ছায়ার মুখোশ গল্পের লিংক || তাজরীন খন্দকার

ছায়ার মুখোশ পর্ব ১
তাজরীন খন্দকার

নতুন বউরে রাতে তর লগে রাখিস ফাইজা। রাশেদ কিছু কইলে আমার কথা কইস, আমার পিঠদাঁড়া ব্যথা করতাছে ঘুমাই যামু।
ফাইজা আচ্ছা বলে মাথা নাড়ালো।
পাশেই বসে থাকা নতুন বউ কোমল চোখে তাকিয়ে আছে, কথার আগামাথা কিছুই বুঝেনি। তার কোলে ৮ মাস বয়সী ছোট্ট একটা বাচ্চা, এতক্ষণ শান্ত থাকলেও এই মূহুর্তে বেশ ছটফট করছে।
ফাইজা এগিয়ে এসে বললো,
‘ ভাবি ওর খিদা লাগছে, আসেন রুমে যাই। ওরে খাওয়াইয়া ঘুম পাড়ামু, আমরাও ঘুমাই যামু৷
আরিদা আস্তে করে বললো,
‘ আর রাফি, রাফান,রাইসা কোথায় ঘুমাবে?
ফাইজা মুচকি হেসে বললো,

‘ ওরা ভাইয়ের লগে ঘুমাইবো, ওরা ওদের বাবা বাড়ি আইলে বাবা ছাড়া ঘুমাইতে পারেনা। রাহাদ তো ছোট, ওরে রাতে উইঠা উইঠা দুধ খাওয়াইতে হয় তাই ও আমার লগে থাকে।
আরিদা কি যেন একটা প্রশ্ন করতে চাইলো, কিন্তু করলোনা। যতই হোক এই বাড়িতে সে নতুন৷ ঘরের মানুষ যেভাবে চাইবে তাকে তো সেটাই মানতে হবে।
শুনতে অবাক লাগলেও সত্যি যে সে এখনো তার বিয়ে করা স্বামীকে ভালোমতো দেখেনি। দ্বিতীয়বার বিয়েটাই বোধহয় এমন, হুট করে কথা হলো দুম করে বিয়ে হয়ে গেলো শেষ!
রাশেদ শুধু বিবাহিত নয়, সে চার সন্তানের বাবা, স্ত্রী মারা গেছে আর আর আরিদাও বিধবা। তারও সন্তান থাকার কথা ছিলো, কিন্তু সেটা পেটে থাকার তিনমাসেই নষ্ট হয়ে গেছে, এরপর তার মানুষটাই তাকে একা করে চলে গেছে৷ এরপর ৪ বছর বাবার বাড়িতে বোঝা হয়ে থেকে রাশেদ ফয়েজীর সাথে বিয়ে হয়েছে। রাশেদের শহরে ব্যবসায়িক অবস্থা বেশ ভালো, শুধু চার সন্তানের দায়িত্ব নিতে হবে বলে তার স্ত্রীর মৃত্যুর ৬ মাসেও তাকে কেউ বিয়ে করতে চায়ছিলোনা। তারা হন্নে হয়ে বউ খুঁজছিলো! সবশেষে আরিদাকে পেলো, টানাপোড়েনের সংসারে বোঝা হয়ে থাকা মেয়েকে সহজেই তারা রাশেদ ফয়েজীর হাতে তুলে দিয়েছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আরিদা ফাইজার পেছন পেছনে তার রুমে গেলো। ফাইজা রুমে গিয়ে রাহাদকে আবারও আরিদার কোলে দিয়ে তড়িঘড়ি করে দুধ বানাতে লাগলো। আরিদা কান্নারত রাহাদকে কোলে নিয়ে ঝাঁকাতে লাগলো। দুধ বানানো শেষ হতেই ফাইজা আরিদাকে ইশারা করলো বিছানায় শুয়ে দিতে। বিছানায় শুয়ে দিতেই ফাইজা রাহাদের মুখে ফিডারডা দিলো, দিতেই কান্না থেমে গেলো। প্রচন্ড খিদা পেয়েছিলো দেখেই বুঝা যাচ্ছে। আরিদার তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করলেও ফাইজার চোখে চোখ পড়তেই চোখ সরিয়ে নিলো, বাচ্চাদের খাওয়ার সময় তাকিয়ে থাকতে হয়না। কি সুন্দর ফুটফুটে একটা বাচ্চা,কত্তো ছোট বেলায় মাকে হারিয়েছে! মার অভাব পূরণ করতে তাকে আনা হয়েছে, সে হলো সৎ মা! এই শব্দটাই বিশ্রী, শুনলেই মনে হয় খারাপ মানুষ ৷ এইতো এলাকার মানুষজন সন্ধ্যায় তাকে ভীড় করে বলছিলো,

