ছায়ার মুখোশ পর্ব ৭
তাজরীন খন্দকার
চুলায় আগুন জ্বলছে, ভেতরের লাকরিগুলো পুড়ে লাল টকটকে হয়ে আছে যেন রক্ত ঝরছে আর চুলার বাইরের অংশটা এখনো পুরোপুরি অক্ষত! সেই লাল আভা থেকে কালো আবছা একটা ধোঁয়া উড়ে আকাশে মিশে যাচ্ছে।
আরিদা চুলার পাশে বসে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তার ভেতরটাও এই পুড়ানো লাকরির মতো রক্তাক্ত, তার নিঃশ্বাসও যদি দেখা যেতো তাহলে বোধহয় এই ধোঁয়ার চেয়েও দেখতে কালো হতো।
‘ কই জামাইরেও ডাকো? কি এক দিশা হইয়া চাইয়া রইছো?
আরিদার ভাবির ডাকে সে চমকে উঠলো, থতমত খেয়ে বললো,
‘ হুহ? হুমমম ডাকতাছি।
আরিদা চুলার কাছ থেকে উঠলো। উঠে ধীরে ধীরে জায়গাটা ছাড়লো। কিন্তু ঘরে যেতে তার ইচ্ছে করছেনা,লোকটাকে ডাকার ইচ্ছেও করছেনা। কেনই যাবে? সে কি তার অংশ নয়? সে কি তার সাথে খোলাখুলি আলোচনা করতে পারতোনা? সেও তো এই মূহুর্তে বাচ্চাকাচ্চার জন্য প্রস্তুত নয়,চারটা বাচ্চাকে তো সে নিজেরই করে নিয়েছিলো! লুকিয়ে কেন তাকে জন্মনিরোধক ঔষধ খাওয়াবে? বললে সে নিজেই খেয়ে নিতো।
তার আরো রাগ লাগছে গতকাল বিদায় নিয়ে আসার সময়, যখন রাশেদের মা তাকে শেষবার কিছু একটা বলে সতর্ক করছিলো। হয়তো এই কাজটার কথাই বলেছে, আরিদাকে সেটা বললে কি আরিদা বুঝতোনা? রাহাদ যথেষ্ট ছোট এই অবস্থায় আরেকটা বাচ্চা নেওয়াটা অযৌক্তিক, মোট কথা আর বাচ্চার প্রয়োজনই নেই, তবুও যেহেতু তার পেটের সন্তান নেই সেহেতু ভবিষ্যতের কথা ভেবে চিন্তা করতেই পারতো তবে সেটা অনেক পরে। আর এই বিষয়টা যে কেউ বুঝবে!
অথচ রাশেদ মার কথামতো লুকিয়ে কাজটা করেছে। সে তো তার মার কথামতো যেকোনো সময় বিষও দিতে পারে! এসব ভাবছে আর আরিদার ভেতরটা পুড়ছে।
আরিদার মা আরিদাকে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘ কিরে মা, মনডা ভালানা? জামাইয়ের লগে কিছু হইছে?
আরিদা ছলছল চোখে তাকিয়ে বললো,
‘ আম্মা আমি কি তোমার কপাল পাইছি? স্বামীরকালেও সুখ পাইলানা,সন্তানেরকালেও পাইলা না, আমারও কি এমন হইবো?
আরিদার মার বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো, কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,
‘ কি হইছেরে মা? আমি তো মনে করছি তুই অনেক সুখে আছত? আমি ভিত্তে ভিত্তে কত খুশি। কি হইছে আমারে ক?তোরে কি জামাই মারে?
আরিদা তড়িঘড়ি করে বললো,
‘ আরে না আম্মা মারেনা, আমি তো ভালোই আছি। খালি এরারে বুঝতে পারিনা,বড়লোক তো! আবছা ঝাপসা লাগে খালি ৷ আইচ্ছা অহন তোমরার জামাইরে ডাক দেও খাইতে।
আরিদার মা আর প্রশ্ন করলোনা, সে যা সহ্য করেছে তার থেকে অবশ্যই তার মেয়ে খারাপ নেই।
খাওয়ার সময় আরিদা একটা কথাও বললোনা। রাশেদ দু একবার এটা ওটা দিতে বলেছে সেটাই দিয়েছে, কিন্তু কোনো আওয়াজ করেনি। ঘরে এসে রাশেদ কয়েকবার আরিদাকে পর্যবেক্ষণ করলো। তারপর বলল,
‘ তোমারে একটা জায়গায় নিয়া যাবো, যাবা?
