ছায়ার মুখোশ পর্ব ১০
তাজরীন খন্দকার
ফাইজার মোবাইল রাশেদ দেখে ফেলায় আরিদা ভরকে গেল। তার তো কথায় কথায় মিথ্যা বলার অভ্যাস নেই, এখন কি বলবে? আরিদা তার অন্যহাতটা মোবাইল ধরে রাখা হাতের উপর এনে রাখলো, যেন ফোনটা দেখা না যায়। আর মনে মনে কোনো অজুহাত খুঁজতে লাগলো,ওদের সাথে মিথ্যা বলার দক্ষতা অর্জন করতেই হবে। আরিদার এমন হকচকিয়ে যাওয়া নিরবতায় রাশেদ আবার বললো,
‘ কি ফাইজার মোবাইল নিয়া আইলা ক্যান? আরিদা?
আরিদা থতমত করে বললো,
‘ মনে হয় ভুলে নিয়া আইছি৷ আমারটা মনে কইরা ওরটা হাতে নিয়া চইলা আইছি৷
বলেই বোকার মতো হাসতে লাগলো।
রাশেদ তার ডান হাতের তর্জনী আঙুলটা আরিদার গালে ঠেকিয়ে ঘাঁড় ঘুরিয়ে দিয়ে বললো,
‘ অই যে দেখো….. তোমার নিজের মোবাইল টেবিলের উপর। দুইটা নিয়াই রুমে আইছো৷ ভুলে আনলে যেকোনো একটা আনতা।এইবার সত্যি কথা কও।
রাশেদ আঙুলটা গালে এমনভাবে ঠেকিয়েছে যে আরিদার গালে সেটা টোল হয়ে আছে। আরিদা ঘাবড়ে একটু এলোমেলোই হয়ে যাচ্ছিলো, প্রথমবার ঠাডা পড়া মিথ্যা কথা, তার উপর ধরা। তখনি তার মনে পড়লো সে আসলে কি প্রসঙ্গে ছিলো। সঙ্গে সঙ্গে রাশেদের হাতে ধরে আস্তে করে হাতটা নিচে নামিয়ে বললো,
‘ আপনারা কথার মারপ্যাঁচে আটকাইয়া গেলে কেমনে জানি নিখুঁত কইরা সেইটা থেকে বের হইয়া যান৷ প্রসঙ্গ বদলানের লাইগা আপনারা মানুষই একেকজন।
রাশেদ সরিয়ে দেওয়া হাত আবারও গালে ঠেকানোর চেষ্টায় বললো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘ তুমিও এখন সেইটাই করতাছো বউ। ফাইজার মোবাইল তোমার কাছে ক্যান এখনো ভালা কইরা কইলা না!
আরিদা রাশেদের বুকের উপর শক্তি দিয়ে ধাক্কা দিয়ে বললো,
‘ বলবোনা, সামনে থেকে সরেন তো। আপনি যেন আমারে সব কন!
রাশেদ সরে গেলো। আরিদা আবার ফিরে বললো,
‘ রুমেই থাকুম। কিন্তু আপনার লগেনা। আর আপনি আমারে ততদিন ছুঁইবেননা, যতদিন না আপনারে চোখ বন্ধ কইরা ভরসা করতে পারি। আপনারে নিয়া আমার অনেএএক সন্দেহ, সব যেদিন বিশ্বাসযোগ্য কথার দ্বারা খোলাসা হইবো ওইদিন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিমু আপনার সাথে আমার আচরণ কিরম হওয়া উচিত!আমারে এতো ভোলাভালা ভাব্বার কিচ্ছু নাই।
‘ তাহলে আমার বউ ভোলাভালা না? উফফ কি সৌভাগ্য আমার!
বলেই রাশেদ বিছানায় ধপাস করে শুয়ে পড়লো। আরিদা বুঝতে পারছে রাশেদ তার সাথে ফ্লার্ট করছে। কিন্তু এসবের জবাব দেওয়া যাবেনা৷ সে মেঝেতে এদিক ওদিক হাঁটছে। রাশেদ আড়চোখে দু একবার দেখছে। কিন্তু কিছু বলছেনা। আরিদা কতক্ষণ পায়চারি করে বললো,
‘ পাশের বালিশটা দেন তো, নিচে ঘুমামু।
রাশেদ মুখ ভেংচিয়ে বললো,
‘ লজ্জায় ফাইজার ঘরে যাইতে পারতেছোনা আহা! তাই বলে নিজের জামাইরেও বিশ্বাস করবানা?