‘ দেহো বউ চাইরডা বাচ্চা মা হারা, তুমি এদের আগলাইয়া না রাখলে একবারে শেষ হইয়া যাইবো, এদের লগে খারাপ করলে আল্লাহ তোমারে মাফ করবোনা।
আরিদা জানেনা সে কেমন মা হবে! সৎ অর্থ তো খারাপ নয়, শুধু সৎের সাথে মা লাগালেই জিনিসটা শুনতে আর ভালো লাগেনা। সে শুধু মা-ই নাহয় হবে!
দুধ খেতে খেতে রাহাদ ঘুমিয়ে গেলো। ফাইজা ফিডার সরিয়ে পাশ থেকে একটা বালিশ ঢিল দিয়ে বললো, অইপাশে শুইয়া পড়েন ভাবি, বাত্তি নিভাইয়া দিতাছি।
ফাইজা উঠে বাতি অফ করতেই যাবে তখন দরজায় কড়া নাড়লো, গম্ভীর কণ্ঠে আওয়াজ এলো,
‘ ফাইজা দরজা খোল।
আরিদা তড়িঘড়ি করে ঘোমটা টেনে মাথা নিচু করে বসলো।
ফাইজা দৌঁড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলো, থতমত করে বললো,
‘ ভাই রাইসারে এখানে নিয়া আইছেন যে?
রাশেদ তাড়াহুড়ো করে বললো,

‘ ওরে ধর, বাকিডিরেও আনতাছি। সবডি ঘুমাইয়া গেছে, ওরা তোর লগে থাকবো।
ফাইজা কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
‘ আম্মা কইছে ভাবি আমার লগে থাকবো। ওরা আপনার সাথেই থাকবো৷
রাশেদ রাইসাকে দিতে গিয়েও দিলোনা, মেনে নেওয়ার ভঙ্গিতে বললো,
‘ আম্মা কইছে? আইচ্ছা তাইলে নিয়া যাই, দরজা লাগাইয়া দে।
চলে যেতেই আরিদা ঘোমটা সরিয়ে স্বাভাবিক হয়ে বসলো। ফাইজা তার ভাবির দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ ভাইরে দেখি লজ্জা পান, দ্বিতীয় বিয়াতে আবার লজ্জা থাহে নাকি?
আরিদা কিছু বলতে গিয়েও বললো না, ওই যে সে নতুন!তার কম কথাই শ্রেয়। প্রথম আর দ্বিতীয়, অনূভুতির কি তফাৎ হয় নাকি? কি জানি আরিদা এখনো ভালো মতো বুঝে উঠতে পারছেনা। বিয়ের আগেও তার মনে হয়েছিলো আর মৃত স্বামী ইমরানকে ভুলতে পারবেনা, কখনোই তার কোনো পুরুষের প্রতি কোনো আবেগ কাজ করবেনা, কিন্তু ঠিকি আশেপাশে রাশেদের উপস্থিতি তার বুকে শিহরণ জাগাচ্ছে।
আপনা আপনিই এটা হচ্ছে, বিয়ে জিনিসটাই বোধহয় এমন, কবুল বলার পর থেকেই মানুষটা নিজের হয়ে যায়, সে যতই অচেনা হোক।

