ছায়ার মুখোশ শেষ পর্ব
তাজরীন খন্দকার
সূর্য ডুবে যাচ্ছে। বাড়ির উঠানে কবুতরগুলো খাবার খাচ্ছে, একেকটা কবুতরের পেট ভরে টইটম্বুর, তাও খাচ্ছে। কারণ সারারাত আর খাবার পাবেনা। আরিদার শাশুড়ী উঠানের চারপাশের সব গাছগুলোর গোড়ায় পানি দিচ্ছে, এইসময় পানি দেওয়া সবচেয়ে ভালো, সূর্যের তাপ থাকেনা ফলে পানির বাষ্পীভবন কম হয়, মাটি ঠান্ডা থাকে আর গাছ তার বৃদ্ধির জন্য দীর্ঘসময় পানির ব্যবহার করতে পারে।
এদিকে আরিদা বাইরে পড়ে থাকা সব জিনিসপত্র ঘরে নিয়ে এলো। উঁকি দিয়ে দেখলো রাশেদ ঘুমাচ্ছে। ডাক্তার এসে ঔষধ লিখে দিয়ে একটা ব্যান্ডেজ পেঁচিয়ে গেছে। আর আরিদা নিজে গিয়ে সেই ঔষধ কিনে এনেছে।
ঘটনাটাকে রাশেদ সবার সামনে মিথ্যাভাবে উপস্থাপন করেছে। বলেছে তার ভুলের জন্যই এক্সিডেন্টটা হয়েছে। তার শাশুড়ী বিশ্বাস করেছে নাকি করেনি জানেনা, কারণ তিনি রুম থেকে তাদের চিৎকার চেঁচামেচি করে কথা বলা নিয়ে অবশ্যই বোধগম্য ছিলেন। কিন্তু এটা নিয়ে তেমন একটা প্রশ্নই করেন নি।
সন্ধ্যার পর থেকেই আরিদা অনেক রান্নাবান্না করছে, এতো বড় একটা আঘাত করেছে, সরাসরি ক্ষমা তো চাইতে পারবেনা! তবে রাশেদের পছন্দের সবকিছু তো রান্না করাই যায়!
রান্নার ফাঁকে ফাঁকে কয়েকবার গিয়ে দেখেও এসেছে রাশেদের কিছু লাগবে কিনা! ব্যথার জন্য ঔষধ খেয়েও কব্জি পর্যন্ত মারাত্মক রকম ব্যথায় রাশেদ কাতর হয়ে আছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আরিদার শাশুড়ী আশপাশ দিয়ে হাঁটে কিন্তু কোনো প্রশ্ন করেনা। সে বুঝে উঠতে পারছেনা আরিদা সব শুনে কি তার ছেলেকে ক্ষমা করে দিয়েছে নাকি? এতো খাতির যত্ন তো এর আগে কখনোই করতে দেখেনি। নিজেই চিন্তা করলো ক্ষমা করে দিতেও পারে, আরিদার এমনিতেও মায়া বেশি। ক্ষমা না করেই বা কি করবে? তার তো যাওয়ারও জায়গা নেই।
বাচ্চাদের সবাইকে একে একে সুন্দর করে খাওয়ায়ে ফাইজার ঘরে ঘুম পাড়িয়ে দিলো। রাশেদ যেহেতু আজকে অসুস্থ তার সাথে সবাইকে রাখা সম্ভব না।
তারপর রাশেদের জন্য রান্না করা সব খাবার রুমে নিয়ে গেলো। রাশেদ এতকিছু দেখে একদম তাজ্জব দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রাশেদও আরিদার আচরণ বুঝতে পারছেনা! তবে কি তাকে ক্ষমা করে দিলো? তার ভেতরকার পাপবোধ, অনুশোচনা, ভেতরে ভেতরে প্রায়শ্চিত্তের আগুনে নিজেকে পুড়িয়ে দেওয়ার আংশিকও কি তাহলে আরিদা বুঝেছে? সে কি তখন বুঝাতে পেরেছিলো কিছুটা? বুঝেছে হয়তো! পৃথিবীর বুকে একজনও কি থাকবেনা যে তাকে বুঝবে? বুঝেছে বলেই হয়তো এতো আয়োজন!