‘ একদম করিনা। আর বিশ্বাস করার আগ পর্যন্ত আপনার স্পর্শও গায়ে লাগাবোনা।
রাশেদ এ কাৎ থেকে ও কাৎ হতে হতে বিরবির করে বললো,
‘ তাইলে বাকি জনম বউয়ের ছোঁয়া না নিয়াই মরা লাগবো।
‘ কিছু কি কইলেন নাকি?
‘ না কিছুই কই নাই।
‘ বালিশটা দেন।
‘ নিজে আইসা নিয়া যাও।
‘ আপনাকে ডিঙায়া যাওয়া লাগবো, আপনি দেন!
‘ তাতে কিছু হইবোনা, তোমার ছোঁয়া লাগলে আমার কোনো সমস্যা নাই। আমি তোমার মতো নির্দয় না।
‘ আপনি মাত্রার বাইরে খারাপ মানুষ ।
‘ জানি। তার লাইগাই তোমার মতো ভালা মানুষ পাইছি যাতে কাটাকাটি হয়।
‘ আবার বলতাছি দিবেন না?
‘ আমি এক কথার মানুষ ।
‘ আমিও এক কথার মানুষ, আপনারে কোনো সুযোগ দিমুনা। বালিশ ছাড়াই ঘুমামু।
‘ সুযোগ কিন্তু আছিলো, মূল্য দিলানা!
কাল থেইকা আবার আগের মতো সকালে যামু আর মধ্যরাইতে ফিরুম। তখন খালি আমারে মনে করবা আর কানবা।
‘ বয়েই গেছে!
বলে আরিদা রাগে গজগজ করে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। গিয়ে সোফার কুশন আনলো, নিচে জায়নামাজ বিছিয়ে লাইট বন্ধ করে কুশনে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে গেলো।
উপরে উপরে হেসে সব সামলে নেওয়ার চেষ্টা করলেও আরিদার রাগকে রাশেদ প্রচন্ড ভয় পাচ্ছে। আরিদা যে সরল তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু সে তার সাথে সাহসী আর বুদ্ধিমতিও। এসব মানুষ আবার কিছু মানুষের জন্য যমদূত! রাশেদের জানা নেই আরিদাকে সামাল দেওয়ার অস্ত্র কি?
শেষরাতে রাহাদের কান্নার শব্দে আরিদার ঘুম ভেঙে গেলো। চোখ খুলে তাকিয়ে একটু অপেক্ষা করলো কান্না থামে কিনা, ততক্ষণে ফাইজা দুধ বানিয়ে দিলে থেমে যাবে। কিন্তু রাহাদের কান্না থামছেনা। আরিদা তড়িঘড়ি করে উঠে দৌঁড়ে রুমে গিয়ে দেখলো রাহাদ নিচে পড়ে কান্না করতেছে, ফাইজা রুমে নেই। আরিদা রাহাদকে কোলে দিয়ে মাথায় শরীরে হাত বুলাতে বুলাতে কান্না থামানোর চেষ্টা করতে লাগলো৷ রাহাদ খাট থেকে নিচে পড়ে গেছে! রাফি আধোঘুমে চোখে বললো,
‘ আমরা কই? রাহাদ কান্দে ক্যান?ও আবার আমাদের লগে আইলো কবে?
আরিদা ফিসফিস করে বললো,
‘ ঘুমাও আব্বা, আমরা আজকে সবাই একলগে থাকছি।
রাফি বিশ্বাস করলো তাই আবার ঘুমিয়ে গেলো।
এদিকে রাহাদের কান্না থেমে গেছে কিন্তু ফাইজা এখনো ওয়াশরুম থেকে আসছেনা।রাহাদকে কোলে নিয়েই আরিদা গিয়ে ওয়াশরুমের দরজা ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেলো। একি! ফাইজা তো ওয়াশরুমে নেই। আরিদা দ্রুত রান্নাঘর দেখলো, সেখানেও নেই। তারপর আবার দৌঁড়ে রুমে এসে দেখলো আলমারির দরজা ফাঁক হয়ে আছে,সে আলমারি খুলে দেখলো কাপড়চোপর এলোমেলো! এটা দেখে তার মাথাটাই এলোমেলো হয়ে গেলো, তবে কি যা ভেবেছিলো তাই হলো? ফাইজা কোনোভাবে ফয়সালের সাথে পালিয়ে গেছে? কিন্তু যোগাযোগ করার রাস্তা তো ছিলোনা, ফোন সে নিয়ে নিয়েছিলো!
