ছায়াস্পর্শ পর্ব ১৬

ছায়াস্পর্শ পর্ব ১৬
জান্নাত চৌধুরী

রাতের কালো আধারিতে লাল আলোর এক বাল্ব জ্বলছে সেচ ঘরে। পুরো ফাঁকা এক চকের মাঝে টিনের তৈরি এক সেজ ঘর –
তাশের আসর বসেছে। রেজা বেশ কয়েকবার জিতেছে , মাচায় বসে আরাধ্য সিগারেট টানছে। হিসেবে মিলছে না , ফোন বেজে উঠলো – অচেনা নাম্বারে কল। আরাধ্য ঠোঁটে সিগারেট চেপে ফোন রিসিভ করতে নিয়েও কেটে দিলো।
সিগারেট ফুরিয়ে আসছে, এদিকে দান উঠতেই বেশ মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয় রেজা। আজ আর সে খেলবে না – বাকিদের যেতে বলে বলতেই এক এক করে বেড়িয়ে যেতে থাকে সকলে। আরাধ্য সিগারেটের শেষ টান দিয়ে ছুড়ে মারে মাটিতে।

-“ছোট নবাব” ! ফিরবেন নাহ –
রেজা ডাকতেই আরাধ্য শুয়ে পড়ে মাচায়। লাল বাল্বের আলোর দিকে তাকিয়ে থাকে কিছু সময়। রেজার গাঢ় সন্দেহ জাগে মনে , কাহিনী কি বুঝতে চেয়ে আবারো প্রশ্ন করে –
-আপনি কি কিছু চিন্তিত ছোট নবাব!
আরাধ্য চোখ বুজলো , গাঢ় এক দীর্ঘশ্বাস নিংড়ে বলে –
-“আর চিন্তা , চিন্তা মানেই চিন্তা। আর এই চিন্তার সাথে যোগ হয়েছে আরো চিন্তা।সবশেষ আমার জীবনটাই চিন্তা, বুঝলি রে শামসির পুত।
রেজা বিরক্ত হয় “ কথায় কথায় এই শামসির পুত শুনতে তার একটু ভালো লাগেনা। ভারাক্রান্ত কন্ঠে বলে ,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-“আপানার এতো চিন্তার কারণ কি আমার আব্বা নাকি ছোট নবাব ?
আরাধ্য শুয়ে থেকেই কিছুটা কাত হয়ে রেজা মুখে দিকে তাকিয়ে বলে –
– “জীবনডা দেখছি অর্জুন গাছ হয়েছে, সবাই ছাল তুলে যার যার কাজে লাগাচ্ছে। আমারো কিছুর প্রয়োজন কোনো মান্দারি শালা আমলেই নিচ্ছে না !
রেজা কপালে গাঢ় ভাজ “ আরাধ্য কথার আগামাথা কিছুই তার মাথা ক্যাপচার করতে পারছেনা। রেজা দুহাতে চুল এলোমেলো করে ধৈর্য্য নিয়ে এবার বেশ শান্ত গলায় প্রশ্ন করে –
“ বলছিলাম কি ছোট নবাব , ব‌উ রানী কি ভুল ভাল কিছু করেছে আপনাকে ?
আরাধ্য চমকানো ভাব নিয়ে বলে – “ ওই চেংড়ি যদি ভুলে ভালে ,আমাকে ভুলিয়ে কিছু করতো। তবুও নিজের পুরুষত্বের অহংকার করতাম। তবে তার যে হেডাম , ছুয়ে দিয়েই নাগিনের মতো ফোঁস করে ফ্যানা তুলে।
রেজা কিছুটা মুসকি হেসে মাচায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বলে-