আরিদা উত্তর দিলোনা। রাশেদ আবার বললো,
‘ একটা সারপ্রাইজ আছে তোমার লাইগা। রেডি হইয়া লও।
আরিদার কোন প্রতিক্রিয়া নেই, কয়েকবার কথা না বলার কারণ জিজ্ঞাসা করার পর বলে উঠলো,
‘ রেডি হইতাছি, তবে অন্য কোনোখানে যামুনা, বাড়ি যামু।
রাশেদ উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
‘ আমি কি কিছু করছি? রাগ করছো ক্যান? লও ঘুইরা আই, ভাল্লাগবো। না কইরো না।
আরিদা রাশেদের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ আমি কে যে আমারে নিয়া ঘুরতে যাওন লাগবো? আম্মার থেইকা অনুমতি লইছেন?
রাশেদের চোখ বড় গেলো। আরিদা এতো শক্তভাবে কথা বলতে পারে তার জানা ছিলোনা। কিন্তু এই মূহুর্তে বুঝে গেছে, আরিদার রাগ নিয়ে প্রশ্ন করলেই সে ফেঁসে যাবে। কারণ শুরু থেকে এই অব্দি অনেক জটিলতা আটকে আছে, যা আরিদা জানেনা। তাই সে আরিদার দুইহাতে ধরে অনবরত বলতে লাগলো,
‘ রাজী হয়া যাও বউ, চলো আমরা ঘুরতে যাই,বিকালে বাড়িত যামু।
আরিদা জোর করে হাত ছাড়িয়ে বললো,
‘ ছাড়েন,ছাড়েন তো। যান যামু।
রাশেদ আরিদার হাত ছেড়ে দিলো। তারপর আরিদা কোনোরকম বোরকাটা পরে নিলো। রাশেদ একটা ধূসর রঙের শার্ট পরে প্যান্টে ইন করে নিলো। তারপর পকেট থেকে ছোট্ট একটা আতরের বোতল বের করে অল্প করে গায়ে মেখে নিলো। চুল ঠিক করতে করতে বললো,
‘ তাইলে চলো যাই।
আরিদা রাশেদের দিকে আড়চোখে তাকালো, সুন্দর লাগছে রাশেদকে। তাতে কি সে দেখবেনা এসব! সে হনহনিয়ে বের হয়ে গেলো। রাশেদ পেছন থেকে ডাকতে লাগলো,
‘ একলগে যাই, দাঁড়াও।
আরিদা থামলোনা, রাস্তায় গিয়ে থামলো। একটা রিকশা ডাক দিয়ে দুজন উঠে পড়লো। আরিদা একদম চেপে বসে আছে। রাশেদ হাত ধরার চেষ্টা করছে কিন্তু আরিদা হাত গুটিয়ে রেখেছে। রাশেদ আরিদার সাথে লেগে বসতে যাচ্ছে, আর আরিদা ওইদিকে চেপে যাচ্ছে, এক পর্যায়ে জায়গা শেষ, আর চাপা যাচ্ছেনা।
আরিদা রাগে ফেটে পড়ছে! কারণ রাশেদ যে তাকে কিছু বলবে বলেই রাগের কারণ আর জিজ্ঞাসা করছেনা সেটা বেশ স্পষ্ট। বাজারে এসে রিকশা থামলো,রাশেদ রিকশা থেকে নেমে একটা সিএনজি রিজার্ভ করলো। সিএনজিতে উঠে বসেই আরিদা খেয়াল করলো তার দিকে একটা বাইকার ছেলে তাকিয়ে আছে, সিএনজির ওইপাশে পেছন হয়ে দাঁড়িয়ে রাশেদ কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছে,কথা শেষ হতেই রাশেদ সিএনজিতে বসলো আর সাথে সাথে সিএনজি ছেড়ে দিলো।
আরিদা পেছন হয়ে দেখলো তাদের পেছন পেছন বাইকার ছেলেটা মাথায় হেলমেট লাগিয়ে আসছে। তাদেরকে ফলো করছে কিনা বুঝতে পারছেনা। এদিকে রাশেদ আবারও তার সাথে এসে চেপে বসেছে। হুট করে বাইকটা তাদের সিএনজিকে ছাড়িয়ে সামনে চলে গেলো। আরিদা এবার একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো, যাক তাদেরকে ফলো করছেনা। চোর ডাকাত কিনা এই সন্দেহে তার বুক কাঁপছিলো।
