ছায়ার মুখোশ পর্ব ১৪
তাজরীন খন্দকার
গরম, শান্ত আর আদ্র একটা রাত। এসব রাতে ঝিঁঝিঁপোকার ডাকে কান ভার হয়ে আসে। দূর থেকে শেয়ালের হাঁকও শোনা যাচ্ছে। আরিদার শাশুড়ী উঠানের পেয়ারা গাছটার নিচে একটা চেয়ার পেতে সেখানে মাথায় হাত দিয়ে একধ্যানে বসে আছে। সবাই ফাইজা আর ফয়সালকে তাদের মতো ছেড়ে দিলেও তিনি কোনোভাবেই মানতে পারছেননা। আর তাই তখন বাড়ি এসে আবারও বের হয়ে গিয়েছিলেন থানায় জিডি করার জন্য, ফয়সালের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ করে এসেছেন। তার পক্ষে তার মেয়ের এই সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই সঠিক বলে চিন্তা করা সম্ভব হচ্ছেনা। আরিদা অনেক্ষণ যাবৎ তার শাশুড়ীর ঘরে আসার অপেক্ষা করলো, কিন্তু তিনি গেলেন না। শেষে সে বাইরে এসে তার শাশুড়ীর কাঁধে হাত রেখে আস্তে আস্তে বললো,
‘ আম্মা উইঠা কয়ডা খাইয়া শুইয়া পড়েন।? এভাবে বইসা থাইকা তো কিছু হইবোনা।
‘ ভালা লাগতাছেনা বউ, পোলাপাইনগুলি ঘুমাইলে তুমিও যাইয়া ঘুমাইয়া পড়ো। আমি রাশেদ আইলে পরে ঘুমামু।
‘ কবে না কবে আইয়ে, ভেতরে আইসা অপেক্ষা করেন। আজকা বাইরে কেমন জানি গরম ভাঁপ লাগতাছে।
‘ যাওতো বউ, তোমারে যা কইছি তা করো গিয়া।
আরিদা মুখ ফিরিয়ে নিলো। থাকুক যেভাবে ভালো লাগে! একটু উঁকি মেরে তার শ্বশুরকে দেখে এলো কিছু লাগবে কিনা। যদিও তার শ্বশুরের ব্যপারে তাকে এতো চিন্তা করতে হয়না, এইদিকটা তার শাশুড়ীই সামলায়। তার কথা সে যতদিন সুস্থ থাকবে ততদিন নিজের স্বামীর সেবাযত্ন সে নিজেই করবে। তাই আরিদা কখনো এটাতে হস্তক্ষেপ করেনা। আজ যেহেতু তার শাশুড়ীর মন খারাপ তাই উঁকি দিয়েছে, কিন্তু তার শ্বশুরের যাবতীয় প্রয়োজন শেষ করেই তার শাশুড়ী উঠানে গিয়ে আসন পেতে দুঃখের বাজার খুলে বসেছে।
আরিদা গিয়ে রাহাদের পাশে ফাইজার রুমে শুয়ে পড়লো। তাদের ব্যপার তারাই সামলে নিবে। তার কিছু যায় আসেনা।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মাঝরাতে রাহাদের ছটফটানিতে আরিদার ঘুম ভেঙে গেলো। রাহাদ খিদা লাগলে এমন করে। আরিদা উঠে বসলো খাওয়ানোর জন্য । তারপর গিয়ে লাইট অন করলো। লাইট অন করতেই দেখলো তার বালিশের পাশে দুইটা বক্স রাখা। একটা ওইযে প্রথমবার একটা চারকোণা বক্স দিয়েছিলো ঠিক তেমন, আরিদা ভাবলো ওটাই কি আবার দিয়েছে নাকি?