– ভাই আপনার অনুভূতি একটা ভাগ করেন। আম্মা কয় আমারেও বিয়া দিবে। আপনার রিভিউ নিয়া আমিও বিয়া করে ফেলতাম।
আরাধ্য ফোট করে উঠে বসে , এ লাথি মারে রেজার পশ্চাৎ বরাবার বেচারা হুমড়ি খেয়ে মাটিতে পড়তেই আরাধ্য বলে-
-এই হলো আমার অনুভূতি। আমি শালা এখনো বাসর রাতে বিড়াল মারতে পারলাম না। তুমি বেটা এসেছো আমার কাটা
ঘায়ে লবণ ঠুকতে।
রেজা করুন চোখে কিছু সময় তাকিয়ে থাকে আরাধ্যের চোখ পানে। ও চোখ দুটো যেন গিলে নিচ্ছে তাকে রেজা মিইয়ে যাওয়া ভেজা বিড়ালের মত করে বলে

-তাই বলে এত জোরে লাথি দেবেন ছোট নবাব
আরাধ্য মাচা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় , জিপারের অংশের জিন্স টেনে বলে-
-বংশের বাতি যে ফুটো করলাম না তাতেই শুকরিয়া আদায় করা উচিত তোর!
রেজা দ্রুত হাতে হাত রাখে ট্রাউজারে জিপারের উপর। আরাধ্য সেদিকে একবার তাকিয়ে মুঝকি হেসে বেরিয়ে যায় সেচ ঘর থেকে।

রাতের আকাশে চাঁদ উঠেছে ,অর্ধপূর্ন চাঁদের চারপাশে মেঘের ভেলা ভাসছে। চাঁদ মুখ লুকাতে চাইছে মেঘের আড়ালে। মানহা ছাদের কিনারায় এসে পা ঝুলে বসেছে, আজকাল রাতবিরেতে ছাদে এসে বসতে তার ভালোই লাগে। এইতো কিছুদিন আগেও রাতের আঁধারে বেলকনিতে দাঁড়াতেও ভয় পেতো যে মেয়েটা সে নাকি ছাদে বসে হাওয়া খাচ্ছে ।
পরিস্থিতি কি তবে মানুষকে পাল্টে দেয়। সত্যিই কি তাই? মানহাকে তবে পাল্টে গেছে বদলে নিয়েছি নিজেকে? প্রশ্নের উত্তর নেই! ঝড়ো বাতাস বইতে শুরু করে, চাঁদ সম্পূর্ণ মুখ লুকিয়ে নিয়েছে। মানহা তাচ্ছিল্যের হেসে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে

এত পরীক্ষা নিও না বিধাতা
তবে তোমার ধারের জীবন তোমাকেই ফিরিয়ে দেব
কথা শেষ করে দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস ফেলে সে , নিস্তব্ধ নিশিথের ওই চাঁদেরও বুঝি মুখ লুকাবার জায়গা রয়েছে। শুধু নেই ব্যর্থ প্রেমিকাদের। এক পাক্ষিক ভালোবাসা যতটা সৌন্দর্য্য নিয়ে জীবনে আসে, ঠিক ততটাই তিক্ততা মুড়িয়ে ফেলে চলে যায়।
মানুষটা যতটা সহজে দূরে চলে যায় আমরা ঠিক ততটা সহজে তাদের ভুলতে পারি না। তাদের জীবনে হয়তো আমরা কয়েক পাতার ছোট এক অধ্যায়, অথচ আমাদের পুরো উপন্যাস জুড়েই ছিলো তারা।
বিজলি চমকাচ্ছে বৃষ্টি ঘুনিয়ে এলো বলে। মানহা চোখ বুঝে নেয়। সাথে সাথেই দু ফোটা নোনা জল গড়িয়ে পড়ে চোখের কোণ উপচে‌।

ঘন বাতাস বইছে- বেশি সময় লাগে না , বাতাসের তালে বৃষ্টির ফোঁটা এসে আছড়ে পড়ে মানহার মুখে। কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই ঝিপঝিপিয়ে বৃষ্টি আসে। ভিজিয়ে দেয় দুটো কান্না মিশ্রিত চোখ। জ্বলন্ত লাভায় পুড়তে থাকা এক ভঙ্গুর হৃদয়ের শিকার হয় এই নিশিথের আগমনী বৃষ্টি।
বৃষ্টি ছন্দে আকাশ ডাকছে ,মানহা চেঁচিয়ে বলে –
এসো বৃষ্টি , মুছে দাও তার স্মৃতি
নিভিয়ে দাও মোর বুকের আগুন।
ভিক্ষে দাও কিছুটা শান্তি।।
আমি ভিক্ষারীনি , বিষাদ’ময়ী
তাহাকে ছুঁতে চেয়েও ছুঁতে পারিনি।
তবুও অপেক্ষায় ছিলাম বহুদিন.
এই বুঝি সে ডাকবে ,আমায় ভালোবাসবে।