রাশেদ খাওয়ার তাড়ায় গ্লাস নিয়ে হাত ধুতে গিয়ে দেখলো তার হাতে তো ব্যান্ডেজ! আরিদা হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে মৃদু হেসে বললো,
‘ অচল কইরা দিছি, ভার আমারেই বইতে হইবো। বসেন ঠিক কইরা, আমি খাওয়াইয়া দিতাছি।
কথাটা রাশেদের বুকের বামপাশটায় দ্রিম করে গিয়ে ধাক্কা খেলো, আর সেখানে থাকা হৃদপিণ্ডের উঠানামা এতো দ্রুত হতে লাগলো যে রাশেদ ব্যান্ডেজে মোড়ানো হাতটা বুকের উপর রাখলো। বিশ্বাস করতে পারছেনা এটা আরিদা বলেছে!
আরিদা ততক্ষণে মুখের কাছে খাবার ধরলো, রাশেদ আরিদার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে খাবার মুখে নিলো। দুই লোকমা খাওয়ার আগেই আরিদা তৃতীয় লোকমা তুলে মুখের কাছে নিলো, রাশেদ বা হাত দিয়ে আরিদাকে থামাতে গিয়ে হাতে ধরলো!ধরেই তার মনে হলো আরিদাকে ছোঁয়া তার বারণ ছিলো। সে সাথে সাথে হাত সরিয়ে নিলো। আরিদা বিষয়টা বুঝলো। কিন্তু কিছু না বলে হাসলো। রাশেদ বুঝলো ধরতে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু সে সাহস করে আর ধরলোনা। যদি আপত্তি না-ই থাকে তাহলে নিশ্চয়ই আরিদাই কোনো না কোনোভাবে তাকে স্পর্শ করবে! আরিদা সবগুলো রান্না থেকে একটু একটু খাওয়ালো। তারপর খাওয়া শেষ হলে সব নিয়ে চলে যেতে লাগলো,তখনি রাশেদ ডেকে বললো,
‘ বাচ্চারা আমার লগে থাকবোনা?
আরিদা পেছন না ফিরেই বললো,
‘ আপনার কিছু দরকার হইতে পারে, লগে আমিই থাকুম।
এটা শুনেই রাশেদের সবপাটি দাঁত বের হয়ে গেলো। হাসি যেন থামতেই চাচ্ছেনা।
আরিদা চলে গেলো। রাশেদ উঠে আয়নার সামনে গিয়ে বা হাতে নিজের চুল ঠিক করতে লাগলো, গালের কাঁচাপাকা গোঁফদাঁড়িতে হাত বুলাচ্ছে আর ভাবছে উফফ! আগে জানলে সেলুনে যাওয়া যেতো! ড্রয়ার থেকে তার পছন্দের পারফিউমটা অল্প মেখে নিলো।
তারপর রাশেদ গিয়ে আবার চুপচাপ শুয়ে পড়লো। কিন্তু আরিদা আসছেনা, অনেক্ষণ হয়ে গেলো।
রাশেদের ছটফটানি বাড়ছে, এতক্ষণ ধরে কি করছে? আসেনা কেন? সে কি গিয়ে দেখে আসবে? না সে যাবেনা। কি না কি ভাব্বে এতে!
