো দরজা।দরজা খুলতেই নীল চোখের অধিকারী ধবধবে ফর্সা পুতুলের ন্যয় এক মুখশ্রী তে তার নজর আটকালো।শাহরান অনিমেষ চেয়ে রইলো সেই বাচ্চাটার প্রতি।তার কেমন আদর জাগলো ।ইচ্ছে হলো গাল দুটো টিপে দিতে আর কোলে নিয়ে আদর করতে।কিন্তু অপরিচিত মানুষ বিধায় নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলো।রূপকথা গলা উঁচিয়ে বেশ কয়েকবার ডাকলো

“শাহ কে এসেছে?
উত্তর এলো না ছেলের।রান্না ফেলে দ্রুৎপদে ড্রয়িংরুমে এলো রূপকথা।সেই সঙ্গে নিজের কাজ ফেলে নীচে নামলো সারফরাজ।উৎকণ্ঠা আর আগ্রহ নিয়ে সারফরাজ রূপকথা দুজনেই দরজার সামনে যেতেই বিস্ময়ে হতবাক রইলো।দরজায় অধীর অপেক্ষায় দাঁড়ানো রুদ্র আর চুপকথা।চুপকথার কোলে পুতুলের ন্যয় দেখতে একটা বাচ্চা মেয়ে।বয়স বোধ হয় দেড় কি দুই।দেখতে হুবুহু মায়ের মতো।কিন্তু চোখ জোড়া পেয়েছে বাবার।সারফরাজ উচ্ছাস আর বিস্ময় দুই ধরে রাখতে না পেরে রুদ্রকে বুকে টেনে শক্ত করে জড়িয়ে বললো
“হুয়াট অ্যা সারপ্রাইজ!এতগুলো বছর পর মনে পড়লো আমাদের কথা?একটা ফোন পর্যন্ত করিস না কোনো দিন।আজ হঠাৎ?আয় আয় ভেতরে আয়।মা তোর কথা ভেবে প্রায়ই কেঁদে বুক ভাষায়।

রূপকথা রুদ্রের মেয়েকে কোলে তুলে চুপকথাকে হাসি মুখে ভেতরে আসতে ইশারা করলো।মায়া ঘরের ভেতর থেকে হট্রগোল এর শব্দ পেয়ে বেরিয়ে এলেন বাইরে।বয়সের ভারে চোখে একটু কম দেখেন আজকাল।চশমা ছাড়া দূরের জিনিস দেখতে কষ্ট হয়।কিন্তু গলাটা বেশ পরিচিত মায়ার।রুদ্রের কন্ঠ সুবহান চৌধুরীর মতো।মায়ার মনে হলো তার বাবা হেসে হেসে কথা বলছে।চোখের সামনে বাবার পুরোনো স্মৃতি মনে পড়তেই চোখ ভিজে উঠলো তার।চোখের জল আড়াল করে সিঁড়ি ধরে নীচে নামলেন তিনি।এরপর রুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে অভিমানী গলায় জিজ্ঞেস করলেন

“এতো বছর পর তোর আমাদের কথা মনে পড়লো বাবা?একটা ফোন ও করিস না কোনো দিন।আমরা বুঝি এতোই পর?সেই যে বিয়ের পরের দিন ই বিদেশ পাড়ি জমালি আর এলি না।তোদের একটা খোঁজ নেবার ও কোনো মাধ্যম আমাদের দিলি না।কেনো রে?কি দোষ করেছি আমরা?
মায়ার অভিযোগে মাথা নিচু করে স্তব্ধ রইলো রুদ্ররাজ।এরপর নিজেকে সামলে বলে উঠলো
“তোমাদের সুখে নজর দিতে চাই না ফুপি।আমার ছায়া যে বড্ড কালো কুচকুচে।সারফরাজ এর জীবনে আমি কি করে আমার অভিশপ্ত নজর ফেলতে পারি বলো?এজন্য ইচ্ছে করেই নিজেকে আড়াল করে রাখি।কিন্তু ফুপি বিশ্বাস করো-আমি দূর থেকে তোমাদের খবর রাখি।যখন দেখি তোমরা সবাই মিলেমিশে ভালো আছো তখন খুব আনন্দ পাই জানো?কিন্তু হিংসেও হয়।বড্ড লোভ জাগে।ইশ আমিও যদি তোমাদের সঙ্গে এই অন্তহীন আনন্দের শরিক হতে পারতাম!