কেটে যেতে থাকে সময় ধূসর নীল আকাশ বেয়ে গড়িয়ে পড়া পানি শান্ত করে প্রকৃতি। মানহা দুচোখ বুজে উপভোগ করে এই বৃষ্টি বিলাশ। মনের কোণে ভেসে ওঠে সেই প্রিয় ‌কিছু লাইন –
কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে
কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে-
তোমারে দেখিতে দেয় না
মোহমেঘে তোমারে দেখিতে দেয় না
মোহমেঘে তোমারে
অন্ধ করে রাখে যে
তোমারে দেখিতে দেয় না
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই
চিরদিন কেন পাইনা?

প্রবল গতিতে বৃষ্টির ঝরছে , ‌ ঝড় বাতাস এসে বারংবার আঁচড়ে ফেলছে জানার পর্দা। থেকে থেকেই বিজলির আলো এসে আলোকিত করছে পুরো ঘর। ইফরাহ বিছানা
ছেড়ে এগিয়ে গিয়ে লাগিয়ে দেয় জানালার কাচ। টেনে দেয় সেই স্নিগ্ধ সাদা রঙা পর্দাটা।বেশ রাত হয়েছে ,সব কিছু ঠিকঠাক করে বিছানায় এসে বসে সে।
আরাধ্য এখনো ঘরে ফেরেনি। তাতে কি মেয়েটার চিন্তা হচ্ছে? একদম নয় ,সে ভাবতে চায় না কিছু।
দিনের ভ্যাপসা গরম টা কাটিয়ে নিচ্ছে রাতের এই বৃষ্টি। একটু শীত শীত লাগছে বটে। ইফরাহ বালিশে হেলান দিয়ে পায়ের উপর একটা কাথা টেনে নেয়।

বেশ দোটানায় পড়েছে সে , কি করা উচিত বুঝতে পারছে না। আরাধ্য জন্য তার অপেক্ষা করা উচিত নাকি শুয়ে পড়বে। এসব নিয়েই বেশ কিছু সময় ভাবে সে। শেষে বিরবিড়িয়ে বলে-
-আজব তো আমি মানুষটাকে নিয়ে এত কেন ভাবছি? তিনি প্রাপ্তবয়স্ক নিজের ভালোটা ঠিক বোঝেন।
ইফরাহ অপেক্ষা করবে না তার জন্য। নিজের মনকে এক বাক্যে স্থির করে শুতে যাবে , এমন সময় দরজায় টাকা পড়ে। শেষ শুতে গিয়েও আর পারল না। পায়ের কাথা সরিয়ে এগিয়ে যায় দরজার দিকে। দরজা খুলেই দেখে –
ভেজা চ্যাপচ্যাপে গেঞ্জি হাতে করে , উদাম শরীরে দাঁড়িয়ে আছে আরাধ্য। বুক ভর্তি লোমগুলোতে ফোঁটা ফোটা পানির কণা। লোকটা বেশি ফর্সা নয় তবে বুকটা মাত্রাধিক উজ্জ্বল। ইফরাহ দৃষ্টি নামিয়ে নিয়ে পাশ কেটে দাঁড়াতেই ,ঘরে প্রবেশ করে আরাধ্য।

ঔ ভেজা কাপড়ের পানিতে পুরো ঘর ভিজে উঠছে। বেশি সময় দাঁড়ায় না আরাধ্য, বিছানার পাশ হতে তোয়ালে তুলে এগিয়ে যায় গোসলখানার দিকে। তার পায়ের প্রতিটি চাপ যেন ফ্লোরে দাগ কেটে যায়। ইফরাহ তার যাওয়ার দিকে কিছু সময় তাকিয়ে বেড়িয়ে যায় ঘর ছেড়ে-
দিনে মাত্রাধিক জ্বর ছিল লোকটার সে কথা ইফরাহ ভুলে নি। এত রাতে আবার ভিজে ফিরেছেন! জ্বর নিশ্চয়ই আরো বৃদ্ধি পাবে?