তারপর নিজের ফোনটা হাতে নিলো, বা হাতে ফোন চালিয়েও ভালো লাগছেনা। তখনি পায়ের আওয়াজ পেলো, রাশেদের বুকের ধুকপুকানি বাড়তে লাগলো। আবারও হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে। আরিদা ভেতরে আসার সাথে সাথেই রাশেদ তাকালোনা, এমন ভান ধরলো যেন কে আসলো তাতে তার কোনো আগ্রহই নেই। তার পাগলামি বুঝতে দেওয়া যাবেনা, তাতে হাসির খোরাক হবে । কিন্তু মেঝেতে দাঁড়িয়ে আরিদা গলা খাঁকারি দিলো। এবার আর না তাকিয়ে পারলোনা, রাশেদ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়েই দ্রুত বাম হাত নিয়ে বুকের বামপাশে জোরে চেপে ধরলো, মনে হচ্ছে তার হাঁর্টটা বেড়িয়েই যাচ্ছে। আরিদা তার দেওয়া সেই ধূসর রঙের শাড়ীটা পরেছে, সাথে তার দেওয়া সব গয়না। মাথায় কোনো ঘোমটা নেই, কোমর পর্যন্ত নেমে আসা চুলের একাংশ ফ্যানের বাতাসে উড়াউড়ি করছে। চিকনাচাকনা জোড়াভ্রুয়ের অধিকারী আরিদা আজকে হাজারটা ফর্সা মেয়েকে অনায়েসে টক্কর দিতে পারবে! রাশেদের পলক আঁটকে গেছে গেছে, সাথে যেন জীবনই আঁটকে গেছে!
তার বিধ্বস্ত জীবনেও জীবনেও কখনো এতো সুন্দর মূহুর্ত আসবে তা ভাবনার অতীত ছিলো।
জীবনটাকে ভয়ংকর সুন্দর মনে হচ্ছে রাশেদের! রাশেদের কপালটাই ভালো, কি ভেবেছিলো আর কি হলো!
সকাল আটটা।
আরিদা রাশেদের পছন্দের তিন রকমের পিঠা বানালো। রাশেদ বাচ্চাদের নিয়ে মেঝেতে পাটি বিছিয়ে আয়েস করে খাচ্ছে। আরিদা কার কি লাগবে তদারকি করছে। আরিদার শাশুড়ী তার স্বামীর জন্য পিঠা নিয়ে রুমে গেছে। এই সময় তাদের গেইট থেকে ডাক এলো,
‘ রাশেদ ফয়েজী কি বাড়িতে আছে?
রাশেদ খাবার থেকে উঠে দ্রুত গেইটের কাছে গেলো। আরিদা পিঠা নিয়া খেলা করতে থাকা রাহাদকে কোলে নিয়ে বুকের মধ্যে কয়েক সেকেন্ড আঁকড়ে ধরলো, হয়তো বুকের মধ্যকার একটা অচেনা ধড়ফড়ানো অনূভুতিকে সামলাতে চাচ্ছে। তারপর উঠে ধীর পায়ে দরজায় গেলো। সে যেতেই রাশেদ তার দিকে তাকালো। তাকিয়ে বললো,
‘ ওহহহহ! এর লাইগাই আমার এতো খাতির যত্ন?
আরিদা কিছু বললোনা। রাশেদ বেশ হাসিখুশিভাবেই লোকগুলোকে বলতে লাগলো,
‘ এই যে আমি আপনাদের সাথেই আছি! আসুন ভেতরে বসি। আমার কিছু জরুরী কাজ আছে সেগুলো পরিবারকে বুঝিয়ে দেই।
তাদের একজন বললো,
‘ কিছু মনে করবেন না, আগে হাতকড়া পরাতে হবে।
তখনি আরিদার শাশুড়ী পেছন থেকে কে আইলো কে আইলো বইলা দরজায় এসেই চিৎকার দিয়ে উঠলো পুলিশ!
আরিদা তার শাশুড়ীর হাত ধরে ফেললো। আরিদার শাশুড়ী আরিদার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ আমার পুতে তো সব কিছু খালাস কইরা দিছিলো, আবার কেডায় করলো এই দুশমনি?
আরিদা বিরবির করে বললো,
‘ আমি!
আরিদার শাশুড়ীর চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। আরিদার কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো,
‘ কখন করলা? ক্যান করলা এইটা? বাচ্চাগুলির কি হইবো এখন?