কথা গুলো বলতে বলতে রুদ্রের গলা ভার হলো।চোখে জল ও জমলো।কিন্তু নিজের অনুভূতি কে প্রশ্রয় দিলো না সে।পলক ঝাপ্টে চোখের জল আড়াল করে পুনরায় বলে উঠলো
“আমার মেয়েকে তোমাদের দেখাতে এনেছি ফুপি।তুমি তো জানতে চুপকথার কন্ডিশন।ওর শারীরিক অবস্থা ঠিক না থাকার কারনে কয়েক বছর আমরা সন্তান নেবার চিন্তা পর্যন্ত করতে পারিনি।সারফরাজ এর ছেলে হয়েছে শুনে খুব খুশি হয়েছিলাম তখন।বিধাতা ওকে দুহাত ভরে দিয়েছে।বিধাতার দেয়া শাস্তি আমি হাসি মুখে মাথা পেতে নিচ্ছি ফুপি।তিনি আমাকেও দুহাত ভরে দিচ্ছেন।কিন্তু একটু দেরিতে।এতেই সন্তুষ্ট আমি।কারন বিধাতা যে আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছেন তা ঢের টের পাই আমি।অনেক অন্যায় করেছি তাই না?একটু সাজাতে যদি সব পাপ দুনিয়াতেই মওকুফ হয় তবে ক্ষতি কি?
সারফরাজ রুদ্রের কাঁধে চাপড় মেরে বলে উঠলো

“এখনো ওসব ধরে বসে আছিস?আমি তো কবেই ভুলে গেছি।তুইও ভুলে যা।
রুদ্ররাজ মাথা নাড়ালো।সে ভুলবে না।চাইলেও এসব সে ভুলতে পারবে না।এমনকি সে ভুলতে চায় ও না।
রুদ্ররাজ ইতস্তত গলায় বলে উঠলো
‘এসব দ্রুত ভুলে গেলে আমি আবার সীমালঙ্ঘন করতে পারি।তাই ক্ষত টাকে প্রতিদিন নিয়ম করে খুঁচিয়ে তাজা করি আমি।যাতে দ্বিতীয় বার একই ভুল করার দুঃসাহস না জাগে।শরীরে বেইমানের রক্ত কিনা!এই নিকৃষ্ট রক্ত ধুয়ে মুছে সাফ করা তো সম্ভব নয় তাই না?
আর কেউ কথা বাড়ালো না।এমন সময় শাহরান এসে রূপকথাকে বলে উঠলো
“ওকে একটু কোলে নিতে পারি মাম্মা?
রূপকথা তাৎক্ষণিক মাথা ঝাকিয়ে বললো

“হ্যা বাবা অবশ্যই।আর ও তোমার কি হয় জানো?
শাহরান চট করে বুদ্ধিদীপ্ত কন্ঠে শুধালো
“কি হয়?আত্মীয় হয়?
রুদ্র প্রশস্ত হেসে শাহরান কে কোলে তুলে বললো
“ও তোমার বোন হয় বাবা।
বোন সম্বোধন শুনেই শাহরানের কেমন রাগ উঠলো।তার চোখ লাল হলো সেই সাথে নাকের ডগা।সারফরাজ খেয়াল করলো তার ছেলের চোখ টলমলে।অনেক রেগে গেলে আর মনোকষ্ট পেলে ছেলের এমন অবস্থা হয়।হঠাৎ এই মুহূর্তে কি এমন হলো সারফরাজ বুঝতে পারলো না।আকস্মিক শাহরানের এমন মুখায়ব দেখে ঘাবড়ে গেলো রুদ্র।ঘটনা বেগতিক বুঝতে পেরে রুদ্রের থেকে ছেলেকে টেনে নিজের কোলে এনে আদর বুলিয়ে ফিসফিস করে শুধালো
“পাপাকে বলো কি হয়েছে?হঠাৎ এতো কষ্ট কেনো?
সারফরাজ এর গলা জড়িয়ে শাহরান ফিসফিস করে বলে উঠলো
“বোনকে কি বিয়ে করা যায় পাপা?

ছেলের এহেন অদ্ভুত কথা শুনে বিষম খেলো সারফরাজ।কাশতে কাশতে তার দম আটকানোর অবস্থা হলো।সারফরাজ এর এমন অবস্থায় সকলেই অবাক হলো সেই সাথে ব্যস্ত হলো রূপকথা।সারফরাজ নিজেকে সামলে চোখ গরম করলো সুফিয়ান চৌধুরীর পানে।জামাই শ্বশুরের চোখাচোখি চললো দীর্ঘ সময়।কেউ বুঝলো না চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কে কি বলছে।কিন্তু যাদের বোঝার তারা ঠিকই বুঝলো।
“হতচ্ছাড়া এখন কেমন লাগছে?নিজের কার্বন কপি দেখে খুব ফাটছে তাইনা?ফাটুক।আমারও ফেটেছিলো।মেয়ের জন্য মুখ বুঁজে সব সয়েছি।এবার সামলাও ঠেলা।শত্রুর মেয়েকে বানাও বউ।আমার কি?আমার নাতির আবদার যদি বিফলে যায় তবে তোর একদিন কি আমার একদিন।
চোখ ইশারার সাথে সাথে আঙ্গুল মুচড়ে দেখালো সুফিয়ান চৌধুরী।সারফরাজ দাঁত কিড়মিড় করে বুঝালো
“প্রতিশোধ নেবার জন্য আমার ছেলের মাথাটা এই বয়সেই খেলেন আব্বা?
“নয়তো কি?
“ঠিক আছে পরে দেখছি আপনাকে।