রাতের প্রায় মধ্য প্রহরের কাছাকাছি।পুরো বাড়ি শান্ত ,গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন প্রায় সকলে। ইফরাহ সিড়ি বেয়ে নেমে সোজা এগিয়ে যায় রন্ধনশালার দিকে। যদিও সে জানে না বাড়ির কোথায় কি আছে তবে খুঁজে নেবে।
রন্ধন ঘরে প্রবেশ করে প্রথমে এদিক ওদিক কিছু একটা খুঁজে চলে সে। তবে কাঙ্ক্ষিত বস্তু চোখে না পড়ায়, রন্দনশালা হতে বেরিয়ে খাবার টেবিলের দিকে এগিয়ে যায় সে। টেবিলে দুটো প্লেটে দুজনের খাবার সাজানো , সাথে দুটো দুধের গ্লাস।
ইফরাহ দুধ খায় না এই জিনিসের প্রতি তার ভীষণ অনিহা। বাড়ির গাভিটার দুধ দোয়াতো জোহরা বেগম। গ্লাস ভর্তি দুধ দুই বোন কে খেতে দিতো‌। তবে তখন কি তা সে খেতো নাকি? ভুলিয়ে ভালিয়ে রাইসা কে দিয়ে খাওয়াতো পুরোটা।
রাইসা তখন খেপে গিয়ে বলতো

-শোন আপা, গুরুজনে কয় দুধে লাবণ্য বাড়ে। আমি কিন্তু প্রতিদিন দুই গ্লাস দুধ খাই। মানে আমি বেশি সুন্দরী হয়ে যাবো‌। তুই কিন্তু তখন বেল পাবি না আপা ..
রাইসা ঢকঢক করে দুই গ্লাস খালি করতেই ,ইফরাহ তখন হাফ ছেড়ে বাচতো!
প্লেটের খাবার গুলোর দেখে নিয়ে ,আবারো রন্ধনশালার দিকে এগিয়ে যায় সে। গ্লাসের দুধ ঠান্ডা পানি হয়ে গিয়েছে , গরম করার প্রয়োজন‌। রন্ধনঘরের চুলা জ্বালিয়ে দুধ গরম করছ সে। এক হাতে খাবার অপর হাতে দুধের গ্লাস নিয়ে হাটা ধরে ঘরের দিকে। ঘরে এসে খাবার গুলো টেবিলে রেখে গোসল খানার দিকে তাকায় ইফরাহ্।

-মধ্যরাতে ঘন্টাখানেক ধরে কি এত গোসল করছেন তিনি?
মনে মনে এমন হাজারো প্রশ্ন করে সে। কেটে যায় আরো মিনিট পাঁচেক..
আরাধ্য গোসলখানার দরজা খুলে ঘরে পা রাখতে লম্বা এক হাঁচি দিয়ে বলে –
-আজকাল শালার সবাই দেখছি আমার পিছনে বড় বাঁশ দিতে উঠে পড়ে লেগেছে।
ইফরাহ বুঝলোনা আরাধ্য কি নিয়ে কথা বলছে ,তাই কোনো উত্তর করে নি সে। আরাধ্য কাঁপতে কাঁপতে বিছানায় গিয়ে বসে। আশ্চর্য কান্ড আজ সে এসেছে থেকে মেয়েটাকে একবারেও বিরক্তি করে নি। ইফরাহ কিছুটা কৌতুহলী হয়ে প্রশ্ন করে –