আরিদা তার শাশুড়ীর চোখে চোখ রেখে বুক টান করে বললো,
‘ কাল যখন উনার ওষুধ কিনবার লাইগা বার হইছিলাম তখন থানায় গেছিলাম। উনি এবং উনার সঙ্গী দুজনের নামেই মার্ডারের মামলা দিয়া আইছি। তাই দ্রুত গ্রেফতার হইছে! পরে সব বিচার বিশ্লেষণ কইরা যা পাইবো তার অনুযায়ীই শাস্তিই হইব। কোনো অপরাধীরই এমনে গায়ে বাতাস লাগাইয়া ঘুরার অধিকার নাই।
আরিদার শাশুড়ী অবাকের শেষপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। কিন্তু এই মূহুর্তে আর কিছু বলতে পারছেনা। রাশেদ হাতে হ্যান্ডকাফ পরা অবস্থায় পুলিশ সদস্যদের নিয়ে রুমে গিয়ে বসলো। তাদের মধ্যে একজন সিনিয়র সদস্য রাশেদের কানে কানে কি যেন বললো। কি বলেছে আরিদা শুনেনি। কিন্তু রাশেদ জবাব দিলো,
‘ নাহ আমি শাস্তির জন্য প্রস্তুত, আজও যদি টাকার জোর কাটাই আমার পুরো জীবনটাই ব্যর্থতায় ছেঁয়ে যাবে। আমি কোনোদিন মাথা উঁচু করে চলতে পারবোনা! অনেক পালিয়েছি, নিজের ছায়ায় মুখোশ লাগিয়ে নিজেকে ভালো দেখানোর চেষ্টা করেছি, কিন্তু শান্তি পাইনি। এবার যদি শাস্তিই আমার শান্তি হয়, তবেই মুক্তি মিলবে আমার! আর আমার পালানোর রাস্তাও নাই অফিসার।
পুলিশ অফিসার আড়চোখে আরিদাকে দেখলো।
এদিকে রাশেদ আরিদাকে ডাকলো, ডেকে তার হাতে কয়েকটা কাগজ দিয়ে বললো,
‘ আমার ব্যাংকের যাবতীয় তথ্য। এগুলো সব তোমার। যা লাগে সব খরচ করবা। আর এই কার্ডটা রাখো, এটা আমার সবচাইতে বিশ্বস্ত সহচরের কার্ড, সে আমার ম্যানাজার আমার বন্ধু আর কাজের একমাত্র ভরসাযোগ্য মানুষ । যার উপর যাবতীয় দায়িত্ব দিয়া আমি রিলাক্সে যা খুশি তাই করতে পারি। তুমি প্রতিদিন তার থেকে একটা হিসাব নিবা। আমার অনুপস্থিতিতে তুমি সবকিছু সামলাইবা! সরাসরি যেহেতু মার্ডার করি নাই, আল্লাহ হায়াতে রাখলে প্রাপ্য শাস্তি পাইয়া ফিরা আমু। ততদিন আমার বাচ্চাগুলিরে দেইখা রাইখো। এতদিন আমার তাদের লাইগাই ডর আছিলো, তারা কার ছায়ায় আশ্রয় নিবো? কিন্তু তোমারে আমি এখন চোখ বন্ধ কইরা তাদের জীবনের ভার দিতে পারি। তুমি শিরিনের মতো একজন শক্তিশালী নারী! আমার বিশ্বাস তুমি সব পারবা। আমার মতো খারাপ মানুষের কপালটারই তুলনা হয়না, খোদা হীরার টুকরা মিলাইয়া দেয়, কিন্তু মূল্য বুঝিনা।
আরিদার শাশুড়ী কাঁদছে, কিন্তু আরিদা একদমই কাঁদছেনা। বরং কাঁদলেই একটা মৃত মানুষের সাথে তার অন্যায় করা হবে। সে আগে শাস্তি ভোগ করুক, মনের বাইরেও শরীরী প্রায়শ্চিত্ত করুক। ফের দেখা হওয়া না হওয়া আল্লাহ জানে, তাই শেষ সময়টুকু তার স্বামীর প্রাপ্য অধিকার দিয়েই স্মৃতিময় করে দিয়েছে!
