ছায়ার মুখোশ পর্ব ৬
তাজরীন খন্দকার
দক্ষিণের বাতাসে রান্নাঘরের দরজাটা বারবার টাসটাস করে আওয়াজ হচ্ছে। আরিদা রুম থেকে ছুটে এলো,সব জানালা লাগালেও এটা লাগাতে ভুলে গেছে। হঠাৎ এতো বাতাস বইছে, বৃষ্টি আসবে নাকি কে জানে! রাতের আকাশের মেঘ আরিদা বুঝতে পারেনা। আর এটা বর্ষাকালও না। জানালা লাগাতে লাগাতেই শীতল বাতাসে তার গা হিম হয়ে এলো। কিন্তু জিনিসটা ভালো অনূভব করলো! তার ইচ্ছে করছে এই মূহুর্তে খোলা আকাশের নিচে কোনো ধানখেতের পাশে বাতাস অভিমুখে দাঁড়িয়ে দুহাত ছড়িয়ে বাতাসকে টেক্কা দিতে! ইমরানের সাথে অনেকবার আরিদা এমন করেছে, ইমরান হাসতে হাসতে বলেছে তুমি যে পাতলা বাতাস আরেকটু বাড়লে উড়ে যাবে।
সবাই ঘুমিয়ে গেলে আলো ঝলমলে রাতে আরিদাকে নিয়ে ইমরান বেড়িয়ে পড়তো,বাড়ির পেছনের ধানখেতের আইল ধরে হাঁটতো। কখনো কনকনে শীতে গায়ে চাদর জড়িয়ে কুয়াশা উপর দুজন হাঁটতে হাঁটতে সুন্দর বর্তমানকে নিয়ে বিস্তর আলোচনা করতো, আবার কখনো তীব্র গরমে লোডশেডিংয়ের পীড়ায় শুষ্ক জমির উঁচুনিচু মাটির উপর হাঁটতে হাঁটতে ভবিষ্যতে অনেক বড়লোক হয়ে সবকিছু অবসান করে ফেলার স্বপ্ন দেখতো।
তার সাথে সবকিছুই স্বপ্ন রয়ে গেলো। বাস্তব হলো সব কেবল আরিদার। এই বাড়িতে বিদ্যুৎ যায়না,অন্য ব্যবস্থা আছে। টানাপোড়েন নেই, ব্যাংকে অঢেল টাকা আছে। প্রতিদিন রান্নাবান্না নিয়ে চিন্তা করতে হয়না, ভরপুর বাজার হয়। এসবকিছু কি আরিদা চেয়েছিলো?
তীব্র অন্যমনস্কতায় কপালে ভাঁজ পড়লো,আরিদা আনমনে এক দু পা করে হাঁটছে। খুব ধীরে ধীরে সে তার শাশুড়ী রুমের সামনে দিয়ে তার রুমের দিকে এগুচ্ছে। দরজা বরাবর আসার পর তার ধীর পাগুলো একেবারেই স্থির হয়ে গেলো। রাশেদ তার মার সাথে কথা বলছে,প্রথম যে বাক্যটা শুনেছে সেটা হলো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘ আম্মা আপনে তো এমন আছিলেন না। ক্যান এমন হইয়া গেলেন? কিছু একটা কন।
তার শাশুড়ীর কোনো জবাব নাই। অনেকটা সময় চলে গেলো, আস্তে আস্তে ভেতরে আর কোনো কথা হচ্ছে কিনা আরিদা শুনছেনা, তার কান অব্দি আসছেনা। সে এখান থেকে চলেই যাবে তখন শুনলো তার শাশুড়ী বলছে,
‘ আইচ্ছা যা তাইলে, পরেরদিন আবার বউরে লইয়া আইয়া পড়বি৷ তোর শাশুড়ীরে আগে থেইকা জানাইয়া রাখিস।
আরিদা এবার বুঝে গেলো কি নিয়ে কথা হচ্ছে! অদ্ভুত একটা আনন্দ অনূভব করলো। সে দ্রুত ফাইজার কাছে চলে গেলো। আরিদা যেতেই ফাইজা তাড়াহুড়া করে কান থেকে ফোনটা সরিয়ে নড়েচড়ে বসলো। আরিদা বলে বসলো,
‘ আরেহ আমারে ডরানের কিছু নাই। প্রেমিকের লগে কথা কইলে আমার সামনেই কইতে পারো।
ফাইজা যেহেতু ধরা, তাই জোর গলায় কিছু বললোনা। শুধু বললো,
‘ এমন কিছুই না, আমার কোনো প্রেমিক নাই।
ফাইজা কথা শেষ করে আরিদার খুশি খুশি চেহেরার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
‘ তোমার আগের বিয়াডা কি প্রেমের আছিলো?