-খাবেন না ?
নরম কন্ঠের শান্ত ডাকে আরাধ্য তাকায় ইফরাহর দিকে ,মুখ ফুটে কিছু বলতে নিয়ে আবারো হাচি দেয় সে। পরপর চারটে হাঁচি দিয়ে খান্ত হয়।
চুল বেয়ে পানি পড়ছে। মুছে নি ঠিক মতো ,ওত সময় তার নেই। ইফরাহর নজর এড়ায় না এসব , ক‌ই থেকে জানি এক শুকনো তোয়ালে এনে আরাধ্যে সামানে দাড়ায়।
-মাথা তুলুন!
ইফরাহর কথায় কানে আঙ্গুল ঢুকিয়ে কিছুটা চুলকে নেয় আরাধ্য। তারপর নিজেই বিরবিয়ে বলে –
-এই কান টাও না ,একেবারে যা তা হয়েছে বাল ! কিসব ভুলভাল শুনে ফেলে!
ভীষণ বিরক্ত হয় ইফরাহ ,চোখ বুজে শ্বাস ফেলে। মনে মনে একশত অভিযোগ তার নিজের নামে। ইফরাহর ধ্যান ভাঙ্গাতে আরাধ্য তুড়ি বাজিয়ে বলে –

-এই ব‌উ কাহিনী কি বলো তো ? আজকাল যত্ন করছো , মেরে টেরে ফেলার পরিকল্পনা করছো নাকি?
ইফরাহ হাত বাড়িয়ে তোয়ালে লাগায় আরাধ্যের চুলে। বেশ যত্ন নিয়ে আলতো হাতে চুলে মুছতে নিয়ে জবাব দেয়-
-মারতে হলে যত্নের প্রয়োজন হয়না। অন্য অনেক উপায় আছে , এই যেমন ধরুন – বুকের বাম দিকের মাঝ‌ বরাবর ছুড়ি বসিয়ে দেওয়া
আরাধ্য মুসকি হেসে ইফরাহর হাত ধরে নিয়ে বলে-
-“নিজেকে অতি চালাক বানতে গিয়ে ,পদে পদে বোকা বুনে যাওয়ার‌ যা ব্যাপার‌খান। উফস সেই রক্তকমলিনী’
ইফরাহ হাত নামিয়ে নেয়।‌লোকটা তাকে ভাঙ্গতে চাইছে তা সে বেশ বুঝতে পারে। ভেজা তোয়ালে হাতে রেখেই জিজ্ঞেস করে –

-কোন আকাম করে ফিরেছেন আজ ? এত রাত অবদ্ধি নিশ্চয়ই কোনো ভালো কাজ করে ফেরেন নি ?
আরাধ্য অবুঝের মতো তাকায় ইফরাহর চোখে। পরক্ষণেই আবার দৃষ্টি নামিয়ে বলে – কৈফিয়ত চাইছো ?
-যদি বলি হ্যাঁ চাইছি ।
সামনের রমনীকে একটুস দেখে আরাধ্য মাথার চুলে হাত বুলিয়ে বলে –
-“চকে গিয়েছিলাম’
ইফরাহ গাঢ় এক নিঃশ্বাস টে আবারো বলে –
-এতো রাতে চকে কি অপকর্ম করেছেন আপনি ?
চুলে হাত বুলাতে বুলাতেই চুল টেনে ধরে দাঁতে দাঁত পিসে আরাধ্য বলে – “সামলে যাও মেয়ে ভুলে যেও না আমি কে ? কার সামনে দাঁড়িয়ে তুমি।”