প্রায় ৪০-৫০ মিনিট পর তাদের সিএনজি একটা শিমুল বাগানের সামনে এসে থামলো। বিশাল বড় বাগান,শতশত শিমুল গাছ। লাল লাল ফুলে ছেয়ে আছে সবটা। অনেক মানুষই এখানে ঘুরতে এসেছে, ছবি তুলছে। রাশেদ ভাড়া দিলো। কিন্তু সিএনজি ড্রাইভার যাত্রীর জন্য দাঁড়িয়ে রইলো।
আরিদা দুইতিন কদম এগিয়ে গেলো, রাশেদ পেছন থেকে একটা দামী ফোন আরিদার সামনে ধরে বললো,
‘ এইটা তোমার! লও, ছবি তুলো। এখন থেইকা আমি দূরে থাকলেও আমাদের কথা হইবো।
আরিদার মুখে অস্পষ্ট একটা হাসির উদয় হলো। তার কখনোই নিজের একটা ফোন হয়নি। এই প্রথম তাকে কেউ ফোন উপহার দিচ্ছে। সে নিবে নাকি ভান ধরে থাকবে ভাবতে ভাবতেই ভো করে তাদের পেছনে কিছু একটা থামলো। আরিদা পেছনে ফিরে তাকালো আর তাকিয়েই চমকে উঠলো। সেই বাইকার ছেলেটা এখানে চলে এসেছে। আরিদা ভয়ে রাশেদের সাথে গিয়ে গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। ছেলেটা বাইক থেমে নেমে হেলমেট খুলে ডাক দিলো,
‘ কি বউ নিয়া খুব রঙঢঙ করতাছেন যে!
রাশেদ ছেলেটাকে দেখে অবাক হলোনা, স্বাভাবিকভাবে বললো,
‘ ফয়সাল?
ছেলেটা ভিলেনের মতো আগাতে আগাতে বললো,
‘ হ্যাঁ ফয়সাল। টাকার জোরে মামলা তুইলা নতুন বউ লইয়া খুব আমোদ করতাছেন? ভাবতাছেন বাঁইচা গেছেন?
আরিদা ভয়ে রাশেদের পেছনে লুকিয়ে পড়লো। রাশেদ শান্ত স্বরে বললো,
‘ ফয়সাল পাগলামি কইরোনা ভাই। তুমিও জানো আমার দোষ নাই, ক্যান আমার সাথে এমন করতাছো? মিথ্যা মামলা টিকবোনা এইটাই স্বাভাবিক।
ফয়সাল ছেলেটা রাগে গজগজ করতে করতে বললো,
‘ অ সব তাইলে এমনি এমনি হইছে? ও নিজেই নিজের ক্ষতি করছে?
শোন তুই দুনিয়ায় নির্দোষ বইলা বাঁইচা গেলেও আল্লাহ তোরে ছাড়বোনা।
রাশেদ হাত বাড়িয়ে ফয়সালকে ধরার চেষ্টা করে বললো,
‘ ফয়সাল তুই তুকারি কইরোনা, মাথা ঠান্ডা করো।
রাশেদের হাত ছিটকে দূরে সরিয়ে বললো,
‘ মাথা ঠান্ডা করুম? তোরে আমি খুন কইরা পরে ঠান্ডা হমু।
আশেপাশে লোকজন জড়ো হয়ে গেছে। সিএনজিওয়ালা দৌঁড়ে এসে ফয়সালকে টেনে দূরে সরিয়ে রাশেদকে বলতে থাকলো,
‘ ভাই আপনে ভেতরে যানগা। আমি হেরে বিদায় করতাছি।
ফয়সাল সিএনজি ড্রাইভারকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বললো,
‘ আমিই যাইতাছি, কিন্তু হেরে আমি পরে দেইখা নিমু,মামলা খালাস করলেই কি আমার থেইকা মুক্তি পাইয়া যাইবো? ফয়সাল কি জিনিস আজকে খালি বইলা গেলাম, পরে দেখাইয়া দিমু।
আরিদা আস্তে আস্তে পেছন থেকে সামনে এলো, দেখলো ছেলেটা চলে যাচ্ছে। সে রাশেদের দিকে তাকিয়ে বললো,
ছায়ার মুখোশ পর্ব ৬
‘ কে আছিলো ও?
রাশেদ ফয়সালের চলে যাওয়ার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
‘ শিরিনের ভাই। ও মনে করে শিরিনের মৃত্যুর জন্য আমি দায়!
আরিদার বুক কেঁপে উঠলো। কণ্ঠেও কাঁপুনি, তাও কাঁপা গলায় বললো,
‘ সত্যিই কি তাই?