ফাইজা বাতি বন্ধ করে দিলো। আরিদা আস্তে করে শুয়ে পড়লো। অনেক জিনিস তার চিন্তায় জড়ো হয়েছে, রাশেদের বউয়ের মৃত্যু কীভাবে হয়েছে সে ভালোমতো জানেনা। আর রাশেদের মায়ের আচরণই বা এমন কেন?তাকে আলাদা ঘরে থাকার নির্দেশ কেন দিয়েছে তাও কেমন যেন লাগছে! অন্যদিকে মা হুকুম দিয়েছে শুনেই কোনো প্রশ্ন না করে ছেলে বিড়ালের বাচ্চার মতো চলে যাওয়াটাও অবাক করার বিষয়। আজকাল এতো বাধ্য ছেলে হয় নাকি?
একটা সময় আরিদা ঘুমিয়ে পড়লো। মাঝরাতে একবার ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো, দেখলো ফাইজা রাহাদকে দুধ খাওয়াচ্ছে। আরিদার ঘুম বেশ ভারী, সে ভালোমতো সজাগ না হয়ে আবারও ঘুমিয়ে পড়েছে, সেই ঘুম ভেঙেছে ভোরে। ঘুম থেকে উঠেই দেখলো ফাইজা নামাজ পড়ে নামাজের বিছানায় বসে আছে, আরিদা তড়িঘড়ি করে ওয়াশরুমের দিকে গেলো, তারও নামাজ পড়া উচিত। ওয়াশরুমে ঢুকতেই যাবে তখন আরিদার শাশুড়ী ডাক দিয়ে বললো,

‘ বউ গোসল কইরা লও৷
বেশ অবাক হলো আরিদা! কেন গোসল করবে? সে বিয়ে গোসল এসব নিয়ে পূর্ব অভিজ্ঞ মানুষ, এমন না যে মেনে নিবে বিয়ের পরদিন গোসল অবধারিত। সে তো তার স্বামীর সঙ্গে ছিলোই না। ফাল্গুনমাসের মাঝামাঝি, সকাল বেলা বেশ শীত শীত লাগে, অকারণে কষ্ট করার মানেই হয়না। তাও দেখানোর জন্য তোয়ালে নিয়ে ঢুকলো, কিছুক্ষণ এমনি এমনি থেকে হাত দিয়ে হালকা চুল ভিজিয়ে চুল পেঁচিয়ে গিয়ে নামাজে দাঁড়ালো। শাশুড়ী পেছন থেকে এসে বললো,
‘ নামাজের সময় পার হইয়া গেছে বউ, আরো আগে উঠবা।
আরিদা মাথা নাড়লো। শাশুড়ীর এমন খবরদারিতে সে বেশ খারাপ অনূভব করতে লাগলো। তার আগের শাশুড়ী একদম বন্ধুর মতো ছিলো, যেভাবে ইচ্ছে চলতে পারতো। কিন্তু এ তো জামাইয়ের সাথে থাকতেই দেয়না, আবার বলে গোসল করতে। কি জানি চারটা বাচ্চা কীভাবে হয়েছে!
আরিদা নামাজ শেষ করে নাস্তা বানাতে গেলো। আরিদা শাশুড়ী একে একে সব দেখিয়ে দিলো। বেশ ভালোমতোই বুঝিয়ে দিলো সকাল দুপুর রাতে কিভাবে কি করতে হবে।
কথামতো সুন্দর করেই নাস্তা তৈরি করলো। সে রুটি বেলে সেঁকে দিচ্ছে ওইদিকে রাশেদ টেবিলে খেতে বসেছে, ফাইজা গরম গরম রুটি নিয়ে নিয়ে রাশেদের পাতে দিচ্ছে। তিনজন বাচ্চা আরিদার পাশে ছুটাছুটি করছে, আরিদার বেশ ভালোই লাগছে।

ওইদিকে আরিদার শাশুড়ীও রাশেদের সাথে বসেছে নাস্তায় বসেছে।
রাশেদ খাওয়ার মধ্যে বলে উঠলো,
‘ আম্মা আপনি তো জানেন আমার ব্যবসার অবস্থা, বাচ্চাদের জন্য আসা যাওয়া করতে করতে অনেক খারাপ পরিস্থিতির মধ্য দিয়া যাইতাছি। একটা বাসা ভাড়া করছি, যেকোনো সময় উঠতে পারুম, ভাবছিলাম ওদের নিয়া যামু নাকি?
কথাটা রান্নাঘর পর্যন্ত পৌঁছালো, শুনেই আরিদা কান পেতে রইলো,তার শাশুড়ী বেশ জোরেশোরেই বললো,
‘ যাইলে যা, তোর আর আসা যাওয়া করন লাগবোনা। কিন্তু বউ বাচ্চা এইহানেই থাকবো। বউ এদেরকে দেইখা রাখবো। আস্তে আস্তে মা মা ডাইকা আপন কইরা নিবো।
রাশেদ আস্তে আস্তে বললো,
‘ আচ্ছা।
আরিদার কান অব্দি সেই শব্দটা পৌঁছালো না ।

ছায়ার মুখোশ পর্ব ২