-ভুলিনি অমি আপনি কে ! তবে আপনি হয়তো ভুলে যাচ্ছেন আমি কে ?
আরাধ্য এক ভ্রু উঁচিয়ে তাকায় ইফরাহর দিকে। কিছু সময় ল্যাদা বাচ্চা মতো তাকিয়ে থেকে বলে –
কে তুমি ?
-মীর পরিবারের ব‌উ রানী। আপনার ঘরনী , আপনার অর্ধাঙ্গিনী। আমি মানতে না চাইলেও খুতবা যখন পড়েছি আপনি আমার স্বামী।
ঘর কাঁপিয়ে হেসে ওঠে আরাধ্য। হাসির মাঝেই উঠে দাড়ায় সে , এক পা দু’পা করে এগিয়ে গিয়ে বলে-
“ক্যারেক্টার পাল্টে নিয়েছো দেখি?”
-শেয়ালের কাছে যেমন মুরগি সুরক্ষিত নয়। তেমনি আপনার জানোয়ারের কাছে কোনো সুস্থ মনের মানুষ সুরক্ষিত নয়।
থেমে যায় আরাধ্যের পা , মূহুর্তেই হিংস্র পশুর ন্যায় থাবা দিয়ে ধরে ইফরাহর গলা। ধীরে ধীরে চাপ বাড়িয়ে বলে –

-“ কেটে পিস পিস করে নদিতে ভাসানোর আগেই সামলে যাহ। নয়তো দাফনের জন্যেও কেউ হদিস পাবে না।”
আরাধ্য হুমকি যেন আরো জেদ বাড়িয়ে তোলে ইফরাহর। কন্ঠে কিছুটা তেজ যোগ করে বলে –
-আপনার মত অমানুষ এটাই পারে, শুধু দুর্বলের ওপর ক্ষমতা ফলানো।
আরাধ্য আরও শক্ত করে চেপে ধরে ইফরাহর গলা! বিকৃত হচ্ছে তার মস্তিষ্ক এই মেয়ে কি তা বুঝতে পারছে না। যেচে পড়ে কে মরণ কে ডেকে আনে। আরাধ্য রাগান্বিত গলায় বলে-
-গলা একদম নামিয়ে কথা বল। নাহলে টুটি টা ছিঁড়ে নেব একদম। দুর্বলের মুখ চালাতে নেই জানিস না ? সাময়িক ছাড় দিচ্ছি তার মানে এই না মুক্তি দেবো তোকে।

ইফরাহ তাচ্ছিল্য হাসে , চোখের কোণে পানি এসে জমেছে। হয়তো পাতা বুঝলেই টুপ করে পড়ে যাবে দু এক ফোঁটা। আরাধ্যের আগুন জ্বলতে থাকা চোখের দিকে তাকিয়ে কন্ঠ কিছুটা খাদে নামিয়ে বলে –
“জানেন তো- ছায়ার সাথেও বসবাস হয়! তবুও আপনার মত পিচাশের সাথে না।
আলগা হয় আরাধ্যের হাতের বাঁধন। গলা ছাড়িয়ে কাঁশতে থাকে ইফরাহ। কোনোমতে নিজেকে সামলে বলে-
-বইয়ের মত পাতা উল্টালে যদি নতুনের সূচনা হতো। তবে আমি সবার আগে এই অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তি নিতাম।

ইফরাহর কথা শেষ হওয়া মাত্রই এক হাতে তার চুলের গোছা চেপে ধরে আরাধ্য । দাঁতে দাঁত চেপে বলে –
-শোনো মেয়ে, কালো মাটি আঁচড়ে সাদা ফুল ও মলিন হয়। ঠিক তেমনি নোংরা মানুষের কাছে এলে সাধু মানুষ পর্যন্ত কলঙ্কিত হয়।
কিছুটা থেমে গাঢ় এক নিঃশ্বাস টেনে নেয় আরাধ্য। ইফরাহর চুলের গোছা ছেড়ে, এগিয়ে যায় বিছানার দিকে ।যেতে যেতে আবারো বলে –
“তোমায় পবিত্রতায় বেধেছি আমি।
এ যেন তোমার সাত পুরুষের ভাগ্য।
নয় তো এমন হাজারটা মেয়ে আজকাল সস্তায় বাজারে কিনতে পাওয়া যায়। কেন এনেছি জানো ?তোমার এই তেজরশ্মি আমার মন পুড়িয়েছে বলে!
নয়তো ফারহান ফাইয়াজ আরাধ্য সংসার করার ছেলে নয়।