আরিদা মাথা নেড়ে বললো,
‘ উঁহু প্রেম না, উনি আমারে পছন্দ করতেন৷
‘ তারপর কেমনে বিয়া অইলো?
‘ বাড়িত প্রস্তাব দিলো, এরপর বিয়া অইলো।
জবাবে ফাইজা কোনো মজা পেলোনা, তাই আর কোনো প্রশ্ন না করে শুধু অ বলে আবার ফোন টিপতে লাগলো। তখনি দরজায় দাঁড়িয়ে রাশেদ ডেকে বললো,
‘ আরিদা সকালে আমরা তোমরার বাড়ি যামু, গুছাইয়া রাইখো সব।
আরিদা জিজ্ঞাসা করলো,
‘ বাচ্চাদেরও গুছাইয়া রাখুম?
রাশেদ উত্তর দিলো,
‘ ওরা বাড়িতে থাকবো, একদিনের জন্য কাউরে নিমুনা। তোমার আম্মা ফোন দিছিলো তোমারে নিয়া দেখাইয়া আননের লাইগা।
আরিদা হাসিমুখে সম্মতি দিলো। কিন্তু ফাইজার মুখ অন্ধকার। হোক এতকিছু দেখার সময় আছে নাকি! পাত্তাই দিলোনা আরিদা। চুপচাপ গিয়ে শুয়ে পড়লো।
পরেরদিন সকাল দশটায় বাড়িতে সিএনজি এলো। আরিদা একটা ছোট্ট ব্যাগে মাত্র একটা কাপড় নিলো। বের হওয়ার সময় রাশেদ তার মাকে যখন বললো আম্মা যাই, তার মা প্রতিত্তোরে বললো,
‘ সাবধানে যা, আর আমি যা কইছি স্মরনে রাখিস।
‘ অবশ্যই আম্মা।
বলেই বেড়িয়ে পড়লো তারা৷ বাচ্চাগুলোর মন খারাপ। কিন্তু রাশেদই ওদেরকে নিতে চাচ্ছেনা। নিজের বাড়িতেই ওরা ভালো থাকে।
যাওয়ার পথে বাজারে নেমে রাশেদ পুরো সিএনজি ভরে বাজারসদায় করলো। এতো জিনিস যে বসার জায়গাও ছোট হয়ে গেছে। এতো জিনিস কেন নিচ্ছে আরিদা জানেনা।
বাড়ির রাস্তায় সিএনজি দাঁড়াতেই আরিদার মা ছুটে এসে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলো। পরনে মলিন কাপড়, রুক্ষ শরীর, ঘামের গন্ধ, কিন্তু আরিদার কাছে এটাই বেহেস্ত!
আরিদার দুই ভাবি পেছন থেকে ডেকে বললো,
‘ ভালা আছো আরিদা?