আজকাল সুফিয়ান চৌধুরীর কথার মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে শাহরান এর বউ।পক্ষীরাজের ঘোড়া দিয়ে স্নো হুয়াইটের মতো টুকটুকে বউ আনবে তারা নানা নাতি মিলে।এরপর সেই বউকে আদর করে বুকে জড়িয়ে ঘুম পাড়াবে শাহরান।এতেই ক্ষান্ত হয়নি এই নানা নামক ইতর লোক।শাহরানের পাপ কিভাবে তাকে নাকানিচুবানি খাইয়ে তার একমাত্র মেয়েকে হাসিল করেছে সেসব গপ্পো রসিয়ে রসিয়ে বলে নাতিকে করেছে ইচড়েপাকা ।
গল্পকে সত্যি ভেবে ছেলে এখনই বিয়ের স্বপ্ন দেখছে এই কথা সারফরাজ প্রকাশ করবে কি করে?তাও আবার এমন মানুষের মেয়েকে নিয়ে ছেলে স্বপ্ন দেখতে আরম্ভ করেছে যে তার নিজের বউকে নিয়েই একসময় টানাটানি করেছে!
এদিকে কথায় কথায় নানান কথা হলো।সুযোগ পেতেই শাহরান শুধু রুদ্রের মেয়ের গাল টিপছে আর চুমু খাচ্ছে।যেনো বাচ্চাটি তার শখের খেলনা।

শাহরান সকলের কথার মধ্যে গলা বাড়িয়ে শুধালো
“তোমার মেয়ের নাম কি গো গুড আংকেল?
নিজের নামের এমন সম্বোধনে অল্প হাসলো রুদ্ররাজ।এরপর বললো
“রোদ।
নামটা নিজ মুখে কয়েকবার আওড়ালো শাহরান।এরপর সকলের অলক্ষে রোদ কে কোলে নিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলো।প্যালেস এর বিশাল উঠানে দাঁড়িয়ে আঙ্গুল উঁচিয়ে শাহরান বলে উঠলো
“এই সব কিছু আমার বুঝলে?আমি এখানের রাজপুত্র।আগেভাগেই সব দেখিয়ে রাখি তোমায়।আমি কত সুন্দর দেখেছো?টাকা পয়সার ও কোনো অভাব নেই।পরে আবার অন্য কাউকে বিয়ে করো না যেনো।আমাকে বিয়ে করলে এঞ্জেলো কে তোমাকে দিয়ে দেবো কেমন?এঞ্জেলো দেখতেও অনেক সুন্দর।ও লাফিয়ে লাফিয়ে তোমাকে খেলা দেখাবে।
ছোট মেয়েটা কি বুঝলো কে জানে?গোলাপি ঠোঁট প্রসারিত করে সে হাসতে লাগলো।সেই হাসি দেখে শাহরান শুধালো

“খুশি হয়েছো?পছন্দ হয়েছে আমাকে?তাইলে মাম্মার মতো আই লাভ ইউ বলো।জানো?রাতের বেলা মাম্মা না আমার পাপাকে লাভিউ বলে চুমু খায়!
এমন সময় নিনাদ সেখানে উপস্থিত হয়ে পেছন থেকে বলে উঠলো
“কি সব পঁচা পঁচা কথা বলছিস?এই বাচ্চা তোর এসব আবোল তাবোল কথা বুঝছে নাকি?তোর বাবা জানলে তোর পিঠের চামড়া তুলবে।
শাহরান সেসব পাত্তা না দিয়ে নিনাদ কে শুধালো
“তুই কখনো ভালোবেসেছিস?
শাহরানের প্রশ্নে নিনাদের চোখে ভেসে উঠলো তার ক্লাসে পড়া ইরিন নামক মেয়েটার হাস্যজল ছবি।মেয়েটার হাসি সুন্দর।হাসলে ডান গালে টোল পরে।মেয়েটার চোখ জোড়া মায়াবী।তাকিয়ে শুধু দেখতেই ইচ্ছে করে।নিনাদের কাছে তার মাকে যতখানি ভালো লাগে ওই মেয়েটাকেও ততখানি ভালো লাগে।তার মনে হয় মেয়েটা তার বহু জন্মের চেনা।
নিনাদ তার বাবা মাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলো ভালোবাসা মানে কি?অভিরূপ ছেলেকে কোলে তুলে বুঝিয়ে উত্তর দিয়েছিলো