-ধরে রেখেছেন কেন? ছেড়ে দিন , এত সস্তা জিনিসে নবাবের মুখ লাগানো উচিত নয় – মুক্তি দিন আমায়।
এ কথায় কিছুটা মুসকিহেসে খাটের পাসিতে হেলান দেয় আরাধ্য। চোখ দুটো বুঝে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলে –
-ও তুমি এ জীবেন ও পাবে না মেয়ে। যতদিন আমার অস্তিত্ব এই দুনিয়ায় থাকবে , ততদিন তোমার মুক্তি নেই।
-তাহলে মরে যান তবুও মুক্তি দিলাম আমায়।
এবার যেন পুরো ঘর কাঁপিয়ে হেসে ওঠে আরাধ্য। তার কি কষ্ট হচ্ছে? প্রিয় মানুষের মুখে মৃত্যু কামনা শুনে কি তার কষ্ট হচ্ছে? একদম নয় , পুরুষের কষ্ট থাকতে নেই। কষ্ট তো শুধু মেয়েদের হয়। এই যে একটু কিছু হলেই চোখের পানি ফেলিয়ে কেমন ফ্যাচ ফ্যাচ করে কাঁদে। আরাধ্যের আবার ওসব ইমোশন নেই। সে হাসি কিছুটা থামিয়ে বলে –
– মুক্তি

এতটুকু বলে আবারো হাসতে শুরু। বেশ অবাক হয় ইফরাহ, সে হাসির মতো কিছু বলছে বলে তার মনে পড়ছেনা। হঠাৎ গর্জে ওঠে আরাধ্য , কিছু সময় আগের থেমে যাওয়া রাগ টা আবারো বাড়তে শুরু করেছে তার। আবারো শিকারী এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে –
-মুক্তি এই শব্দটা মস্তিষ্কের ডিকশনারি থেকে চিরো তোরে মুছে ফেলো মেয়ে।‌ এসেছো নিজের ইচ্ছেতে , তবে মুক্তি ! সে তো আমার ইচ্ছে।
ইফরাহর চোখ ঝাঁপসা হয়ে আসে। কোনো মতে কান্না আটকে ভেজা তোয়ালে হাতে এগিয়ে যায় বেলকনিতে –
নেতিয়ে পড়া শরীর দু’চোখ বুঝে কিছু সময় নিশ্চুপ থাকে আর। ভীষণ মাথা ধরেছে তার !জ্বর এসে আবারো হয়তো ঘিরে ধরেছে তাকে। ধীরে ধীরে খাটের পাশি ছেড়ে গা এলিয়ে দেয় সে।
তবে এ সুখ যেন সহ্য হয়না ইফরাহর। ভেজা তোয়ালে বেলকনিতে নেড়ে খাবার প্লেট হাতে এগিয়ে এসে দাঁড়ায় আরাধ্য মাথার কাছে। কিসময় তাকিয়ে থেকে ডেকে ওঠে সে –

-খাবার এনেছি উঠুন !
অভিমানি এক চিকন স্বর কানে যেতেই ক্লান্ত শরীর টেনেটুনে উঠে বসতেই আরাধ্য খাবার প্লেট আর গ্লাস হাতে ইফরাহ দাঁড়িয়ে। সে ভ্রু জোড়া কুঁচকে বলে –
-খাবার এনেছো বুঝলাম তবে ওটা কি ?
নিজেকে শান্ত রেখেই তার ডান হাতে তাকায় ইফরাহ। তারপর দৃষ্টি উঠিয়ে বলে –

ছায়াস্পর্শ পর্ব ১৫

দুধ এনেছি খেয়ে নিন !
ইফরাহর কথায় আরাধ্য কিছুটা কিছুটা দুষ্টু হেসে বলে –
“চুমুকে নাকী চেটে।
ছোট ছোট চোখ করে আরাধ্যের মুখ পানে তাকায় ইফরাহ। সে তাকাতেই টুকস করে চোখ টিপে লোকটা।

ছায়াস্পর্শ পর্ব ১৭

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here