একটু বিরক্তির সাথে সে সেটা খুললো। কিন্তু খুলেই সে একটু হেসে ফেললো,এটার ভেতরে একটা সোনার লেয়ারড চেইন সাথে আবার ছোট ছোট একজোড়া দুল। অন্য রকম সুন্দর জিনিসগুলো। আরিদা হাত দিয়ে একটু ছুঁয়ে দিলো। ছুঁয়ে দিতেই তার মনে হলো এগুলোও আবার শিরিনের জিনিস নয়তো? এরপর নিচের গোল বক্সটা খুললো,দেখলো হ্যাঁ এটার ভেতর চুড়ি। তবে সেই চুড়িগুলো না অন্য চুড়ি। এগুলো বেশ মোটা মোটা ৷ আর এটার সাথে ছোট একটা কাগজ পেঁচানো। আরিদা সেটা খুলে দেখলো সেখানে ডাক্তারি স্টাইলে লেখা,বুঝতে কষ্ট হলেও বুঝেছে এখানে লেখা আছে, ” নতুনকে নতুনেই সাজানোর ইচ্ছা, আগেরবারের জন্য ক্ষমা চাই”।
আরিদা এবার কিঞ্চিৎ আওয়াজ করে হেসে ফেললো, এগুলো রেখে ফাইজার পড়ার টেবিলটার পাশেই তাকিয়ে দেখলো সেখানে অনেকগুলো ব্যাগ রাখা। আরিদা তড়িঘড়ি করে উঠে ব্যাগগুলোর মধ্যে কি আছে তা উপর দিয়েই দেখতে চেষ্টা করলো, একি! সবগুলোই তো শাড়ী। গুনেগুনে দেখলো এখানে ১০ টা শাড়ী। আরিদা কোনো কাগজ আছে কিনা খুঁজতে লাগলো, সবগুলো খুঁজে একটা ধূসর রঙের শাড়ীতে একটা কাগজ পেলো, সেখানে লেখা ” বলেছিলাম ৫ টা দিবো, দেরি হয়েছে বলে ঘুষ হিসেবে দ্বিগুণ দিলাম। আর এই যে রঙটা একদম তোমার মতো সাদামাটা, পরলে তোমাকে মনে হবে যেন, এক টুকরো মেঘ”
খুশিতে গদগদ হয়ে আরিদা কাগজ দুটো বুকের উপর ধরে রুমে চোখ বন্ধ করে দুইতিনবার পায়চারী দিলো। তখনি রাহাদ কেঁদে উঠলো। আরিদার হুশ এলো, আরেহ সে তো রাহাদকে খাওয়ানোর জন্য জেগেছিল। রাহাদকে খাওয়াতে খাওয়াতে হুট করে তার মনে হলো, রাশেদ এসব কেন করছে? অতি ভক্তি তো চোরের লক্ষণ! তাকে খুশি করতে এতো আয়োজন করেছে নিশ্চয়ই তার প্রতিজ্ঞা ভেঙে দেওয়ার জন্য। সে সত্য না বলে কোনো কিছুর বিনিময়েও কথা দেওয়ার কথা ভুলবেনা। রাশেদকে বুঝতেই হবে তার! এরপর নাহয় তার সাথে একটা সংসার সাজাবে!
আরিদা খুশি হতে চাচ্ছে কিন্তু সে পারছেনা, রাশেদের অন্য উদ্দেশ্য থাকতে পারে এটা মাথায় আসার পর থেকে সে একদম শুরু থেকে হিসাব মেলাচ্ছে, না না এসব উপহারেও জটিলতা আছে। রাশেদ কোনোভাবেই সরল ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য না,কেননা তার মধ্যে আরিদা কখনোই কোনো সরলতা খুঁজে পায়নি।
আরিদা জিনিসগুলো উঠিয়ে রেখে শুয়ে পড়লো৷ কোনো কিছুই পরার প্রয়োজন মনে করলোনা। রাশেদের উদ্দেশ্য বুঝার আগ পর্যন্ত আরিদা একদম বোকাবনে যাবেনা!
রাশেদ প্রতিদিনই কোনো না কোন উপহার দিতেই লাগলো। আর ব্যপারটা এমন হয়ে গেছে যে আরিদা যা বলে রাশেদ তাই করে। সে মজা করে অসম্ভব কিছু বললেও রাশেদ তা বাস্তব করে ফেলে। আরিদা ভীষণ খুশি হয় তবে তার কথা ভুলেনা, আর রাশেদও কিছু বলতে আসেনা। আরিদার একটাই প্রশ্ন সে এতকিছু করতে পারবে অথচ সত্য বলতে পারবেনা? তাহলে তো ঘাপলা আছেই!