রাশেদ তার মাকে বললো,
‘ আম্মা আরিদাকে শিরিনের মতোই আদরে রাইখেন। শিরিনের মৃত্যুর পর আপনিই একদিন কইছিলেন আমারে আপনার পোলা ভাবতে আপনার ঘৃণা হয়, আম্মা আমি ঘৃণার বোঝা হালকা কইরা বুক ফুলাইয়া আপনার কোলে ফিরুম। মানুষ নাকি ভুলের সাজা পাওয়ার পর ফুলের মতো আবার নিষ্পাপ হইয়া যায়। আমিও আম্মা নিষ্পাপ হইয়া আমু। আপনি শুধু আরিদারে একটু আগলাইয়া রাইখেন। তাইলে আরিদা আমার বাচ্চাগুলারে দ্বিগুণ আগলাইয়া রাখবো।
তারপর আরিদার দিকে তাকিয়ে রাশেদ বললো,
‘ আর আরিদা তুমি ফয়সালরে জানাইয়া দিও আমার জেলে যাওয়ার এই সংবাদ। আমি জানি সে আমার বইনের লগে কি করবে? কারণ সে জানতো তার বোন কি কারণে কষ্ট পাইছিলো। বইলা দিও, আমি শাস্তি পাইতাছি। তাহলে আমার বিশ্বাস আমার বইনের লগে আর খারাপ করবোনা। ওরে আমি চিনি, আমার সাজার কথা শুনলেই সে শান্ত হইয়া যাইবো।
আরিদা মাথা নাড়লো।
রাশেদ এবার অফিসারকে বললো,
‘অফিসার আমার সাথে একটু আব্বার রুমে আসবেন? আব্বাকে একটু জড়িয়ে ধরতে চাই। আব্বারে কোনোদিনও জড়িয়ে ধরা হয়নি আমার। জানিনা ফিরে এসে আর আব্বাকে দেখতে পাবক কিনা!
আরিদা এবার কেঁদে দিলো। সে একদম চাচ্ছেনা, তবুও তার চোখে পানি এসে পড়েছে।
রাশেদ পুলিশের সঙ্গে রুমে যেতেই তার বাবা হাঁসফাঁস করতে শুরু করেছে, ছেলেরে ধইরা কাঁদতে শুরু করে দিয়েছে।
পেছন থেকে এক পুলিশ সদস্য বললো,
‘ স্যার মানতাসা ম্যাডামরকেও ধরে ফেলছে। চলেন এবার উনারে নিয়ে থানায় যাই। এই মামলা দ্রুতই আদালতে উঠবে।
এটা শুনতেই আরিদার ঠোঁটের কোণে একটা হাসি ফুটলো। রাফান আর রাইসা পুলিশ দেখে ভয়ে ফাইজার রুমে বসে আছে, আর রাফি পিছু পিছু গিয়ে সবকিছু দেখছে। তাকে দেখলে মনে হয় সে যেন সব বুঝতে পারছে। কিন্তু একটা শব্দও করছেনা। যখন রাশেদকে নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে রাশেদ রাফিকে বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরে একটা চুমু খেলো। আর পেছনে রাফান আর রাইসার লুকোনো দৃশ্যে তাকিয়ে বললো,
‘ তুমি আমার বড় ছেলে, আমার সাহসী পুত্র। ভাইবোন আর মাকে দেইখা রাইখো হ্যাঁ?