“ভালোবাসা মানে হলো কাওকে খুব খুব ভালো লাগা।তার সাথে বারবার কথা বলতে মনে চাওয়া।তাকে এক পলক না দেখলে মনে ভার হওয়া।তার হাজার বকবকানি তে বিরক্ত না হওয়া এমনকি সারাক্ষন সেসব বকবকানি শুনতে ইচ্ছে করা।ঘুমুতে যাবার আগে সেই মানুষটির কথা ভাবা এমনকি ঘুমের ঘোরে এবং জাগরণে।মানুষটা খেলো কিনা?ঘুমালো কি না ,শরীরের যত্ন নিলো কি না এসব নিয়েও সারাক্ষন ভাবা।এরপর তাকে ছাড়া সব কিছু পানসে লাগা।
অভিরূপ আরো অনেক কঠিন কঠিন কথা বলেছে কিন্তু নিনাদ সেসব বুঝে না।নিনাদ যতটুকু বুঝেছে তাতে ভালোবাসা মানে হলো কাউকে ছাড়া সব কিছু খালি খালি ফাঁকা ফাঁকা লাগা।যেমনটা মা বাড়িতে না থাকলে অনুভূত হয়।
নিনাদ ভাবনার সাগরে ডুবে থাকতেই শাহরান প্রস্থান নিলো।বাপের পুরো সম্পত্তি মেয়েটাকে দেখানো চাই।কারন সুফিয়ান চৌধুরী বলেছে যার টাকা আছে মেয়েরা তাকেই বিয়ে করতে চায়।

দুপুরের খাবার টেবিলে খেতে খেতে রুদ্র সকলের উদ্দেশ্যে জানালো তারা আজই চলে যাবে।ইতস্ততা আর লজ্জা ভাব নিয়ে রূপকথা সামান্য অনুরোধ করলো।সারফরাজ আর মায়া শক্ত করে ধরলো রুদ্ররাজ কে।কিন্তু রুদ্র শুনলো না।সারফরাজ বুঝলো রুদ্রকে মানানো এতোটা সহজ নয়।তাই সে আর কথা বাড়ালো না।শুধু অল্প করে বললো
“যোগাযোগ টা রাখিস।
রুদ্র জবাব দিলো না।ঝটপট খাবার খেতে লাগলো।

রুদ্ররাজ দের বিদায়বেলায় শাহরান ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেললো।রুদ্রের খারাপ লাগলো এটা দেখে।ছেলেটার মায়াবী মুখ আর চোখ দেখে তার থেকে যেতে ইচ্ছে করলো।কিন্তু রূপকথার সামনে তার লজ্জায় নতজানু হয়ে আসতে চায় শরীর।মায়ার সামনে জতখন থাকে ততক্ষণ অপরাধ বোধ ঘুণ পোকার ন্যয় কুঁড়ে কুঁড়ে খায় তাকে।সারফরাজ এর প্রতি করা অন্যায় তার হৃদয়ে চাবুকাঘাত করে।সব কিছুর মার্জনায় তার উন্মাদের ন্যয় চিৎকার করতে ইচ্ছে করে।আজ ও তার ব্যতিক্রম হলো না।বুকে পাথর বেঁধে মেয়েকে কোলে নিয়ে দ্বিতীয়বার পেছন না ফিরে চললো রুদ্ররাজ।শাহরান রোদের পা টেনে ধরলো।ছোট ছেলেটা চিৎকার করে কাঁদতে চাইলো।তার বুকে অদ্ভুত জন্ত্রনা হচ্ছে।কিন্তু সেই জন্ত্রনার নাম জানে না শাহরান।

চেকমেট পর্ব ৬৯

ধীরে ধীরে বর্ধিত দূরত্বে রোদের জুতা খোলে হাতে এলো শাহরানের।সেই জুতার পানে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো শাহরান।যেনো তার সব হারিয়ে গেলো।কঠিন রুদ্র তবুও ফিরলো না।চুপকথা ব্যাথিত চোখে একবার পিছন ফিরলো।ছোট রোদ কেমন করুন গলায় কেঁদে উঠলো। নিমিষেই রুদ্রের গাড়ি সারফরাজ এর বাড়ির আঙিনা ছাড়ালো।শাহরান শব্দ করে কেঁদে সারফরাজ এর কোমড় জড়িয়ে ধরলো।রূপকথা কপাল কুঁচকে ঘটনা বোঝার চেষ্টা করলো।মায়া রেখা নাতির হঠাৎ কান্নার হেতু খুঁজে পেলো না।যা বোঝার বুঝলো সারফরাজ।শুধু তপ্ত শ্বাস ছেড়ে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে সকলের অলক্ষে বলে উঠলো
“বড় হও ওকেই এনে দেবো।প্রমিস।

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here