এভাবেই চলতে লাগলো দিন। বাচ্চাদের নিয়ে তার ভালো সময় কেটে যায়।
চারমাস পর,
আরিদার ফোনে একটা কল আসলো,অচেনা নাম্বার। আরিদা ফোন রিসিভ করতেই শুনলো ফাইজার গলার আওয়াজ। এতদিনে তারা কতো খোঁজ করেছে কিন্তু কেউই ফাইজার খোঁজ পায়নি। ফয়সাল যে কোথায় চলে গেছে কেউ জানেনা,বাড়িতেও আসেনি। এই বিষয়ে পুলিশও তেমন একটা সাহায্য করেনি। মেয়েরও ১৮+ বয়স, ছেলের তো কবেই ২৫+ । তারা স্বইচ্ছায় গিয়েছে তাই এটা কোনো অপরাধের পাল্লায় পড়ে না।
আরিদা ফাইজার কথা না শুনেই তার শাশুড়ীকে জোরে জোরে ডাকতে শুরু করে দিলো।
তার শাশুড়ী আসার আগেই আরিদা যখন শান্ত হলো শুনলো ফাইজা ওপাশ থেকে কাঁদছে। আরিদার মুখে লেগে থাকা হাসিটা মূহুর্তে হারিয়ে গেলো, সে প্রশ্ন করতে লাগলো,
‘ ফাইজা ফাইজা? কাঁনতাছো ক্যান?
কিন্তু ওপাশ থেকে আর কথা নেই। তখনি তার শাশুড়ী এসে বললো,
‘ কেমন আছে আমার ফাইজা, দেও আমারে আমি কথা কমু?
আরিদা লাউড স্পিকার দিয়ে তার শাশুড়ীর হাতে দিলো। ফাইজা তার মার গলা শুনতে পেয়েই বলে উঠল,
‘ আম্মা ভাবির লগে কথা আছে দেও।
হাসি মুখটা অন্ধকার হয়ে গেলো তার শাশুড়ীর। এতদিন পর মেয়ে ফোন দিয়েছে অথচ সে তার সাথে কথা বলতে চায়না। আরিদা তার শাশুড়ীর মুখের দিকে তাকিয়ে স্পিকার অনই রাখলো, আর ফাইজার উদ্দেশ্যে বললো,
‘ ফাইজা কোনো সমস্যা?
ফাইজা ডুকরে কাঁদছে। কান্নার জন্য কথাই বলতে পারছেনা। আরিদা আবারও জিজ্ঞাসা করলো, কয়েক মিনিট এমন কান্নাই করলো। তারপর হঠাৎ বলে উঠলো,
‘ ভাবি ফয়সাল আমারে ঠকাইছে, আমার পেটে দুইমাসের বাচ্চা, আর সে অন্য মাইয়ার লগে রাতদিন কথা কয়,নেশা কইরা বাড়ি আইয়ে, কিছু কইলে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করে। আমারে আইয়া নিয়া যান, আমার দমবন্ধ হইয়া যায়, আমি সহ্য করতে পারিনা। আমার ভুল হইছে আপনার কথা না শুইনা, মাফ কইরা দেন দয়া কইরা।
আরিদা তাড়াহুড়া করে বললো,
‘ ফাইজা কই আছো তোমরা আমারে ঠিকানাডা দেও, আজই আননের ব্যবস্থা করতাছি। দরকার হইলে আমি নিজে গিয়া আনুম।
তখনি কি যেন একটা আওয়াজ হলো আর ফোন কেটে গেলো। আর ফোন ঢুকছেনা। আরিদা ভীত চোখে তার শাশুড়ীর দিকে তাকালো। তার শাশুড়ীর চোখ আগুনের গোলার মতো টকটকে লাল হয়ে আছে,তার ভেতরে টলমল করছে পানি, সে তাকাতেই ঝরঝর করে সেগুলো গাল বেয়ে পড়তে লাগলো। আরিদা শান্তনা দেয়ার জন্য কিছু বলতে যাবে তখনি বলে উঠলো,
‘ ফয়সাল ভালা পোলা না আমরা আগেই জানতাম, ফাইজাও হেরে দুচক্ষে সহ্য করতে পারতোনা, হাইরে কি থেইকা কি কইরা আমার মাইয়াডার মন বদলাইয়া দিলো! আর ভাইগা নিয়া গিয়া আমার মাইয়ার জীবনডারে শেষ কইরা দিলোরে!