আরিদার কপাল বেয়ে মিহি ঘাম ঝরে পড়ছে। বুক ধড়ফড় করছে! আরিদা ছাড়া কেউ জানেনা ঘটনা কি ঘটতে পারে। আরিদা কথা লুকানোর জন্য যদি ফেঁসে যায়, আর তাকে সবাই দোষ দেয়? আরিদার অদ্ভুতরকম ভয় হচ্ছে।
এদিকে রাহাদ দুধ খাওয়ার জন্য ছটফট করছে। আরিদা ঝিমঝিম করা হাতে রাহাদকে দুধ বানিয়ে দিলো।
আরিদা ভেবেই পাচ্ছেনা এই পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দিবে?
সকাল হতে হতে বিষয়টা নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে। সবাই জাগার আগ পর্যন্ত বিষয়টা জানাজানি হবেনা। তাহলে এটাই বলা যেতে পারে ভোরে হাঁটতে বের হয়েছে এরপর খোঁজ জানা নেই, কোথায় গিয়েছে নাকি কেউ তুলে নিয়েছে খোঁজ নেন। এটা বলাই কি যুক্তিসঙ্গত?
পরক্ষনেই আরিদা চিন্তা করলো তার মিথ্যা বলার দরকার কি? কিসের জন্য এতো ভীত সে? ফাইজা তাকে বারণ করেছে বলে ফয়সালের সাথে প্রেমের বিষয়ে মুখ খুলতে জড়তা চেপেছে নাকি সে বিষয়টাকে চেপে গেছে বলে নিজের জন্য ভয় পাচ্ছে?
তখনি ভয়ের মধ্যে আরেক ভয়ানক স্বর কানে এলো। তার শাশুড়ী ডাকছে আর বলছে,
‘ এই আমার মোবাইলডা তো পাইতাছিনা। ফাইজা নিছতরে?
আরিদা এবার থমকে গেলো। তাহলে তার শাশুড়ীর মোবাইল ফাইজা রাতে নিয়ে এসেছে? আর এনেই ফয়সালকে সবকিছু জানিয়ে দিয়েছে?! আরিদা তো ফাইজাকে কথা দিয়েছিলো কাউকে বলবেনা, তবে এতে তাড়াহুড়ো করে পালিয়ে যাওয়ার কি ছিলো? নাকি ফয়সালের ভয় ছিলো? আরিদা যদি ভুলেও বলে দেয় রাশেদকে তাহলে তার ফাইজাকে পাওয়ার সম্ভাবনা জিরো হয়ে যাবে? তাই সময় নষ্ট করেনি?
এদিকে তার শাশুড়ী দরজায় ধাক্কাচ্ছে আর বলছে,
‘ কিরে ফাইজা উঠস নাই? আজান দিছে উঠ, আর আমার মোবাইলডা নিছতনি জানাইস।
আরিদা এবার জোরে বললো,
‘ উঠছি আম্মা। রাহাদরে ঘুম পাড়াইয়া আইতাছি।
আরিদার শাশুড়ী চলে গেলো।
ছায়ার মুখোশ পর্ব ৯
সকাল হতেই একটা হুলস্থুল কান্ড বেঁধে গেলো। ফাইজা কোথায় গেলো? আরিদা কেবল উত্তর দিচ্ছে,
‘ আমি তো জানিনা, আমি দেখিনি।
সত্যিই আরিদা দেখেনি। শুধু অনুমান করতে পারে কোথায় গেছে। কিন্তু তার অনুমান নিয়ে কেউ প্রশ্ন করছেনা, কেবল কোথায় চলে গেলো এটা নিয়ে রীতিমতো কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে। রাশেদ আরিদার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে, কেননা সে রাতে ফাইজার মোবাইল আরিদার কাছে দেখেছিলো। তার শাশুড়ী তাকে কয়েকবার ভালো করে জিজ্ঞাসা করে শেষে রেগে বললো,
‘ জানোনা ক্যান? রাইতে ছিলা কই?