আরিদা তার মাকে ছেড়ে হেসে বললো,
‘ জ্বী ভালাই। সিএনজিতে অনেক জিনিস বাইত নিয়া আইয়েন ।
বলতে বলতেই তারা আনতে চলে গেলো, আরিদার দুই ভাইয়ের এক ভাই এসেছে, সেও হাতে নিলো। সবাই নিয়েও শেষ হলোনা। আবার এসে নিতে হবে। এতো ভারী জিনিস নিচ্ছে তাও হাসির বিন্দুমাত্র কমতি হলোনা।
ঘরে গিয়ে আরিদা বললো,
‘ আম্মা কি রানছো?
‘ তোর জামাইয়ের লাইগা রাতা মোরগ ধইরা রাখছি, এহনো জবাই দেই নাই মা। অত সকালে আইবি যে বুঝি নাই।
‘ আরে না না রান্দো, দুপুরেই খামু আমরা। তোমরার জামাই সব বাজার কইরা আনছে, ৫ কেজি গরুর মাংস, ৫ কেজি খাসির মাংস, ৫ টা মুরগী,দুইটা বড় মাছ দুধ ডিম আর যত সবজি ফলমূল সামনে পাইছে সব কিনছে। ওইগুলা থেইকাও অল্প কইরা রাইন্দো।
আরিদার মা এবার মুখ ফ্যাকাসে করে বললো,
‘ অইগুলো তো দুই বউ নিজেদের ঘরে লইয়া গেলো। ফিরিজে রাইখা দিছে মনে হয়।
‘ কি কও? না এইগুলা নিয়া এমন করতোনা।
বলতেই বলতে বড়জন এসে বললো,
‘ আম্মা জামাই আমার এনেই খাইবোনে আজকে।
পেছন পেছন ছোটজন এসে বললো,
‘ ভাবি দুপুরে খাওয়াক, আমি তাইলে রাইতে খাওয়ামু।
আরিদা তৎক্ষনাৎ রাজী হয়ে গেলো। চলে যেতেই আরিদা বললো,
‘ কইছিলাম না এমন করতোনা।
তার মা তার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ এতো সরলা হইলে টিইকা থাকবি কেমনেরে মা? ওরা তো কইছে বাজারগুলা হজম করনের লাইগা। আর তোর জামাই এইসব ক্যান আনছে,শ্বশুর বাইত মাইনষে এততা আনে?
‘ জিগাইছিলাম, কইলো প্ররথম বার জামাইদের এমন কইরা যাওন লাগে যেন সবাই স্বরণে রাখে। মিছা কয় নাই আম্মা, এতকিছু না আনলে কি এরা এমন খাতির করতো?
তার মার কাছে এসব স্বরণ টরনের কোনো আলাদা প্রতিক্রিয়া নেই। মনে হচ্ছে কিছু না আনলেই তিনি খুশি হতেন। তার অল্প যা আছে তা দিয়েই জামাইয়ের আপ্যায়ন করতেন। যেই ননদের জন্য তারা শাশুড়ীকে তাদের থেকে আলাদা করে দিলো বাড়তি মানুষ খাওয়াতে পারবেনা বলে, আজকে কিনা সেই ননদের জামাইয়ের বাজারসদাই হজম করার জন্য অভিনয় করছে।
রাত ৯ টা৷ ওরা তাড়াতাড়ি খেয়ে তার মায়ের ঘরে এসে বসেছে। রাতেও এখানেই থাকবে। তার মা তার চাচীর সাথে চলে গেছে। আরিদা পাশে বসতেই রাশেদ আরিদাকে প্রশ্ন করলো,
‘ ভাবিরা কি দুধ জ্বাল দেয় নাই?
আরিদা থতমত করে বললো,
‘ দাঁড়ান জিগাইয়া আইতাছি।
বলেই আরিদা তার ছোটভাবির ঘরের দরজায় গিয়ে বললো,
‘ দুধ জ্বাল দিছিলেন ভাবি?