আরিদার শাশুড়ীর কান্নায় আরিদার অস্থির লাগছে। ধ্যাত!সে নিজেও এর জন্য দায়ী৷ সে চেয়েছিলো বলেই রাশেদ আর বাঁধা হয়নি, নয়তো ঠিকি তাদেরকে খুঁজে বের করতো। তার মনে হয়েছিলো তারা সুখেই থাকবে,কিন্তু ফয়সাল তো মারাত্মক খারাপ একটা ছেলে। আরিদা জানেনা কীভাবে সে এই কথা রাশেদকে জানাবে। ফাইজা নিশ্চয়ই সুযোগ পেয়ে আবারও যোগাযোগ করবে, সেই পর্যন্ত চুপচাপ থেকে অপেক্ষা করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে । অন্যথায় তাদের খোঁজার কোনো রাস্তা নাই।
অপেক্ষা করতে করতে এক সপ্তাহ কেটে গেলো। আরিদা উঠানে বাচ্চাদের ধোয়া কাপড় নাড়ছে।
তখন তাদের বাড়িতে থ্রিপিস আর চার ইঞ্চি হিলের জুতা পরা একটা সুন্দরী মেয়ে আসলো। মেয়েও বলা যায়না, বয়স আনুমানিক ৩০+ তো হবেই। তবে সে যে বেশ আভিজাত পরিবারের কেউ বেশভূষায় তাই বুঝা যাচ্ছে, আরিদার কাছে আসার পর একটা মিষ্টি মাতাল করা ঘ্রাণ তার নাকে বাজলো। আরিদা তাকাতেই মেয়েটা বলে উঠলো,
‘ রাশেদ ঘরে আছে?
‘আরিদা মাথা নেড়ে বললো,
‘ জ্বী আছে ভেতরে যান৷
মেয়েটা ঠকঠক করে হেঁটে ঘরে প্রবেশ করলো। আরিদা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। হয়তো ব্যবসায়িক কাজ, বড়লোকদের দেখতেও অন্য রকম লাগে। তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে, রাশেদ কতো সুন্দর মেয়েদেরকে প্রতিদিন দেখে তবুও তার জন্য কতো পাগলামি করে! অথচ সে পাত্তাই দেয়না।
আরিদা কাপড় নেড়ে মিনিট দশেক পর ঘরে ঢুকতেই দেখলো রাশেদের দরজা লাগানো, মেয়েটা বাইরে থেকে ডাকতেছে। আরিদাকে দেখে এবার অন্য রকম দৃষ্টি দিলো, পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিলো। তখন তো এভাবে তাকায়নি, এখন এভাবে তাকানোর মানে কি আরিদা জানেনা। তখনি মেয়েটা বলে উঠলো,
‘ তোমাকে হ্যাল্পিংহ্যান্ড ভেবেছিলাম, কিন্তু তুমি নাকি রাশেদ ফয়েজীর ওয়াইফ? বিশ্বাসই হচ্ছেনা রাশেদ তোমার মতো একজনের জন্য এমন পাল্টে গেলো।
ছায়ার মুখোশ পর্ব ১৩
আরিদা রাগে ফেটে পড়ছে, কিছু একটা বলতেই যাচ্ছিলো। তখনি রাশেদ ধাম করে দরজা খুললো। খুলেই খালি বালতি হাতে আরিদাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো, রাশেদ মেয়েটার দিকে তার চেয়েও দ্বিগুণ ক্ষুব্ধ হয়ে বললো,
‘ আমার বউয়ের নখের যোগ্যতাও তোর নেই, তুই আবার আমার বউরে অপমান কইরা কথা কস! বেয়াদব মহিলা বাড়ি যা নিজের৷
আরিদা থতমত করে বললো,
‘ এভাবে বলতাছেন ক্যান? কে উনি?