রাফি মাথা ঝাঁকালো। রাফান আর রাইসা দরজার পেছন থেকে উঁকি মারছে, সামনে আসছেনা। রাশেদের ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে তাদের জড়িয়ে ধরবে। কিন্তু তাহলে তার যে যাওয়া হবেনা, রাইসা এসে তাকে একটু ছুঁয়ে দিলেই সে সকল মনোবল হারিয়ে ফেলবে। শুধু আরিদার কোলে থাকা রাহাদের গালে ছোট্ট করে একটা চুমু দিয়ে বললো,
‘ বাবার চেহেরা ভুইলা যাইয়োনা বাজান! দ্রুতই ফিরা আমু।
তারপর দ্রুত পায়েই বের হয়ে চলে গেলো। আরিদা গেইটে হেলান দিয়ে চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। বাচ্চাদের থেকে তাদের বাবাকে আলাদা করে দেওয়ায় কিঞ্চিৎ খারাপ লাগছে আবার অপরাধী তার প্রাপ্য সাজা মেনে নিয়েছে বলে তার অদ্ভুত একটা শান্তিও লাগছে!
তিনমাসের গভীর অনুসন্ধান আর পর্যবেক্ষণে সব সঠিক তথ্য আদালতের হাতে উঠে এসেছে, সাথে উঠে এসেছে মানতাসার কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য, সে মাদক ব্যবসার সাথে মারাত্মকভাবে জড়িত, তার অনেক প্রকার মাদক আমদানি রপ্তানির সাথে হাত রয়েছে। ইয়াবা,হিরোইন,কোকেইনসহ অসংখ্য মাদকদ্রব্য বহুবার চালান করেছে, তার কয়েকজন সাথী সঙ্গীকেও ধরে আনা হয়েছে। সে এতটাই উচ্চাকাঙ্খী ছিলো যে সে টাকার জন্য অন্ধকার পথে পা দিতেও দ্বিধা করেনি।
যোগ্য প্রমাণ আর সাক্ষীদের জবানবন্দিতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮ অনুযায়ী মানতাসার বিরাট অংকের জরিমানাসহ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড নিশ্চিত করেছে আদালত।
এদিকে রাশেদের অন্য কোনো অপরাধ শনাক্ত করতে না পারায়, আর সরাসরি স্ত্রীর মৃত্যুতে তার হাত না থাকায় অর্থদন্ডসহ ৫ বছরের জেল নিশ্চিত করেছে। আর রুগীর বিস্তারিত না জেনে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য ওই হাসপাতালেও জরিমানা জারি করেছে।
৫ বছর পর,
ফাইজা আর ফয়সাল তাদের সাড়ে চার বছরের মেয়ে ফৌজিয়াকে নিয়ে সবার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ফয়সাল রাশেদের শাস্তির সংবাদ শুনে সত্যিই প্রতিশোধের তাড়না থেকে বের হয়ে এসেছিলো। প্রাপ্য শাস্তি পেয়েছে বলে আত্মতৃপ্তির সহিত অভিনন্দন জানানোর জন্য কারাগারের বাইরে দাঁড়িয়ে রাশেদের অপেক্ষায় আছে।
রাশেদ বের হয়ে সবার আগেই দেখলো তার ছেলেমেয়েদের। সবাই কি সুন্দর বড় হয়ে গেছে। কতো লম্বা লম্বা হয়ে গেছে। তারপর সে গিয়ে তার মাকে জড়িয়ে ধরলো। তার বাবা এখনো ভালো আছে শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো। আর আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে খুঁজতে লাগলো, কিন্তু সে যাকে খুঁজছে সে নেই। রাশেদ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললো,
‘ আম্মা আরিদা?
তার মা হেসে বললো,
ছায়ার মুখোশ পর্ব ১৬
‘ যেই পরিমাণ দায়িত্ব চাপায়া গেছত বেচারির উপরে, তার কি দম ফালানোর সময় আছে? বাড়িতে আছে তোর লাইগা সেইদিনের মতো সাইজা গুইজা হরেক পদের রান্না করতাছে! যেমন রাইখা গেছিলি তেমনই আছে। চল বাড়ি যাই।
রাশেদের শুষ্ক চেহেরাটা কেমন যেন ঝলমল করে উঠলো। বুকের ভেতর এখান থেকেই ধুকপুক শুরু হয়ে গেছে।