ঘর থেকে আওয়াজ এলো
‘ না বড় ভাবি দিছে।
আরিদা আবার বড় ভাবির ওখানে গেলো। গিয়ে জিজ্ঞাসা করতেই তিনি বললেন,
‘ হ তোমার ভাতিজার লাগাইয়া অল্প জ্বাল দিছিলাম।
‘থাকলে একগ্লাস দেন তো৷
তিনি কিছু না বলে ঠান্ডা হয়ে যাওয়া একগ্লাস দুধ দিলেন। আরিদা সেটা নিয়ে ঘরে গেলো। রাশেদ বললো,
‘ একগ্লাস?
‘ দুইগ্লাস খাইবেন?
‘ না তোমার লাইগা একটা । আচ্ছা আরেকটা গ্লাস থাকলে নিয়া আও৷ এইটাই ভাগ কইরা খাবো।
আরিদা গ্লাস দেওয়ার পর রাশেদ বললো,
‘ ঘরে চিনি থাকলে অল্প চিনি নিয়া আসো। আমি আবার মিষ্টি ছাড়া খাইতে পারিনা।
আরিদা আবার গেলো চিনি আনতে। চিনি আর চামচ এনে রাশেদের হাতে দিলো। রাশেদ চিনি দিয়ে নিজেই নেড়েচেড়ে আরিদার হাতে একটা দিলো আরেকটা নিজে রাখলো। এরপর দুজনই দুজনের দিকে তাকালো, আর একসাথে দুই চুমুকে হাফগ্লাস হাফগ্লাস দুধ শেষ করে ফেললো।
খেয়ে আরিদা প্রশ্ন করলো,
‘ বাড়িতে তো কখনো দুধ খেতে দেখিনি , আজকে এতো
পেরেশানি করাইয়া খাওয়ানের কি আছিলো।
রাশেদ জবাব দিলো,
‘ আসলে বিয়ার রাইতে সবাই খায় তো, সেইজন্য!
আরিদার জবাব,
‘ আমাদের বিয়া হইছে অনেকদিন।
‘ কিন্তু এই প্ররথম আমরা একসাথে।
আরিদা এবার লজ্জামাখা স্বরে বললো,
‘ বুঝছি যান।
তারপর বৈদ্যুতিক আলোটা নিভে গেলো। তারপর তারা যখন চোখ খুললো দেখলো সূর্যের আলোতে ঘরটা আবার আলোকিত।
আরিদা রাশেদের বুকের উপর থেকে হাতটা সরিয়ে দ্রুত গিয়ে দরজা খুলে দিলো। তাদের দেরিতে উঠতে দেখে তার বড়ভাবি রসিকতার সাথে বললো,
‘ আরে বিয়ার বছর ঘুম ফুরায় না। নাস্তা বানাইয়া রাখছি, মুখ ধুইয়া আইয়ো।
আরিদা টিউবওয়েলে গেলো মুখ ধুতে। তার মা কোথা থেকে যেন তার দিকে ছুটে এলো। তার হাতে একটা ঔষধের পাতা। সেটা আরিদার হাতে দিয়ে বললো,
‘ বেড়ার পাশে পাইলাম, এইডা কিসের ঔষধ? আমি তো ঘরবাড়ি ঝাড়া দিছি কালকা, কিছুই আছিলোনা।
আরিদা দেখে বললো,
‘ জন্মনিরোধক মনে হইতাছে।
ছায়ার মুখোশ পর্ব ৫
বলেই সে থেমে গেলো, নতুন পাতা কোনো ময়লা নেই। যেন এখনি খোলা। আবার প্রশ্ন করলো,
‘ কোনদিকে পাইছো?
হাত দিয়ে তাদের থাকার জায়গাটার ঠিক পেছনটা দেখালো। আরিদার বুক কেঁপে উঠলো। তাহলে কি রাতে দুধ নিয়ে এতো তালবাহানা করে রাশেদ তাকে জন্মনিরোধক ঔষধ খাইয়েছে?